অমুসলিমদের দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)

রচনায়: সৈয়দ আশরাফ আলী

বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেড়শ’ কোটি মুসলমান নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) হচ্ছেন সর্বযুগের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু এই দাবি যখন করা হয় তখন অমুসলিমগণ কিংবা যারা ধর্মে আদৌ বিশ্বাস করে না, তারা অনেকেই প্রতিবাদ করে, ভ্রূকুটি করে এবং প্রয়োজনবোধে ব্যঙ্গ করে। এ কথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বা সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন “ধ্রুব”-এর দ্বারা প্রভাবান্বিত মুষ্টিমেয় দুর্বলচিত্ত মুসলমানও এই দাবির পটভূমিকায় উচ্চারণ করে যে, আমরা মুসলমান বলেই না কি এরূপ দাবি করছি।

কিন্তু তারা বোধ হয় জানে না যে, আমাদের এই দাবি শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দাবি নয়, এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন উইলিয়াম ম্যুরের মত কঠোর ইসলাম- বিদ্বেষী। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন জন স্টুয়ার্ট মিলের মত Utilitarianism-এর একজন প্রখ্যাত প্রবক্তা, ঘোর নাস্তিক ও বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর মত অহিংসবাদী ধর্মপ্রাণ হিন্দু। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন বসওয়ার্থ স্মিথের মত ধর্মভীরু পাদ্রী। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মত জগৎ-বিখ্যাত বীর ও মনীষী। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন বার্নার্ড শ’র মত বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন-এর মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক। এই দাবির স্বীকৃতি দিয়েছেন গুরু নানকের মত উদারপ্রাণ ধর্মগুরু। যারা ইসলামের কথা শুনে উন্নাসিক হয়ে পড়ে; যারা মনে করে যে, ইসলাম হচ্ছে মধ্যযুগের চিন্তাধারা এবং আধুনিক বিশ্বের অনুপযোগী, তারা যদি একটু খোঁজ রাখতে কষ্ট স্বীকার করে, অজ্ঞতার মায়াজাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার সামান্য প্রয়াস নেয় তাহলে দেখতে পাবে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে মুসলমানরাই শুধু শ্রদ্ধা করে না, পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বী বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বরাও মেনে নিয়েছেন তাঁকে যুগস্রষ্টা হিসেবে, মহামানবরূপে; এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে।

অমুসলিমদের দৃষ্টিতে ইসলামের নবী সম্পর্কে আলোচনা শুরু করার পূর্বে প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে এবং স্বল্পসংখ্যক তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণা বিরাজ করছে, তা’ আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এটি হচ্ছে একটি সুপরিকল্পিত কূট- চক্রান্তের ফলশ্রুতি। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’র মত নির্ভরযোগ্য প্রকাশনাও দাবি করছে: Few great men have been so maligned as Muhammad….. Christian scholars of medieval Europe painted Muhammad as an imposter, a lecher and a man of blood. A corruption of his name, Mahound, came to signify the devil. This picture of Muhammad and his religion still retains some influence. একই এনসাইক্লোপেডিয়া হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে আবার চিহ্নিত করেছে “জগতের ধর্ম-প্রবর্তকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সফলকাম পয়গম্বর” হিসাবে।

ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধ এই চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র যে কত সুপরিকল্পিত, তার ছোট্ট একটি নিদর্শন মেলে মাইকেল হার্টের বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ ‘দি হানড্রেড—এ কিং অফ দি মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসন্‌স ইন হিস্টরী’ শীর্ষক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি ২৭ বছর পূর্বে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর মধ্যেই এই গ্রন্থটি তাৎপর্যময়ভাবে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের দরুন। এর কারণ বোধ হয় এই যে, এই গ্রন্থটিতেই মাইকেল হার্টের মত একজন বিশ্ববিখ্যাত অমুসলিম দাবি করেছেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল বিরল ব্যক্তিত্ব অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাঁদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর স্থান সর্বশীর্ষে। তাঁর ভাষায় :

My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular levels.

তাঁর এই অভিমতের জন্য এই গ্রন্থটির প্রায় সমস্ত কপিই মুসলিম-বিদ্বেষীরা সংগ্রহ করে এমনভাবে বিনষ্ট করে যে, অনেকে মনে করতে থাকেন, এ জাতীয় কোন গ্রন্থ আদৌ প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটির “রিভিউ” বা পর্যালোচনা প্রকাশিত হয় বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউজউইক’ পত্রিকার ১৯৭৮ সালের ২১শে জুলাই তারিখের সংখ্যায়। তবুও এটি নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর যে, মুসলিম-বিদ্বেষীরা দাবি করে যে, এ জাতীয় গ্রন্থ না কি আদৌ প্রকাশিত হয়নি। এই ঢাকা শহরেই অল্প কয়েক বছর পূর্বে একটি সেমিনারে তথাকথিত ‘আঁতেলেকচ্যুয়ালরা’ এই গ্রন্থটির অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে। এ থেকে সহজেই উপলব্ধ হয় যে, এক শ্রেণীর মুহাম্মদ (সা)-বিদ্বেষী লোকদের চক্রান্ত, দুরভিসন্ধি কত মারাত্মক ও কত ভয়ংকর ছিল।

এই গ্রন্থটির প্রায় সমস্ত কপিই পুড়িয়ে ফেলা হয়। কারণ, তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তো স্বীকার করতে পারে না যে, ১৪ শ’ বছর পূর্বের পার্থিব অর্থে নিরক্ষর একজন আরব পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। তাদের ‘ধ্রুব’, তাদের আধুনিক শিক্ষা তাদেরকে তো এই সত্য স্বীকার করতে দেবে না!

কিন্তু কেন এই চক্রান্ত, কেন এই বিষোদগার? এর কারণ, হযরত (সা) শুধুমাত্র আরবদের জন্য বা মুসলমানদের জন্যই প্রেরিত হন নি। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্ব- জগতের জন্য, সকল সৃষ্টির জন্য রহমত- রাহমাতুললীল ‘আলামীন। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :

“হে মানবকুল! নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর রাসূল বা প্রেরিত দূত।”

তাঁর পূর্বসূরীদের মত তিনি কোন একটি জাতির জন্য, কোন একটি দেশের জন্য, কোন একটি সমাজের জন্য প্রেরিত হন নি। আমরা বিশ্বাস করি যে, তিনি বিশ্বজগতের সমস্ত সৃষ্টির কল্যাণের জন্যই প্রেরিত হয়েছেন।

অবশ্য এ দাবি শুধুমাত্র মুসলমানদেরই নয়। জর্জ বার্নার্ড শ’-ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন:

‘মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ধর্মযাকজগণ তাঁদের অজ্ঞতা কিংবা গোঁড়ামির কারণে মুহাম্মদকে কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত করিয়াছেন। বস্তুত তাহাদিগকে মানুষ মুহাম্মদ এবং তাঁহার দর্শনকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল। তাহাদের কাছে মুহাম্মদ ছিলেন দজ্জাল। আমি তাঁহাকে অধ্যয়ন করিয়াছি -আশ্চর্য মানুষ তিনি! আমার বিশ্বাস, তাঁহাকে দজ্জাল না বলিয়া বরং মানব জাতির ত্রাণকর্তা বলাই উচিত। আমি বিশ্বাস করি, যদি তাঁহার মত কোন ব্যক্তি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করিতেন তবে তিনি ইহার সমস্যাগুলি এরূপভাবে সমাধান করিতে পারিতেন যাহাতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত শান্তি ও সুখ ইহজগতে আনয়ন করিতে সমর্থ হইতেন।”

গুরু নানক উল্লেখ করেছেন: “এখন দুনিয়াকে পরিচালিত করার জন্য কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ। সাধু, সংস্কারক, গাজী, পীর, শেখ ও কুতুবগণ অশেষ উপকার পাবেন যদি তাঁরা পবিত্র নবীর উপর দরূদ পাঠ করেন। মানুষ যে অবিরত অস্থির থাকে এবং নরকে যায় তার একমাত্র কারণ এই যে, ইসলামের নবীর প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা নেই।”

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্যার সিভি রমণ বলেছেন: “মুহাম্মদের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ও কলঙ্কহীন। মুহাম্মদ কখনও নিজেকে ভগবানের সমান বলে মনে করেন নি। তাঁর অনুসারীরা কখনও একবারের জন্য বলে না যে, তিনি একজন মানুষের চেয়ে বেশি অন্য কিছু ছিলেন। তারা কখনও তাঁর উপর ঐশী সম্মান আরোপ করে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা) অন্য যে কোন ব্যক্তির চেয়ে দুনিয়ায় অধিকতর মঙ্গল সাধন করে গেছেন।”

