উম্মাহর প্রতি পথনির্দেশ

উম্মাহর প্রতি পথনির্দেশ (মক্কা শরিফের জুমার খুতবা)
শায়খ ড. সালেহ বিন মুহাম্মাদ আলে তালেব
—————————————————–
চারপাশের এ অগ্নিগর্ভ বিশ্বে ও দ্রুত পরিবর্তনশীল এ যুগে দ্বীন, দেশ, নিরাপত্তা ও ঐক্যের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনগুলো অাঁকড়ে ধরা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ যুগে যখন সৃষ্টির মাপকাঠিতে পরাশক্তিগুলো উম্মাহর পেছনে লেগেছে, তখন আমাদের সৃষ্টিকর্তার রজ্জু শক্তিশালী করার প্রয়োজন খুব বেশি। তিনিই সব বিপদ থেকে রক্ষাকারী। ক্ষমতা যতই থাক তার শাস্তি থেকে রক্ষাকারী কেউ নেই।

তাঁর রজ্জু নিরাশ লোকের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। এতে সব শক্তি ও মাপকাঠি পাল্টে যায়। ইবরাহিম (আ.) কে পুড়িয়ে মারার আগুন ঠান্ডা হয়েছে। মুসা (আ.) এর সামনে সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। মুহাম্মদ (সা.) ও মুসলমানদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ধেয়ে এসেছে, যখন তারা সংখ্যায় অল্প ও নগণ্য ছিল। তাদের শাসন পূর্ব-পশ্চিম ছাড়িয়ে গেছে। যারা যথার্থভাবে তাঁর অনুগ্রহ তালাশ করে ও উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করে আল্লাহর অনুগ্রহ তাদের সঙ্গেই থাকে।

তাদের তিনি মর্যাদা, সম্পদ ও সাহায্য দান করেন। আরবে আমরা সেই অনুগ্রহ দেখতে পেয়েছি কীভাবে তা প্রতিফলিত হয়েছে ও কী ফল বয়ে এনেছে। যে সময়ে মানুষের বুদ্ধিজাত, সে সময়কার মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে পৃথিবী দুইটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, ফলে ৭০ মিলিয়নের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং এ দেশগুলোর কোনোটিই এক বিঘতও সম্প্রসারিত হয়নি, ঠিক একই সময়ে আল্লাহ এদেশে আমাদের প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন।

সীমিত সামর্থ্য ও প্রাথমিক উপকরণ দিয়েই এদেশের বিভিন্ন অংশকে অখন্ড রেখেছেন। সেখানে শান্তি ও সৌহার্দ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে মাটির গর্ভ থেকে খনি বের হয়েছে, যা পৃথিবীতে বিরল। যেহেতু এদেশের নির্মাতারা ও এ ভূখন্ডের একতাবদ্ধ ব্যক্তিরা সর্ব প্রথম আল্লাহর একত্ব ও তাওহিদের ধারক ছিলেন। মৌলিকভাবে নেককার ছিলেন। তাই আল্লাহ তাদের জন্য এমন কাজ সহজ করে দিয়েছেন, যা তাদের চেয়ে জনবল ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালীদের জন্যও সহজ করেননি। একই দৃশ্য ইসলামের প্রাথমিক যুগেও ছিল। সর্বোপরি এটাই আল্লাহর অমোঘ বিধান।

বর্তমানের বিচ্ছিন্ন বিভক্ত আরব ও মুসলিম শক্তিকে অন্যদের শক্তির সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তথাপি শত্রুদের মোহ বেড়েই চলছে। মুসলিম উম্মাহর পেছনে তাদের তৎপরতা প্রকট হচ্ছে। আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোনো রক্ষক নেই। আমরা এমন সময়ে আছি, যেখানে আমাদের আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী মোতাবেক বাহ্যিক শক্তি অর্জন করে লালসা পোষণকারীদের দমন করবে। ‘তোমরা যথাসাধ্য শক্তি অর্জনের প্রস্তুতি নাও।’ (সূরা আনফাল : ৬০)।

ঠিক তেমনি একইসঙ্গে আমাদের উচিত হলো আত্মিক শক্তিরও গুরুত্ব দেয়া। তা হলো দ্বীনের অর্জন ও ঐতিহ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া। তাকে শক্তিশালী করা। এটি এমন অস্ত্র, যা ব্যর্থ হয় না। এমন বর্শা, যা বিফলে যায় না। এ সময়ে আমাদের সমাজে ধর্মের গায়ে যে কোনো আঘাতই দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। আমাদের ওপর থেকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্যের হাত উঠিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা। বিশেষ করে যে অপতৎপরতা প্রকাশ্যে ও খোলামেলা চালানো হয়। ইসলাম ধর্ম শুধু আখেরাতের মুক্তির গ্যারান্টিই নয়, বরং পৃথিবীতে উম্মাহর টিকে থাকা ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করারও উপায়। অন্যথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই। উম্মাহর অন্যতম অন্যায় হলো আল্লাহর হক ও বিধানের সামনে তার আবেগকে শিথিল করে দেয়া। তার ভালোবাসা ও ক্রোধকে মূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। শত্রুরা এ উম্মতকে তখনই পরাজিত করতে সফল হয়, যখন তারা বিভক্ত থাকে, বিচ্ছিন্ন থাকে, তাদের প্রতিপালক থেকে উদাসীন হয়ে দূরে থাকে। আমরা পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্য বিশ্বকে দেখতে পাই তা নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় যতই ডুবে থাক সঙ্কট ও বিপদের মুহূর্তে তার ধর্মকে মনে রাখে।

যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীতে প্রভুর আশীর্বাদ নিয়ে কথা বলে। পক্ষান্তরে আমাদের হতভাগারা যখনই সঙ্কট প্রকট হয়েছে ও দুর্বিপাক বেড়ে গেছে আমাদের জীবনে ধর্মের হাতকে দুর্বল করে দিতে ততই তৎপর হয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের সমাজে ধর্মীয় আচারগুলো কমতে থাকে। তারা প্রবৃত্তির কামনার উপকরণগুলোকে প্রসার করেছে, যাতে মানুষের মন তার নেশায় সমর্পিত হয়, ভবিষ্যতের সঙ্কট ও বিপদ থেকে বেখেয়াল থাকে। এটিই হলো শূন্যতার মুহূর্ত জাতি তার দীর্ঘ ইতিহাসে যেখানে পেঁৗছলে পরাভূত হয়। বাগদাদ ও স্পেনের ইতিহাসে এ শিক্ষা ও বার্তা পাওয়া যায়। জাতির ওপর সঙ্কট নেমে আসলে, তার ধর্ম ও ভূখন্ড আক্রমণের টার্গেটে পতিত হলে তাকে বিলাসিতা ও খেলতামাশা থেকে দূরে থাকতে হবে।

সব শক্তি ও প্রচেষ্টা তার স্রষ্টা ও প্রতিপালকের নৈকট্য অর্জনে ন্যাস্ত করতে হবে। দ্বীনকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করতে হবে। সব ধরনের গোনাহ, অপরাধ, কাম-প্রবৃত্তি, অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে বিরত থাকতে হবে। ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে যাও। আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী।’ (সূরা জারিয়াত : ৫০)।
আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো একতা ও জোটবদ্ধ থাকার নেয়ামত। আল্লাহ আমাদের ঐক্যের নির্দেশ দিয়েছেন। আগের জাতিদেরও এ নেয়ামত দান করেছেন। ‘তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের অন্তরগুলোকে এক করে দিয়েছেন। তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেছ।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। অনৈক্য ও বিভক্তি দিয়ে কোনো নেয়ামতের সুফল উপভোগ সম্ভব নয়।

আমরা অনেক দূরের দেশকে দেখে আসছি, তাদের ওপর দিয়ে নদনদী প্রবাহিত হচ্ছে, ভূমিগুলো সম্পদে ভরপুর। তারপরও তাদের দারিদ্র্যের দিন ও ভয়ের রাত বাড়ছেই। এমনকি তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছে। অন্য দেশে নিচু হয়ে বসবাস করাকে প্রাধান্য দিয়েছে। শান্তি, নিরাপত্তা ও আবাসনের সন্ধানে। যে সুখে আছে, সে বিপদগ্রস্তের ভোগান্তি জানে না। সুখের প্রকৃত মর্ম বোঝে না। তাই সুখ ও নেয়ামতগুলো যাতে স্থায়ী থাকে সেজন্য আমাদের তার প্রতি সব উপায়ে যত্নশীল হতে হবে। বিশেষ করে এ যুগে দেশ ও জাতিকে নিরাপদ করতে লেখনী ও জিহ্বা এক্ষেত্রে সচেতন রাখতে হবে।

দেশপ্রেমিকরা অবশ্যই রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমের মঞ্চে দেশ, জাতি, জনতা, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও ভূখন্ডের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ঈমানদার ব্যক্তি উম্মাহর জন্য আন্তরিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করে যাবেন। বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করবেন।

২৯ সফর ১৪৩৭ হি. মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা

সংক্ষেপে ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button