বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ী সালাহ উদ্দিন আইউবী
রচনায়: এ. বি. এম. কামাল উদ্দিন শামীম
দিগ্বিজয়ী বীর, উন্নত চরিত্র ও উদার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এ পৃথিবীতে কম জন্মায়নি। কিন্তু বিশেষ কতকগুলো গুণপনার কারণে সে অসাধারণ মানুষদের মধ্যেও কতিপয়কে স্বতন্ত্র বলা চলে, তেমনি স্বতন্ত্রদের অন্যতম ছিলেন সুলতান গাজী সালাহ উদ্দিন আইউবী। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁর মত অমিততেজাশক্তি- সাহস সম্পন্ন বীর, মহানুভব শাসনকর্তা ও ন্যায়পরায়ণ অনাড়ম্বর ব্যক্তিত্বের খুব কম সন্ধানই ইতিহাস দিতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পর নানা কারণে সুলতান সালাহ্ উদ্দিন আইউবীর নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
সুলতান মাহমুদ সালজুকের শাহজাদাদের শিক্ষক ছিলেন ইমাদ উদ্দিন জঙ্গী। এক সময় তিনি মৌসেল-এর গভর্ণর নিযুক্ত হন এবং কিছুদিন পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তাইগ্রীস নদীর বাম তীরে নিজের ভক্ত-অনুরক্ত ও পরিবার-পরিজনসহ নজমুদ্দিন আইউবীর তাকরীত দুর্গে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সে দুর্গে আশ্রয় নিতে পারলে দুশমনদের হাত থেকে নিশ্চিত রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। সুউচ্চ সুরক্ষিত দুর্গে গোপন পথে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু মালিকের অনুমতি ব্যতীত প্রবেশাধিকার অনুচিত ভেবে তাঁরা আবেদন জানালেন। তাঁদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলো না। তাইগ্রীস নদী অতিক্রম করে আসার জন্য দুর্গাধিপতি নৌকা পাঠিয়ে দিলেন। সমস্ত সেনাবাহিনী নিরাপদে দুর্গে প্রবেশ করে নিশ্চিন্ততা লাভ করলো।
সে দুর্গে ক্ষমতাহারা গভর্নর ইমাদ উদ্দিন জঙ্গী কয়েক মাস অবস্থান করার পর ভক্ত-অনুরক্তদের একত্রিত করে ভাগ্য পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি হারানো দুর্গ দখল করে নিলেন এবং সিরিয়ায় এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। সে সাম্রাজ্য ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সার্থক প্রতিরোধ গড়ে তুললো। শুধু তাই নয়, তিনি ক্রুসেডারদের নিকট থেকে এক বিরাট এলাকাও ছিনিয়ে নিলেন।
১১৩৮ সালে দুর্ভাগ্যক্রমে নজমুদ্দিন আইউবীকে তাকরীত থেকে বেরুতে হলো। বেরিয়ে তিনি মৌসেল অভিমুখে যাত্ৰা করলেন। যে রাতে তাকরীতকে চিরবিদায় জানিয়ে নজমুদ্দিন আইউবী ও তাঁর বংশধরগণ মৌসেল যাচ্ছিলেন সে রাতেই আইউবীর গৃহে এক ফুটফটে সুন্দর শিশু ভুমিষ্ট হয়। জন্মের পর শিশুটির নাম রাখা হয় ইউসুফ। বিশেষ এক দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ভূমিষ্ট এই নবজাত শিশুই পরবর্তী কালে সালাহ উদ্দিন আইউবী নামে খ্যাতি লাভ করেন।
নজমুদ্দিন আইউবী ও তাঁর খান্দান মৌসেল যাওয়ার পর ইমাদ উদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করে নিজেদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করেন। ইমাদ উদ্দিন জঙ্গী তাঁর দুর্দিনের হিতাকাংখী নজমুদ্দিনের অনুগ্রহ ভুলে যাননি, তিনি তাঁকে বা’লাবাক প্রদেশের গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।
