সাহিত্যের পাতায় মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা

হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ মুসলমানদের ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, পাষন্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর এ জাতীয় কোনো গালি দিতে বাদ দেয়নি। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘মৃণালীনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজ সিংহ’ ও ‘কবিতা পুস্তক’, ইশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দামোদর মুখোপাধ্যয়ের ‘প্রতাপসিংহ’ যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যয়ের বঙ্গানুবাদিত ‘রাজস্থান’ দীন বন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’ ইত্যাদি ইসলাম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩ খ্রি.) কাব্যসজ্জায় সুস্পষ্ট মুসলমান বিদ্বেষ পাওয়া যায় । “হেমচন্দ্র তাঁর বীরবাহুতে (১৮৬৪ খ্রি.) লিখেছে – আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর’। [ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক,  প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭০]।

বহু কাল থেকেই বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা ও চরম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মুসলমানরা। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭ খ্রি.) পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮ খ্রি.) স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা, দেশপ্রীতি এবং বিদেশাগত মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৯ তে প্রকাশিত অশ্রুমতী নাটক উৎসর্গ করেন অনুজ রবীন্দ্রনাথকে। এবং উক্ত নাটক ছিল মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। উক্ত নাটকের সৈন্যগণ বলছে, “আজ আমরা যুদ্ধে প্রাণ দেব,চিতোরের গৌরব রক্ষা করব,মুসলমান রক্তে আমাদের অসির জ্বলন্ত পিপাসা শান্ত করব”… (অশ্রুমতী : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক সমগ্র, সাহিত্য সংসদ,২০০২, পৃষ্ঠা ১১৩।)]।

ইংরেজদের সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে খুশী হয়ে ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত রচনা করেছিলেন;

একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)

হাঁসফাঁস করে যত প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে

বিশেষত: পাকা দাড়ি পেট মোটাভূড়ে

রোদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়া মাথা ফূড়ে

কাজি কোল্লা মিয়া মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি

কাছা খোল্লা তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি

এই কবিতায় চরম মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে।শুধু তাই নয় ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত স্পষ্টতই ব্রিটিশদের দালাল ছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছিলেন;

ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়

মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়  (দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলী,পৃ. ১৯১)।]

বঙ্কিমচন্দ্র তার শেখা প্রায় সবকটি গালি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে দিতে বাদ রাখেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসে এক মন্তব্যে বলেন, ‘‘ধর্ম গেল, জাত গেল, মান গেল, কূল গেল, এখনতো প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের (মুসলমানদের) না তাড়াইলে আর কি হিন্দুয়ানি থাকে’’। এমনকি গল্পের মাধ্যমে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার ইচ্ছাও প্রকাশ পেয়েছে এ উপন্যাসে; ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা মাধবের মন্দির গড়িব?” [আনন্দমঠ, তৃতীয় খন্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ]।

শুধু তাই নয়, “তিনি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ দানেশ খাঁকে দিয়ে মুসলমানদেরকে ‘শুয়ার’ বলে গালি দিয়েছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে কতিপয় স্ত্রীলোককে দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুখে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছেন। ‘মৃণালিনী’তে বখতিয়ার খিলজীকে ‘অরণ্য নর’ বলেছেন। কবিতা পুস্তকে তিনি লিখেছেন, ‘‘আসে আসুক না আরবী বানর – আসে আসুক না পারসী পামর’’। (আফজাল চৌধুরীর শেষ কবিতা: মুকুল চৌধুরী, দৈনিক সংগ্রাম,ঈদসংখ্যা-২০১২)।

আরেক সাম্প্রদায়িক কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার বন্ধু চির মুসলিম বিদ্বেষী ব্রাহ্ম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি মুসলমান জাতি ও সমাজ সম্বন্ধে তার নানা লেখায় বরং বিরূপ মন্তব্যই করিয়াছেন। (বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা, মনিরা কায়েস, পৃ. ২৩)। তাই শিবনারায়ণ রায় বলেছেন: “তিনি (রবীন্দ্রনাথ) কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই চর্চা করেননি। সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন.. (প্রতিক্ষণ, জুলাই ১৯৯৩, পৃ. ১৭)।” যেমন, গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “ভালো মানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্ম প্রচার করেন নি।” (গোরা,পৃষ্ঠা ১৭)।” তাইতো সলিমুল্লাহ খান তাঁর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভারতের বৃহৎ হিন্দুজাতি – খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন – সবাইকে হিন্দু বানাইতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না’। (বণিক বার্তা ২০ অক্টোবর, ২০১২)।

রবীন্দ্রনাথ তার ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে মুসলিম চরিত্র হরণ করেছে এভাবে-

আল্লা হো আকবর’ শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিনলক্ষ যবনসেনা, অন্যদিকে তিনসহস্র আর্যসৈন্য। হর হর বোম্‌ বোম্‌! পাঠক বলিতে পার, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশজন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া  পতিত  হইল?  বলিতে  পার,  কাহার  প্রতাপে  এই অগণিত  যবনসৈন্য  প্রচণ্ড  বাত্যাহত অরণ্যানীর  ন্যায়  বিক্ষুব্ধ  হইয়া  উঠিল?—  কাহার বজ্রমন্দ্রিত  ‘হর  হর  বোম্‌  বোম্‌’ শব্দে  তিনলক্ষ ম্লেচ্ছকণ্ঠের  ‘আল্লা  হো  আকবর’   ধ্বনি  নিমগ্ন  হইয়া  গেল? ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো শরৎচন্দ্র ও তার অনেক লেখায় মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। শরৎচন্দ্র তার “বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা” নামক প্রবন্ধে চরম মুসলিম বিদ্বেষী লেখা লিখেছেন। তাইতো সাহিত্যিক ও সমাজ দার্শনিক আহমদ ছফা বলেছেন,  “এইরকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে”  (যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ৫৬)।

[ঐ প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলমানদের পাণ্ডা বলে সম্ভোদন করেন। বলেন; “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ।হিন্দু-মুসলমান-মিলন একটা গালভরা শব্দ। বস্তুতঃ, মুসলমান যদি কখনও বলে—হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুতঃ অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই।” 

ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কতটা সাম্প্রদায়িক ছিলো ঐসব কবি সাহিত্যিকগণ। তাইতো ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন,“কি পরিতাপের বিষয় আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাশেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তাহা পড়িতে পায় না। এখন হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষণের কথা,কৃষ্ণার্জ্জনের কথা, সীতা-সাবিত্রির কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। সম্ভবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের বড় লোক নেই। এই সকল পুস্তুক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ব বিহীন করা হয়। বুদ্ধদেবের জীবনী চারপৃষ্ঠা আর হযরত মোহম্মদ (সাঃ) এর জীবনী অর্ধপৃষ্ঠ মাত্র। অথচ ক্লাসে একটি ছাত্রও হয়তো বৌদ্ধ নহে। আর অর্ধাংশ ছাত্র মুসলমান।.. মূল পাঠ্য ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের সম্বদ্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়া ফেলা হয়,আর মুসলমানদিগের বেলা ঢাকঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়। [সূত্রঃ আমাদের (সাহিত্যিক) দারিদ্রতা, মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জৈষ্ঠ ১৩২৩, সংগ্রহে মুস্তফা নুরউল ইসলামঃ সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, পৃঃ ৩০-৩১]।

এখনো ভারতের পাঠ্যপুস্তকে অনেক মুসলিম সফল ন্যায় পরায়ণ শাসকদের ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়েছে।সহজেই বোঝা যায় এই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছে হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ,মুসলমানরা নয়।

উৎসঃ ইমন (আলোকিত আধারে ), সাহিত্যের পাতায় হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা,সামহোয়্যার ইন ব্লগ, ০৭ ই জুলাই, ২০১৫

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button