আমার জীবনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন – একজন মুসলিম বোনের গল্প!

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

আজ আমি আপনাদের সাথে আমার হিজাব শুরু করার আগের ও পরের জীবনের কথা শুনাতে চাই। আমি ২০ বছর বয়সী একজন মুসলিম মেয়ে যার জন্ম আরব উপসাগরীয় এলাকায়-ইসলামের আদি জন্মভূমিতে।আমি বিশ্বাস করতাম হিজাব তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।যদিও আমার মা হিজাব পড়তেন, তিনি আমাকে বা আমার বোনকে তা পড়ার ব্যাপারে জোর করেন নি। তিনি মনে করতেন কাজটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করা উচিত, নতুবা তার আওতার বাইরে চলে গেলেই আমরা হিজাব পড়া ছেড়ে দিব। আমি মনে করি ধারণাটা কিছু মাত্রায় সঠিক।

অথবা আমরা যখন বড় হব তখন হিজাব পড়াটাকে আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হবে। কারণ সারাজীবন ধরে একটি বিষয়ে অভ্যস্ত হওয়া আর তারপর হঠাৎ করে সেটা বদলে ফেলা খুব কঠিন। মন পরিবর্তন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যাই হোক, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে আমি খুবই ভালবাসতাম যেহেতু আমি দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ছিলাম।আর এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ।আমি দামী দামী জামা-কাপড় কিনতে, সেগুলো দিয়ে নিজেকে সাজাতে খুবই পছন্দ করতাম। সবাই যখন আমার দিকে তাকাত এবং বিশেষভাবে চিহ্নিত করত, ব্যাপারটা আমি চরমভাবে উপভোগ করতাম। আমি ভালবাসতাম প্রশংসা শুনতে –বাহ মেয়েটাতো দারুণ সুন্দরী।

আমার মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হবার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি আমেরিকাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানে আমি একটি বিষয় লক্ষ করলাম যা আগে কখনও দেখিনি। তা হল মুসলিম সমাজ এবং সম্প্রদায়। এ এক অসাধারণ সমাজ আদর্শ মুসলিমদের নিয়ে যারা ইসলাম পালন করছে আমি যেভাবে অভ্যস্ত তার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায়। আরব উপসাগরীয় এলাকার মুসলিমরা জন্মগতভাবে মুসলিম। তাদের কোন প্রশ্ন করতে হয়না কারণ সব কিছুই খুব সুস্পষ্ট। আমাদের নিজেদের ঈমান নিয়ে এবং কিভাবে আল্লাহতে বিশ্বাস করতে হবে এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি কারণ আমরা বেড়েই উঠেছি মুসলিম হিসেবে এবং আমাদের চারপাশের সবাই ছিল মুসলিম।  প্রকৃত ইসলামের স্বরূপ কেমন এটা এবং সব ধরণের ধর্মাবলম্বী সম্বলিত একটি মিশ্র সমাজে বাস করার অনুভূতি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। আমি উপলব্ধি করলাম উপসাগরীয় লোকজন বিশুদ্ধ ধর্ম পালন করত না, যা করত তা হল ধর্ম এবং সংস্কৃতির এক ধরণের মিশ্রণ।আমি আবিষ্কার করলাম-অনেক কিছু, যাকে আমি ইসলামিক বলে মনে করতাম, আসলে সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরম ভুল!আমি জানলাম যে বিশুদ্ধ ইসলাম সেটা না যার মাঝে আমরা বেড়ে উঠেছি বরং তা ছিল অর্থহীণ বিষয়ে পূর্ণ যা বহুদিন ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বিশুদ্ধ ইসলামের শিক্ষার উৎস শুধুই ক্বুরআন ও সুন্নাহ।