সালাহ উদ্দিনের বয়স যখন নয় বছর তখন ইমাদ উদ্দিন জঙ্গী নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর নূরুদ্দিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১১৫৪ সাল থেকে ১১৬৪ সাল পর্যন্ত দামেস্কের একজন বিশিষ্ট সেনাপতি হিসেবে সালাহ উদ্দিন নূরুদ্দিনের দরবারে অবস্থান করেন। আরব ঐতিহাসিকদের মতে সালাহ উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই উত্তম গুণাবলী ও যোগ্যতা সম্পন্ন নওজোয়ান ছিলেন। সুলতান নূরুদ্দিনের দরবারে অবস্থান কালে সালাহ উদ্দিন তাঁর নিকট থেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা, সুন্দরভাবে মানুষের সাথে মেশা, আল্লাহদ্রোহীদের সাথে জিহাদে লিপ্ত থাকা প্রভৃতি গুণাবলী অর্জন করেছিলেন। বীরত্ব ও বাহাদুরীতে সুযোগ্য হলেও সালাহ উদ্দিন নির্জনতাকে অধিক ভালোবাসতেন। তাঁর বয়স যখন পঁচিশ বছর তখন পিতৃব্য আসাদ উদ্দিন শোরসোই তাঁকে মিসর অভিযানে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। শোরসোহ নুরুদ্দিনকে এ ব্যাপারে অবহিত করলে তাঁর একান্ত অনুরোধে অবশেষে সালাহ উদ্দিন মিসর অভিযানে যেতে সম্মত হন। সে অভিযানে তিনি রাতারাতি প্রচুর খ্যাতি লাভ করেন। দুনিয়ার বিশিষ্ট সেনানায়কদের বীরত্ব ও মহত্ত্ব তাঁর সম্মুখে ম্লান নিষ্প্রভ হয়ে পড়লো।
প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক লেনপুনের ভাষায় সালাহ উদ্দিনের মিসর অভিযান ছিল এইরূপ : একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় জোরপূর্বক তাঁকে মিসর পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু যে পথে পা-বাড়াতে তিনি ভয় পেতেন সে পথই তাঁকে প্রভূত খ্যাতি ও পথের দিশা দান করেছে। অতি অল্প সময়েই তিনি মিসরের ফাতেমী খিলাফতের অবসান ঘটান। অতঃপর নূরুদ্দিনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নিজেই দেশ শাসন করতে লাগলেন। কিন্তু এ প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। কার্যতঃ সালাহ উদ্দিনই ছিলেন স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বাদশাহ।
মিসর অভিযানের মাধ্যমেই সালাহ উদ্দিন ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনভাবে সুদক্ষ সেনাপতির মত যুদ্ধ করে তৃতীয় অভিযানে ১১৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি মিসর জয় করেন। মিসর জয়ের পর সালাহ উদ্দিন ক্রুসেডারদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। দ্বিতীয় কাবা বায়তুল মুকাদ্দাস ও জেরুজালেম নিয়ে ইউরোপের সমগ্র খৃস্টান রাজশক্তি ও মুসলমানদের মধ্যে যে দু’শ বছরের যুদ্ধ চলে খৃস্টানরা তার নাম দিয়েছে ক্রুসেড যুদ্ধ। খৃস্টানদের সাথে সালাহ উদ্দিন তেইশ বছর স্থায়ী এক ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের সূচনা করেন। সে দীর্ঘ সময়ে সাফল্য ও ব্যর্থতা সমভাবে তাঁর সম্মুখে এসেছিল কিন্তু জয়ের আনন্দে বিভোর হয়ে উচ্ছৃঙ্খল ও বল্গাহারা বিলাস-ব্যসনে তিনি যেমন গা এলিয়ে দেননি, তেমনি পরাজয়ের বেদনা তাঁকে করতে পারেনি মনোবল- হারা—হতোদ্যম। মর্দে মুমিনের মত তিনি অসীম সাহসে শত্রুদের মুকাবিলা করেছিলেন আর পুত্র-কন্যা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে তাঁবুর জীবনকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন হাসিমুখে।
সুলতান সালাহ উদ্দিন ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপকে কঠোর হস্তে দমন করেন। মুসলিম মিল্লাতকে নতুন ভাবে সংগঠিত করে তাদের মধ্যে নব জীবনের সঞ্চার করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আরব, সিরিয়া, ইরাক তাঁর আয়ত্তাধীন হয়ে গেলো এবং তিনি দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি নিয়োগ করলেন।
