“উমার (রা) কে নিয়ে একটি জঘন্য মিথ্যাচার”

“উমার (রা) কে নিয়ে একটি জঘন্য মিথ্যাচার”
লেখক: ফারহান গনি
.
Our YouTube channel:
.
মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তখন মিশর জয় করেছিলেন। মিশরের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন সাহাবী আমর্ ইবনুল আ’স (রা)।
.
“ইয়াহইয়া আল নাহাউঈ নামের এক জ্ঞানী লোক সেই সময় থাকতো মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। তিনি আমর্ ইবনুল আ’সকে কিছু দার্শনিক উক্তি শোনালেন আর আমর্ ইবনুল আ’স খুশি হয়ে তাকে কিছু দিতে চাইলেন। নাহাউঈ তাঁর কাছ থেকে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির বইগুলো নিতে চাইলেন।

কিন্তু আমর্ তা করার আগে খলিফা উমরের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। চিঠির উত্তরে খলিফা উমর লিখে পাঠান, ‘বইপত্রগুলো যদি কুরঅানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। কাজেই এগুলোর ধ্বংস অনিবার্য। আর বইপত্রগুলোতে যদি কুরঅানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কথা থেকেও থাকে, তবে সেগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত। তাই বইগুলো ধ্বংস কর।’ এরপর আমর্ ইবনুল আ’স বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরিটির বইয়ের খন্ডগুলো আলেকজান্দ্রিয়া শহরের স্নানাগারে পাঠিয়ে দেন আর সেখানে পানি গরম করার জন্য এই বইগুলো জ্বালানো হল। সবগুলো বই জ্বালিয়ে শেষ করতে ৬ মাস লেগেছিল। ”
.
এতক্ষন যা পড়লেন তা হল ইতিহাসে উমর (রা) এর নামে করা অন্যতম একটি মিথ্যাচার। তবে ইসলাম বিদ্বেষী মহলে এই গল্পটি খুবই ফেমাস। এই গল্প উল্লেখ করার পরই তারা লাইন জুড়ে দেয়, “দেখো মুসলমানরা কত নীচু প্রজাতির, জ্ঞানচর্চার প্রতি তাদের কী অনীহা, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্ববহ লাইব্রেরী ধ্বংস করে তারা মানবসভ্যতাকে কয়েকশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে, ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা…
.
প্রথমেই বলে রাখি, উপরের গল্পটি সর্বপ্রথম ইবনে আল ক্বাফতির বর্ণনা হতে পাওয়া যায় যিনি এটি ইবনে আল আবারি থেকে বর্ণনা করেছিলেন খলিফা উমরের মৃত্যুর আরো কমপক্ষে ৫০০ বছর পরে। এরপর সিরীয় খ্রিষ্টান লেখক বার-হিব্রাইউস ইবনে আল ক্বাফতি থেকে কপি পেস্ট মারেন।[১]

মজার ব্যাপার হল – বিখ্যাত ইসলামী ইতিহাসবিদদের কোনো বর্ণনাতেই এই ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আল ওয়াক্বিদি, আত তাবারী, ইবনে আল আথির, ইবনে আব্দুল হাকাম, ইয়াকুত আল হামাবী কেউই কখোনোই নিজেদের গ্রন্থে এই ঘটনাটি উল্লেখই করেন নি।
.
যাই হোক, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ইতিহাসে অনেকবারই যুদ্ধ আর অগ্নিকান্ডের শিকার হয়। প্রথম ঘটনাটি ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৮৯-৮৮ অব্দে। এই সময়ে টলেমী-VIII আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। এই সময়ে দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং লাইব্রেরীর কিছু অংশে অগ্নিসংযোগ ঘটে।

পরবর্তী অগ্নিসংযোগ হয় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের মিশর জয়ের সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ অব্দে। মিশর ও রোমের এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে সিজার আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

পরবর্তী অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে ২৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই সময় পলিমারের রানী জেনেবিয়া সম্রাট অ্যারেলিয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। এই বিদ্রোহ দমন করতে যেয়ে অ্যালেরিয়ান ও জেনেবিয়ার মাঝে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অ্যারেলিয়ান লাইব্রেরীটির যে অংশ অক্ষত ছিল সেখানেও আগুন লাগিয়ে দেন।

