আফসোফ লাগে!
বেশ কদিন আগে ভার্সিটির এক ছোট ভাইকে দেখে—চোখ একেবারে ছানাবড়া। ছেলেটা আগে মাঝেমধ্যে মসজিদে যাতায়াত করতো। এখন বামদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তার টি সার্টে দেখলাম চে গুয়েভারার ছবি। এর কারণ জানতে চাইলাম। সে গুয়েভারার জীবনী বলতে শুরু করলো। গুয়েভারা নাকি অনেক বিপ্লবী ছিলো। তাই গুয়েভারাকে সে পছন্দ করে। গুয়েভারার আদর্শ তার ভালো লাগে।
একদিন এক বন্ধুকে দেখলাম টম ক্রুজের ছবিঅলা টি সার্ট গায়ে। আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে জানালো, ক্রুজ অনেক স্মার্ট। হ্যান্ডসাম। বিখ্যাত অভিনেতা। তাই সে ক্রুজের ছবিযুক্ত টি সার্ট গায়ে দিয়েছে। ক্রুজকে দেখে সে অভিভূত হয়।
গ্রামে গিয়ে দেখি, ছোট্ট ছেলে মেসির ছবিঅলা জার্সি গায়ে ফুটবল খেলছে। ছেলেটি জানালো, মেসি অনেক ভালো খেলে। তাই সে বাবাকে বলে, এই জার্সি কিনিয়ে এনেছে। তার পাশে আরেকটি ছেলেকে দেখলাম, মটো পাতলো কার্টুনের ছবি। সেও নাকি অনেক বায়না করে, বাবাকে দিয়ে এটা কিনিয়ে এনেছে।
বড় আফসোফ লাগে! যখন দেখি মুসলিমরা আল্লাহর শত্রুদেরকে অনুসরণ করছে। অনুকরণ করছে। আধুনিকতার নামে, স্টাইল কিংবা ফ্যাশনের নামে—নিজেদের আদর্শ বিকিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। অথচ এটা যে সুস্পষ্ট জাহেলিয়াত, সে কথা কানেই তুলছে না। অবশ্যি না তুলারই কথা। আলট্রা মডার্ন হওয়ার স্বপ্ন, আমাদের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সে স্বপ্নই আমাদের জাহেলিয়াতের দিকে টেনে নিচ্ছে।
ভাই আমার! আমাকে বলো তো, কেনো তুমি তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছো?
কেনো তাদের স্টাইলের মধ্যে জীবনের সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছো?
কেনো তাদেরকে জীবনের মডেল বানিয়েছো?
কেনো?
তোমার রব কি এমন কাউকে পাঠাননি, যিনি ওদের চাইতে পুত-পবিত্র?
যিনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী? যিনি আসমান ও যমীনের রবের কাছে সর্বাধিক সম্মানিত?
সেই মহা মানবকে নিজের জীবন থেকে ডিলিট করে দিয়েছো? আর সে জায়গায় ক্রুজ, মেসি, শাহরুখ কিংবা রোনালদোকে বসিয়ে দিয়েছো?
ভাই আমার! তুমি কি সত্যিই তাঁকে ভুলে গেছো?
তোমার কি মনে নেই তাঁর সৌন্দর্যের কথা?
মনে নেই তাঁর সুমহান চরিত্রের কথা?
ভুলে গেছো তাঁর মহানুভবতার কথা?
তাঁর উদারতা, বদান্যতা, বীরত্বগাথা—সবই কি ভুলে গেছো?
