অহংকার: এক ঘৃণিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

সমাজের কিছু মানুষ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সার্টিফিকেট, জ্ঞান-গরিমা, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি কারণে অহংকারে ফেটে পড়ে, মানুষকে ঘৃণা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং নিজের আমিত্ব বজায় রাখতে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে।
এ লোকগুলোকে সমাজের দুর্বল ও অসহায় লোকেরা সামনা-সামনি সম্মান করলেও তাদের প্রতি অন্তরে পোষণ করে পর্বতসম ঘৃণা। মহান রাজাধীরাজ আল্লাহর চোখেও এরা হয় অত্যন্ত তুচ্ছ ও ক্রোধের শিকার। ‘অহংকার পতনের মূল’ এ প্রবাদ জেনেও এবং যুগে যুগে অহংকারীদের পতন ও ধ্বংসের নিমর্ম ইতিহাস দেখেও এদের চরিত্রের পরিবর্তন না হওয়া নিশ্চয় হত ভাগ্যের প্রমাণ।
তাই আসুন, আমরা আমারে মন থেকে অহংকার নামক এই ঘৃণিত চরিত্রকে বিদায় করে আল্লাহর আনুগত্যশীল দাসে পরিণত হই এবং মানুষের সাথে বিনয়ী ও নম্রতার সাথে আচরণ করি।

নিশ্চয় আল্লাহর আনুগত্যশীল, সচ্চরিত্রবান ও বিনয়ী ব্যক্তিরা যেমন হয় আল্লাহর প্রিয়ভাজন তেমনি হয় মানুষের ভালবাসার পাত্র।
নিম্নে কুরআন-সুন্নাহ থেকে অহংকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হল:
◈ ১) দুর্বলের এত অহংকার কেন?
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا
“অহংকার করে জমিনে চলা ফেরা কর না। কারণ, তুমি তো (পায়ের আঘাতে) মাটি বিদীর্ণ করতে পারবেনা বা দৈর্ঘ্যে পাহাড়ের সমানও হতে পারবে না।” (সূরা ইসরাঃ ৩৭ ও ৩৮)
◈ ২) তোমার আচরণ তোমার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّـهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ – وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ
“অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। চলা ফেরায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর এবং আওয়াজ নিচু করে কথা বল। নিশ্চয় সবচেয়ে অ পছন্দনীয় আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।” (সূরা লোকমান: ১৯-১৮)
◈ ৩) অহংকার সাজে কেবল আল্লাহর:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহ বলেন, “মর্যাদা আমার লুঙ্গি আর অহংকার আমার চাদর। কেউ এ দুটির কোন একটি নিয়ে টানাটানি করলে তাকে আমি আযাবে নিক্ষেপ করব।” (হাদিস কুদসী-সহীহ মুসলিম)
হাদিসের ব্যাখ্যা:
এ হাদিসে কুদসীতে মর্যাদাকে লুঙ্গি আর অহংকারকে চাদরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ, যে ব্যক্তি মর্যাদা ও অহংকার করে সে যেন এ দুটি জিনিসকে তার শরীরে জড়িয়ে রাখে যেমন লুঙ্গি ও চাদর দ্বারা মানুষ নিজ শরীরকে আবৃত করে রাখে। তবে এগুলো পরিধানের ক্ষেত্রে তার সাথে অন্য কেউ শরিক হয় না। ঠিক তেমনি মর্যাদা ও অহংকার আল্লাহ তাআলার লুঙ্গি ও চাদর। সুতরাং এ গুলোতে আল্লাহর সাথে অংশ গ্রহণ করা কারও জন্য শোভনীয় নয়। তাই উপরোক্ত উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। আর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ তো আল্লাহ তাআলার প্রাপ্য। (ইবনুল আসীর-জামিউল উসুল)
◈ ৪) সুন্দর জুতা-জামা পড়া অহংকার নয়:
“যার মনে বিন্দু মাত্র অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, মানুষ তো চায় তার জামা-কাপড় সুন্দর হোক, জুতা সুন্দর হোক। তিনি বললেন: আল্লাহ নিজে সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় মনে করা। (সহীহ মুসলিম)
অন্য বর্ণনায় এসেছে: “যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে যাবে না। আর যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না।” (সহীহ মুসলিম)
হাদিসটির অর্থ: ইমাম নববী রহ. সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না।” এ কথাটির অর্থ হল, সে ব্যক্তি মুত্তাকী-পরহেজগার লোকদের সাথে প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে যাবে না। বরং আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে নিরীক্ষণ করে হয় শাস্তি দিবেন অথবা মাফ করে দিবেন।
“যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে যাবে না।” এ কথাটির অর্থ হল, সে চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য জাহান্নামে যাবে না। (বরং সারা জীবনের পাপাচারের শাস্তি ভোগ করার পর তার অন্তরে সামান্যতম ঈমান থাকার কারণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে)। (ইবনুল আসীর জামিউল আসার কিতাবে এ কথা উল্লেখ করেছেন)।
◈ ৫) অহংকারীদের কঠিন পরিণতি:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “দুনিয়াতে যারা অহংকার করতো কিয়ামতের দিন তাদের হাশর হবে মানুষ আকৃতিতে ভুট্টার দানার মত অতি ক্ষুদ্রকায় অবস্থায়। তাদেরকে চারিদিক থেকে লাঞ্ছনা ও তিরস্কার ঘিরে ধরবে। এমতাবস্থায় জাহান্নামের জেলখানার দিকে তাদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। (সে জেলখানাটির নাম বুলিস)। আনিয়ার নামক আগুন এসে তাদেরকে গ্রাস করবে আর পাপীষ্ঠ জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ তাদেরকে পান করানো হবে।” (তিরমিযী। তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন আর জামিউল উসুল কিতাবের গবেষক এতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন)।
◈ ৬) মাটির তৈরি মানুষের কীসের এত অহংকার?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তাআলা তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের মূর্খতা সুলভ অহংকার এবং বাপ-দাদা নিয়ে পরস্পর বড়ত্ব দেখানোর কুপ্রথা দূরভিত করেছেন। মানুষ দু ভাগে বিভক্ত: এক শ্রেণীর মানুষ সৎ-ইমানদার-পরহেজগার। আর এক শ্রেণী হতভাগ্য পাপাচারী। সকল মানুষই আদমের সন্তান। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।” (তিরমিযী। তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন আর জামিউল উসুল কিতাবের গবেষক এতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন)।
◈ ৭) ভূমিধ্বসের কবলে এক অহংকারী:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “(আগের যুগের ঘটনা) এক ব্যক্তি রাস্তা ধরে হাঁটছিল। পরনে ছিল দুটি সুন্দর পোশাক যেগুলো দেখে সে আত্ম অহমিকায় ভুগছিল। মাথা ছিল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পথ চলছিল অহংকারের সাথে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাকে ভূমি ধ্বসের কবলে নিক্ষেপ করলেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নিচে ঢুকতেই থাকবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে অহংকার নামক নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য থেকে হেফাজত করুন এবং বিনয়-নম্রতা ও সদাচরণের সৌরভময় চরিত্রের অধিকারী করুন। আমিন।
▬▬▬▬ ◐◯◑ ▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 planet128skybet88 slot gacor skybet88 skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 skybet88