এইখানেই শেষ না। ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে বিশপ থিওফেলাস প্যাগানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন এবং তিনি প্যাগান মন্দির বন্ধের নির্দেশ দেন। প্যাগানরা তাতে অস্বীকৃতি জানালে থিওফ্যালাস তাদের সকল মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করেন। তখন লাইব্রেরীর যে অংশটুকু বেঁচেবুচে ছিল সেটাও ধ্বংস হয়।
.
তো ডিয়ার “কলা”জ, কি মনে হয় আপনাদের ? চারবার ভয়াবহ আগুন লাগার পরও আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী খলিফা উমরের সময় ছিল ? আর সেখানে এত্তওওগুলো বই ছিল যে তা জ্বালাতে ৬ মাস লেগেছিল ?
.
এবার আসুন কিছু সূত্র মেলানো যাক।

* যদি সেই সময় আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে কোনো বই থেকেও থাকতো, তাহলে তো বাইজেন্টাইনরা মিশর ত্যাগ করার আগেই সেগুলো নিয়ে চলে যাওয়ার কথা।

* আমর্ ইবনুল আ’সকে যদি উমর (রা) সত্যিই বলে থাকতেন যে, “সবগুলো বই ধ্বংস করে দাও”, তাহলে তো সাহাবি আমর্ এই নির্দেশ পালনে মোটেও কালক্ষেপণ করতেন না। বরং সাথে সাথেই পুরো লাইব্রেরীতে আগুন লাগিয়ে দিতেন বা সব বই সাগরে ফেলে দিয়ে নষ্ট করে দিতে পারতেন। সেখানে তিনি কেন বইগুলো ধ্বংস করতে ছয় মাস লাগালেন ?

মুসলিম এবং নন-মুসলিম সবগুলো সোর্সকে একত্র করলে এটা সহজেই বোঝা যায় যে, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের জন্য উমর (রা) মোটেও দায়ী নন।

তিনজন বিখ্যাত নন মুসলিম হিস্টোরিয়ানের মতামত দিয়ে শেষ করবো।

আমেরিকান ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস বলেন,

“The myth of the Arab destruction of the library of Alexandria is not supported by even a fabricated document”

অর্থাৎ আরবদের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের কাহিনী একটি জাল দলিলপত্র দ্বারাও সমর্থিত হয় না। [২]
.
কলাবিজ্ঞানিদের অতি শ্রদ্ধাভাজন (নাস্তিক দার্শনিক) স্যার বারট্রান্ড রাসেল বলেন,

“Christian propaganda has invented stories of Mohammedan intolerance, but these are wholly false as applied to the early centuries of Islam.”

অর্থাৎ “মুসলমানদের অসহিষ্ণুতা নিয়ে যে গল্পগুলো বলা হয় তা খ্রিষ্টান প্রোপাগান্ডা দ্বারা তৈরি এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাথে মিলালে তা সম্পূর্ণই মিথ্যা। “[৩]
.
আলফ্রেড জে বাটলারের উক্তিটি শোনার পর আপনার আর কোনো সন্দেহই থাকবে না। তিনি বলেন,

“When one has deducted all the writings on vellum, how can it be seriously imagined that the remainder of the books would have kept the 4,000 bathfurnaces of Alexandria alive for 180 days ? The tale, as it stands, is ridiculous.”

অর্থাৎ “বইগুলোর সংখ্যা এতবার হ্রাস পাওয়ার পরও কারো পক্ষে এটা কিভাবে ভাবা সম্ভব যে অবশিষ্ট বইগুলো ১৮০ দিন ধরে ৪০০০ স্নানাগারের চুলাকে জ্বালিয়ে রাখতে পারে ? গল্পটি খুবই হাস্যকর দাঁড়ায়।” [৪]

======
Writer’s profile: https://tinyurl.com/yb6kg85d

তথ্যসূত্র :

[১] Dr. Muhammad Ali al-Sallabi, Umar Ibn al-Khattab – His Life & Times; volume 2
[২] Bernard Lewis, What Happened To The Ancient Library Of Alexandria,p. 215
[৩] Bertrand Russell, Human Society In Ethics And Politics, p. 217
[৪] Alfred J. Butler, The Arab Conquest Of Egypt And The Last Thirty Years Of The Roman Dominion,p. 408

এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠ এর প্রতিবেদন:

#callingtotheone_refutations01
(একের আহ্বানে কতৃক ঈষৎ সম্পাদিত)
www.callingtotheone.com

Original Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member