চেপে রাখা ‘মোপলা’ বিদ্রোহ
‘মোপলা’ মালাবারের একটা মুসলমান সম্প্রদায়। এদের সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত পূর্বেই দেয়া হয়েছে [চেপে রাখা ইতিহাস বইয়ে পাবেন]। মোপলাদের বড় দোষ অথবা গুণ হচ্ছে, তারা বরাবর ইংরেজ বিরোধী। তারা ছোট বড় অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে পাঁচটি বিদ্রোহ বিপ্লবের দাবীদার। সাতান্নর বিপ্লবের পরেও তাদের এ বিদ্রোহগুলো যথাক্রমে হয়েছিল ১৮৭৩, ১৮৮৫, ১৮৯৪, ১৮৯৬, ১৯২১ খৃস্টাব্দে।
বিপ্লবীদের একশ ভাগই ছিলেন মুসলমান। আর যেহেতু সেখানকার রাজামহারাজা-জমিদাররা বারেবারে ইংরেজদের হয়ে সাহায্য করে এসেছেন, তাই বিপ্লবী মোপলা বাহিনী হিন্দু বিত্তবানদেরও শত্রু মনে করতে দ্বিধা করেনি উপেক্ষিত শোষিত অনুন্নত নিম্নেশ্রেণীর অমুসলমানরা প্রতিবারেই মোপলাদের সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছা কররেও নেতৃস্থানীয় ধনী মধ্যবিত্তদের কৌশলময় প্রচারের তাদের সম্ভব হয়েছিল যে ওটা হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। আর তাই অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যবহারের ফলে নীল বিদ্রোহের মত মিলিত হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। আর তাই অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যবহারের ফলে নীল বিদ্রোহের মত মিলিত হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হতে পারেনি। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মুহাম্মদ আলীদের খিলাফত আন্দোলনেও এ মোপলা বাহিনী রক্তাক্ত সাড়া দিতে ভুলেনি।। ইংরেজ সরকার সারা ভারতে যা করেনি তা করেছে মোপলাদের মালাবারে। তারা সভা-সমিতি ও সম্মেলন করতে পারতেন না, কারণ কঠোরভাবে তা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতেও বিপ্লবকে দমান যায়নি, বরং আগুণে পেট্রোল ঢালা হয়েছে। ফল হিসেবে ১৯২১ খৃষ্টাব্দে মোপলারা মালাবারকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন। সৈন্যদের সাথে মুসলমান মোপলাদের ভয়াবহ সংগ্রাম শুরু হয়। একদিকে শাষক ও শাসক ইরেজ ও তাদের ধামাধরা স্থাবকের দল, অন্য দিকে শাসিত শোষিত মৃত্যু পথযাত্রী বিপ্লবী দল। ইংরেজ সৈন্যদের হাত হতে ওয়াতানাদ ও এরনাদ নামক দুটি স্থান ছিনিয়ে নেয়া হলে যুদ্ধ আরো জোরদার হয়।
তাছাড়া, সে সময় এ এলাকার বাইরে চিঠি পত্র, টেলিগ্রাম ইত্যাদির যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। আর বাইরে থেকে আসা প্রত্যেকটি চিঠি পরীক্ষা করে তবে বিলি করা হত। সামান্য ক্ষতির গন্ধ থাকলে তা বিনয় করা হত। তবে সরকারি খবরাখবর আদান প্রদান অব্যাহত ছিল। মোপলা বাহিনী ইংরেজের সাহায্যকারী কিছু ভারতীয় নেতাদের এ সময় নিহত করেন। চতুর ইংরেজরা মুসলমান কর্তৃক হিন্দু আক্রান্ত এ কথাটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রচার করে সাফল্য লাভ করে। ইংরেজের এ সমস্ত ফুপ্তি সরকারিতাৰে গোপন রাখার চেষ্টা করা হলেও কিন্তু