সরকারের অনুগত দুনিয়ালোভী আলেম

মূলঃ The Evil scholar
লেখকঃ হাফিয ইবন রজব আল হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ
========================
জেনে রাখুন, শান শওকত আর মান মর্যাদার কামনা বাসনা অনিবার্যভাবে একটি ব্যাপক ক্ষতির কারণ ।এই মান মর্যাদা আর শান শওকত অর্জনের জন্যে আপনাকে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তখন থেকেই এই ক্ষতির সূত্রপাত হয়। আর মান মর্যাদা, শান শওকত অর্জনের পরেও এই ক্ষতি হতেই থাকে, কারণ এবার আপনার পরিশ্রম ব্যয় হবে তা ধরে রাখার সুতীব্র বাসনার পিছনে , যা জন্ম দিবে অবিচার, ঔদ্ধত্য, বেপরোয়া মনোভাব আর বাদবাকী অন্যায় কাজ।

আবু বকর আল-আজুরি, যিনি ছিলেন চতুর্থ শতকের শুরুর দিকের একজন অন্যতম বিচক্ষণ আলেম, তিনি আলেমদের আচার-আচরণ এবং সংবেদনশীলতা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, আর তাঁর রচিত এ প্রবন্ধটি এ বিষয়ের উপর লেখা বাছাইকৃত সেরা কিছু কাজের মধ্যে একটি।

যদি কেউ এটি পড়ে থাকেন তাহলে তিনি জানতে পারবেন সত্যনিষ্ঠ (সালাফ) আলেমগণের অনুসৃত পথ সম্পর্কে, আরও জানতে পারবেন অভিশপ্ত নব আবিষ্কৃত বিষয়াদি, বিদ’আত পথভ্রষ্টতা যা তাদের পথের বিপরীত সে সম্পর্কে। তাই তিনি সবিস্তারে দুনিয়ালোভী আলেমদের কথা বর্ণনা করেছেন, তার রচনার নির্বাচিত অংশ উল্লেখ করা হলঃ

“দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও মোহ, প্রশংসা, সম্মানের আকাঙ্ক্ষা, মানুষের মাঝে সুমর্যাদা ইত্যাদি কারণে তিনি (দুনিয়ালোভী আলেম) ধোঁকার শিকার হয়েছেন। একজন সুন্দরী নারী যেভাবে অলংকার ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে এই দুনিয়ার জন্যে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে ঠিক সেভাবে একজন দুনিয়ালোভী আলেম গহনা হিসেবে ব্যবহার করে তার ইলম-জ্ঞানকে, কিন্তু সে আলেম তার অর্জিত জ্ঞানের উপর আমল করে না। (ইলমের উপর) আমলের সৌন্দর্য দিয়ে সে নিজেকে সজ্জিত করে না”।

এরপর তিনি একটি দীর্ঘ বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন,

“কাজেই এই স্বভাব আর অনুরূপ আচরণসমূহ তার অন্তরে প্রভাব বিস্তার করে ফলে সে তার অর্জিত ইলম থেকে উপকৃত হয় না, সে তার মর্যাদা, উপাধি ইত্যাদি বহন করে আর তার নফস বহন করে সম্মান, খ্যাতি, মর্যাদার প্রতি মোহ- (আর এ সম্মান ও খ্যাতির প্রতি মোহের কারণে) সে পছন্দ করে রাজাদের সাথে ও রাজপুত্রদের সাথে উঠাবসা করতে। এরপর সে তাদের মত বিলাসী জীবন যাপনের দিকে আকৃষ্ট হয়, তাদের মত জৌলুসপূর্ণ সাজপোশাক পরে, আরামদায়ক বাহনের ব্যবস্থা করে, চাকর বাকর, মিহি কাপড়, বিলাসবহুল শয়নকক্ষ ও খাদ্য ইত্যাদির দিকে মোহগ্রস্ত হয়। সে আরও পছন্দ করে লোকেরা যেন তার দরজায় ভিড় করে থাকে, যাতে তার প্রতিটি কথা শোনা হয়, যাতে তার কথা মান্য করা হয়- আর এগুলোর শেষেরটি (মান্য করা) পূরণ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে যদি সে কাজীর(বিচারক) পদটি লাভ করতে পারে- তাই সে এ পর্যায়ে এসে এদিকে ধাবিত হয়।

কিন্তু এরপরও সে এগুলো (বিলাস,দুনিয়া) অর্জন করতে পারে না যতক্ষণ না সে নিজের দীনকে বিক্রি করে, তাই সে নিজের স্থানচ্যুত করে শাসকদের কাছে আর তার দোসরদের কাছে, তাদের সেবায় নিয়োজিত করে নিজেকে আর তাদের কাছে স্মারক হিসেবে উপঢৌকন পাঠাতে শুরু করে। যখন সে শাসকদের দরবারে, প্রাসাদে প্রবেশ করে সেখানকার মন্দ কাজ দেখতে পায় তখন সে চুপ করে থাকে ।

