আল্লাহ কেন সকল মানুষকে মুসলিম হতে বাধ্য করেন নি?
এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝেই কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেক মুসলিম ভাইকেও অনেক সময় বলতে শোনা যায়, ‘তাহলে আল্লাহ কি চাইলে সবাইকে মুসলিম বানাতে পারতেন না?’ আমরাও তখন অজ্ঞতার কারণে সাথে সাথে বলি, ‘আসলেই তো!’ সুতরাং আল্লাহই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন ধর্ম গ্রহণের কিংবা ভিন্ন মত অবলম্বনের অনুমতি বা সুযোগ দিয়েছেন তাহলে আমরা কেনো তাদেরকে ইসলামের কথা বলতে যাবো? এক্ষেত্রে অনেকে একধাপ এগিয়ে সুরায়ে কাফিরুনের মূল অংশ গুলো বাদ দিয়ে কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নভাবে শেষ আয়াতটি উল্লেখ করে পান্ডিত্য ঝাড়েন। বলেন দেখেন আল্লাহই সূরায়ে কাফিরুনে বলেছেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার।’ এই কথা বলে তারা মারাত্মক দু’টি অন্যায় করেন।
এক, পুরো সূরার মূলভাবকে গোপন করে বিচ্ছিন্নভাবে কেবলমাত্র শেষের আয়াতটিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা। আর শেষের আয়াতে মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘দীন’ শব্দের স্থলে ‘ধর্ম’ শব্দ বসিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান। অথচ সূরায়ে কাফিরুনের পুরোটা পড়লে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হতে বাধ্য। এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। এ ব্যাপারে আজ শুধু পুরো সূরাটি উল্লেখ করে দিচ্ছি।
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ (১) لا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ (২)
وَلا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (৩) وَلا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ (৪)
وَلا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (৫) لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ (৬)
অর্থ: “হে নবী আপনি বলুন, হে কাফির সম্প্রদায়। তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার
ইবাদাত করি না। এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও। আর তোমরা যার ইবাদত করছ আমি তার ‘ইবাদাতকারী হব না। আর আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।” (সূরা কাফিরুন ১০৯, আয়াত ০৬)
এবার আসল কথায় আসা যাক। কাউকে কোনো কাজে বাধ্য না করা আর তাকে অন্যায় করতে সুযোগ দেয়া এক কথা নয়। একমাত্র জিন ও মানুষ ছাড়া এই মহাবিশ্বের আসমান, যমীন, পাহাড়, সাগর, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, নিহাড়িকাপুঞ্জসহ সকল সৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবেই মহান আল্লাহর পুরোপুরি অনুগত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ.
অর্থ:
“তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? অথচ আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে ইচ্ছায় হোক বা অনিচছায় হোক, সব সৃষ্টি একমাত্র আল্লাহরই অনুগত হয়ে মুসলিম হয়ে গেছে এবং তাঁর দিকেই সবাই ফিরে যাবে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৮৩)
এই সকল সৃষ্টির কোনো একটি সামান্যতমও ব্যতিক্রম করে না। মহান আল্লাহর নির্দেশনার বাইরে যায় না। প্রত্যেকটি সৃষ্টি তার জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া নির্ধারিত নিয়ম ও বিধান অনুযায়ী চলে। নির্দিষ্ট দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করে। ইরশাদ
হয়েছে,
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ
الْعَلِيمِ. وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ
الْقَدِيمِ. لا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلا اللَّيْلُ
سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ.
অর্থ: “সূর্য তার নিজ কক্ষপথে ঘুর্ণয় করে। এটা তার জন্য মহান পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। আর চন্দ্রের জন্য আমি কিছু পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছি সুতরায় সে সেই পথে ঘুরে ঘুরে (মাসের শেষ সময়ে) একেবারে ক্ষীনকায় হয়ে যায়। সুর্যের ক্ষমতা নেই চন্দ্রকে ধরার আর রাতও দিবসের আগে চলে যেতে পারবে না। মূলত: প্রত্যেকটি সৃষ্টিই তার নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে।” (সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৩৮-৪০)
এই সকল সৃষ্টি পরিপূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহর অনুগত। তারা আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিয়েছে শর্তহীনভাবে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোনভাবেই তাদের ক্ষমতা নেই আল্লাহর বিধানে বাইরে যাবার। তারা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করে এবং প্রশংসা করে।
ইরশাদ হয়েছে,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهً.
অর্থ: “আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে আছে ইচছায় অথবা অনিচছায়।” (সূরা রা’দ ১৩, আয়াত ১৫)
আরো ইরশাদ হচ্ছে,
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ
وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ
وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ.
