ধর্ম যার, উৎসব তার

মক্কার কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো – “চলুন না, একবছর আপনি আমাদের মাবূদ প্রতিমাগুলোর ইবাদাত করবেন, পরের বছর আমরাও আপনার আল্লাহর ইবাদত করবো?”

কুফফারদের এই ঘৃণ্য প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্‌ সুবহানাল্লাহু তা’আলা নাযিল করলেন সুরা কাফিরুনের ছয় ছয়টা আয়াত – না, এই জঘন্য প্রস্তাব কখনোই বাস্তব হওয়ার নয়। “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” বলে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহান ওয়া তা’আলা কুফফারদের কুফরে থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা আর অসন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়ে মুসলিমদের পথ আর তাদের পথ আলাদা করে দেন।

অথচ মজার ব্যাপারটা হলো,  সেই “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” আয়াতের অর্থের মধ্যে আজকালের মডারেইট আর সেকুলাররা ধর্মনিরপেক্ষতা খুঁজে পায়। নিজের ঈমান ঠিক রেখে নাকি কুফফারদের যে কোন উৎসবেই যাওয়া যাবে, প্রসাদ-লাড্ডু খাওয়া যাবে, ফাঁকফোকরে একটু আ্যশও করা যাবে। কারণ আল্লাহই তো নাকি বলে দিয়েছেন, আমার ধর্ম আমার নিজেরই কাছে, তাদের ধর্ম তাদের কাছে।

 

বলি, ঈমান তো বোধয় পাঁজরের কোন হাড়ের নাম। জন্মের পর একবার কালিমা পড়লেই সে হাড় পাঁজরে গজিয়ে যায় আর এমনই শক্তের শক্ত হয়ে যায় সেই হাড় যে শুধু ছেনি-হাতুড়ি দিয়েই ‘ঈমান’ নড়বড় করা সম্ভব – অন্য কিছু দিয়ে নয়।

রহমানের বান্দা কারা, সেটার পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ সুবহান ওয়া তা’আলা সুরা ফুরকানের ৭২ নাম্বার আয়াতে দুটো  বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেনঃ

وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا

“এবং যারা বাতিল/মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়,তখন তারা মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়।”

এই আয়াতের ‘বাতিল’ কথাটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক মুফাসসিরীনে কিরাম বলেছেন – এটা হলো অমুসলিমদের পার্বণ আর মেলা। ইবন কাসীর আয়াতের অর্থ করেছেনঃ

“আল্লাহর সৎ বান্দারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়না অর্থাৎ শির্ক করেনা, মূর্তিপূজা থেকে তাঁরা বেঁচে থাকে এবং মুশরিকদের আনন্দ-উৎসবে যোগদান করেনা।”

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,

“মহান আল্লাহ তাদের ঈদ-অনুষ্ঠানকে ‘বাতিল’ বলে আখ্যায়ন করেছেন এবং রহমানের বান্দাদেরকে সেখানে উপস্থিত হতে ও তা দর্শন করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং সেখানে উপস্থিত হওয়া এবং তা দর্শন করা বৈধ না হয়, তাহলে তাতে অংশগ্রহণ করা এবং সহমত পোষণ করা কি হতে পারে?” (ইক্বতিযা ১/৪২৭)

শুধু কুরআনেই এতগুলো স্পষ্ট দলিল থাকা সত্ত্বেও সব কিছু এক পাশে রেখে একজন মুসলিম যখন বলে “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এবং এর পক্ষে নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তি প্রদর্শন করে, তখন উপলব্ধি করি – সমস্ত উলামায়ে কিরাম কুরআন এবং হাদিসকে তাঁদের জীবদ্দশায় শুধু ভুল ভাবেই বুঝে গেলেন!

