এবং হিমু যখন প্র্যাকটিসিং মুসলমান (পর্ব-৯)
গুলশান এলাকায় সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে কুৎসিত বাড়িটা রেশমা খালার। ভুল বললাম । বলা উচিত গনি মিয়ার অর্থাৎ আমার খালু সাহেবের। খালু সাহেব গনি মিয়া মানুষটা ছিলেন অন্যরকম। তাঁর সিক্সথ সেন্স ছিল আকল্পনীয়। মানুষের সিক্সথ সেন্স প্রখর থাকতেই পারে। কেউ কেউ কিছু ব্যপার আগে আগে অনুভব করতে পারে। ভাগ্য বলে দেয়া বা ভাগ্য গননা করা হারাম কিন্তু আগে আগে কিছু বুঝতে পারার ব্যপারটা সত্য, এটা একটা অনুভূতি । এমনকি মৌমাছির মত একজন আরেকজনের সাথে কোন মাধ্যম ছাড়াই যোগাযোগ করার ঘটনাও খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইংরেজিতে একে বলে টেলিপ্যাথি। এগুলো সবই আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা। আল্লাহ কিছু মানুষকে বিশেষ কিছু সময়ে এই ক্ষমতা দিয়ে দেন ।
আমাদের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা) এরও এমন কিছু ক্ষমতা ছিল। তখন খালিফা উমর বিন খাত্তাব (রা) এর শাসন আমলের ঘটনা ।
একদিন খুতবা দেয়ার সময় হঠাত উমর (রা) বলে উঠলেন
‘ইয়া সারিয়া! আল-জাবাল।
ইয়া সারিয়া! আল জাবাল।
মদিনায় – মসজিদে নববীতে জুমার খুৎবার অবস্থায় খলিফা উমর (রা.) হঠাৎ করে এই অপ্রসাঙ্গিক এবং অসংলগ্ন বাক্য উচ্চারণ করায় সবাই বেশ অবাক এবং বিস্মিত হল। এরপর আবার খলিফা যথারীতি তাঁর খুৎবা পাঠ করতে থাকেন।
‘ইয়া সারিয়া! আল জাবাল- খুৎবার এ অপ্রাসঙ্গিক অংশটি সবার মধ্যে কৌতহলের সৃষ্টি করল…
অন্যদিকে একই সময় ইরাকের দূরবর্তী স্থানে নেহাবন্দে যেখানে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি সারিয়া হঠাতই এক অদৃশ্য কণ্ঠে রহস্যময় এই বাক্যটি নিজ কানে শুনতে পান। দুইটি বাক্য কোথা থেকে কে উচ্চারণ করেছেন, এ কথা ভেবে তিনি রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়েন।
খুৎবার মাঝে হঠাৎ খলিফার অদ্ভুত বাক্য উচ্চারণ কেন, কারো সাহস হচ্ছে না খলিফাকে জিজ্ঞাসা করতে।
খুৎবা ও নামাজ শেষে মসজিদে উপস্থিত অনেকের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কানা ঘুসা শুরু হয়।
হযরত ওমর (রা.) এর সাথে অন্তরঙ্গ ছিল হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এর সাথে।
খোলামেলা আলোচনা করতেন তিনি খলিফার সাথে। তিনি অসংকোচে খলিফাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ আপনি খুৎবার মধ্যে অসংলগ্নভাবে ইয়া সারিয়া! আল জাবাল (দুই কিংবা তিনবার) উচ্চারণ করলেন- কেন?
উত্তরে উমর (রা) একটি সৈন্য বাহিনীর কথা উল্লেখ করলেন। যারা নেহাবন্দে জিহাদে লিপ্ত, এ বাহিনীর সেনাপতি সারিয়া। তিনি বলেন, আমি দেখেছি সারিয়া একটি পর্বতের পাশে লড়ছেন। অথচ, তিনি জানেন না যে, সামনে এবং পেছন থেকে এগিয়ে এসে শত্রু বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলার উপক্রম করেছে। এ শোচনীয় অবস্থা দেখে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি, আমি স্থির থাকতে না পেরে আওয়াজ দিতে থাকি হে সারিয়া পর্বতের সাথে মিলে যাও।
ইয়া সারিয়া! আল-জাবাল। (হে সারিয়া পর্বতের সাথে মিলে যাও। )
নেহাবন্দের রণক্ষেত্র থেকে বেশকিছুদিন পর কাসেদ মদীনায় আগমন করেন এবং যুদ্ধের বিবরণ দিতে থাকেন এবং পূর্ণ ঘটনা ব্যক্ত করেন। কাসেদ জানান, আমরা যখন যুদ্ধে লিপ্ত তখন হঠাৎ একটি অদৃশ্য কণ্ঠ শোনা গেল, ইয়া সারিয়া! আল জাবাল। আওয়াজটি শোনা মাত্র আমরা পর্বতের সাথে মিলে যাই এবং আমাদের বিজয় সূচিত হয়।
ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (রা.) তাঁর বিখ্যাত ‘তারিখুল খোলাফা’ গ্রন্থে ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
হয়ত উমর (রা) এর মত এমন না তবে আমার খালু সাহেবের সিক্সসেন্স ও ছিল মারাত্মক । তিনি সস্তা গণ্ডার সময়ে গুলশানে দু বিঘা জমি কিনে ফেলে রেখেছিলেন। তার বেকুবির উদাহরণ হিসেবে তখন এই ঘটনা উল্লেখ করা হত। যার সঙ্গেই দেখা হত রেশমা খালা বলতেন, বেকুবটার কাণ্ড শুনেছ? জঙ্গল কিনে বসে আছে।
খালু সাহেবের চেহারা বেকুবের মতই ছিল। অন্যের কথা শোনার সময় আপনা আপনি মুখ হা হয়ে যেত। ব্যবসা বিষয়ে যেসব কথা বলতেন সবই হাস্যকর বলে মনে হত। যে বছর দেশে পেয়াজের প্রচুর ফলন হল এবং পেয়াজের দাম পড়ে গেল সে বছরই তিনি পেয়াজের ব্যবসা শুরু করলেন। ইন্ডিয়া থেকে পেয়াজ আনার জন্য এল সি খুললেন। অন্য ব্যবসায়ীরা হাসল। হাসারই কথা। রেশমা খালা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি না কি বেকুবের মত পিয়াজের ব্যবসায় নামছ ? যত দিন যাচ্ছে তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে । আগে মাঝে মধ্যে হা করে থাকতে এখন দেখি সারাক্ষণই হা করে থাক। পেয়াজের ব্যবসার এই বুদ্ধি তোমাকে কে দিল?
কেউ দ্যায় নাই। নিজেরই বুদ্ধি। পেয়াজের ফলন খুব বেশি হয়েছে তো, চাষিরা ভাল দাম পায় নাই। এই জন্য আগামী বছর পেয়াজের চাষ হবে কম। পেয়াজের দাম হবে আকাশ ছোঁয়া।
তোমার মাথা!
দেখ না কি হয়।
গনি সাহেব যা বললেন তাই হল । পরের বছর পেয়াজ দেশে প্রায় হলই না।
রেশমা খালা হতভম্ব । তিনি বলে বেড়াতে লাগলেন, বেকুব মানুষ তো। বেকুব মানুষের উপর আল্লাহর রহমত থাকে। যে ব্যবসাই করে— দু হাতে টাকা আনে। টাকা ব্যংকে রাখার জায়গা নেই , এমন অবস্থা।
রেশমা খালার আফসোসের সীমা নেই। বেকুব স্বামী টাকা রোজগার করাই শিখেছে, খরচ করা শিখেনি। তিনি আফসোসের সঙ্গে বলেন, টাকা খরচ করতে তো বুদ্ধি লাগে। বুদ্ধি কোথায় যে খরচ করবে? খালি জমাবে।
গনি সাহেব মাছ গশত এক সাথে খান না । ছোটবেলায় তার মা বলেছেন, মাছ গোশত একসাথে খেলে পেটের গণ্ড গল হয়? সেটাই মাথায় রয়ে গেছে। গাড়িতে চড়তে পারেন না, বেবি টেক্সি, সি এন জিতেও না। পেট্রোলের বা গ্যাসের গন্ধ সহ্য হয় না। বমি হয়ে যায়। লোকজনের গাড়ি থাকে। গনি সাহেবের আছে রিকশা । সেই রিকশার সামনে পেছনে ইংরেজিতে লেখা ‘privet’ শুধু প্রাইভেট রিকশা না , তার একটা প্রাইভেট টম টম ও আছে। ইলেক্ট্রিসিটিতে চলে। এই জিনিসও তিনি একটা প্রাইভেট লিখে ব্যবহার করেন। যেসব জায়গায় রিকশা যায় না সেসব জায়গায় তিনি এই জিনিসে করে যান।
সেই রিকশা বা টমটমে কোথাও যেতে হলে রেশ্মা খালার মাথা কাঁটা যায়। বিশেষ করে রিকশার ব্যপারে খালার লজ্জা বহুগুণ বেরে যায়। সাধারণ রিকশায় চড়া যায়, কিন্তু প্রাইভেট লেখা রিকশায় কি চড়া যায়? লোকজন কেমন কেমন চোখে তাকায়।
শেষ পর্যন্ত রেশমা খালা গাড়ি কিনেছিলেন। খালু সাহেব নাকে অডিকলন ভেজানো রুমাল চাপা দিয়ে কয়েকবার সেই গাড়িতে চরলেনও, তারপর আবার ফিরে গেলেন প্রাইভেট রিকশা আর টম টমে। তাতে তার ব্যবসা বাণিজ্যের কোন অসুবিধা হল না। ব্যবসা বাণিজ্য হুর হুর করে বাড়তে লাগল কাপড়ের কল দিলেন গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি করলেন।
রেশমা খালার শুধু আফসুস । খালি টাকা , আর টাকা। কি হবে টাকা দিয়ে? একবার দেশের বাইরে যেতে পারলাম না। এমন এক বেকুব লোকের হাতে পড়েছি, আকাশে প্লেন দেখলে তার বুক ধড়ফড় করে। এই লোককে নিয়ে জীবনে কোনদিন কি বাইরে যেতে পারব? কোন দিন পারব না। লোকে ঈদের শপিং করতে সিঙ্গাপুর যায় ব্যাংকক যায়। আর আমি কোটিপতির বউ, আমি যাই গাউছিয়া, বসুন্ধরা, যমুনায় ।
খালু সাহেবের মৃত্যুর পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে । পরিবর্তন যে কি পরিমাণ হয়েছে সেটা তার বাড়িতে ঢুকে দেখলাম।
পুরোন বাড়ি ভেঙ্গে কি হুলুস্থুল করা হয়েছে। মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। ময়লা জুতা পায়ে দিয়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ভয় লাগে।ঘরে ঘরে ঝাড়বাতি। ড্রয়িংরুমে ঢুকে আমি হতভম্ব গলায় বললাম সর্বনাশ। রেশমা খালা আনন্দিত গলায় বলল বাড়ি রিনভেশনের পর তুই আর আসিস নি তাই না।
না। তুমি তো ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলেছ।
আর্কিটেক্ট ভালো পেয়েছিলাম টাকা অনেক নিয়েছে । ব্যাটা কাজ জানে, টাকা তো নিবেই। ভেতরের সব কাজ দিয়েছি ইন্টারনাল ডিজাইনারকে। আমেরিকা থেকে পাশ করা ডিজাইনার। ফার্নিচার -টার্নিচার সব তার ডিজাইন। দেয়ালে যে পেইন্টিং গুলি দেখছিস সেগুলিও কোণটা কোথায় বসবে , সে- ই ঠিক করে দিয়েছে।
এই বাড়িতে তো খালা আমি থাকতে পারব না। দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। এখনি শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।
রেশমা খালা আনন্দিত গলায় বললেন , তোর ঘর দেখিয়ে দি। ঘর দেখলে তুই আর যেতে চাইবি না। গেস্ট রুম আছে দুটা। তোর যেটা পছন্দ সেটাতে থাকবি। একটায় ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার , অন্যটায় মডার্ন। তোর কোন ধরনের ফার্নিচার পছন্দ? দুটা ঘরই দেখ। যেটা ভাল লাগে । দুটাতেই এটাচড বাথ। দুটাতেই এসি ।
এত বড় একটা বাড়িতে একা থাকো ?
একা তো থাকতেই হবে উপায় কি? গোষ্ঠির আত্মীয়স্বজন এনে ঢুকাব? শেষে ঘুমের মধ্যে মেরে রেখে যাবে। সবাই আছে টাকার ধান্দায়। মানুষ দেখলেই আমার ভয় লাগে।
আমাকে ভয় লাগছে না?
না তোকে ভয় লাগছে না। তোকে ভয় লাগবে কেন? শোন , কোন বেলা কি খেতে চাস বাবুর্চিকে বলবি। রেঁধে দেবে। দুজন বাবুর্চি আছে। ইংলিশ ফুডের জন্যে একজন , বাঙ্গালি ফুডের জন্যে একজন।
চাইনিজ ফুড কে রাঁধে?
ইংলিশ বাবুর্চিই রাঁধে। ও চাইনিজ ফুডের কোর্সও করেছে। রাতে কি খাবি চাইনিজ?
তুমি যা খাঁও তাই খাব।
তোর যখন চাইনিজ ইচ্ছা হয়েছে তখন চাইনিজই খাব। দাড়া বাবুর্চিকে বলে দি । এই বাড়ির মজা কি জানিস- কথা বলার জন্যে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হবে না। ইন্টারকম আছে। বোতাম টিপলেই হল। আয়, তোকে ইন্টারকম ব্যবহার শিখিয়ে দি ।
ইন্টারকম ব্যবহার করা শিখলাম। বাথরুমের গরম পানি , ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা শিখলাম। এ সি চালানো শিখলাম। রিমোট কন্ট্রোল এ সি । বিছানায় শুয়ে শুয়েও বোতাম টিপে এ সি অন করা যায়। ঘর আপনা আপনি ঠাণ্ডা গরম হয়।
তোর গান বাজনার সখ আছে ? একটা মিউজিক রুম রয়েছে , সিডি ডিভিডি এমনকি গ্রামোফোন সব আছে।
আর কি আছে ?
প্রেয়ার রুম আছে।
সেটা কি?
প্রার্থনার ঘর। নামাজ পড়তে ইচ্ছে হলে নামাজ পড়বি । দেখবি ? দেখতে হলে অজু করে ফেল। অজু ছাড়া নামাজ ঘরে ঢোকা নিষেধ।
নামাজ ঘরে কি আছে ? জায়নামাজ টুপি?
আরে না। জায়নামাজের দরকার নেই। মেঝে সবুজ মার্বেলের। রোজ একবার সাধারণ পানি দিয়ে মোছা হয়, তারপর গোলাপ জল মেশানো পানি দিয়ে মোছা হয়।
চারদিকে কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত ফ্রেমে বাধিয়ে রেখেছি। ইসলামিক আর্চ ডিজাইন। এই ডিজাইন আবার অন্য একজনকে দিয়ে করিয়েছি।
নামাজ তো পড়ছই তাহলে খালা?
শুরু করব দেখি । ছোট বেলায় কোরান শরিফ পড়া শিখেছিলাম , তারপর ভুলে গেছি। কথায় বলে না — অনভ্যাসে বিদ্যা নাশ। ঐ হয়েছে। একজন মাওলানা রেখে কোরআন শরীফ পড়া শিখে তারপর নামাজ ধরব।
এখনই ধরে ফেলো । একবারে শিখে ধরতে হবে না, — এর মধ্যে যদি তোমার সময় শেষ হয়ে যায় খালু সাহেবের মত বলা যায় না ।
রেশমা খালা সরু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন । আমার কথাটা ভালো লাগে নি মনে হয়।
আয় নামাজঘর দেখে যা। বাংলাদেশে এই জিনিস আর কারো ঘরে নাই। এখন আবার অনেকেই আমার ডিজাইন নকল করছে। প্রেয়ার রুম বানাচ্ছে। নকলবাজের দেশ। ভাল কিছু করলেই নকল করে ফেলে।
তোমার বাড়িতে তো সবি আছে দেখছি । নিশ্চই বারও আছে ?
আছে। থাকবে না কেন? বার ছাড়া কোন মডার্ন বাড়ির ডিজাইন হয়? ছাদের চিলেকোহটায় বার।তোর তো এখন আর ঐ সবের বদ অভ্যেস থাকার কথা না। থাকলেও ভুলে যা। আমার বাড়িতে বেলেল্লাপনা চলবে না। যা, অজু করে আয় , তোকে নামাজ ঘরটা দেখিয়ে আনি।
ওজু করে নামাজঘর দেখতে গেলাম। খালা মুগ্ধ গলায় বললেন, ঘরে কোন বাল্ব বা টিউব লাইট দেখছিস?
না।
তারপরেও ঘর আলো হয়ে আছেনা?
হ্যাঁ ।
এর নাম কন্সিল্ড লাইটিং। বাঁ- দিকের দেয়ালে দেখ একটা সুইচ , টিপে দে ।
টিপলে কি হবে?
টিপে দেখ না। বিসমিল্লাহ বলে টিপবি।
আমি বিসমিল্লাহ বলে সুইচ টিপে আতংক নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার ধারনা , সুইচ টেপা মাত্র নামাজঘর পুরো পুরি পশ্চিম দীকে ঘুরবে। তা হল না। যা হল সেটাও কম বিস্ময়কর না। কোরান তেলাওয়াত হতে লাগল। মিসারই রাশিদ আল আফাসি সাহেবের সুমধুর তেলাওয়াত।
রেশমা খালা বললেন, পুরো কোরান শরিফ রেকর্ড করা আছে। একবার বোতাম টিপে দিলে অটোমেটিক কোরান খতম হয়ে যায়।
সেই কোরান খতমের সোয়াব তো তুমি পাও না, সোয়াব পায় তোমার ঐ ডিভিডি প্লেয়ার। তোমার কথা বলা মুশকিল— কিন্তু এই ডিভিডি প্লেয়ারটার বেহেশতে যাবার খুবই উঁচু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে খালা ।
খবরদার , নামাজ ঘরে কোন ঠাট্টা ফাইজলামি করবি না।
নামাজ ঘরে কোরআন পাঠ চলছে। আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কুরান তিলাওয়াত শুনতে ইচ্ছা করছিল। কি মধুর তেলাওয়াত । এই বাড়িতে সময় কাটানোর এই একটা দিক ভালো লাগছে।সুরা বাঁকারা মুখস্ত করতে এই ঘরটায় সময় কাটানো যাবে। কুরান পাঠ চলতে লাগল। খালা আমাকে ছাদের চিলেকোঠায় বার দেখাতে নিয়ে গেলেন। শ্বেত পাথরের কাউন্টার টেবিল। পেছনে আলমারি ভর্তি নানা আকারের এবং নানা রঙের বোতল ঝিক মিক করছে।
কালেকশান কেমন, দেখেছিস?
হু। আক্কেল গুড়ুম অবস্থা । শুধু আক্কেল গুড়ুম না একই সাথে বে আক্কেল গুড়ুম ।
বে আক্কেল গুরুম আবার কি?
ও তুমি এখন বুঝবে না। করেছ কি তুমি? দুনিয়ার বোতল জোগাড় করে ফেলেছ!
খাওয়ার লোক নেই তো। শুধু জমছে।
তোমার এখানে সবচেয়ে দামি বোতল কোনটা খালা ?
পেটমোটা বোতল টা। — ঐ যে দেখে মনে হচ্ছে মাটির বোতল। পঞ্চাশ বছরের পুরানো রেড ওয়াইন। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বিশেষ বিশেষ উৎসবে এই জিনিস খাওয়া হয়।
দাম কত তা তো বললে না।
দাম শোনার দরকার নেই।। দাম শুনলে ভিমরি খেয়ে পরে যাবি । পরে ডাক্তার ডাকতে হবে।
এমনিতেই ভিমরি খাচ্ছি । আজ আর আমার ভাত খেতে হবে না। ভিমরি খেয়ে পেট ভরে গেছে।
আনন্দে খালার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। আমার মুখ হয়ে গেল অন্ধকার। এক সপ্তাহ এ বাড়িতে থাকা যাবে না। আজই পালাতে হবে। রাতটা কোনমতে পার করে সকালে সূর্য ওঠার আগেই হ্যাপিশ।
আয় লাইব্রেরি ঘর দেখি।
আবার লাইব্রেরি ঘরও আছে?
বলিস কি! লাইব্রেরি ঘর থাকবে না ? লাইব্রেরি ঘর পুরোটা কাঠের করেছি। মেঝেও কাঠের। সব রকম বই পত্র আছে ; ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুই বই পড়ে কাঁটাতে পারবি। নিউ মার্কেটের এক দোকানের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে রেখেছি — ভাল ভাল বই এলেই পাঠিয়ে দেয় । লাইব্রেরি ঘরে কম্পিউটার বসিয়েছি। তুই কম্পিউটার চালাতে জানিস ।
থোরা বহত।
মানে কি ?
মানে অল্প স্বল্প ।
আমি তো একদমই জানি না । যাদের কাছ থেকে কিনেছি ওদের বলা আছে, অবসর পেলেই খবর দেব, ওরা এসে শিখিয়ে দেবে।
অবসর পাচ্ছ না ?
অবসর পাব কোথায়? সকালটায় একটু অবসর থাকে । দুপুরে খাঁওয়ার পর ঘুমুতে যাই — সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাই। সারারাত জেগে থাকি— দুপুরে না ঘুমালে চলবে কেন?
সারা রাত জেগে থাক কেন?
ঘুম না হলে জেগে না থেকে করব কি?
ঘুম হয় না?
না।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
ডাক্তারের পেছনে জলের মত টাকা খরচ করেছি। এখনো করছি। এখনো চিকিৎসা চলছে। সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসা করছেন।
তারা কিছু পাচ্ছে না ?
পাচ্ছে কি পাচ্ছে না ওড়াই জানে। ওদের চিকিৎসায় লাভ হচ্ছে না। এখন তুই হলি ভরসা।
আমি ভরসা মানে? ভরসা তো করবে আল্লাহর ওপর । আর আমি তো ডাক্তারও না।
ডাক্তার না হলেও তোর নাকি অনেক ক্ষমতা । সবাই বলে। তুই যা দোয়া করিস তাই নাকি কবুল হয় । তুই আমাকে রাতে ঘুমের ব্যবস্থা দে। তুই যা চাইবি তা — ই পাবি। তোর খালুর পুরানো গাড়িটা তোকে না হয় দিয়ে দেবো।
খালুর সেই পুড়ন গাড়ি পাব এই অনন্দ আমাকে তেমন অভিভূত করতে পারল না । আমার ভয় হল এই ভেবে যে রেশমা খালা আমার উপর ভর করছেন। সিন্দাবাদের ভুত সিন্দাবাদের উপর একা চেপেছিল। রেশ্মা খালা আমার উপর একা চাপেন নি , তার পুরো বাড়ি নিয়ে চেপেছেন। একদিনেই আমার চ্যাপ্টা হয়ে যাবার কথা এবং আমি চ্যাপ্টা হওয়া শুরু করেছি ।
হিমু।
জ্বি ।
আমার ব্যপারটা কখন শুনবি ?
তোমার কোন ব্যপার?
ওমা এতক্ষণ কি বললাম — রাতে ঘুম না হওয়ার ব্যপারটা।
একসময় শুনলেই হবে।
এখন তুই কি করবি?
বুঝতে পারছি না। নিজের ঘরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব বলে ভাবছি। যে বিছানা বানিয়েছ শুতে সাহসও হচ্ছে না।
রেশমা খালা বললেন, বিছানা এমন কিছু না । সাধারণ ফোমের তোষক । তবে বালিশ হচ্ছে পাখির পালকের।
বল কি?
খুব এক্সপেন্সিভ বালিশ। জ্যান্ত পাখির পাখা থেকে এইসব বালিশ তৈরি হয়। মরা পাখির পালকে বালিশ হয় না।
একটা পালকের বালিশের জন্যে কটা পাখির পালক লাগে?
কি করে বলব কটা — কুড়ি পচিশ টা নিশ্চয়ই লাগে।
একটা বালিশের জন্যে তাহলে পঁচিশটা পাখির আকাশে ওড়া বন্ধ হয়ে গেলো?
অধ্যাত্মিক ধরনের কথা বলবি না তো হিমু। এইসব কথা আমার কাছে ফাজলামির মত লাগে।
ফাজলামির মত লাগলে আর বলব না।
যা তুই রেস্ট নে । চা কফি কিছু খেতে চাইলে ইন্টারকমে বলে দিবি।
তুমি কি বেরুচ্ছ?
হু । বললাম না সকালে আমি একটু বেড় হই। দিন রাত ঘরে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসবে না । তুই তো এখন আর বেড় হবি না?
না।
তাহলে তালা দিয়ে যাই ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তালা দিয়ে যাবে মানে?
খালা আমার চেয়েও অবাক হয়ে বললেন, তুই আমার মূল বাড়িতে থাকবি তোকে তালা দিয়ে যাব না? লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস চারদিকে।
ঘরে যদি আগুণ টাগুণ লেগে যায় তখন কি হবে?
খামাখা আগুণ লাগবে কেন? আর যদি লাগে প্রতি ফ্লোরে ফায়ার এক্সটিংগুইসার আছে।
তালা দেয়া অবস্থায় কতক্ষণ থাকব।
আমি না আসা পর্যন্ত থাকবি। আমি তো আর সারাজীবনের জন্যে চলে যাচ্ছি না । ঘন্টাখানিক ঘুরঘুরি করে চলে আসব। সামান্য কিছুক্ষণ তালাবদ্ধ থাকবি এতেই মুখ চোখ শুকিয়ে কি করে ফেলেছিস।
খালা আমি হচ্ছি মুক্ত মানুষ । পাখি হয়ে উড়তে চাই । এটাই সমস্যা।
বিছানায় শুয়ে বইটই পড় টিভি দেখ আমি তোকে কফি দিতে বলে যাচ্ছি।
কি টিভি দেখব ? পিস টিভিও তো নাই।
ইউটিউবে লেকচার টেকচার দেখ।
আমি কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দে তালা দেয়ার আওয়াজ পেলাম। এ বাড়ির সব কিছু আধুনিক হলেও তালাগুলি সম্ভবত মান্ধাতার আমলের । বড্ড শব্দ করে।
(চলবে ইন শা আল্লাহ … )