বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি

জীবনের প্রতি দু‘টো দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত রয়েছে। একটি হলো বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অপরটি হলো সঠিক (ইসলামী) দৃষ্টিভঙ্গি। এ উভয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব মানব জাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও এর অর্থ:

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলো- মানুষের সমস্ত চিন্তা-চেতনা পার্থিব ও তাৎক্ষণিক ভোগ-বিলাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সকল চেষ্টা সাধনা ও পরিশ্রম কেবল এ উদ্দেশ্যেই ব্যয় করা। এসবের পরিণাম কি হতে পারে সে ব্যাপারে তার কোনই চিন্তা ভাবনা থাকে না এবং সে জন্য সে কোন কাজও করে না। পরন্তু এদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এও জানে না যে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার এ জীবনকে আখেরাতের ক্ষেত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। দুনিয়াকে তিনি করেছেন আমলের স্থান এবং আখেরাতকে করেছেন প্রতিদান দেয়ার স্থান। অতএব যে সৎ ও পুণ্য কাজ দ্বারা পার্থিব জীবনের এ সুযোগ গ্রহণ করেছে, সে দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতে লাভবান হয়েছে। আর যে দুনিয়ার এ সুযোগ নষ্ট করেছে সে তার আখেরাতকেও হারিয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

‘সে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (সূরা হাজ্ব, ১১)


আল্লাহ এই দুনিয়া অনর্থক সৃষ্টি করেননি। বরং এক মহান উদ্দেশ্যে তিনি একে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন:

যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ? (সুরা মূলক, ০২)

অন্যত্র তিনি বলেন:

‘ভূ-পৃষ্ঠের সব কিছুকেই আমি পৃথিবীর শোভা করে দিয়েছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কে কর্মে শ্রেষ্ঠ। (সুরা কাহফ, ০৭)

আল্লাহ তাআলা এ জীবনে ধন-সম্পদ, সন্তান সন্ততি, মান-ইজ্জত, নেতৃত্ব এবং অন্যান্য এমন উপভোগ্য ক্ষণস্থায়ী ও প্রকাশ্য শোভা বর্ধনকারী বস্তু সৃষ্টি করেছেন, যা স্বয়ং তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। অধিকাংশ লোকের দৃষ্টিই এসব বাহ্যিক চাকচিক্য ও সৌন্দর্যের প্রতি সীমাবদ্ধ এবং এ সবের গোপন তত্ত্ব ও রহস্য সম্পর্কে তারা কোন চিন্তা ভাবনা করে না। ফলে শেষ পরিণাম কি হবে সে সম্পর্কে কোন রকম চিন্তা-ভাবনা করে না। ফলে শেষ পরিণাম কি হবে সে সম্পর্কে কোন রকম চিন্তা – ভাবনা না করেই তারা দুনিয়ার এসব ধন-দৌলত অর্জন, জমা করা ও উপভোগে মত্ত হয়ে পড়ে। এমন কি অবস্থা এত দূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় যে, এ দুনিয়ার জীবন ছাড়াও আরেক জীবন যে আছে তাও তারা অস্বীকার করে বসে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

‘তারা বলে, আমাদের এ পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না।’(সূরা আনআম, ২৯)

জীবনের প্রতি যারা এরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তাদের প্রতি আল্লাহ কঠিন শাস্তি ভয় প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

‘নিশ্চয়ই যেসব লোক আমার সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে না এবং পার্থিব জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ও তা নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকে এবং যারা আমার নিদর্শন সমূহ সম্পর্কে গাফিল, এমন লোকদের আবাস হল অগ্নি- তাদের কৃতকর্মের বদলা হিসাবে।(সূরা ইউনুছ,৭-৮)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

‘এ যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও এর চাকচিক্য কামনা করে আমি তাদেরকে দুনিয়াতেই তাদের আমলের পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করি এবং এখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এদেরই জন্য আখেরাতে অগ্নি ব্যতীত অন্য কিছুই নাই এবং তারা এখানে যা করে, আখেরাতে তা নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তারা যে সব কাজ-কর্ম করে সবই নির্থক। (সূরা হুদ, ১৫-১৬)

শাস্তি এই বাণী উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের শামিল করছে। চাই তারা ঐ ধরনের লোক হোক, যারা দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে আখেরাতের কাজ করে থাকে, যেমন মুনাফেক, রিয়াকারী, অথবা হোক তারা কাফির, পুনরুত্থান ও হিসাব দিবসের প্রতি যাদের ঈমান নেই যেমন জাহেলী যুগের লোকদের অবস্থা এবং বর্তমান যুগের পুঁজিবাদ, কমিউনিজম ও নাস্তিক্যবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদরে ন্যায় মাননতা বিধ্বংসী মতবাদ সমূহ। জীবনের প্রকৃত কদর এরা বুঝতে পারেনি এবং জীবনের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গি পশুর দৃষ্টিভঙ্গিকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। বরং এরা তো পশুর চেয়েও অধম। কেননা তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধিকে অকার্যকর করে সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য বস্তুবাদের প্রতি নিয়োজিত করেছে। আর এমন জিনিসের পেছনে তারা তাদের সমস্ত সময় ব্যয় করে দিচ্ছে যা তাদের জন্য স্থায়ী নয় এবং তারাও তা স্থায়ীভাবে ভোগ করতে পারবে না। আর নিজেদের সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণামের জন্য তারা কিছুই করছে না, যা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