ধর্ম আর ধর্মের উৎসবকে কি আলাদা করা যায়? চলুন দেখি।

আল্লাহ exist করেন (C)  বলেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে (D1), সেই পৃথিবীতে মানুষ এসেছে (D2), মানবকল্যাণে মানুষের মধ্যে নবী-রাসূল ইসলাম নিয়ে এসেছেন (D3), নবী-রাসূলের মধ্যে ইব্রাহিম (আ:) এসেছিলেন (D4), ইব্রাহিম (আ:) এর মাধ্যমে কুরবানির সূচনা হয়েছিল (D5), তা থেকে মানুষ পেল ঈদ-উল-আযহা নামক এক উৎসব (E)।

একটা ইভেন্ট (E) আরেকটা ঘটনা (C) এর ওপর causally নির্ভর করবে if and only if C exist করার কারনেই E ঘটে, এবং C-এর অস্তিত্ব না থাকলে E-এর কোন অস্তিত্ব থাকে না।

এখানে আল্লাহ exist করেন হচ্ছে Cause, যেই Cause এর ফলে D1, D2, …, DK  নামক অনেকগুলো ধারবাহিক এবং সম্পর্কযুক্ত ঘটনার সিকুয়েন্সের মাধ্যমে ঈদ-উল-আযহা নামক উৎসব  অর্থাৎ Effect (E) পেয়েছি।

গোটা ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘Causal Dependence’। David Lews নামক এক অ্যামেরিকান দার্শনিক ‘Causation’ নামক পেপারে Causal Dependence এর এই ব্যাপারটা তুলে ধরেন।

উৎসব জিনিসটা হচ্ছে একটা ইভেন্ট। উৎসবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইকিপিডিয়াতে লেখা আছেঃ

“A festival or gala is an event ordinarily staged by a community, centering on and celebrating some unique aspect of that community and its traditions, often marked as a local or national holiday, mela or eid.”[১]

সরল কথায়, উৎসব হচ্ছে এমন একটা ইভেন্ট যেটা কোন সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় এবং ঐতিহ্যের বিশেষ কিছু দিককে উপজীব্য করে পালন করে।

কাজেই বোঝা গেল উৎসব জিনিষটার সাথে অবশ্যই কোন না কোন সম্প্রদায় (Community) জড়িত থাকে, যারা নিজেদের সম্প্রদায় এবং ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করেই উৎসব পালন করে। সম্প্রদায়টা হতে পারে অঞ্চলভিত্তিক অথবা ধর্মভিত্তিক।

ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা বা বড়দিন, যে কোন উৎসবই কোন কিছুর effect, cause না। Causal Dependence-এর সিকুয়েন্সের আলোকে, এই ইফেক্টগুলোর Cause যদি আমরা খুঁজতে যাই, দেখা যাবে সেখানে C হিসেবে আছে আল্লাহ, যিশু খ্রিষ্ট অথবা ব্রহ্মা-কৃষ্ণ। আমি যেভাবে সবকিছুর Cause হিসেবে আল্লাহকে মনে করি, সেভাবে সনাতন ধর্মালম্বীগণ সবকিছুর Cause হিসেবে ব্রহ্মাকে মনে করবেন, ক্রিশ্চিয়ানরা মনে করবেন জেসাস ক্রাইস্টকে। আমার কাছে ঈদ নামক উৎসবের অস্তিত্ব আছে কারণ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আছেন। তাদের কাছে বড়দিনের উৎসব আছে কারণ ঈশ্বর জেসাস আছে, দুর্গাপূজা আছে কারণ ব্রহ্মা আছে।

যুক্তিশাস্ত্রে ‘Necessary Causes’ নামে একধরনের Cause আছে। যেটার মানে, “If x is a necessary cause of y, then the presence of y necessarily implies the presence of x.”

এটার সোজা মানেটা হচ্ছে, ধর্মীয় উৎসবের জন্য সেই ধর্মের সৃষ্টিকর্তা যদি necessary cause হয়,তবে সেই ধর্মীয় উৎসবকে মেনে নেয়া মানে সেই ধর্মের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত্বকে মেনে নেয়া। আর Causal Dependence-এর আলোকে আমরা দেখেছি ধর্মীয় উৎসবের জন্য সেই ধর্মের সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই necessary cause।

তাহলে যে ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে সেটা হল, ধর্ম থেকে উৎসবকে আলাদা করা যায়না। উৎসব E পাওয়াই গেল C থেকে, যাদের মাঝখানে D1, D2, …, DK এর মত অনেকগুলো কাহিনী আছে। Causal Dependence-এর আলোকে, আপনি E মেনে নিচ্ছেন মানে আপনি C-এর স্বীকৃতি দিচ্ছেন, বড়দিনের সময় ঈশ্বর রূপে জেসাস ক্রাইস্টকে আর পূজার সময় ভগবান রূপে ব্রহ্মা-বিষ্ণুকে।

আল্লাহ সুবহান ওয়া তা’আলা ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, আপনি তাহলে মুসলিম রইলেন কীভাবে?

যারা বলেন ধর্ম যার যার, উৎসব সবার – তারা কোন থিয়োরির আলোকে এই কথা বলতে পারেন? বিজ্ঞানমনস্ক এই জাতি সামান্য Cause-Effect রিলেশনশিপ বুঝবে না, তা কী করে হয়?

জোরাজুরি করে যারা ধর্ম থেকে উৎসবকে আলাদা করতে চান তাদেরকে আমি প্রায়ই এই কথাটা জিজ্ঞেস করি,

আপনার স্ত্রী পরপুরুষের সাথে ব্যভিচার করে একটা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। আপনার স্ত্রী সেই সন্তানের জন্মদিন কাল ঘটা করে পালন করবে। আপনি শামিল হবেন না জন্মদিনের এই উৎসবে?

প্রায় সবারই উত্তরটা হয় – ওকে আমি আগে তালাক দিব।

কেন? উৎসব পালনে সমস্যা কোথায়? আপনি এখানে উৎসবটা আলাদা করে দেখছেন কেন? সন্তান যার যার উৎসব সবার হতে সমস্যা কী?

মনে রাখবেন, আপনার স্ত্রী অন্যের সাথে ব্যভিচার করে সন্তান জন্ম দিয়েছে, এই ব্যাপারটা আপনার জন্য যতটা না অপমানজনক, মুমিনদের তারচেয়ে বেশি আপমানজনক কিছু লোক আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করছে – এই ব্যাপারটাতে। মুমিনরা তাই অন্য কোন ধর্মের উৎসবে শরিক হয়না, শির্ক জিনিষটাকে তাঁরা একদম সহ্য করতে পারেনা, শির্কের ব্যাপারে তাঁরা অনেক সেনসিটিভ।

কতটা সেনসিটিভ? সেটা শুনুন এবারঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় এক ব্যক্তি মানত করে যে, সে ‘বাওয়ানা’ নামক স্থানে একটা উট কুরবানী করবে।

সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে কথাটা উল্লেখ করলো এবং বলল, “আমি বাওয়ানা নামক স্থানে একটি উট কুরবানী করার জন্য মানত করেছি।” (অর্থাৎ মানত পুরো করতে কোন বাধা আছে কি না)

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সেখানে দেব-দেবীর কোন মূর্তি ছিল বা আছে কি না যাদেরকে জাহিলিয়াতের যুগে পূজা করা হতো। সাহাবীরা বললেন যে, নেই। তখন তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, জায়গাটা কি  তাদের (কুফফারদের) আনন্দ-মেলার স্থান-সমূহের কোন স্থান বা সেখানে তাদের কোন মেলা বসত কি না।  সাহাবীরা এবারও বলেন – না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ব্যক্তিকে তার মানত পুরো করার অনুমতি দিলেন।[২]

কী বুঝলেন, শির্ক নিয়ে মুসলিমদের কতটা সেনসিটিভ হওয়া উচিত?

আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়া তা’আলা আমাদেরকে তাঁর জ্ঞানের সমস্ত শির্ক থেকে আমাদেরকে মুক্ত রাখুক। আমীন।

অত বড় লেখা যারা সময় নিয়ে পড়লেন তাঁদেরকে আল্লাহ্‌ উত্তম জাযা দিক।


[১] wikipedia.org/wiki/Festival

[২] আবু দাঊদ, ৩৩১৩। তাহক্বীক – সহীহ।

[সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ বারো মাসে তের পার্বণ, তাফসির ইবনে কাসীর]

Original Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88