এসো, আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিই। তোমাকে সেই মহাপুরুষের কিছু বর্ণনা শুনাই, অবগাহন করাই—সত্যের বার্তাবাহকের পবিত্র চরিত্রের আলোয়।
জানতে চাও তার সৌন্দর্য, বীরত্ব, তাঁর মহানুভবতা সম্পর্কে? তবে বলি শুনো।
অসাধারণ সুন্দর ছিলেন তিনি। চিত্তাকর্ষ দৈহিক গঠন ছিলো তাঁর। উচ্চতা মাঝারি। খুব বেঁটেও ছিলেন না, আবার অস্বাভাবিক লম্বাও ছিলেন না। কালো চুল ছিলো তাঁর। চমকানো কালো। চুল বেশি কোঁকড়ানোও ছিলো না, আবার একেবারে খাড়াও ছিলো না। ছিলো এ দুয়ের মাঝামাঝি। চুল ছিলো কানের লতি অথবা কাঁধ পর্যন্ত। চুলে সিঁথি করতেন।
উজ্জ্বল চেহারা ছিলো তাঁর। গায়ের রঙ ছিলো গোলাপী ও গৌর বর্ণের মাঝামাঝি। একেবারে সাদা ফ্যাঁকাসেও ছিলেন না, আবার কালোও ছিলেন না। সুন্দর গঠন। সটান সোজাও নয়, আবার ঝুঁকে পড়াও নয়। সুরমারাঙা চোখ। লম্বা পলক। ঋজু কণ্ঠস্বর। লম্বা ঘাড়। সাদা-কালো চোখ। সুরমা কালো পলক। ভ্রু ছিলো সুক্ষ্ম ও জোড়া লাগানো।
কপাল অত্যধিক মাংসলও ছিলো না, আবার একেবারে শুকনোও ছিলো না। ছিলো এ দুয়ের মাঝামাঝি ও প্রশস্ত। উভয় কাঁধের মধ্যে দূরত্ব ছিলো। বুক ছিলো প্রশস্ত। বুকের ওপর থেকে নাভি পর্যন্ত হালকা চুলের রেখা ছিলো। দেহের অন্যান্য অংশ ছিলো লোমশূন্য। হাত পা ছিলো মাংসল। পেশি ছিলো চওড়া। তালু ছিলো প্রশস্ত। তাঁর হাতের তালুর চেয়ে অন্য কারও তালু বেশি নরম ছিলো না। এমন কোনও রেশম ছিলো না, যা তাঁর হাতের চাইতে বেশি কোমল।
পায়ের গোড়ালি ছিলো সরু। চলার সময় স্পন্দিত ভঙ্গিতে পা তুলতেন। দেখে মনে হতো যেনো ওপর থেকে নিচের দিকে যাচ্ছেন। তিনি হাঁটলে মনে হতো যমীন তাঁর জন্যে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তাঁর সাথিরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন, কিন্তু তিনি ক্লান্ত হতেন না।
তিনি যখন ঘেমে যেতেন, তখন তাঁর চেহারা আরও সুন্দর মনে হতো। তাঁর ঘাম থেকে খুশবু বের হতো। এ ঘাম ছিলো উত্তম খুশবু। তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যখানে ছিলো নবুওতের মোহর। তিনি যখন হাসতেন, মনে হতো মুক্তো ঝরছে। সবসময় মুচকি হাসতেন। আয়িশা (রা.) তাঁর ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে কবিতা আবৃতি করতেন—
“তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম
চমকানো মেঘ যেনো চমকায় অবিরাম”
কোনও জিনিস তাঁর মতো সুন্দর ছিলো না। তাঁকে দেখলে মনে হতো—চেহারায় সূর্য জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে দেখলে সবচে উজ্জ্বল মনে হতো। কাছ থেকে দেখলে মিষ্টি-মধুর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মনে হতো। হঠাৎ কেউ তাঁকে দেখলে, অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতো। পরিচিত কেউ দেখলে, তাঁর ভালোবাসায় ব্যাকুল হয়ে যেতো।
তিনি উঠতে বসতে আল্লাহর স্মরণ করতেন। ইস্তিগফার করতেন। সমাবেশে তাঁর জন্যে স্পেশাল জায়গা রাখা হতো না। কেউ রাখলে তিনি অপছন্দ করতেন। মজলিসের যেখানেই জায়গা পেতেন, সেখানেই বসে যেতেন। উপস্থিত সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। সবাই ভাবতো, তাকেই তিনি সবচেয়ে বেশি মহব্বত করেন।
তাঁর মজলিসে অনর্থক কোনও কথা আলোচিত হতো না। মজলিস হতো ইলমের মজলিস। আমানদারীতার মজলিস। সত্যবাদিতা ও লজ্জাশীলতার মজলিস। সেখানে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতো না। কারও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হতো না। অশালীন কোনও আলোচনার স্থান হতো না। কাউকে হুমকি-ধমকি দিয়ে কথা বলা হতো না। কারও কোনও প্রয়োজন দেখা দিলে, তা পুরো করা হতো। বড়ো এবং ছোটো সবাইকে কদর করা হতো। অপরিচিত কাউকে অবজ্ঞা করা হতো না।
তাঁর প্রকাশভঙ্গি ছিলো সুস্পষ্ট। কথা খুব সংক্ষিপ্তও ছিলো না, আবার দীর্ঘও ছিলো না। তিনি যখন কথা বলতেন, মনে হতো যেনো দাঁতের ফাঁক দিয়ে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সব সময় প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতেন। ভাষা ছিলো অলংকৃত। অল্প কথায় অনেক বেশি কিছু বুঝাতে পারতেন। আরবের সকল ভাষার জ্ঞান ছিলো তাঁর। প্রত্যেক গোত্রের সাথে তাঁদের ভাষায় ও বাকরীতিতে কথা বলতেন। বেদুইনদের মতো দৃঢ়তাব্যঞ্জক বাকভঙ্গি, শহুরে নাগরিকদের বিশুদ্ধ ভাষা ছিলো তাঁর আয়ত্তাধীন।
তিনি সব সময় স্পষ্ট করে কথা বলতেন। অনর্থক এদিক-সেদিকের আলোচনা করতেন না। তাঁর কথা সবাই বুঝতে পারতো। কথার মধ্যে কোনও বাহুল্য থাকতো না। তিনি কারও প্রশংসা করলে, অতিমাত্রায় প্রশংসা করতেন না। কারও প্রতি রুষ্ট হলেও, কখনও ধমকের সুরে কথা বলতেন না। কারও কথা যদি অপছন্দনীয় হতো, তবে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
তাঁর মুখ দিয়ে শুধু এমন কথাই বের হতো, যা কল্যাণকর। তিনি যখন কথা বলতেন, তাঁর সাথিরা তখন এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতেন। কোনও টুঁ শব্দটিও করতেন না কেউ। তাঁরা মাথা এমনভাবে নিচু করে রাখতো যে, দেখে মনে হতো তাদের মাথায় চড়ুই বসেছে। তাঁর কথা শেষ হলে সাথিরা কথা বলতেন। সবার কথাকে গুরুত্ব দিতেন। কেউ কথা বললে, তিনি তাঁর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতেন। কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নীরব থাকতেন।
যে কথা শুনে তাঁর সাথিরা অবাক হতো, সে কথায় তিনিও অবাক হতেন। যে কথায় তাঁর সাথিরা হাসতো, সে কথায় তিনিও হাসতেন। তবে তাঁর সামনে কেউ জোরে হাসতো না। তিনি নিজেও কখনও জোরে হাসেন নি। মুচকি হাসিই ছিলো তাঁর চিরচেনা বৈশিষ্ট্য। কেউ লম্বা করে কথা বললে, তিনি বিরক্তবোধ করতেন না। অপরিচিত কেউ অসংযমী হলে, তিনি ধৈর্য হারাতেন না। ইহসানের বিনিময় ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারেই অন্যের প্রশংসা করতেন না।
কেউ কোনও দরকারে তাঁর কাছে বসলে, প্রয়োজন পুরো না হওয়া পর্যন্ত তিনি উঠে যেতেন না। কখনও তাঁর ধৈর্যের চ্যুতি ঘটতো না। কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে, তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে না। কিছু না থাকলে বলতেন, পরে এসো। হাসিমুখে সন্তুষ্ট করতেন। তাঁর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি ছিলো তাকওয়া। সাথিরা তাঁকে নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।
তিনি ছিলেন সর্বাধিক লাজুক, নিম্ন দৃষ্টির অধিকারী। পর্দানশীল কুমারী মেয়েদের থেকেও, তিনি অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। কারও চেহারার দিকে তিনি—অপলক দৃষ্টিতে তাকাতেন না। সবসময় দৃষ্টি নিচু রাখতেন। তাঁর লজ্জাশীলতা এত বেশি ছিলো যে, কারও মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। কারও দোষ-ত্রুটি থাকলে, মানুষের সামনে তাঁকে অপমান করতেন না। কিংবা সে লোকের নাম ধরে সমালোচনাও করতেন না।
বিখ্যাত আরবি কবি বলেন—
লজ্জাশীল তিনি তাই দৃষ্টি নত তাঁর
তাঁকে দেখে চোখের নজর, নত যে সবার
তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয় তখন
অধরে তাঁর মৃদু হাসি ফোটে যখন