যখন আমেরিকার লোকজন জানতে পারল যে আমি মুসলিম, তখন তারা সবসময় ইসলামের ব্যাপারে আমাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করত। অধিকাংশ সময়েই আমি তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। ফলে আমি বিভিন্ন ইসলামী বই এবং ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম-বিশুদ্ধ ইসলাম জানার আশায়। আমার অবস্থা ছিল এমন ব্যক্তির মত যে কখনও ইসলামের কথা আগে শোনেনি। আমি অনেক কিছু জানতে পারলাম যা আমি আগে জানতাম না।আমি মসজিদে যাওয়া শুরু করলাম এবং প্রচুর ভাই বোনদের সাথে ইসলামিক বিষয়ে কথা বলা ও আলোচনায় অংশ নিতে লাগলাম। আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমার নিজের দেশে আমি কখনও কোন মসজিদে যাই নি এবং সেটার কথা চিন্তাও করিনি। যদিও আমার দেশে হাজার হাজার মসজিদ ছিল।আমি ছাড়া মসজিদের সমস্ত বোনরা হিজাব করত।আমি বাদে আর সবাই ছিল আমেরিকান। তারা আমার ব্যাপারে খুবই উদার ছিল আর সেজন্য আমি তাদের খুবই সম্মান করি। আমি এটা নিয়ে সবসময়ের জন্য ভাবা শুরু করলাম এবং আমার হিজাব পড়া নিয়ে প্রচুর স্বপ্ন দেখতে লাগ্লাম।আমি হঠাৎ এক অচেনা অনুভূতির সম্মুখীন হতে লাগলাম- আর তা হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে তা উপভোগ করার বদলে আমার বিতৃষ্ণা বোধ হতে থাকল। আমার নিজেকে একটা ছবির মত মনে হত যার কোন ব্রেন বা হৃদয় বলতে কিছু নেই। পরিশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হিজাব শুরু করলাম। এটা আমার জীবনের নেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। জীবনে প্রথমবারের মত আমি অনুভব করলাম যে আমি একজন দৃঢ় চিত্তের মানুষ।আমি যা বিশ্বাস করি সে অনুযায়ী কাজ করি।চারপাশের মানুষ আমার ব্যাপারে কি বলল বা আমার দিকে কিভাবে তাকাল, আমি তা গ্রাহ্য করি না।

হিজাব পড়ার পর প্রথম দিনটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আমি এত সুখী আর উদার জীবনে আর কখনও বোধ করি নি যেমনটি করেছিলাম সেদিন। আর বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিল যে আমি আসলেও এটা করতে পারব এবং প্রত্যেকে বলেছিল যে আমার এটা বেশী দিন স্থায়ী হবে না। সম্ভবত তাদের এই অনুমান অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি যা আজও আমাকে হিজাব পড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। আমার নিজের সাথে এজন্য যুদ্ধ চালাতে হয়েছে। আমার আমি সবসময়ই দুনিয়ার এই জীবনটাকে খুব ভালবাসে এবং তাকে সর্বোত্তমরূপে ভোগ করতে চায়। কিন্তু তখন সময় এসেছিল তাকে থামানোর এবং আমি তা করেছিলাম।কিছুদিন পর থেকে সবাই আমাকে সম্মানের চোখে দেখা শুরু করল যেভাবে তারা আগে কখনও দেখেনি। সবাই আমাকে চরমভাবে বিশ্বাস করা শুরু করল এই কারণে যে তারা জানত আমি একজন ধার্মিক ব্যক্তি। কি তাদের মাঝে এই ধারণার জন্ম দিল?   -হিজাব

আমি এখন যে কোন জায়গায় যেতে পারি এবং কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকায় না যে আমি একটা ছবি বা প্রাণহীণ পুতুল।তবে আমি এখনও সুন্দর করে পোশাক পড়ি এবং সাজগোজ করি, যখন আমি শুধু আমার বোনদের মাঝে থাকি আর দেখা গেল সেটা আরও বেশি মজা- নির্মল বিনোদন।

আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ হিজাব বাধ্যতামূলক করেছেন আমাদের সাহায্য করার জন্য, আমাদের জীবনকে সহজতর করার জন্য। এটা নারী ও পুরুষের মাঝে সম্মানজনক সেতুবন্ধনের সাহায্য করে। তাছাড়াও এটা হল নিজের সৌন্দর্য শুধু নিজের কাছে এবং যাদের কাছে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন শুধু তাদের কাছেই তুলে ধরার ব্যাপার।এটা অন্য সকল ধর্মের মত একটি চিহ্ন বা স্মারক যে আমি একজন মুসলিম। যেমন ইহুদীরা তাদের মাথার উপর একটা ছোট কাপ পড়ে আর খ্রিস্টানরা পরে ক্রস।তাদের কেউই জনসম্মুখে এটা পড়তে লজ্জিত বোধ করে না। কোন মানুষ এব্যাপারে খারাপ ধারণাও পোষণ করে না।

একটা মেয়ে হিজাব পড়ে যেন এটা তাকে ভুল বা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়া থেকে বাঁচায়। যে মেয়েটা হিজাব পড়ে সে এমন দৃঢ়চিত্ত হয় যে, যে কোন কিছু করতে পারে এবং জীবনের পথে যে কোন সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে।  তোমার চারপাশের সবাই তোমাকে বিশ্বাস করবে কারণ তুমি নিজেকে বিশ্বাস কর। তুমি কি জান না যে তোমার বাহ্যিক দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ? তুমি কি জান না তা খুব মূল্যবান? তুমি যে সুন্দর এটা বলার জন্য তোমার কাউকে প্রয়োজন নেই, কারণ তুমি তা জান। আর তোমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যও তোমার কাউকে দরকার নেই যেন তুমি একটা সুন্দর ছবি না চিত্রকর্ম, কারণ তুমি একজন মানুষ।

অনুবাদঃ   হামিদা মুবাশ্বেরা

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan