ইসলামে আদল বা ন্যায়বিচার

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। অত:পর দরুদ ও শান্তির ধারা বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সাথীদের উপর।
আদল আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ইনসাফ, সুবিচার বা সমান করে দেয়া ইত্যাদি।
আদল হল; কুরআন ও সুন্নাহ মুতাবেক যাবতীয় কথা ও কাজে কম বা বেশি না করে মধ্য-পন্থা অবলম্বন করা।
ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় আল্লাহর নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী যার যা হক্ব ও অধিকার আছে, তা আদায়ের সুষ্ঠু নীতিমালা ও সুব্যবস্থা করার নীতিই আদল, যাকে ইনসাফও বলা হয়। পার্থিব জীবনের সর্বত্র ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কেননা আদল ছাড়া ব্যক্তিগত জীবন হতে জাতীয়, আন্তর্জাতিক কোন জীবনই শান্তি-শৃংঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিরা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কর্ম জীবন ও পেশাগত জীবন নির্বাহ করে। কাজেই কারো প্রতি যাতে জুলুম না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর একমাত্র আল্লাহর বিধানই মানুষের সমাজ জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ ٱللَّهَ يَأْمُرُ بِٱلْعَدْلِ وَٱلإحْسَانِ وَإِيتَآءِ ذِي ٱلْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ ٱلْفَحْشَاءِ وَٱلْمُنْكَرِ وَٱلْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
অর্থাৎঃ “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমারেকে ন্যায়বিচার ও সদাচারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।” (সূরা নাহাল:৯০)।


দেশের শাসন ব্যবস্থা যদি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, তবে জাতীয় জীবনে অশান্তি, বিশৃংঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়।
আদল বা ন্যায়বিচারের বিপরীত হল যুলুম। যা ইনসাফের খেলাফ। যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো যুলুম। একে অবিচারও বলা হয়। অবিচার হল বড় যুলুম। অবিচারের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এটা কোন সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট হতে পারে না। সুতরাং জাতীয় জীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থাৎঃ “ হে ঈমানদারগণ! সত্যের উপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোন দলের শত্রুতা তোমারেকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয় যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা কর। এটি আল্লাহ ভীতির সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় কর! কারণ, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন। (সূরা আল-মায়েদাঃ৮)
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা বিচারকের দায়িত্ব।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ۚ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا
অর্থাৎঃ “ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে কত উত্তম উপদেশই না দিচ্ছেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। (সূরা নিসাঃ৫৮)

তিনি আরো বলেন:
وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
অর্থাৎঃ “আর যখন তুমি বিচার করবে, তখন লোকদের মাঝে ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা মায়েদা :৪২)
আদল বা ন্যায়বিচার একটি মহৎ গুণ। পারস্পরিক সম্পর্ক সামাজিক বা শান্তি-শৃংঙ্খলা ও সুশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল ন্যায়বিচার। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
অর্থাৎঃ “ আমি আমার রসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও (সত্য মিথ্যার) মানদন্ড যাতে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। (সূরা হাদীদঃ ২৫)
তিনি আরো বলেন:
فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ
অর্থাৎঃ হে নাবী! তাদেরকে আহ্বান কর (দ্বীনের প্রতি), আর তোমাকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তুমি তার প্রতি সুদৃঢ় থাক, আর তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না। আর বল, আল্লাহ যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। তোমাদের মাঝে ইনসাফ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরও প্রতিপালক, তোমাদেরও প্রতিপালক। (সূরা আশ-শূরাঃ১৫)
ন্যায়বিচারের ব্যপারে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, যেই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ন্যায়ের মানদন্ড অবশ্যই কায়েম রাখতে হবে। এখানে কোন হেরফের করা যাবে না। এ ব্যাপারে আল্লাহর কঠোর নির্দেশ রয়েছেঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوْ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
অর্থাৎঃ হে ঈমানদারগণ! ন্যায়ের প্রতি সুপ্রতিষ্ঠ ও আল্লাহ্র জন্য সাক্ষ্যদাতা হও যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা মাতা-পিতা এবং আত্মীয়গণের বিরুদ্ধে হয়, কেউ ধনী হোক বা দরিদ্র হোক, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যাতে তোমরা ন্যায়বিচার করতে পার এবং যদি তোমরা বক্রভাবে কথা বল কিংবা সত্যকে এড়িয়ে যাও তবে নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত।(সূরা আন-নিসাঃ ১৩৫)
তিনি আরও বলেনঃ
وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ
অর্থাৎঃ “আল্লাহ আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়ামায়া তোমাদেরকে যেন প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক।(সূরা আন-নূরঃ২)
আর যে বিচারক ন্যায়বিচারকার্য সম্পদন করবেন তার জন্য মহা খুশির সংবাদ হল; যে দিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তার ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদেও একজন হল; ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা শাসক।
সুতরাং বিচারকগণ যেন কোন অবস্থাতেই নিজের অথবা অন্যদের খেয়াল খুশিমত বিচারকার্য সম্পাদন না করেন। তাহলে কিন্তু এই সুসংবাদের বিপরীতে তাদেও জন্য রয়েছে দু:সংবাদ।

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ
অর্থাৎঃ আর তুমি তাদের মধ্যে বিচার ফয়সালা কর তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ না করে। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক তারা যেন আল্লাহ তোমার প্রতি যা নাযিল করেছেন তার কোন কিছু থেকে তোমাকে ফেতনায় ফেলে বিভ্রান্ত করতে না পারে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ, আল্লাহ তাদের কোন কোন পাপের কারণে তাদেরকে শাস্তি দিতে চান, মানুষদের অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে সত্য ত্যাগী। (সূরা মায়েদাঃ ৪৯)
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, একবার কুরাইশের মাখযূমী বংশের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে, তার হাত কাটার নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘব করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করা হলে তিনি বলেনঃ তোমাদেও পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কোন সাধারণ লোক অন্যায় করলে, তার শাস্তি হতো। অথচ কোন মর্যাদাবান লোক অন্যায় করলে, তার শাস্তি হতো না। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও যদি এ কাজ করত, তবুও আমি তার হাত কাটার নির্দেশ দিতাম। (বুখারী ও মুসলিম)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদল ও ইনসাফ এরূপ ছিল যে, সত্য-মিথ্যা অনুধাবন করেও তিনি এক ইহুদী ও মুসলমানের মধ্যকার আহুত সমস্যা সমাধানে ইহুদীর পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন।
ফলে মানব জাতির ইতিহাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদল ও ইনসাফ বা সুবিচার প্রতিষ্ঠার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাওয়া যায়, যায় তাঁর কর্মময় জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত। ন্যায়বিচার শুধু আদালতের ক্ষেত্রেই নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল স্তরে।
আজকাল অনেককে ব্যক্তি ও পরিবারে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েম না করলেও রাষ্টীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য খুব তৎপর। প্রকৃতপক্ষে এটাও একটি বেইনসাফি ও অবিচার। যেমন; অনেকেই আমরা নিজ স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুবিচার করি না। স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি, ছেলে-মেয়েদের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় বা দানের ক্ষেত্রে কম-বেশী করছি, বোনদেরকে মীরাছ বন্টনের সময় ঠকাচ্ছি, পিতা-মাতার হক্ব হচ্ছে সব চেয়ে বেশী, তাদের সাথেও অবিচার করতে পিছ পা হচ্ছি না, তাই যদি না হবে তাহলে কোন সভ্য সমাজের লোক কি নিজ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে কখনও রেখে আসতে পারে? এটা তো শুধু অবিচার নয়, এটা অমানবিক এবং মনুষ্যত্বকেও হার মানায়। ধিক! শত ধিক!।
আর এ কারণেই আজকের সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়বিচার দারুনভাবে উপেক্ষিত। কারণ এর গোড়া পত্তন করতে হবে ব্যক্তি ও পরিবার থেকে। তাহলেই তার প্রতিফলন বা সুফল আমরা পাব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

সূত্র:

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88