ভালোবাসার মাপকাঠি
১.
মাসজিদ থেকে বের হয়ে বাসার পাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকলো শফিক। এক প্যাকেট জেমস চকলেট নিল সীমার জন্যে। অভিমান ভাঙ্গানোর দাম ১০ টাকা। আল্লাহ্র কাছে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো, অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া বউ পেয়েছে বলে।
মাসজিদে যাওয়ার আগে হঠাৎই রাগ করে ফেলেছিল সীমার সাথে। চোখে পানি চলে আসলেও সীমা আর আগের মতো রিএক্ট করেনি, মুয়াযের সাথে খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সীমার মন খারাপ কখনো চোখ এড়ায় না শফিকের।
হঠাৎ রেগে যাওয়াটা শফিকের অনেক পুরানো বদভ্যাস। তখন শফিক এতো কঠিন কথা বলতে পারে, যা ঠান্ডা মাথায় সে ভাবতেও পারে না। শফিকের কঠিন কথায় সীমার সারাক্ষণ ঝরণার মতো কল কল হাসি মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায়। পকেট থেকে কাঁচের স্কেলটা বের করে শফিক। লাভ স্কেলটার ভ্যালু এখন আর জিরো দেখাচ্ছে না। সীমার সাথে তখন কথা না বললেই হতো। তাহলে সীমা আর বুঝতে পারতো না লাভ লেভেল কতটা নিচে নেমে গেছে।
সালাহ্ শেষে শফিক অনেকদিন চেক করে দেখেছে ভ্যালু ইনক্রিজ করে। এই বিষয়টা প্রথম সীমাই ওকে দেখিয়েছিল। আল্লাহ্র দিকে ধাবিত হলে ভালোবাসার অনুভূতির তরঙ্গ কেমন বেড়ে যায়। সেই তরঙ্গ স্কেলের তরঙ্গের সাথে অনুরণ করে মান বৃদ্ধি করে দেয়।
সারাদিন তো আখিরাত নিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব না। তাই ভালোবাসায় টইটম্বুর স্কেল কমই দেখা যায়। ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি হয় আর ভালোবাসাও কমে বাড়ে। শফিক চেষ্টা করে যেখানে যতটুকু ভালোবাসা দেখানো উচিত তার বেশি না দেখাতে। ভালোবাসার মান জিরো হয়ে গেলে তখন চাইলেও রাগ, ঘৃণা লুকানো সম্ভব না।
সীমার অবশ্য সাংসারিক বুদ্ধি একেবারেই কম ছিল। সারাদিন অপাত্রে ভালোবাসা ঢেলে যখন তখন বিষন্নতায় ভুগত। কিছু বলতে না বলতেই কেঁদে দিত। শফিক সীমাকে বুঝিয়েছে অনেক। সাইকিয়াট্রিস্টকেও দেখিয়েছে। ওষুধ লাগেনি, তিনি আচ্ছা মতো কাউন্সেলিং করে দিয়েছেন সীমাকে। সীমা এখন অনেকটাই ম্যানেজ করতে শিখে গেছে। শফিক যখন বলে , ‘ডঃ সুফিয়ার কাছে নেয়াটা কেমন ওয়াইজ হয়েছিল বলোতো!’ সীমার ঠোটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে।
২.