ছোটখাট অনেকগুলো যুদ্ধে লিপ্ত হবার পর অবশেষে ১১৮৭ সালের মার্চ মাসে সুলতান সালাহ উদ্দিন ক্রুসেডারদের কর্তৃত্ব খতম করে দিয়ে ইসলামের বিজয় সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে জিহাদ ঘোষণা করেন। সিরিয়া, ইরাক, জজিরা-ই-দিয়ারই বকর, মিসর প্রভৃতি স্থান থেকে সৈন্যরা এসে আশতুরা নামক স্থানে সমবেত হলো। অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে ক্রুসেডাররা নিজেদের খুঁটিনাটি বিভেদ-মতানৈক্য ভুলে জেরুজালেমের বাদশাহ গাঈ-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের মুকাবিলার জন্য অগ্রসর হলো। ২৬শে জুন মুসলিম বাহিনী অগ্রাভিযান শুরু করলো। ক্রুসেড বাহিনী তখন সফুরীয়া কূপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
জুলাই মাসের ৩ তারিখে ক্রুসেড বাহিনী সফুরীয়া থেকে তবরীয়ার দিকে যাত্রা করলো। মুসলমানরা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। ক্রুসেড বাহিনীর যাত্রার সাথে সাথেই তারা বীর বিক্রমে হামলা চালালো। অসংখ্য ক্রুসেডার মুসলমানদের তীক্ষ্ণ তলোয়ারের আঘাতে ঢলে পড়লো। গাঈ তখন সেনাবাহিনীকে থেমে যাবার নির্দেশ দিলেন।
ঐতিহাসিক লেনপুল সে যুদ্ধের দৃশ্য আঁকতে গিয়ে লিখেছেন :
সে রাতের কথা কখনো ভুলবার নয়। সারারাত সবার মুখে একই শব্দ –, পানি পানি পানি। পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। কাছেই মুসলিম বাহিনী ছিল প্রহরারত। তাদের পদধ্বনি স্পষ্ট শোনা যেত। কখনো কখনো আল্লাহু আকবর আবার কখনো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ধ্বনি আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলতো। অবশেষে যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলিম বাহিনী প্রথমে তীর বর্ষণ শুরু করলো। তারপর তারা ক্রুসেডারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ফলে শুরু হলো সম্মুখ যুদ্ধ। সৈন্যবাহিনী তীব্র পিপাসার প্ৰকোপ সত্ত্বেও প্রাণপণে লড়লো। স্বয়ং গাঈ তার সেনাবাহিনীকে প্রেরণা দিচ্ছিলো। সূর্যের অনল বর্ষণের মধ্যে মুসলমানদের বিরামহীন আক্রমণে ক্রুসেড বাহিনী অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। উষ্ণতা ও ধুঁয়া যেন প্রলয়ের সৃষ্টি করলো। ক্রুসেডারদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও দিশেহারা ভাব দেখা দিলো। তারা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিল কিন্তু রণকুশলী সুলতান সে পথও বন্ধ করে রেখেছিলেন! তাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে তিনি হত্যা করলেন। মুসলমানরা পাহাড়ের উপর অবস্থানকারী গাঈকেও ঘেরাও করলো। ক্রুসেড বাহিনী প্রাণপণে চেষ্টা করেও স্থায়ী ক্যাম্প এবং ‘পুণ্য’ ক্রুসেভা সংরক্ষণ করতে পারলো না। ক্রমাগত আক্রমণ দ্বারা সব উড়িয়ে দেয়া হলো। পুত ক্রুশ তখন মুসলমানদের করায়ত্ব। সালাহ উদ্দিন তখন কৃতজ্ঞতায় সিজদায় শির অবনত করলেন।
ক্রুসেড বাহিনীর বাহিনীর বাছাই করা নওজোয়ানরা বন্দী হলো। বাদশাহ গাঈ, তাঁর ভ্রাতা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট খৃস্টানরাও বন্দী হলো।
ক্রুসেড যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর সুলতান সালাহ উদ্দিন বায়তুল মুকাদ্দাসকে খৃস্টানদের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এটা ছিল তাঁর বহুদিনের মানস লালিত আকাংখা। ১১৮৭ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের সম্মুখে হাজির হলেন। কিন্তু ইসলাম বিনা কারণে রক্তপাত ঘটানো পছন্দ করে না। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য। এজন্য সুলতান সালাহ উদ্দিনও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া রক্তাক্ত পথে অগ্রসর হবার পক্ষপাতি ছিলেন না।
তাঁর জীবন ছিল ইসলামী আদর্শে সমুজ্জ্বল। এজন্য সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবার প্রশ্নই ওঠে না। বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করতে গিয়ে সুলতান একান্তভাবে চাচ্ছিলেন যেন বিনা যুদ্ধেই খৃস্টানরা অস্ত্র সংবরণ করে। কারণ এতে ঐতিহ্যবাহী বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্ৰতা অক্ষ থাকবে। আলাপ- আলোচনা করার পর খৃস্টানরা বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করলো। মুসলিম মুসলিম অধিকার স্বীকৃত হবার পরই সমগ্র শহরে আযানের আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। মহান আল্লাহর যিকিরে দিক-দিগন্ত মুখরিত হয়ে উঠলো।
দীর্ঘ নব্বই বছর পর মুসলমানদের শহর তাদের হাতে ফিরে এলো। কুবা-ই-সাখরার ওপর থেকে ‘ক্রস’ চিহ্ন নামিয়ে ফেলা হলো। মসজিদে আকসার জন্য সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী নির্মিত বহুমূল্য মিম্বর সালাহ উদ্দিন এনে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। সে মিম্বরটি তৈরী করা হয়েছিল হলব শহরে। সুলতান জঙ্গীর আশা ছিল, বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের পর তা মসজিদে আকসায় স্থাপন করা হবে। সুলতান সালাহ উদ্দিন তাঁর সে আশা পূর্ণ করেন।
বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকারের পর সালাহ উদ্দিন আইউবী যে মহানুভবতা ও উদারতার পরিচয় দেন, খৃস্টান ঐতিহাসিকের জবানীতে তার অনবদ্য বিবরণ পাওয়া যায় :
‘তখন সালাহ্উদ্দীন মানবীয় মহত্ত্বের শীর্ষদেশে আরোহন করেছিলেন। দায়িত্বশীল সঙ্গীদের নেতৃত্বাধীনে তাঁর সেনাবাহিনী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা এতো সুন্দর ছিল যে, কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, খৃস্টানদের প্রতি অশোভন কোন আচরণ করা হয়নি। শহর থেকে বের হওয়ার সকল পথেই ছিল সুলতানের পাহারাদার। শহরের বিশিষ্ট দ্বার বাব-ই-দাউদে একজন বিশ্বস্ত আমীরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি শহর ছেড়ে বাইরে গমন কারী সকল ব্যক্তির নিকট থেকেই ফিদিয়া বা মুক্তিপন আদায় করতেন।
‘শহরের সমস্ত অধিবাসী একে একে এসে আত্মীয়-স্বজনসহ ক্রমশঃ বেরিয়ে পড়লো, মুসলমানরা খৃস্টানদের মাল-পত্র খরিদ করছিল যেন তারা স্বাধীনতা লাভের জন্য ফিদিয়া দিতে পারে।
‘১০৯৯ সালে ক্রুসেডারগণ বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে বিজিতদের সাথে অমানবিক আচরণ করে। তারা শহরের অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে মুসলমানদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। অসংখ্য মুসলমানকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। মসজিদে আকসার ছাদ ও মিনারের উপর তাদেরকে প্রকাশ্যে জবাই করা হয়। তারা পবিত্র শহরকে হত্যাকেন্দ্রে পরিণত এবার মুসলমানরা তা পুনর্দখল করে এবং সেই পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিদের ব্যাপারে মহানুভবতার পরিচয় দেয় তাদের প্রতি দয়া ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে।
হিত্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসে খৃস্টানদের শোচনীয় পরাজয়ের খবর ইউরোপে পৌঁছলে তাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এবং ইউরোপের বিভিন্ন খৃস্টান রাষ্ট্র থেকে দলে দলে সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু অমিততেজা বীর সুলতান সালাহ উদ্দিন এর মুকাবিলার জন্য দঢ়তার সাথে প্রস্তুত হলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর যুদ্ধ চললো। সিরিয়ার সমুদ্রোপকূল খৃস্টানদের অধিকারে চলে গেল। এক সময় তারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দ্বারপ্রান্তেও উপস্থিত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু দঢ়চেতা সুলতান বিন্দু মাত্র মনোবল মনোবল হারাননি। যে কোন মূল্যে শহরের পবিত্রতা রক্ষার্থে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সুলতান সালাহ উদ্দিনের অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেনপুল লিখেছেন : বৃহস্পতিবার সারাটা দিন যুদ্ধ প্রস্তুতিতে অতিবাহিত হলো। জেরুজালেমের নিকটবর্তী এলাকার সমস্ত কূপ এবং পুকুর নিশ্চিহ্ন করে অথবা এগুলোতে বিষ মিশিয়ে দেয়া হলো। শুক্রবার রাত সুলতান অত্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে অতিবাহিত করেন। ফজর পর্যন্ত তিনি স্বীয় প্রাইভেট সেক্রেটারী কাজী বাহাউদ্দিনের সাথে পরামর্শ করেন। পরদিন ছিল শুক্রবার। অতি নম্রতা ও বিনয়ের সাথে সুলতান ফজরের নামায আদায় করেন। দীর্ঘক্ষণ সিজদায় পড়ে রইলেন তিনি। তাঁর চোখের পানিতে জায়নামায সিক্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যায় তাঁর সেনাপতি সংবাদ দিল যে, শত্রু অগ্রাভিযান চালিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলের ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিল কিন্তু এখন তারা পিছপা হচ্ছে। পরদিন সংবাদ এলো, ক্রুসেড বাহিনীর মধ্যে মতবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কেউ সামনে আবার কেউ পিছনে হটে যাবার পক্ষপাতি। এ সংকটাবস্থার মীমাংসার ভার দেয়া হয়েছে জুরির উপর। জুরি জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছনে সরে কায়রোর উপর আক্রমণ করার পক্ষে রায় দিলো। কায়রো ছিল ২৫০ মাইল দূরে। পরদিন তারা ফিরে চলে গেল। মুসলমানদের মন আনন্দে নেচে উঠলো। সুলতান সালাহ উদ্দিনের মুনাজাত আল্লাহ কবুল করলেন।
দীর্ঘ পাঁচ বছর যুদ্ধের পর উভয় পক্ষ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে রামলাহ্ নামক স্থানে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক লেনপুল লিখেছেন : পবিত্র যুদ্ধ সমাপ্ত। দীর্ঘ পাঁচ বছরের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ শেষ হলো। ১১৮৭ সালের জুলাই মাসে মুসলমানদের হিত্তিন যুদ্ধে বিজয়ের পূর্বে জর্দান নদীর পূর্ব পারে মুসলমানদের এক ইঞ্চি যায়গাও ছিল না। ১১৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রামলাহ্ চুক্তিকালে ‘সুর’ থেকে ইয়াকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার একমাত্র সমুদ্রোপকূলে সামান্য ভূমি ছাড়া বাকী সমস্ত ভূমিই ছিল মুসলমানদের অধিকারে। এ চুক্তিপত্রের জন্য সালাহ উদ্দিনকে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হতে হয়নি।
ক্রুসেডাররা যতটুকু জয় করে তার বৃহদংশটি ছিল ফিরিঙ্গিদের হাতে। কিন্তু শুধু জান-মালের প্রতি লক্ষ্য করলে এই পরিণতি ছিল অতি তুচ্ছ, নগণ্য। তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধে সমগ্র খৃস্টান জগতের সামগ্রিক শক্তি সম্মুখে অগ্রসর হয়, কিন্তু এতে সালাহ উদ্দিনের শক্তিকে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত করতে পারেনি।
এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর মহাবীর রিচার্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য যোদ্ধাগণ জেরুজালেমের উপর আক্রমণের অপূর্ণ আকাংখা নিয়ে সিরিয়া ত্যাগ করেন।
