
মহানবীর (সাঃ) শিশু প্রীতি
সাহাবী খালেদ বিন সাঈদের কন্যা
খালেদ বিন সাইদ (রাঃ) ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি রাসুলুল্লাহর (সাঃ) কাছে আসার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন। তাঁর ছোট মেয়েটি কান্না জুড়ে দিলো। সেও রাসুলুল্লাহর দরবারে যাবে। কন্যাকে খুশী করার জন্য খালিদ বিন সাঈদ (রাঃ) তাকে একটি লাল জামা পরিয়ে রাসূলের (সাঃ) কাছে নিয়ে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ (দঃ) ছোট্ট শিশুটিকে দেখে খুশি হলেন। তার জামা কত সুন্দর, কি সুন্দর বলে তাকে বাহবা দিলেন। মেয়েটিকে রাসূল (সাঃ) কোলে বসালেন। মেয়েটি নবুওতি মোহর নামে খ্যাত রাসূলের ঘাড়ের গোস্ত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। জামার ভিতরে পিঠে হাত ঢুকিয়ে দিলো।
সাহাবী খালেদ বিন সাঈদ তা দেখে রাগ করলেন। মেয়েকে ধমক দিলেন। প্রিয় নবী তাকে শান্ত হতে বললেন এবং মেয়েটিকে বিরক্ত না করতে নির্দেশ দিলেন।
কোন উপলক্ষে রাসূলুল্লাহর কাছে একটি ছোট চাদর আসে। চাদরটির রং ছিল কালো। দুই পাশে ছিল সুন্দর আঁচল। চাদরটিতে ছিল লতা, পাতা, ফুল, ফলের বুনট। মহানবী (সাঃ) চাদরটি তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন – চাদরটি কাকে তিনি দিবেন। সামনে বসা সাহাবীগণ চুপ রইলেন। তারা কোন কিছু বললেননা, শুধু হাসলেন।
তাদের মনের ভাব হলো – আমরা কিছু বলবোনা। রাসূলের মন যাকে এই চাদরটি দিতে চায়, সেই এই চাদরটি যেন পায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের মনের ভাব বুঝলেন। তিনিও হাসলেন। বললেন – কোন একজন গিয়ে খালেদ বিন সাঈদের মেয়েটিকে নিয়ে আসো।
সাথে সাথে খালেদ (রাঃ)-এর মেয়েটিকে আনা হলো, তার সঙ্গে মেয়েটির দাদিও এলো। রাসূল (সাঃ) মেয়েটির গায়ে কালো চাদর পড়িয়ে দিলেন। বললেন এটি পর। চাদরটি পরতে পরতে একেবারে পুরাতন করে ফেলো। মেয়েটি চাদর পেয়ে আনন্দে আটখানা।
চাদরে যে লতা-পাতা, ফুল-ফল ছিল, রাসূল (সাঃ) তা মেয়েটিকে দেখালেন। মেয়েটির দাদীকে বললেন দেখো দেখো খালিদের মা, “কত সুন্দর ! কি চমৎকার এই সুন্দর লতা-পাতা এবং বুনট।”
দু’টি কন্যার মা
একদিন হযরত আয়েশার (রাঃ) ঘরে একজন মেয়েলোক আসে। তার সাথে ছিল ছোট দু’টি মেয়ে। নবী গৃহে সে দিন অন্যদেরকে দেয়ার মতো কিছু ছিলোনা। বিবি আয়েশা (রাঃ) এদিক, সেদিক তাকালেন কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে।
ঘরের এক কোণায় দেখলেন মাটিতে একটি খেজুর পড়ে আছে। তা তুলে মুছে স্ত্রী লোকটিকে দিলেন। স্ত্রী লোকটি খেজুরটি দু’টুকরা করলো। নিজে না খেয়ে মেয়ে দু’টিকে ভাগ করে দিলো।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘরে ফিরলে হযরত বিবি আয়েশা (রাঃ)-এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। নবী। করিম (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ যে নারীকে সন্তানের প্রতি মমতা দান করেন, সে যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে”। (হযরত আয়েশা বর্ণিত হাদীসঃ বুখারী)।
শিশুর জন্যে কষ্ট করে মা আনন্দ পায়। বাবার মৃত্যুতে বয়স্কা মেয়ে কাঁদে। বিগলিত অশ্রুধারায় তার গাল ভিজে যায়। তার শিশু ছেলেটি কোলে লাফিয়ে পড়লে অর্ধেক ব্যথা দূর হয়ে যায়।
শিশুরা অল্পতে তুষ্ট। একটি চকলেট, একটু মিষ্টি পেলে কত খুশী হয়। সারাদিন সারা বাড়ীতে এবং আল্লাহর দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। তার নিজের প্রয়োজন ঘুমাবার জন্যে একটি ছোট্ট বিছানা।
বড়দের প্রয়োজন কতটুকু ? সারা দুনিয়াটা পেলেও পেট ভরেনা। মঙ্গল গ্রহটা তার দরকার হবে।