দেড় বছরের ছোট্ট মুয়াযের সামনে কাঁদা যায় না। মুয়ায বলে ওঠে, “মা, ব্যথা? কষ্ট মা?” দেড় বছরেই পটপট করে কথা বলা শিখে গেছে মুয়ায। ওর সামনে কিছু বলাও বিপদ , করাও বিপদ। তবে চোখের পানি এখন অনেকটাই সামলে নিতে পারে সীমা। সকল প্রশংসা শুধুই আল্লাহ্র। সেদিন রামীসার পরামর্শ এতটাই কাজে লাগবে ভাবতেও পারেনি সীমা।
রামীসা ওর ভার্সিটির বন্ধু। সীমা সবসময়ই লাভস্কেলের বিড়ম্বনায় পর্যুদস্ত ছিল। মেপে মেপে ভালোবাসা ওর ধাঁতে সয় না। সবাই ওকে ছোটবেলা থেকে পাগলি হিসেবেই চিনে।
মা ওকে বারবার বলত, ‘সীমা! স্কেলের দিকে কিন্তু নজর রেখো মা।‘ সীমা শুনেও শুনত না। কাউকে একগাদা ভালোবাসা দিয়ে কখনো হাপুস নয়নে কাঁদত, কখনো ঝগড়া লাগাতো, কখনো বা মনমরা হয়ে বসে থাকতো। মা কাঠের স্কেলটা বের করে দেখতেন ভালোবাসার কেমন নাজেহাল দশা হল।
বিয়ের আগে তেমন একটা সমস্যা হয়নি। সীমাকে সবাই এভাবেই চিনতো। আর রক্তের প্রতি মানুষের লাভস্কেলে একটু বেশি ভালোবাসা থাকেই, যতই মান অভিমান হোক না কেন! সীমা ভেবেছিল তার মাপহীন ভালোবাসা দিয়ে শশুড়বাড়িতেও জীবনটা কাঁটিয়ে দিবে। শশুড়বাড়ীর সবাই উদার মনের। কিন্তু সারাক্ষণ কেউ পকেট থেকে, কেউ ব্যাগ থেকে, কেউ দেয়ালে ঝুলন্ত লাভস্কেল চেক করতে থাকেন। হঠাৎ গল্পের মাঝে কাজের ছুঁতায় উঠে স্কেল চেক করেন। কেউ সীমার হাসির দিকে বিরক্ত হয়ে তাকান, সরে যান প্রগলভ এই মেয়েটার সামনে থেকে।
প্রচন্ড মাপা ভালোবাসার এই বলয়ে সীমা বেমানান। বিয়ের পর মা-ও যেন সীমার পর হয়ে গেছেন। কখনো ভুল বুঝেন, কখনো ভালোবাসেন। সীমাও সবাইকে ভুল বুঝে অল্পে কেঁদে কেটে একাকার। রামীসা অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সীমার করূণ অবস্থা বুঝেছিল। এক ছুটির দিনে কার্জন হলে সীমাকে ডাকল। তবে অবশ্যই লাভ স্কেল সাথে আনতে বলল। সীমা একটু অবাক হলেও ব্যাগে লাভ স্কেল নিল। শাশুড়িমার কাছে মুয়াযকে রেখে সীমা বের হলো। শাশুড়ি মা লাভস্কেল চেক করে বললেন দেড় দুই ঘন্টার বেশি দেরি না করতে।
মুয়ায এতো ভালোবাসা কেড়ে নেয় যে বেশিক্ষণ ওর সাথে থাকা কঠিন। মন খারাপ লুকিয়ে সীমা বের হয়ে পড়ে। মাপা মাপা আবেগের বলয় থেকে বের হয়ে নিঃশাস নিল সে।
রামীসাকে পুরো ভার্সিটি লাইফে কোনদিন লাভস্কেল বের করতে দেখেনি সীমা। আজ সেই সীমাকে স্কেল আনতে বলেছে। সীমার রিকশা কার্জনে এসে থামল। গেইট দিয়ে ঢুকতেই সীমার মন আনন্দে ভরে উঠল। জোরে নিঃশাস নিল সীমা। এখন লাভস্কেল বের করলে না জানি কতো ভালোবাসা দেখবে। কার্জনের সবুজ ঘাস ওর চোখে প্রশান্তি দেয়। পুরানো ইট-কাঠের বিল্ডিংগুলো অন্যরকম মায়া তৈরি করে।
ছেলেদের হলে ঢোকা একদমই পছন্দ না হলেও সীমার জোরাজুরিতে রামীসা শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুর পাড়ে এসে বসে। ফটোকপির দোকানগুলো এখানে হওয়ায় না চাইতেও মেয়েদের এদিকে আসতেই হয়। সিড়িতে বসে নিস্তরঙ্গ পুকুরের দিকে চুপচাপ দুজন তাকিয়ে থাকল।
নিরবতা ভাংল রামীসা, “তোর কি সবসময় মনে হয় তোকে সবাই কষ্ট দিচ্ছে কিন্তু সেটা তারা বুঝতে পারছে না। দোষ হচ্ছে তোর আবেগের?”