সুলতান সালাহ উদ্দিন আইউবীর দ্বারা আল্লাহ তা’আলা ইসলামের গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ইসলামের এক দুর্ভেদ্য রক্ষাকবচ। তিনি না হলে ইংরেজ, জার্মান এবং রোমীয়রা পরস্পর একত্র হয়ে ইসলামকে সম্পূর্ণ বিপন্ন করে ছাড়তো। সিরিয়া, ইরাক এবং মিসরে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হতো।
সিকান্দার রুমী এবং চেঙ্গীজ খানের মত সালাহ উদ্দীন তাঁর শক্তি রাজ্য জয় আর শান-শওকত বৃদ্ধির কাজে ব্যয় করেননি। মিসর, সিরিয়া, মৌসেল, কুর্দিস্তান এবং আরব এলাকার জনগণের উপর তার যে খেদমত রয়েছে ইতিহাস কোনদিন তা বিস্মৃত হবে না।
ঐতিহাসিক ইবনে খালকান লিখেছেন : মহানুভব সুলতান সালাহ উদ্দিন যখন মিসরের ফাতেমী বংশের শাসনকর্তা আল- আজেদ-এর স্থলে শাসন ক্ষমতা লাভ করেন তখন মিসরের শাহী খাজাঞ্চিতে মোতি, জওহর এবং স্বর্ণ-চাঁদীর অসাধারণ সঞ্চয় মওজুদ ছিল। সুলতান মিসরের দরিদ্র জনগণের মধ্যে তা বিলিয়ে দেন এবং দীর্ঘকাল থেকে সঞ্চিত সেসব মূল্যবান সম্পদ দিয়ে হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, সড়ক, সেতু প্রভৃতি জনকল্যাণ মূলক কাজে ব্যয় করেন এবং জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত করেন। ফাতেমী বংশের বাদশাহদের দীর্ঘকাল থেকে গড়ে তোলা বহু মূল্যবান ইমারতসমূহ সালাহ উদ্দিন ওলামায়ে কেরাম ও সুফী-সাধকদের দান করেন, যেন তাতে জনসাধারণের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেয়া হয়।
প্রত্যেক শতাব্দীতে আল্লাহ তা’আলা মুসলিম মিল্লাতের খেদমত করার জন্য যেসব ব্যক্তিকে পাঠান, সুলতান সালাহউদ্দিন ছিলেন তাদের একজন। চরিত্র ও নৈতিকতার দিক থেকে তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন আকিদা, বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী। নামায, রোযার কঠোর পাবন্দ ছিলেন তিনি। বিশেষ ওজর ব্যতীত জীবনে জামায়াত ছাড়া নামায আদায় করেননি। এমন কি মৃত্যুর পূর্বেও ইমামকে ডেকে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করেছেন।
শাহী মসনদে আসীন হবার পূর্বে সুলতান সালাহ উদ্দিন অতি মূল্যবান পোশাক পরিধান করতেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন হবার পর শাহী আবা যদিও পরিধান করেছেন তা ছিল কর্তব্যের খাতিরে, বিলাসিতার জন্য নয়। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ যা তিনি সাধারণত ব্যবহার করতেন তা ছিল খুব কম মূল্যের। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর ও ইবনে সিদাদ লিখেছেন : সারা জীবনে সুলতান কখনো রেশমী বস্ত্র পরিধান করেননি এবং রঙিন পোশাক পরিচ্ছদে সজ্জিত হননি। বিলাসিতা বা আড়ম্বরকে তিনি সদা-সর্বদা এড়িয়ে চলতেন। তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করতেন না। শাহী খাজাঞ্চিতে যে অর্থ সংগৃহীত হতো তা তিনি সাথে সাথেই ব্যয় করে ফেলতেন। শুষ্ক-নীরস রুটি ছিল তাঁর প্রাত্যাহিক খাদ্য। এই অনাড়ম্বর নির্বিলাস বাদশাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভাবলে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সুলতান সালাহ উদ্দিন আইউবী কোনদিন জীবনে ব্যক্তিগত আক্রোশে কারো উপর প্রতিশোধ নেননি, জোর-জবরদস্তি করে অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করেননি, কোন অনৈসলামী ট্যাক্স বা কর ধার্য করে জাতীয় স্বার্থ বিগর্হিত কোন কাজ করেননি; মিসর, সিরিয়া, ইরাক, আরব, মৌসেল, কুর্দিস্তানের বিরাট সাম্রাজ্যাধিপতি হয়েও তাঁর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা বাড়ীঘর ছিলো না। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা নিত্যব্যবহার্য আসবাবপত্র বলতে যা বুঝায় তাও তার ছিল না, সব কিছুর মালিকানা ছিল রাষ্ট্রের। আমিরুল মুমেনীন আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ও ওমর ফারুক (রাঃ)-র মত সালাহ উদ্দিন আইউবীর জীবন যাপন ছিল অতি সাদা-সিধা, অনাড়ম্বর ও আল্লাহভীতিতে ভরপুর। ইসলামের আবির্ভাবের ৫৮৯ বছর পরেও সালাহ উদ্দিন আইউবী ইসলামী খেলাফতের যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তা সীমিতসংখ্যক মুসলমান নরপতি ব্যতিত আর কারো জীবন ইতিহাসে দেখা যায় না।
যে সুলতান সালাহ উদ্দিন লুই ফিলিপস, ফ্রান্সীস এবং রিচার্ডের মত প্রতাপশালী বাদশাহকে সিরিয়ার সমুদ্র-সৈকতে পরাজিত করেছিলেন, তাঁর যুদ্ধের হাতিয়ার, সাজ-সরঞ্জাম এমন কি ঘোড়াটি পর্যন্ত নিজের মালিকানাধীন ছিলোনা। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করেও তিনি ছিলেন রিক্ত মুসাফিরের মত। ইন্তেকালের সময় ছেলে-মেয়েদের জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এমন কি তাঁকে যে কাফন পরানো হয়েছিল তাও এক প্রতিবেশী ধার দিয়েছিলো।
দায়িত্ব সচেতন ও ও কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত সুলতান সালাহ উদ্দিন কখনো সরকারী কাজ-কর্ম এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হতেন না। যুদ্ধের ব্যস্ততা ব্যতীত সপ্তাহে দু’দিন তিনি দু’টি বড় মোকদ্দমার আপিল শুনতেন। সে সময়ে ওলামায়ে কেরাম ও ফকীহদের এক জামাতও তাঁর পাশে থাকতো। তিনি যদি কোন ভুল করতেন তবে তার প্রতিবাদের ও সংশোধনের পূর্ণ অধিকার ছিল। সপ্তাহের সে দু’দিনে অভাবগ্রস্ত নির্যাতিত জণগণের তাঁর নিকট সরাসরি ফরিয়াদের পূর্ণ অধিকার ছিল। সুলতান ফরিয়াদীদের কাছে ডাকতেন এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাদের কথা শুনে সুবিচার করতেন। যে এলাকাতেই তিনি সফর করতেন, তাঁর সওয়ারীর সামনে এক ব্যক্তি আওয়াজ দিতে দিতে যেতো, হে জণসাধারণ! তোমাদের শাসনকর্তা সুলতান সালাহ উদ্দিন তোমাদের নিকট এসেছেন। তাঁর কোন পুত্র, কোন নায়েব বা অন্য কেউ যদি তোমাদের উপর অবিচার করে থাকে তবে তা সরাসরি তাঁর নিকট বলে দাও। কেউ যদি কষ্ট দিয়ে থাকে তবে সুলতানের সামনে এসে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে সুবিচার আদায় করো।
জনগণের প্রয়োজনের প্রতি সুলতান খুব বেশী মনোযোগী ছিলেন। বিধবা, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্ত দারিদ্র্য প্রপীড়িতদের প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তিনি গোপন মজলিস বসাতেন। আর যদি কেউ লজ্জায় তাঁর নিকট বলতে সংকোচ বোধ করতো তাহলে সুলতান নিজে গিয়ে তার কথা শুনতেন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন।
যারা কর্জ নিয়ে আদায় করতে পারছে না তাদের সংবাদ নিয়ে তিনি তা আদায় করে দিতেন। নিঃসহায় মুসাফিরদের সফরের ব্যয় নির্বাহের জন্য সুলতান সালাহ উদ্দিন প্রতি দিনের জন্য তিনশত আশরাফী বরাদ্দ রেখেছিলেন, কখনো কখনো তা চার শতেও উন্নীত হতো।