ভারতীয় নেতৃমহলে তা পেয়ে যায়। সাথে গান, মাওলানা মহান আলী ও মাওলানা শওকত আলী মোপলা হত্যা এবং নকল সাম্প্রদায়িকতার খেলা বন্ধ করতে মালাবারে প্রবেশ করতে উদ্যত হলে, ইংরেজ তাদের মালারে ঢুকতে না দিয়ে এবং জানিয়ে দেয়া হয়, কাউকে এখন মালাবারে ঢুকতে না দেয়ার আইন চালু রয়েছে। (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম পৃষ্ঠা ২৩০-১)। এবার ব্রিটিশ সরকার মালাবারে হাজার হাজার সৈন্য নানা ধরনের ট্যাঙ্ক, কামান, বোমা কতকগু্লো গানবোট এবং রণতরী নিয়ে আসে। তার আগে ইংরেজী কায়দায় অপপ্রচার হয়েই ছিল। সুতরাং হিন্দুরা বিপ্লবী মুসলমানদের তাদের শত্রু মনে করে লড়াইয়ে নেমে পড়েন একদিকে ইংরেজ শক্তি তো আছেই, অন্য দিকে বাড়িতে পল্লীতে হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই-এ লড়াই এক বীভৎস রূপ নিল। যুদ্ধ চলল এক মাস। তারপর একদিন ইরেজরা আকাশ হতে বোমা বর্ষণ রণতরী হতে শেল বর্ষণ, ট্যাঙ্ক ও কামান হতে গোলা বর্ষণ করে মোপলাদের ঘরবাড়ি, দোকান পাট, ভয়ঙ্কুপে পরিণত করে। যুদ্ধ শেষে মোপলা বাহিনীর দশ হাজার পুরুষ নারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর জীবন্ত যাদের পাওয়া যায় তাদের বন্দী করে বিচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের পূর্বেই অনেক পুরুষ ও শিশুকে হত্যা এবং নারীদের উপর লজ্জাকর পাপাচার করা হয়। বাকী বেঁচে থাকা আসামীদের বিচার-ফল এমন দাঁড়ায়-এক হাজার জনের ফাঁসি দু হাজার লোকের দ্বীপান্তর অর্থাৎ সে আন্দামানে শ্রমসহ নির্বাসন আর আট হাজার লোকের পাঁচ হতে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। শাস্তির কি সুষম পরিবেশন।
এ অত্যাচারের ইতিহাসে আর একটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। জীবন্ত বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে বাছাই করা আশিজনকে ট্রেনে একটি ছোট্র কামরায় দরজা জানালা বন্ধ করে কালিকটে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বন্দী বিপ্লবীরা পানির জন্য চিৎকার করেন এবং পানি ভিক্ষা চান। কিন্তু সে আর্তনাদে নিষ্ঠুরদের প্রাণবিগলিত হয়নি। যখন ট্রেন কালিকট পৌছাল তখন দেখা গেল অধিকাংশই শহীদ হয়েছেন। আরও দেখা গেল, একজন অপর জনের জিভ চুষে পিপাসা মেটাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে শুষ্ক রসনা ততটুকু রস দিতে পারেনি বা তাদের বাঁচাতে পারেনি। যাহোক এতবড় একটা কাণ্ড ঘটবার পরও তখনকার ভারতীয় নেতারা সবাই যেন ক্ষেপে গেলেন ব্যাপারটা মুসলমানদের মনে বেদনা সৃষ্টির এটাও অন্যতম একটা কারণ বলা যায়। খিলাফত কমিটির নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী এটা নিয়ে হৈ চৈ করতে গিয়ে বাধা পেয়ে খুব আঘাত পান এবং কংগ্রেসের উপর আস্থা হারান। (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৩)
সম্পূর্ণ লিখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে :
গোলাম আহমদ মোর্তজা রচিত ‘চেপে রাখা ইতিহাস’ বই থেকে।