এর চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যাপার হল সে শাসকদের কাছে নিজের অবস্থানকে আরও উঁচুতে নেয়ার জন্যে তাদের মন্দ কাজগুলোর প্রশংসা শুরু করে, এমনকি কিছু কিছু মন্দ কাজকে ভালো কাজ বলেও অপব্যাখ্যা দান করে। তাই, যখন সে নিজেকে একটি দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরণের আচরণে অভ্যস্ত করে নেয় তখন বাতিল তার ভিতরে শিকড় গেঁড়ে বসে- তখন এগুলো দেখে সেই শাসকেরা তাকে বিচারক (কাজী) পদে নিয়োগ দেয় আর এভাবেই তারা সেই আলেমকে জবাই করে, যে জবাই করতে কোন ছুরি লাগে না” ।

[প্রসংগত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেকটি হাদীস, “যাকে বিচারক নিযুক্ত করা হয়েছে তাকে যেন ছুরি ছাড়াই যবেহ করা হয়েছে”, আহমাদ, আবু দাউদ ৩৫৩৩,৩৫৩৪ ইফা; তিরমিযি]

এবারে (বিচারকের আসন দান করে) শাসকেরা তাকে এমন একটি অনুগ্রহ করেছে যার কারণে সেই আলেমকে আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয় এবং কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে হয়। কাজেই এবার তাকে প্রচুর কষ্ট স্বীকার করতে হয় যেন সে নিশ্চিত হতে পারে যেন শাসকদের রাগিয়ে দেয়ার মত কিছু না ঘটে যায়, যাতে শাসকেরা তাকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে না দেয়।

একদিকে যখন সে শাসকদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার জন্যে একের পর এক কষ্ট স্বীকার করে চলে, অপরদিকে সে ভুলে যায় আরেকজন ক্ষমতাশালী, সর্বশক্তিমান, বিশ্ব জাহানের শাসক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কথা, তাঁর সন্তুষ্টি, তিনি যেন রাগান্বিত না হন, সেদিকে সে বেমালুম ভুলে যায়। কাজেই সে এতিমদের সম্পদের সুষম বন্টন করে না, বিধবা, ফকির মিসকিন, ওয়াকফ সম্পত্তি যারা জিহাদে নিয়োজিত রয়েছে, মক্কা ও মদীনার সম্ভ্রান্ত লোকেরা, আর সর্বোপরি যে সম্পদ মুসলিমদের কল্যাণে ব্যয় হবার কথা-বরং সে সম্পদ ব্যয় করে তার কর্মচারীদের পিছনে, সভাসদ, চাকরদের পিছনে। কাজেই সে যা খায় তাও হারাম এবং যা খাওয়ায় তাও হারাম,আর যা বৃদ্ধি করতে থাকে তা হল নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষী। কাজেই তার জন্যে দুর্ভোগ, তার জন্যে অভিশাপ যার ইলম থাকা সত্ত্বেও সে এ ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পতিত হয়।

নিশ্চয়ই এটাই সে ইলম,
যা থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, এবং আমাদের প্রতিও আদেশ করেছেন যেন আমরাও এ ধরণের ইলম থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। এ ধরণের ইলমের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কেয়ামতের দিন সব থেকে ভয়াবহ আযাব যাকে দেয়া হবে সে হচ্ছে এমন আলেম যার ইলম দ্বারা তাকে আল্লাহ উপকৃত করেন নি।” [বর্ণনায় ইবন আব্দুল বার্র, জামি’ বাইয়্যানিল ‘ইলম (১/১৬২), তাবারানী, দারেমী]

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়শই এই দু’আ করতেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় কামনা করছি অসার জ্ঞান হতে, অশ্রুত দো’আ হতে,এবং এমন প্রবৃত্তি হতে যা পরিতৃপ্ত হয় না,এমন অন্তর হতে যা বিগলিত হয় না” (আবু দাউদ, সহীহ)

তিনি আরও দু’আ করতেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নী আস’আলুকা ইলমান নাফি’আন, ওয়া আউযুবিকা মিন ইলমিন লা ইয়ানফা’উ” ।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এমন জ্ঞান যা কাজে লাগে, আর আমি আপনার নিকট এমন জ্ঞান হতে আশ্রয় চাই যা কোন কাজে আসে না” [ইবন মাজাহ ৩৪৮৩]

ইমাম আবু বকর আল-আজুরি রাহিমাহুল্লাহু তায়ালার উক্তি এখানেই শেষ হলো, যিনি তার ইহকালের জীবন কাটিয়েছিলেন চতুর্থ শতাব্দীর শেষভাগে (মৃত্যু ৩৬০হিজরী) আর সেই সময় থেকেই ফিতনা, ফাসাদ দুর্নীতি বাড়তে লাগল-এরপর তা বহুগুণে বেড়েই চলেছে – লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

মূলঃ The Evil scholar
লেখকঃ হাফিয ইবন রজব আল হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ
সৌজন্যেঃ Kalamullah.Com
অনুবাদঃ সরল পথ

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan