উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নাগরিক যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে সাহাবী হবার গৌরব অর্জন করেন
চেরামান পেরুমল উপমহাদেশের সর্বপ্রথম নাগরিক যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পবিত্র সাহচর্য লাভ করে সাহাবী হবার গৌরব অর্জন করেন। উনার নিবাস ছিল ভারতের বর্তমান কেরালা প্রদেশের মালাবার অঞ্চলের ’Kodungaloor ‘কোডুঙ্গোলর’ এলাকায়। উনি উক্ত অঞ্চলের সম্রাট ছিলেন। একাধারে ২৬টি বৎসর তিনি রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পুরো দক্ষীণ ভারতের ২৫০০ মাইলেরও বেশী এলাকা জুড়ে উপকুলীয় এ রাজ্যের সীমানা ছিল বিশাল। অনেক ঐতিহাসিক উনার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।
প্রাচীন বইয়ের মধ্যে এম. হামিদুল্লাহ রচিত “মুহাম্মাদ রসূলুল্লহ” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘চক্রবতী ফারমাস’ যা চেরামান পেরুমল এর অন্য একটি উপাধি; নিজ অঞ্চলে থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা বা অলৌকিক ঘটনা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেণ। পবিত্র কোর’আনের সূরা-ক্বমার এ এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজার কথা উল্লেখ আছে। তাফসিরে উক্ত সূরার ব্যাখ্যায় এই পূন্যাত্মা সাহাবীর ইসলাম ধর্ম গ্রহনের কথা উল্লেখ আছে। ওখানে আরো বলা আছে যে, মালাবারের এই মহারাজা ডায়েরী লিখতেন। যেদিন এই চন্দ্রদ্বিখন্ডনের মু’জেজা সংগঠিত সেই, উনি সেইদিনের ঘটনা সবিস্তারে তারিখ সহ লিখে গেছেন। উনার রচিত সেই ডায়েরী এখনও সংরক্ষিত আছে। মক্কার কাফেরদের দাবীর মুখে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা হাতের ইশারায় চাঁদকে দিখন্ডিত করে দেখান। চাঁদের একটা অংশ আকাশের পূর্বাংশে আর অপরাংশ পশ্চিম দিকে সরে যায় কিছুক্ষণের জন্য। উপস্থিত অনেকেই সে রাতে এ দৃশ্য দেখেছিল। কাফেরদের কেউ কেউ এটা বিশ্বাস করলেও নিজের চোখে দেখা সত্তেও কেউ কেউ তা যাদু হিসেবে অভিহিত করে।
জোৎস্নারাতে রাজা চেরুমল রাজপ্রসাদের ছাদে বসে ছিলেন রাণী সাথে করে। হঠাৎ চাঁদকে দ্বিখন্ডিত হতে দেখে রাণীসহ তিনি ও তার সভাসদরা যারপরনাই বিষ্মত হন। এ বিষয়ে তিনি রাজজ্যোতিষীদের কাছে জানতে চান। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই মালাবার উপকুলে আগত আরব বণীকদের মাধ্যমে স্থানীয় আরব বণীক ও তাদের ভারতীয়রা জানতে পারেন যে, আরবে এক নবী আত্বপ্রকাশ করেছেন, তিনি একত্ববাদ প্রচার করেন, তিনিই নিজ হাতের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন। এ কথা শুনে অভিভূত রাজা চেরামান পেরুমল আরবের সেই নবীর সাথে স্বাক্ষাতের জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন, শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন একদল আরব বণীকদের সাথে। হিজরতের পূর্বে সম্ভবত ৬১৯-৬২০ খৃষ্টাব্দে, ২৭ শে শাওয়াল সকাল নয়টার দিকে প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর সাথে তাঁর দেখা হয়।
সেখানেই তিনি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা: এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বক্কর রা: সহ আরও কয়েকজন সাহাবীর উপস্থিতিতে স্বয়ং আল্লাহর হাবীব সা: তার নাম রাখে তাজউদ্দীন। রাজা চেরামান পেরুমল রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য উপঢৌকন হিসেবে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত আচার নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় এক বাদশাহ কর্তৃক আদার সংমিশ্রণে তৈরী সেই আচার সংক্রান্ত একটা হাদিসও আমরা দেখতে পাই, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাইদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে হাদিসটি। হাদীস সঙ্কলনকারী হাকিম (রঃ) তার ‘মুস্তাদরাক’ নামক কিতাবে হাদীসটি সঙ্কলন করেছেন। হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ), চেরামান পেরুমল (রাঃ) কে ‘মালিকুল হিন্দ’ তথা ‘ভারতীয় মহারাজ’ বলে সম্বোধন করেন।
عن ابى سعيد الخدرى (رضى لله عنه) قال اهدى ملك الهند الى النبى (صلى الله عليه وسلم) جرة فيها زنجبيل فاطعم اصحابه قطعة قطعة واطعمنى منها قطعة [رواه المستدرك حاكم]
হযরত আবু সাঈদ সা’দ বিন মালিক বিন সিনান আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘ভারতীয় মহারাজ নবীজী (সাঃ) এর জন্য এক বয়াম আচার নিয়ে আসলেন যার মধ্যে আদার টুকরা ছিল। নবীজী (সাঃ) সেই টুকরাগুলা তার সাহাবীদের ভাগ করে দিলেন। আমিও খাবার জন্য একটি টুকরা ভাগে পেয়েছিলাম’।
প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত মালিক ইবনে দীনারের বোন রাজিয়া’র সাথে রাজা পেরুমল তথা সাহাবী তাজউদ্দীন রা: এর বিয়ে হয়। তিনি সেখানে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ বৎসর অবস্থান করে রাসুলুল্লাহ সা: এর নির্দেশে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সাথে মালিক ইবনে দীনারসহ আরও ক’জন ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে দক্ষিণপূর্ব আরবের এক বন্দরে (বর্তমান ওমানের সালালা শহর) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। আজও তার কবর রয়েছে ওমানের সালালা শহরে, মর্যাদাবান এক সাহাবী হিসেবে বিশ্বের মুসলমানদের কাছে সেটি এক অনবদ্য আকর্ষণ।
ওদিকে মালিক ইবনে দিনার রা: এবং তার বোন রাজিয়া রা:সহ অন্যান্য মুসলমানগণ ঠিকই কেরালাতে আসেন, মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে চেরুমান পেরুমল তথা তাজউদ্দীন রা: তার আত্বীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লিখে পাঠান সাহাবী মালিক ইবনে দিনারের হাতে। মালিক ইবনে দিনার, তার বোন রাজিয়া দলবল সহ কেরালায় আসেন এবং এখানেই তারা বসতী স্থাপন করেন। এর আগে থেকেই সেখানে এক বিরাট আরব বণীকদের বসতী গড়ে উঠেছিল। মালিক ইবনে দিনার সেখানে ভারতের প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন। সেখানেই এই মহান তাবেঈ ও তার বোন হযরত রাজিয়া রা: এর কবর আজও বিদ্যমান রয়েছে।
নন আরব সাহাবীদের মাঝে তার নাম আছে। দেখুনঃ