যে মা সারাটি জীবন তার একমাত্র সন্তানের ভালোবাসা এবং সেবায় নিয়োগ করে সেও বহু কাজ তার পুত্রের মাধ্যমে করাতে ব্যর্থ হয়। শিশু প্রপৌত্রটি নিজে না বলে বা না চেয়েও তার এক রোখা পিতাকে দিয়ে বহু কাজ করিয়ে নিতে পারে।
শিশু পুত্রের শুধুমাত্র প্রয়োজনের কথা ধাত্রী বলে দিলেও পিতা পুত্রের জন্যে এমন বহু কাজ করে থাকে, যা অন্য কোন ক্ষেত্রে সে করতে সম্মত হবে না।
কত মধুর, কত করুণাময় শিশু জীবন। ঐশ্বর্যশালী পিতা, শক্তিমান ভ্রাতা নয়, অসহায় দুর্বল। শিশুই নারীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি।
শিশুকালে মৃত জান্নাতি শিশুর মা-বাবা পাপ করতেও লজ্জা পাওয়া উচিত। কারণ তাদের পাপের কথা জেনে জান্নাতি শিশু অন্যদের কাছে লজ্জা পাবে।
জান্নাতী শিশুরা কি মা-বাবা কী অপরাধে কোথায় আছে তা খবর নিবেনা? আপন শিশুর মৃত্যু এক ধরণের সৌভাগ্য বলা যেতে পারে।
ক্ষুদ্র সাপের বাচ্চা বাড়ীতে রাখুন। ক্ষুদ্র হলেও ছোবল মারবে। বাঘের ক্ষুদ্র বাচ্চা প্রতিপালন করুন। মোরগের বাচ্চা পেলে কামড়াবে।
হাজারটি তিন বছরের মানব শিশু একত্র করুন। একটি আরেকটিকে কামড়াবে, থাপ্পর মাড়বে। কারণ এটা সমবয়সীদের প্রতি তাদের আদর প্রকাশের ভাষা।
নিজেরা অকারণে কাঁদে। নিজের ছোট ভাইটাকে অকারণে কাঁদিয়ে তামাশা দেখে। একটি দু’টি নয়, হাজার শিশুর মাঝেও হিংসা, ঘৃণা, জিঘাংসা দেখা যাবেনা। সবার মাঝে সরলতা, পাপহীনতা পবিত্রতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
শিশুরা অযথাও কাঁদে। তাদের কান্না দেখে মায়ের হাসি পায়। এ দুনিয়ায় শিশুর অকারণ কান্না অপেক্ষা জান্নাতে গিয়ে মা-বাবার জন্যে কান্না অনেক উপকারে আসতে পারে। শিশুর কষ্টের কান্না হৃদয়বিদারক।
ছোট শিশু মৃত্যুকে ভয় করেনা। মায়ের মৃত্যুতেও কাদেনা। মায়ের মুত্যু এবং ঘুমের মাঝে সে পার্থক্য করতে পারেনা।
তার অবচেতন মনে রয়েছে জীবনের স্বপ্ন। ছোট্ট শিশুও চোখ রাঙানোকে ভয় করে। ধমকে ভীত হয়। ছোট বেতকে ভয় করে, যদি একবার বেতের ব্যথা পেয়ে থাকে।
দৈহিক শাস্তি এবং ব্যথা মানসিক দুঃখ ও বেদনার তুলনায় এক কানাকড়িও নয়। তবে দৈহিক শাস্তি দিয়েই বা কি লাভ !
যদিও শিশু কাঁদে, মুহূর্তে ভুলে যায়। শিশু শারিরীক ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু তাদের জীবনে কোন দুঃখ নেই। শত অভাবের মাঝেও তাদের জীবন আনন্দময়।
বাবা মায়ের কৃত দোয়া ও স্নেহের ঐশ্বর্য থাকলে দারিদ্রতা তার সাফল্যের ধারা রুদ্ধ করতে পরেনা।
ফিরিস্তারা হুকুম ছাড়া কোন কাজ করতে পারেনা। কিন্তু মানুষ আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে পারে। মানব জীবনের লক্ষ্য ফিরিস্তা হওয়া নয়, ফলপ্রসু কল্যাণময় মানুষ হওয়া।
শিশুদের চোখে দেখা যায় বেহেস্তের দীপ্তি ও ঔজ্জল্য। এর মাঝে পাপের কোন স্পর্শ নেই। তাদের চোখ পাপ দেখলেও পাপের কারণ শিশু অনুভব করে না।
মানব প্রকৃতি অনুসারেই মানব শিশু বড় হয়ে উঠে প্রত্যেক শিশুর মাঝেই লুকায়িত থাকে মানবিক ও পাশবিক পদ্ধতি। আভিভাবকেরা যদি শিশুকালেই মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে তাদের উৎসাহিত ও সচেষ্ট হন তাহলে বয়সকালে তাদের মাঝে পাশবিক গুণাবলী খুব একটা প্রকাশ পায়না।
যে শিশুটি সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণ নিরাশ, মানবিক গুনে গুনান্বিত সে শিশুটি হতে পারে পরম সৌভাগ্যবান এবং আনন্দের কারণ।
বংশবৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবেই শিশুকে গ্রহণ করা ঠিক হবেনা। যৌনাঙ্গের অনাকাঙখীত ফলফসল মাত্রই নয় শিশু।
সন্তানের মাধ্যমেই মানুষ পুনর্জন্ম লাভ করে।
সন্তান মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
সূত্র: মহানবী ও শিশু বই থেকে। লেখক: এ. জেড. এম. শামসুল আলম