স্বামী বিবেকানন্দ ‘দি গ্রেট টিচার্স অব দি ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “তারপর আসেন সাম্যের দূত মুহাম্মদ। তুমি প্রশ্ন কর, তাঁহার ধর্মে কি ভাল আছে ? যদি তাহাতে ভাল না থাকে, তবে কিরূপে তা বাঁচিয়া থাকে? কেবল …. ভালই বাঁচে, কেবল টিকিয়া থাকে।

পবিত্র লোকের জীবন কি দীর্ঘতর হয়? নিঃসন্দেহে, কারণ পবিত্ৰতা শক্তি, সৎস্বভাব শক্তি। মুসলমান ধর্ম কিরূপে বাঁচিয়া রহিল, যদি তাহার শিক্ষার কিছুই ভাল না থাকে? তাহাতে নিঃসন্দেহে বহু কিছু ভাল আছে। মুহাম্মদ ছিলেন সাম্যের পয়গম্বর, মুহাম্মদ ছিলেন মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের পয়গম্বর সার্বজনীন বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের।”

বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক এইচ, জি, ওয়েলস ইসলামকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছেন। মহানবীকে তিনি নানাভাবে দোষারোপ করেছেন। অন্যায়ভাবে বিভিন্ন কলঙ্কে কলঙ্কিত করেছেন। তবুও তিনি স্বীকার করেছেন: “দ্ব্যর্থবোধক কোন প্রতীক ছাড়াই, অন্যকে মসীলিপ্ত বা পুরোহিতগণের স্তুতি না করেই, মুহম্মদ সেই আকর্ষণীয় বিশ্বাসগুলি মানব জাতির হৃদয়ঙ্গম করিয়েছিলেন। ইসলাম সৃষ্টি করেছিল এমন এক সমাজ, এর আগে দুনিয়ায় অস্তিত্বশীল যে কোন সমাজের তুলনায় যা ছিল ব্যাপক নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক অত্যাচার থেকে অধিকতর মুক্ত।”

অনেকের হয়ত ধারণা হতে পারে যে, অমুসলিমদের এই চক্রান্তের কাহিনী মুসলমানদের মনগড়া, তাদের কল্পনার ফলশ্রুতি। কিন্তু ‘দি হানড্রেড’ শীর্ষক মাইকেল হার্টের যে গ্রন্থটির বিষয় পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি সম্পর্কে পুস্তকের দোকানে কিংবা গ্রন্থাগারে খোঁজ নিলে প্রতীয়মান হবে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এমন কি এই বইয়ের কোন কপি এককালে (মাত্র ২৭ বৎসর পূর্বে) এশিয়ারও কোনও দোকানে বা লাইব্রেরিতে পাওয়া যেত না। প্রকাশিত হবার মাত্র এক বৎসরের মধ্যেই ‘দি হানড্রেড’ গ্রন্থটি প্রায় কপূরের মত গায়েব হয়ে যায়; মিশে যায় ওমর খৈয়ামের ভাষায় “yesterday’s seven thousand years”-এর সঙ্গে।

আরও একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা হয়ত উপলব্ধ হবে যে, ইসলামবিরোধীরা ইসলামকে কিভাবে বাধা প্রদান করে। বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে যখন সনি লিষ্টনকে পরাজিত করে “বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন’ আখ্যা লাভ করেন, তখন অমুসলিম সাংবাদিকরা তাঁর বিজয়ের সংবাদ নির্দ্বিধায় পৃথিবীর প্রতিটি কোণে পৌঁছে দেন। কিন্তু এই একই ব্যক্তি পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মোহাম্মদ আলী নাম গ্রহণ করেন, তখন সেই সংবাদ সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখা হয় মাসের পর মাস। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে থেকেও আমরা এ খবর জানতে পেয়েছি বহু মাস পরে এবং সেটিও সম্ভব হয় মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত প্রয়াসের মাধ্যমে। ‘বক্সিং রিং’-এর মধ্যেই প্রতিপক্ষকে বার বার আঘাত করে তিনি জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, What is my name? What is my name? তাঁর এই উন্মত্ত রূপ দেখে সেদিন দর্শকেরা এবং সাংবাদিকেরা সহজেই বুঝতে পেরেছিল, পৃথিবীও জানতে পেরেছিল যে, সত্যিই তিনি আর ক্যাসিয়াস ক্লে নন। তিনি তখন পুরোপুরি মুসলমান মোহাম্মদ আলীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