সুলতান সালাহ উদ্দিনের রোজনামচা লেখক ও তাঁর সঙ্গী ইমাদউদ্দিন আল-কাতেব লিখেছেন : সারাদিন যত ব্যস্ত থাকেন না কেন, সুলতান জণগণের অভাব-অভিযোগের সুরাহা করার ব্যবস্থা না করে বিছানায় যেতেন না। কঠিন ব্যধি বা অসুবিধার সময়েও তিনি তাঁর এ নিয়ম পরিত্যাগ করেননি। অভাবগ্রস্ত দুঃখী- দরিদ্রের আবেদনে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতেন। আবেদনকারী মুসলমান কি অমুসলমান তার প্রতি তাঁর লক্ষ্য থাকতো ইমাদউদ্দিন আল-কাতের এবং ঐতিহাসিক ইবনে সিদাপ বায়তুল মুকাদ্দাস, মক্কা ও দামেস্ক অবরোধকালীন কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন : সুলতান সালাহ উদ্দিন ঐসব অসহায় খৃস্টানদের সাথেও অনুগ্রহের বিষ্ময়কর নমুনা দেখিয়েছেন যারা গতকালও তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সেসব খৃস্টানের মধ্যে নারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবা সবাই ছিল। অসহায় নারীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল মাত্রাতিরিক্ত। একদা দুর্যোগ মূহূর্তে একজন খৃস্টান রমনী কাঁদতে কাঁদতে সালাহ উদ্দিনের নিকট হাজির হয়ে বললো : ‘আমার ছেলে যুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছে’। সালাহ উদ্দিন সে ছেলের খোঁজ করার জন্য যাবতীয় কাজ-কর্ম মুলতবী করে দিলেন।
সঙ্গী-সাথী বা প্রতিবেশীদের যে কেউ রোগাক্রান্ত হতো বা ঋণগ্রস্ত হয় পড়তো, সুলতান তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেন। বাহাউদ্দিন আল-কাতেব তাঁর মৃত্যুর সময়কার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন : যখনই তাঁর নিকট কোন অনাথ এসেছে, সুলতান উদার চিত্তে তার প্রয়োজন পূরণ করেছেন, তার মাসোহারা ধার্য করে দিয়েছেন, তার লালন-পালনের সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কোন বৃদ্ধাকে দেখলেই তাঁর প্রাণ বেদনায় কেঁদে উঠতো। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য-সহিঞ্চুতার সাথে তার কথা শুনতেন এবং অভাবগ্রস্ত হলে এমন সাহায্যের ব্যবস্থা করতেন যাতে আজীবন তার কোন কষ্ট না হয়। বাহাউদ্দিন আল-কাতেব এমন হাজার হাজার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কথা লিখেছেন যাদের জন্য সালাহ উদ্দিন দরাজ হাতে সাহায্য করেছেন। তাদের সব দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ তাঁর মমত্ববোধের কারণে তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল।
ইসলামী অনুশাসন তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন। মোটকথা তাঁর জীবন, শাসন ব্যবস্থা সবই ছিল ইসলামী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ নমুনা। জীবনের কঠিন ও নাজুক সময়ে তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া-মোনাজাত ও কান্নাকাটি করতেন।
কাজী ইবনে সিদাদ লিখেছেন: বায়তুল মুকাদ্দাসের সঙ্কট সময়ে তিনি সারা রাত দোয়ার ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন। বিনয়, নম্রতা, দয়াশীলতা, মহত্ত্ব ও উদারতায় তিনি ছিলেন ইতিহাসের বিস্ময়। যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে মনে হতো সন্তান হারা মায়ের মত। অশ্বারোহণ করে এক সারি থেকে অন্য সারি পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়াতেন। আর সৈন্যদের জেহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে বলতেন: “তোমরা ইসলামের বিজয়ে সাহায্য করো।” এ কথা বলতে তার দু’চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠতো।
আজীবন ইসলামের বিজয় ঘোষণা করে এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি আঞ্জাম দিয়ে, মুসলিম জাহানকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করে মহাবীর বিশ্ববিখ্যাত সেনাপতি গাজী সুলতান সালাহ্ উদ্দিন আইউবী ৫৮৯ হিজরীর সফর মাসে ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখে ইন্তেকাল করেন।