অর্থ: “তোমরা কি লক্ষ্য করনি যে, বস্তুত ঃ আল্লাহই এক সত্তা যাকে সেজদা করে সকলেই, যারা আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এবং সেজদা করে সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও বহুসংখ্যক মানুষ। (সূরা হজ্জ ২২, আয়াত ১৮)
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, মহান আল্লাহ চাইলে পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টির মতো মানুষ ও জিন সম্প্রদায়কেও প্রকৃতিগতভাবেই তার অনুগত ও বাধ্য করতে পারতেন। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সব মানুষকে মুসলিম হতে বাধ্য করতে পারতেন। তিনি চাইলে সকল মুসলমানকেও তার সকল নিয়মাবলী যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে পালন করতে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এটি করেন নি।
কিন্তু কেনো এটা করা হয় নি? বিচক্ষণদের জন্য এটিই হচ্ছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ নিজেই বলেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا
بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ
بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ
لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آَتَاكُمْ
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ
بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (৪৮)
অর্থঃ “সুতরাং আপনি তাদের মধ্যে ফয়সালা করুন আল্লাহ যা নাযিল করেছে তদনুসারে এবং আপনার কাছে যে সত্য এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি নির্দিষ্ট শরীয়ত ও নির্দিষ্ট পন্থা। আর যদি আল্লাহ্ চাইতেন, তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের সাইকে এক জাতি করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে চান যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তাঁর মাধ্যমে। অতএব নেক কাজের প্রতি ধাবিত হও। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তারপর তিনি তোমাদের অবহিত করবেন সে বিষয়ে যাতে তোমরা মতভেদ করতে।” (সূরা মায়িদাহ ৫ ঃ ৪৮)
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই সমগ্র মহাবিশ্বকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি সুন্দরতমভাবে সৃষ্টি করেছেন মানুষ। অনেক আদর ও মমতায় তিনি তৈরী করেছেন আমাদেরকে। তিনি ইরশাদ করছেন,
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ (৪)
অর্থ: “অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে।” (সূরা তীন ৯৬, আয়াত ০৪)
এই পৃথিবী ও তার সকল সম্পদরাজি এবং তার মধ্যকার সকল উপায় উপকরণ মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একমাত্র মানুষের জন্য। এই মানুষের জন্যই তিনি সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র। মানুষের সেবায় তিনি নিয়োজিত করেছেন সকল মাখলুকাতকে। সকল মাখলুকাত ও সৃষ্টির মাঝে তিনি মানুষকে এভাবে করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ সম্মানিত। ইরশাদ করেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آَدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي
الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى
كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا (৭০)
অর্থ: “আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিয্ক। আর আমি মানুষকে আমার অনেক সৃষ্টির উপর অনেক মর্যাদা দিয়েছি।” (সূরা ইসরা ১৭, আয়াত ৭০)
এবার চিন্তা করুন। এতো সম্মানিত মানুষকে যদি মহান আল্লাহ বাধ্য করেন, তাহলে কি তার সম্মান থাকে? কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে অনেক সম্মান দিয়ে এনে তারপর যদি তাকে বলা হয় যে, আপনি ঠিক ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলবেন। এক মিনিট কম-বেশি করতে পারবেন না। এই এই কথা বলতে হবে। এর বাইরে কিছু বলতে পারবেন না।…
এভাবে বিভিন্ন ব্যাপারে যদি তাকে প্রকৃতিগতভাবেই বাধ্য করা হয় তাহলে প্রধান অতিথির সম্মান কি আর বাকি থাকে? প্রধান অতিথির সামনে বা সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে মূলনীতি পেশ করা যায়। এলাকার কে কেমন, কার সাথে কেমন ব্যবহার করা উত্তম-মন্দ তা তাকে জানানো যায়। কিন্তু তাকে নির্দিষ্ট কোনো কাজের ক্ষেত্রে বাধ্য করা যায় না।
একইভাবে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাও তার এই বিশাল সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে প্রধান অতিথি করে পাঠিয়েছেন। এই মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টির উপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। এরপর মানুষকে তার দেয়া পথে ও পদ্ধতি অনুসারে চলতে বলেছেন। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তাদেরকে বাধ্য করেন নি। এটাই মানুষের জন্য পরীক্ষা। কারা তার রবের এতো নিয়ামত পেয়ে কৃতজ্ঞ হয় আর কারা অকৃতজ্ঞ হয় -এখন এটিই দেখার বিষয়। মানবজাতির মধ্যে যারা এই বিশ্ব ও মহাবিশ্বের এতো নিয়ামত পেয়ে তার প্রতিপালক ও স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল হবে তাদের জন্য পরকালে রয়েছে অফুরন্ত নিয়ামত। আর অকৃতজ্ঞদের জন্য আযাব।
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ
وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ
فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (১৩) وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ (১৪)
অর্থ: “এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৩-১৪)
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে বোঝার এবং সঠিক পথ বেছে নেয়ার তাওফীক দিন।
আমীন।
লেখকঃ মুহাম্মাদ ইসহাক খান ।