একইভাবে আজও আমরা সঠিকভাবে জানি না, চন্দ্রপৃষ্ঠে পদার্পণকারী প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং সত্যিই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন কি না। বৃটেন, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃত হয়েছে যে, নীল আর্মস্ট্রং ও মাইকেল কলিন্স ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। এই বাংলাদেশ থেকেও সরাসরি পত্র লেখা হয়েছে নীল আর্মস্ট্রং-এর কাছে। ‘নাসা’-র কাছে এই সত্যের স্বীকৃতির জন্য পত্র মারফত বেশ কয়েকবার অনুরোধ জানান হয়েছে। কিন্তু সুস্পষ্ট কোন উত্তর, কোন স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি কোনটি অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে শুধুমাত্র বিভ্রান্তিকর, দায়সারা গোছের উত্তর।

বলা বাহুল্য, আমাদের নবীর মহত্ত্বকে, প্রতিভাকে, ঔদার্যকে অমুসলিম মনীষীবৃন্দ যে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন, তা’ও সুস্পষ্টভাবে আমাদের কাছে পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি।

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মত পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম-বিরোধী এই মনোভাবের ব্যতিক্রম ঘটে, যখন বিখ্যাত মনীষী টমাস কার্লাইল এডিনবার্গের বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ৮ই মে তারিখে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেন ইসলামের নবীকে মহামানব হিসাবে। Hero, Hero worship and the Heroic in History সিরিজে বক্তৃতা প্রদানকালে ‘Hero as prophet’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি উল্লেখ করেন: Our cur- rent hypothesis about Mahomet, that he was a scheming Imposter, a Falsehood incarnate, that his religion is a mass of quackery and fatuity, begins really to be untenable to us. The lies, which well- meaning zeal has heaped round this man, are disgraceful to our- selves only.

নিবেদিতপ্রাণ ও একনিষ্ঠ খ্রিস্টান ধর্মযাজক বসওয়ার্থ স্মিথও উল্লেখ করেছেন: ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ ছিলেন একাধারে ‘পোপ’ ও ‘সীজার’। কিন্তু পোপের অসম্ভব দাবি, অথবা সীজারের বিশাল সৈন্যবাহিনী কোনটিই তাঁহার ছিল না। যদি কোন মানুষ স্থায়ী সেনাবাহিনী, দেহরক্ষী, রাজপ্রাসাদ, নির্দিষ্ট রাজস্ব ছাড়াই কেবলমাত্র ঐশ্বরিক অধিকারের বলে রাজ্য শাসন করার দাবী করিতে পারেন, তবে মোহাম্মদই হইতেছেন সেই ব্যক্তি। সাধারণ রাজপুরুষগণ, এমনকি নেপোলিয়ান, ক্রমওয়েল ও সীজারের ন্যায় শক্তিমান পুরুষগণও ক্ষমতার প্রলোভন ও আকর্ষণ হইতে নিজদিগকে দূরে রাখিতে পারেন নাই। মোহাম্মদ পূর্ণ বিনম্রতায় রাজদরবারের ঐশ্বর্য্য, আড়ম্বর ও আত্মাভিমানের অনেক ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিলেন। তিনি ক্ষমতার আড়ম্বরের কোন মূল্য দেন নাই, তিনি কেবল মূল্য দিয়াছেন সত্যের। তাঁহার সমসাময়িক ব্যক্তিগণ, এমনকি তাঁহার শত্রুগণও যাঁহারা তাঁহার বাণীকে অস্বীকার করিয়াছিলেন, তাঁহারাও একবাক্যে প্রতিটি বিষয়ে তাঁহার ন্যায়পরায়ণতা, দয়ার্দ্রচিত্ততা ও সত্যনিষ্ঠার উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। জগতের ইতিহাসে এক বিশেষ সৌভাগ্যের বলে তিনি একাধারে একটি ধর্ম, একটি জাতি ও একটি সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা। যদিও তিনি নিরক্ষর ছিলেন এবং লিখিতে-পড়িতে পারিতেন না, তবুও তিনি ছিলেন এমন একটি গ্রন্থের ধারক, যাহা একাধারে একটি কাব্যগ্রন্থ, আইনশাস্ত্র, প্রার্থনা পুস্তক ও ‘বাইবেল’ এবং আজও পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ অধিবাসী যাহাকে নিখুঁত রচনাকৌশল, জ্ঞানগর্ভ ও সত্যজ্ঞানের প্রেরণার দিক দিয়া অলৌকিক বলিয়া শ্রদ্ধা করেন। মুহাম্মদ ইহাকে একটি অলৌকিক বস্তু বলিয়া দাবি করিয়াছিলেন এবং সত্যই ইহা ছিল একটি অলৌকিক সৃষ্টি। তিনি যে দাবি লইয়া জীবন আরম্ভ করিয়াছিলেন জীবন-সায়াহ্ন অবধি সেই দাবি লইয়া তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। ইহা অপেক্ষা তাঁহার সততা ও আন্তরিকতার বড় প্রমাণ আর কি হইতে পারে? আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি যে, একদিন না একদিন প্রকৃত খ্রিস্টধর্ম ও জগতের শ্রেষ্ঠতম দর্শনও তাঁহাকে ঈশ্বরের একজন আদর্শ পয়গম্বর আখ্যা দিতে বাধ্য হইবে।”

হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সামগ্রিক জীবনের একটি সুন্দর ছবি অঙ্কিত হয়েছে মনীষী স্ট্যানলি লেনপুলের অপূর্ব ভাষায়:

“এই মানুষটির মধ্যে একদিকে নারীসুলভ কোমলতা ও অন্যদিকে গৌরবব্যঞ্জক তেজস্বিতার এমন সমাবেশ ছিল যে, এরূপ চরিত্র মানুষের মনে যে প্রেম ও ভক্তিভাব জাগাইয়া তোলে তাহাতে সমালোচক নিজের অজ্ঞাতসারেই অভিভূত হইয়া পড়েন এবং তাঁহার পক্ষে সঠিক রায় দান দুরূহ ব্যাপার হইয়া পড়ে। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া নিঃসঙ্গভাবে তাঁহার স্বজাতির ঘৃণা-বিদ্বেষ সহ্য করিযাছেন, আবার তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি করমর্দনের সময় অপরের হাত হইতে নিজের হাতকে কখনও প্রথমে সরাইয়া লন নাই। শিশুদের পরমপ্রিয় সেই ব্যক্তিটি কখনও তাঁহার মনোরম লোচনের মৃদু হাসি এবং তাঁহার মধুর কণ্ঠের মধুরতর সম্বোধন ছাড়া শিশুদের পাশ দিয়া যান নাই। সেই মানুষটির অকপট বন্ধুপ্রীতি, মহান ঔদার্য, অসম সাহসিকতা ও আশাবাদ ইত্যাদি গুণাবলী সমালোচনাকে স্তুতিবাদে পরিণত করে।”

“তিনি সেই অর্থে একজন ভক্ত ছিলেন যখন ভক্তিই হয় পৃথিবীর সারবস্তু, যাহা মানব- জীবনকে পচনের হাত হইতে রক্ষা করে। যখন জগতকে অনুপ্রাণিত করিবার জন্য ভক্তির একান্ত প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল, তিনি সেই সময়েই একজন ভক্তের বেশে আবির্ভূত হন, এবং তাঁহার ভক্তি ছিল মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত। যে সামান্য কয়েকজন ভাগ্যবান মানুষ একটি বিরাট সত্যকে জীবনের মূল উৎসরূপে বিবেচনা করার পরম সৌভাগ্য লাভ করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদেরই অন্যতম। তিনি ছিলেন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর দূত। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আত্মবিস্মৃত হন নাই এবং তাঁহার অস্তিত্বের নির্যাসস্বরূপ ছিল যে বাণী সেই বাণীকে তিনি বিসর্জন দেন নাই। তিনি নিজের দীনতাবোধ হইতে উদ্ভূত মধুর নম্রতা ও বিরাট কর্তব্যানুভূতি-সঞ্জাত মর্যাদাবোধের সহিত তাঁহার জাতির নিকট আপন বারতা বহন করিয়া আনিয়াছিলেন।”

প্রেক্ষিতে, নিতান্তই স্বাভাবিক যে, জন উইলিয়াম ড্রেপারের মত বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক তাঁর ‘এ হিস্টরী অব দি ইনটেলেকচ্যুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব ইউরোপ’ শীর্ষক গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করেছেন যে

“হযরত মুহাম্মদ মানব-ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন।” সুপ্রসিদ্ধ ফরাসি দার্শনিক ও ঐতিহাসিক লামার্টিনও অভিমত প্রকাশ করেছেন যে: “যে কোন মাপকাঠিতেই মানব-মহত্ত্ব বিচার করা হোক না কেন, আমরা সহজেই জিজ্ঞাসা করতে পারি-কোন মানুষ কি তাঁর (মহানবীর) চেয়ে মহৎ ছিলেন?”

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button