পারভীনের পর্দা
রচনায়: মুহাম্মাদ আব্দুল মাজেদ*
পারভীন অন্যান্য দিনের মত আজও খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে। ওযূ সেরে ফজরের ছালাত আদায় করে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করেছে। এরপর সে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। তখনও আকাশ পুরো ফর্সা হয়নি। চারিদিক থেকে পাখির কলরব ভেসে আসছে। সকালের শীতল হাওয়ায় পারভীনের মনের ব্যথা অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসে । সে । তাকায় দূর আকাশের দিকে, আর ভাবে_এই নোংরা পৃথিবীর কথা, যেখানে নিজের ভাল কাজ করার অধিকারটুকুও নেই। কী এমন অন্যায় সে করেছে, তা সে ভেবে পায়না।
সেতো শুধু বোরক্বা পরে কলেজে যায়। কোন ছেলের সাথে কথা বলে না, ক্লাশ ছেড়ে কোথাও যায় না। আচ্ছা এগুলোই কি তার দোষ? তাহলে শাহীনা, কণা, গোলাপী ওরা যেভাবে উচ্ছৃংখলভাবে চলাফেরা করে সেইটাই কি ভাল ? না, তা হবে কেন ?
আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদের সূরা নূরের চার রুকূতে বলেছেন,
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ ۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘হে নবী! আপনি ঈমানদার নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনমিত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে । তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’।
আলোচ্য আয়াতে যে কথাগুলি বলা হয়েছে, তা মেনে চলা প্রত্যেক নারীর জন্য ফরয।
প্রতিদিনের মত গতকালও পারভীন যথারীতি কলেজে গিয়েছিল। সে স্কুল জীবন থেকেই বোরক্বা পরত। শাহীনা, কণা, গোলাপী সবাই পারভীনের খুব কাছের বান্ধবী। স্কুল থেকে ওরা খুব অন্তরঙ্গ। কলেজে উঠেও সেই অন্তরঙ্গতা মলিন হয়নি। এদের মধ্যে একমাত্র পারভীনই বোরকা পরে। অন্যদের মধ্যে শাহীনা, গোলাপী ততটা উচ্ছৃংখল নয়, যদিও বোরক্বা পরে না। কিন্তু কণা খুব উচ্ছৃংখলভাবে চলাফেরা করে। ও প্রায় সময়ই বোরক্বা পরার জন্য পারভীনকে উল্টাপাল্টা বকে। কলেজে ওঠার পর বোরক্বা নিয়ে প্রায়ই পারভীনের সাথে তার কথা কাটাকাটি হ’ত। ওর এক কথা, বোরক্বা পরলে সামাজিক হওয়া যায় না।
টিফিন পিরিয়ডে সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লে কণা পারভীনকে বলল, চল, আর সঙ সেজে বসে না থেকে একটু বাইরে ঘুরে আসি। বোরকা নিয়ে বান্ধবীদের রসিকতা সে অনেক সহ্য করেছে। আজ আর পারল না। বলে উঠল, সঙ আমি সাজি, না তোরা? ঠোঁটে লিপ-স্টিক, কপালে টিপ আর ফিনফিনে জামা পরে তোরাই তো প্রতিদিন সঙ সেজে কলেজে আসিস। একথা শুনে অপমানে কণার চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। সে বলে, কী, এত বড় কথা! দাড়া দেখাচ্ছি মজা। এই বলে টান দিয়ে পারভীনের মুখের নেকাব খুলে ফেলল কণা। লজ্জায়, অপমানে পারভীনের চোখ-মুখও লাল হয়ে যায়। ও শুধু বলে, কাজটা ভাল করলে না কণা। এরপর বাকী ক্লাশের সময় আর কারো সাথে কথা না বলে বেঞ্চে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে পারভীন। অতঃপর কলেজ ছুটি হলে বাড়ী চলে আসে।
ঘটনাটি বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে পারভীনের। একবার মনে হচ্ছে কণার সাথে সে আর কখনো কথা বলবে না। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে তায়েফে সত্যের দাওয়াত দিতে গিয়ে নবীজী (ছাঃ) তায়েফবাসীর হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অকল্যাণ কামনা না করে তিনি কল্যাণ কামনা করেছিলেন। এ কথা মনে করে পারভীন ভাবে, হয়ত দোষ আমারই । কণাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। আজকে কণার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ।
কলেজের সময় হয়ে গেছে। ঝটপট তৈরী হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল পারভীন। কিন্তু একি? আজ তার কোন বান্ধবীই কলেজে আসেনি। এমন তো কোন দিন হয়না । তাই ও চিন্তিত হয়ে পড়ল। ভাবল, কলেজ ছুটি হ’লে কণাদের বাসায় যাবে। কণাদের বাসায় পৌছে কলিংবেল বাজাতেই ওদের কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। পারভীন জিজ্ঞেস করল, কণা আছে? মেয়েটি জবাব দিল, না। পারভীন আবার বলল, তাহলে খালাম্মাকে ডেকে দাও । কাজের মেয়েটি তখন কেঁদে ফেলল। পারভীন অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে খুলে বল। মেয়েটি যা বলল তাতে জানা গেল, গতকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে একদল সন্ত্রাসী কণার মুখে এসিড ঢেলে দিয়েছে। কণা এখন হাসপাতালে। একথা শুনে পারভীন ভয়ে কেপে উঠল। পর্দাহীনতার পরিণামে যে কত রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ ঘটনা তারই প্রমাণ ।
আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায় পারভীন। হাসপাতালে পৌছে নাসের কাছ থেকে রুম নম্বর জেনে নিয়ে সেই রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রুমের দরজা খুলেই চোখ পড়ে শাহীনা, গোলাপীর দিকে। কাছে গিয়ে দেখে কণার মুখের এক পাশের চামড়া সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। পারভীনকে দেখে কণা কেঁদে ফেলে। পারভীন সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। কণা পারভীনকে বলে, পারভীন আমি অন্যায় করেছি। সেরে উঠলে আমিও বোরক্বা পরেই কলেজে যাব। সাথে সাথে শাহীনা আর গোলাপীও বলে ওঠল, শুধু তুই কেন, আমরাও যাব। আনন্দে পারভীনের চোখে পানি এসে যায়। বলে, তোদের নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আজ তা পূরণ হ’লরে। অতঃপর পারভীন ওদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, হে আল্লাহ! ওদের তুমি হেদায়াত দান কর। ওদের সকলের চোখে আনন্দের ঝিলিক, দুর্লভ কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আর বুকে একটি সোনালী সুন্দর সমাজ গঠনের আকাঙ্খা ।
অতএব প্রত্যেক ঈমানদার নারীর উচিৎ হবে পর্দার সাথে চলাফেরা করা এবং সেই সাথে পুরুষদের কাজ হবে মহিলাদেরকে পর্দা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ সকলকে তাওফীক্ব দিন। আমীন!
**আব্দুল্লারপাড়া, পোঃ বারকোনা, গাইবান্ধা ।
সূত্র: পুরনো আত-তাহরীক।