তারা পশুর চেয়েও অধম এজন্য যে, পশুর শেষ পরিণাম বলতে কিছু নেই এবং এমন কোন বিবেক-বুদ্ধিও নেই যদ্ধারা সে চিন্তা- ভাবনা করেতে পারে। অথচ এদু’টি বস্তুই ঐ লোকদের রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেন:

‘আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শুনে ও বুঝে?তারা তো পশুর মতই, বরং আরো অধিক পথভ্রষ্ট। (সূরা ফোরকান,৪৪)

এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের আল্লাহ তাআলা অজ্ঞ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন:

‘কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্বন্ধে অবগত। আর আখেরাত সম্বন্ধে তারা গাফিল।(সূরা রূম, ৬-৭)

এসব লোক যদিও দুনিয়ার বিভিন্ন আবিষ্কার ও কারিগরি বিদ্যায় দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা অজ্ঞ ও নির্বোধ। এরা জ্ঞানী হিসাবে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত নয়। কেননা এদের জ্ঞান পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক অতিক্রম করে সামনে এগোতে পারেনি। তাদের জ্ঞান অপরিপূর্ণ। তাই ‘আলেম’ বা জ্ঞানী এ মর্যাদাসম্পন্ন অভিধায় তারা অভিষিক্ত হতে পারে না। বরং ‘আলেম’ নামে অভিহিত হওয়ায় যোগ্য তারাই, যারা আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং তাঁকে ভয় করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। (সূরা ফাতির,২৮)

আল্লাহ তাআলা কারূন ও তাকে প্রদত্ত গুপ্তধন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে যা উল্লেখ করেছেন, তাতে জীবনের প্রতি বস’বাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি স্পষ্ট চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে:

‘অতঃপর কারূন জাঁকজমক সহকারে তার সম্প্রদায়ের সামনে বের হল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত, তারা বলল, আহা! কারূনকে যেরূপ দেয়া হয়েছে আমাদেরকেও যদি তা দেয়া হত। নিশ্চয়ই সে বড় ভাগ্যবান। (সূরা কাসাস, ৭৯)

এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, লোকেরা তাদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কারূনের মত হতে আকাঙ্ক্ষা বোধ করতে, তার প্রতি ঈর্ষা পোষণ করত এবং তাকে মহা ভাগ্যবান বলে মনে করত। বর্তমানে কাফির রাষ্ট্রে অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিক দিয়ে তারা সমৃদ্ধ। ফলে দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলমানগণ তাদেরকে সম্ভ্রম ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। অথচ তাদের কুফুরীর মন্দ পরিণামের প্রতি এসব দুর্বল মুসলমানগণ দৃষ্টিপাত করে না কার্যত: এ ভুল দৃষ্টিভঙ্গি তাদের অন্তরে কাফিরদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার উদ্রেক করে এবং তাদেরকে কাফেরদের মন্দ চরিত্র ও অভ্যাস অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ তারা চেষ্টা সাধনায়, বিভিন্ন রকম আবিষ্কার ও কারিগরি ক্ষেত্রে উপকারী বস্তু তৈরি ও শক্তি- সামর্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে না।

জীবনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি

জীবনের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো: এ দুনিয়ায় যত সম্পদ, কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব ও বৈষয়িক শক্তি-সামর্থ্য রয়েছে, সব কিছুকেই আখেরাতের কাজের সহায়ক মাধ্যম হিসাবে গণ্য করা। প্রকৃত অর্থে দুনিয়া স্বয়ং নিন্দিত বস্তু নয়। বরং প্রশংসা ও নিন্দা উভয়ই দুনিয়ায় বান্দার কাজের প্রতি প্রযোজ্য। দুনিয়া আখেরাতের সেতু এবং পারাপারের রাস্তা। দুনিয়া থেকেই জান্নাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হয়। জান্নাতবাসীগণ যে উত্তম জীবন লাভ করবে, তা মূলত: দুনিয়ায় তাদের উত্তম বপন-কার্যের বিনিময়েই অর্জিত হবে। অতএব দুনিয়া হলো জিহাদের স্থান, নামায, রোযা ও আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের স্থান এবং কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার সাথে ধাবিত হওয়ার ক্ষেত্র। আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন:

‘পানাহার কর তৃপ্তি সহকারে। তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে’ (সূরা হাক্কাহ,২৪)

মূল: সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান

অনুবাদ : মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

source:

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88