সলাতের কোয়ালিটি কিভাবে বাড়াবো ?
সলাতে মন এদিক-সেদিক কেন যায়?
মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে আমাদের মন সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের শরীর সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ইচ্ছে করলেই আমরা পারি আমাদের হাতকে উর্ধ্বমুখী করতে, আবার খেয়াল-খুশি মত নিম্নে নামাতে। সহজ ভাষায় বলা যায় আমাদের মনোভাব অনুযায়ী সব আদেশ নিষেধ শরীর গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু আমাদের চালিকা শক্তি মন আমাদের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা গ্রাহ্য করে না। আমরা অধিকাংশ মানুষ হয়তো লক্ষ্য করে থাকবো মন স্থির নয়; বরং সর্বদা চলমান।
উদাহরণস্বরূপ সদ্য পরীক্ষায় অংশ নেয়া একজন ছাত্রের কথা বলা যায়। যখন ছাত্রটি পরীক্ষা শেষ করে সলাতে দাঁড়ায়, তার মাথার মধ্যে আপনা আপনি পরীক্ষা মূল্যায়নের বিষয়টি চলে আসে। সে সলাতের মধ্যে চোখ বুলায় প্রশপ্নত্র ও উত্তর পত্রের দিকে। মিলিয়ে নেয় কি চাওয়া হয়েছে আর সে কি লিখেছে। সর্বোপরি সে তার পুরো পরীক্ষার উপর একটি সার্বিক মূল্যায়ন করে নেয়। অনুরূপভাবে একজন ব্যবসায়ী যখন সলাতে দাঁড়ায় তার মনোযোগ চলে যায় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে। ‘আজ কত বিক্রি হল’ অথবা ‘আজকের লভ্যাংশটা বেশ ভালই’। সম্ভবতঃ একথাগুলোই সে অবচেতন মনে আউড়ে যায়। এ ধারার বাইরে কেউ নয়; এমনকি একজন গৃহবধু সেও সলাতে দাঁড়িয়ে ভাবে “তাহলে আজকে কি রান্না করা যায়; পোলাও নাকি বিরিয়ানী?”
এভাবে সার্বিকভাবে বলা যায়- যখনই আমরা সলাতে দাঁড়াই, আমাদের মন তখনই উড়াল দেয় এখানে সেখানে। কিন্তু প্রশ্ন আসে কেন এমন হয়? কেন আমরা পারি না মনকে বেঁধে রাখতে? উত্তরটা হলো মনের শূন্যতা। আরো খোলাসা করে বলা যায়, যখন আমরা সলাতে দাঁড়াই মনকে তখন কোন কাজ দিই না। কিন্তু মন কোন কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। তাই মন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
মনকে কিভাবে স্থির রাখা যায়?
বেশির ভাগ সলাত আদায়কারী সলাতের মধ্যে যে অংশগুলো তিলাওয়াত করে থাকে যথা সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য অংশ সেগুলো পুরোপুরি আত্ত্বস্থ অর্থাৎ মুখস্থ ও ঠোটস্ত। এমনকি সে ঘুমের মধ্যেও পড়ে যেতে পারে-
একজন মুসলিম সূরা ফাতিহা অবচেতন মনেও হাজার মাইল বেগে অবলীলায় তিলাওয়াত করতে পারে। এই যে যান্ত্রিকতা বা স্বতঃস্ফূর্ততা এর কারণে তেলাওয়াতের সময় তার মস্তিষ্কের খুব ক্ষুদ্রতম অংশ ব্যবহৃত হয়। অধিকন্তু বেশিরভাগ মুসলিম সলাতের মধ্যে যে অংশগুলো তিলাওয়াত করে সে অংশসমূহের কোন অর্থ জানে না। যেহেতু তারা আরবি জানে না এবং অথর্ও বুঝে না। সে কারণে অবচেতনভাবেই তার মন এদিক-সেদিক চলে যাওয়ার বড় ধরনের সম্ভাবনা থেকে যায়।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন মনকে কাজ দেয়া বা ব্যস্ত রাখা। তাই সলাতে পবিত্র কুরআন থেকে যখন যে অংশ তিলাওয়াত করা হয়, তার অর্থ ও বিশ্লেষণের কাজে মনোনিবেশ একটি উত্তম প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারে। যদি আমি কথা বলি ইংরেজিতে অনুবাদ করি ইংরেজিতে, আর যদি বাংলা হয় তবে বাংলাতে। অনুরূপভাবে যে ভাষাটি আমি সবচেয়ে বেশি বুঝি সেই ভাষায় তিলাওয়াতকৃত অংশটুকু অনুবাদ করা। উদাহরণস্বরূপ ফাতিহা তিলাওয়াতের সময়-