সীমা বলল, “হুম মনে হয়।”
– “শোন সীমা! কষ্ট আমরা সবাই সবাইকে দেই। বুঝে, না বুঝে। কেউ অনুতপ্ত হই, কেউ হই না। কেউ অনুতপ্ত হয়েও মাফ চাইতে পারি, আর কেউ পারি না ইগোর ঠ্যালায়। এই হলো পার্থক্য।”
– “আমি আবেগকে কন্ট্রোল করতে চাই।”
– “আবেগ নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরী, কিন্তু আবেগহীন হওয়ার কোনো মানেই হয় না। তুই কখনো খেয়াল করে দেখেছিস রামাদানে ভালোবাসা স্কেলটা খুব কমই নীল হয়।”
– “হ্যা। রামাদানে, সালাহ, যিকর, তারাবীহ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকি; পাপ পূণ্যের চিন্তাও বেশি আসে তাই দুনিয়ার অনেক কিছুই চিন্তায় আসে না।”
– “এক্সাক্টলি সীমা। তুই দুনিয়া নিয়ে যত কম চিন্তা করবি তোর লাভ লেভেল বাড়বে। এই দুনিয়ার বেশিরভাগ বিষয়ই দূষিত। খেয়াল করে দেখিস যেদিন গীবত বেশি হয় সেদিন লাভ স্কেলের কেমন করূণ দশা থাকে।”
– সীমা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই বলতে চাচ্ছিস যে যত দ্বীনের দিকে ঝুঁকবে তার ভেতরে ভালোবাসা তত বেশি থাকবে? তাহলে নাস্তিকরা এতো ভালোবাসা দেখায় কিভাবে?”
– রামীসা বলল, “জানিসই তো ওদের দড়ি ঢিল করে রাখা হয়েছে। এই দুনিয়ায় ওরা মৌজ মাস্তি করে নিক। আমাদের পরীক্ষা তো একটু বেশিই হবে। আর আল্লাহর দয়া তো দুই প্রকার। এই দুনিয়ায় আমাদের প্রতি যেমন আল্লাহ্ রহম করেন, ওদের প্রতিও করেন। কিয়ামতের দিন ওরা আর দয়া পাবে না।”
– “তাহলে আবেগ কন্ট্রোল করতে আমাকে কী কী করতে হবে। আমি মেপে মেপে ভালবাসতে পারবো না।”
– “তুই তো ফরযগুলো আদায়ের চেষ্টা করিস। হারাম থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। গীবত থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। যত পারিস যিকর কর। আল্লাহ্র যিক্রে অন্তর ঠান্ডা হয় রে। তাহাজ্জুদে আল্লাহ্র কাছে কাঁদ। কুরআন পড়। কেউ কষ্ট দিলে পাল্টা কষ্ট না দিয়ে, তার সামনে বেসামাল আবেগ না দেখিয়ে যিক্র কর। যাদের কথায় কষ্ট পাচ্ছিস তাদের ভালো দিকগুলোর কথা চিন্তা করে সম্মান কর। খারাপ কথা মাথায় আসলে সাহাবীদের জীবনী পড়। মনের মধ্যে একটা জগত তৈরী কর। কিছু হলেই সালফে সালেহীনের জীবনে ঢুকে পড়ে তাদের কষ্টের সাথে নিজেরটা মিলিয়ে নিস। তাদের ঈমানের শক্তি থেকে শক্তি নিস। তোর কষ্টগুলো কখনো তুচ্ছ নয়। কিন্তু এই কষ্টে ডুব দিয়ে জীবনটা ম্যারম্যারা করে ফেলিস না।”
– “চেষ্টা করব এখন থেকে, স্কেলটা কেন আনতে বলেছিস? তোকে তো একদিনও দেখলাম না স্কেল ইউজ করতে?”
– “স্কেলটা এই পুকুরের পানিতে ফেলে দে। যে আল্লাহ্কে সুখের দিনে মনে রাখে, আল্লাহ তাকে দুঃখের সময় দেখবেন। তোর স্কেল লাগবে না। কষ্টের পর স্বস্তি আসবে। তুই আল্লাহ্কে মনে রাখবি আল্লাহ্ তোর মনকে ভালোবাসায় ভরে দিবেন। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। কোনো কোনো দিন এদিক সেদিক হয়ে যাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে কন্সিস্ট্যান্সি বাড়বে। মেপে মেপে ভালোবাসা আমাদেরকে মানায় না।”
সীমা স্কেলটা ছুড়ে ফেলল। রামীসা বলল না যে অনার্স সেকন্ড ইয়ারে সে-ও লাভ স্কেল ছুড়ে ফেলেছিল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সীমাকে বেশিরভাগ সময়ই যিক্র করতে হয়। রান্নার সময় বিড়বিড় করে। শফিক হঠাৎ রেগে গেলেও। মা এর সাথে ভুল বোঝবোঝিটাও এখন কমে গেছে।
“জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।”
[১৩:২৭]
………………………………
ভালোবাসার মাপকাঠি
উম্মে লিলি