রেষারেষি থেকে তিনি ছিলেন সর্বদাই দূরে। তাঁর ক্ষমার যোগ্যতা এতটাই বেশি ছিলো যে, তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করার পরেও তিনি ধৈর্য ধরেছেন। তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলার পরেও, রক্তাক্তকারীদের ক্ষমা করেছেন। তিনি কখনও নিজের জন্যে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ নেননি। তবে কেউ আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করলে তাকে শাস্তি দিতেন।
তাঁকে দুটি কাজের একটিকে বেছে নিতে বলা হলে, তিনি সহজটিই বেছে নিতেন; যদি সেটা গোনাহের কাজ না হতো। তিনি ছিলেন ন্যয়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন সত্যবাদী, বিশিষ্ট আমানতদার। শত্রু-মিত্র সকলেই এ ব্যাপারে একমত। তাঁর উপাধি ছিলো ‘আল-আমীন’। তাঁর চিরশত্রু আবু জাহল পর্যন্ত, তাঁর সত্যবাদিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতো।
আত্মীয়তার সম্পর্ক পালনে তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। আত্মীয়দের সাথে হৃদ্যতা ও বদান্যতার ক্ষেত্রে, তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন আন্তরিক। বিনম্র। অতুলনীয় সৌজন্যবোধের অধিকারী। অত্যন্ত উদার স্বভাবে মানুষ। কখনও অনিচ্ছাকৃতভাবেও অশালীন কথা বলেননি। ফাহেশা কাজ করেননি। কোনও আত্মীয়কে অবজ্ঞা করেননি। সব সময় আত্মীয়দের খোঁজ-খবর রেখেছেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) মারা যাওয়ার পর, তিনি খাদিজার (রা.) বান্ধবীদের পর্যন্ত খোঁজ-খবর নিতেন। কখনও ভালো খাবার পেলে, তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।
তিনি মন্দের বদলা মন্দ দিয়ে দিতেন না। মন্দের বিপরীতে ক্ষমার রীতি অবলম্বন করতেন। রাস্তা-ঘাটে চিল্লাচিল্লি করতেন না। বাজারে হৈ-হুল্লোড় করতেন না। কেউ তাঁর হাত ধরলে, তিনি তা ছাড়িয়ে নিতেন না। অপেক্ষা করতেন, কখন লোকটি নিজে থেকেই হাত ছাড়িয়ে নেয়। যে কেউ তাঁকে দাঁড় করিয়ে কথা বলতে পারতো। ছোট ছোট বাচ্চারা, তাঁর হাত ধরে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতো।
তিনি দাস-দাসীদের প্রতি কখনও খারাপ আচরণ করেননি। কোনও দাসকে গালি দেননি। এমনকি এ কথাও বলেননি, ‘কেনো তুমি এটা করলে না?’ কিংবা এও বলেন নি, ‘কেনো তুমি এটা করলে?’ তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ দাসদের থেকে উন্নত ছিলো না। গরিব-মিসকিনদের তিনি ভালোবাসতেন। গরিবদের সাথে উঠাবসা করতেন। তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। গরিবদের জানাযায় ইমামতি করতেন। কিয়ামতের দিন গরিবদের সাথে উঠার দোআ করতেন।
তিনি নিজ হাতেই সব কাজ করতেন। একবার সফরে ছিলেন। সে সময় একটি বকরি জবাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁর সাথিদের একজন বলেন, ‘জবাই করার দায়িত্ব আমার।’ আরেকজন বললেন, ‘চামড়া ছাড়ানোর দায়িত্ব আমার।’ অন্যজন বললেন, ‘রান্নার দায়িত্ব আমার।’ তখন তিনি বললেন, ‘কাঠ সংগ্রহের দায়িত্ব আমার।’ তাঁর সাথিরা বললেন, ‘আমরা আপনার কাজ করে দেবো।’ তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তোমরা আমার কাজ করে দেবে। কিন্তু আমি তোমাদের চাইতে স্বতন্ত্রতা অবলম্বন করতে চাই না। কেনোনা, বান্দাহ তার আচরণে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে নিজেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মনে করবে, আল্লাহ তা পছন্দ করে না।’
তিনি সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশ্যি সে চিন্তা আরাম আয়েশের জন্যে নয়। ক্ষমতার জন্যেও নয়। চিন্তা করতেন তাঁর উম্মাহর জন্যে। উম্মাহর কল্যাণের জন্যে। অত্যন্ত কোমল হৃদয় ছিলো তাঁর। তিনি কোনওদিন পানাহার দ্রব্যের সমালোচনা করতেন না। স্বল্প-দামি হাদীয়া এলেও, তা গ্রহণ করতে সংকোচবোধ করতেন না। নিজের জন্যে কারও ওপর ক্রুদ্ধ হতেন না। ইশারা করতে তিনি—হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত উল্টোতেন। খুশি হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। রাগান্বিত হলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
সব সময় সাথিদের ঐক্যবদ্ধ রাখতেন। দলাদলি অপছন্দ করতেন। সাথিদের মধ্যে কখনও অনৈক্য তৈরি হতে দিতেন না। সকল গোত্রের সম্মানিত লোকদের তিনি সম্মান করতেন। সম্মানিত লোকদেরই নেতা করতেন। মানুষের অনিষ্ট থেকে সাবধান থাকতেন। সব বিষয়েই মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন।
সাথিদের খোঁজ নিতেন। তাঁদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতেন। কোনও বিষয়ে অমনোযোগী থাকতেন না। যে কোনও বিষয়ের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতেন। সত্য ও ন্যায় থেকে দূরে থাকাকে অপছন্দ করতেন। অন্যায় থেকে সর্বাদা দূরে থাকতেন। কিন্তু কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করতেন।
তিনি ছিলেন নিরহংকার। অতি বিনয়ী। তিনি আরবের নেতা হয়েও কখনও নেতার মতো ভাব দেখাননি। শত-শত দেহরক্ষী রাখেনি। মাথায় কোনও মুকুট পরেননি। দামি-দামি পোশাক গায়ে দেননি। কেউ তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলে, তিনি তা অপছন্দ করেছেন। তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন। নিজের ছেঁড়া জামা নিজেই সেলাই করতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন। গৃহস্থালির কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন।
তিনি এমন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, যার ঘরের উনুনে আগুন জ্বলেনি। কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ নয়—মাসের পর মাস। শুধুমাত্র খুরমা ও পানি খেয়েই তিনি ও তাঁর পরিবার দিনযাপন করতেন। মাঝে মাঝে খেজুর হতো তাঁর খাদ্যসামগ্রী। দামি খেজুর নয়, একেবারে সাধারণ মানের খেজুর। পরপর অনেক রাত তিনি অভুক্ত থাকতেন। পেটে ক্ষিদে নিয়ে বিছানার পার্শ্ব পরিবর্তন করতেন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ন্যুব্জ হয়ে যেতেন। টানা তিনদিনও তিনি অভুক্ত অবস্থায় কাটিয়ে দিতেন।
তাঁর শত শত দেহরক্ষী ছিলো না। ঘরে মনি মুক্তার ছড়াছড়ি ছিলো না। শরীরে রেশমের দামি কাপড় ছিলো না। স্বর্ণের কোনও অলঙ্কার তাঁর পরনে ছিলো না। তাঁর মাথায় মুকুটও ছিলো না। অথচ সে সময়ের রাজা বাদশাদের ক্ষেত্রে এগুলো অত্যন্ত মামুলি বিষয় ছিলো।
তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। কঠিন পরিস্থিতিতে যখন অন্যদের পদস্খলন হয়ে যেতো, সে সময়েও তিনি অবিচল থাকতেন। তাঁর দৃঢ়তায় বিন্দুপরিমাণ বিচলিত ভাব প্রকাশ পেতো না। বড়ো বড়ো বাহাদুররা যখন পিছপা হয়েছে, তখনও তিনি দৃঢ়চিত্তে সামনে এগিয়ে যেতেন। পিছু হটতেন না। যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতো, পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়ে যেতো, শত্রুরা যখন তীব্র আক্রমণ শুরু করতো; তখন সাথিরা তাঁর আড়াল গ্রহণ করতেন। তাঁর কাছ থেকে বীরোচিত উদ্দীপনা পেতেন। শত্রুর ভয় তাঁকে ভীত করেনি কভু। ময়দান থেকে কখনও পালিয়ে যাননি তিনি। সংখ্যাধিক্কের ভয়ে কখনও বিচলিত হননি।
ভাই আমার! তুমি কি জানো, আমি কার কথা শুনাচ্ছি?
হ্যাঁ, আমি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহর কথাই বলছি। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
ইনিই তিনি, যিনি সর্বাধিক দানশীল, সাহসী, সত্যবাদী। যিনি সর্বাধিক অঙ্গীকার পালনকারী। যার আভিজাত্য ছিলো ক্রুজ, মেসি কিংবা গুয়েভারার চাইতেও বেশি। যার বীরত্ব ছিলো খালিদ ইবনু ওয়ালিদ কিংবা আকেলজান্ডার এর চেয়েও বেশি। ইনিই তিনি, যার সৌন্দর্য ছিলো ইউসুফ (আ.) এর চেয়েও বেশি। ইনিই তিনি, যার প্রতি যার প্রতি তোমার রব অনুগ্রহ বর্ষণ করতে থাকেন। ইনিই তিনি, ফিরিশতারা যার জন্যে প্রতিনিয়ত মাগফিরাত কামনা করতে থাকে। ইনিই তিনি, কিয়ামতের দিন যাকে প্রথম সুপারিশকারী বানানো হবে। ইনিই তিনি, যাকে মাকামে মাহমুদ দান করা হবে। ইনিই তিনি, যাকে প্রথম বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে।
ভাই আমার! ইনিই সেই ব্যক্তি, যাকে তোমার মেনে নেওয়া উচিৎ।
আদম (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইদরিস (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। নূহ (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। হুদ (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। সালিহ (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইবরাহীম (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। লুত (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইসমাঈল (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইসহাক (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইয়াকুব (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইউসুস (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। আইয়ুব (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। শুয়াইব (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। মূসা (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। হারূন (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইউনুস (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। দাউদ (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। সুলাইমান (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইলইয়াস (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইলইয়াসা (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। যুফিকল (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। যাকারিয়া (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ইয়াহহিয়া (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। ঈসা (আ.)-কে একটি জাতির জন্যে পাঠানো হয়েছিলো।
কিন্তু মুহাম্মাদকে ﷺ?
মুহাম্মাদকে ﷺ গোটা গোটা মানবজাতির জন্যে আদর্শ হিসেবে পাঠানো হয়েছে। ইনিই তিনি, যাকে তোমার জন্যে আদর্শ হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। ইনিই তিনি, যাকে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে থেকে সর্বাধিক সম্মানিত করা হয়েছে। ইনিই তিনি, যার উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে তোমার রব সার্টিফাই করেছেন।
ভাই আমার! তাকে বাদ দিয়ে, তুমি কার পেছনে দৌড়াচ্ছো?
তুমি কি ভুলে গেছো, তোমার রবের বাণী? তোমার মনে নেই তোমার রব কি বলেছেন?
“তুমি বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [‘আলি ইমরান, (০৩) : ৩১ আয়াত] “অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও—তাহলে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্যে সে দায়ী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী। এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া।” [ নূর, (২৪) : ৫৪ আয়াত]
==========================
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
1) আল-কোরআন কারীম।
2) ইবনু কাসীর, ইসমাঈল ইবনু ওমার, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ; (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, মে, ২০০৭ ইং)।
3) মুবারকপুরী, শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, (আল-কোরআন একাডেমি ২১ তম প্রকাশ, নভেম্বর, ২০১৩)।
4) ইবরাহীম আলি, সীরাতুন নবি, (মাকতাবাতুল বায়ান, ১ম প্রকাশ, ২০১৭)
5) আলবানী, মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন, সহীহ শামায়েলে তিরমিযী, ( ইমাম পাবলিকেশন, ১ম প্রকাশ, ডিসেম্বর, ২০১৪ ইং),
6) তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা, শামায়িলুন নবী, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সেপ্টেম্বর, ২০১৩)