“পরম করুণাময় অশেষ মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
১. সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সারা জাহানের রব।
২. যিনি পরম করুণাময় অশেষ মেহেরবান।
৩. বিচার দিনের মালিক।
৪. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি। আর একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
৫. আমাদের সহজ সরল সঠিক পথ দেখাও।
৬. ঐসব লোকের পথ, যাদের তুমি নিয়ামত দিয়েছ।
৭. তাদের পথ নয় যারা গযবপ্রাপ্ত এবং পথহারা।”
এভাবে যদি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত এর সাথে সাথে তার অর্থটি অনুধাবনের প্রয়াস চালানো হয়, তবে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ পাবে। যখন মস্তিষ্ক তিলাওয়াতকৃত অংশটুকু অনুবাদের কাজে ব্যস্ত থাকবে, তখন সে আর এদিক সেদিক ছুটাছুটি করবে না। কিন্তু কয়েক দিন বা কয়েক মাস পরে এ পদ্ধতিটিও আর কাজে লাগবে না। কেননা ততদিনে এ কাজটিও মস্তিষ্ক স্বতঃস্ফুর্তভাবে করতে সক্ষম হয়ে যাবে। আগেই বলা হয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক খুব শক্তিশালী। তাই একসাথে দুটি কাজ তথা তিলাওয়াত ও অনুবাদ যৌথভাবে করা তার জন্যে তেমন কঠিন নয়। তাই হয়তো আবার এক সময় মন এদিক সেদিক চলে যেতে পারে তবে সম্ভাবনা একটু কম। যেহেতু মস্তিস্কের একটি অংশ তিলাওয়াত ও অন্য অংশ অনুবাদে ব্যাপৃত থাকবে তাই মনছুট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
এভাবে মনের ঘাড়ে লাগাম পরিয়ে তাকে এদিক সেদিক চলে যাওয়া থেকে নিবৃত্তির কার্যকর পন্থা হচ্ছে যা তিলাওয়াত করা হয় ও সে অংশের মাতৃভাষায় অনুবাদ। এ দু’টি বিষয়ের দিকে মনোযোগ তীব্র করা। আমরা জানি মস্তিস্ক একই সাথে একটির অধিক বিষয়ে শতভাগ মনোযোগ দিতে পারে না। অতএব যখন দু’টি একই সময়ে শতভাগ মনোযোগের চেষ্টা করা হবে তখন মনের ছুটাছুটি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। এক কথায় বলা যায় মস্তিষ্ক কুরআন তিলাওয়াত ও এর অনুবাদ এ দু’টি কাজে নিবদ্ধ করে অর্থের প্রতি শতভাগ মনোযোগ নিবদ্ধ করলে আল্লাহ চাহেতো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মনের বেখেয়ালি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
সলাতের কোয়ালিটি কিভাবে বাড়াবো?
১) অল্প পানি দিয়ে খুবই যত্ন সহকারে ওযু করি, পানির অপচয় না করি।
২) সলাতের ভেতর সূরাগুলো খুবই আস্তে আস্তে তিলাওয়াত করি এবং সেইসাথে অর্থগুলো অনুধাবন করতে থাকি। দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদের দৃষ্টি থাকবে সিজদার স্থানের উপর। সলাতের মধ্যে নড়া-চড়া না করার চেষ্টা করি এবং এদিক সেদিক না তাকাই।
৩) খুবই ধীরে ধীরে রুকুতে যাবো, রুকুর সময় পিঠ যেন সোজা থাকে, বাঁকা যেন না হয় এবং আমাদের দৃষ্টি এবারও সিজদারস্থানে রাখি। রুকুতে দীর্ঘ সময় কাটাই এবং তাসবীহগুলো খুবই ধীরে ধীরে পড়তে থাকি এবং সেই সাথে অর্থগুলোও অনুধাবন করার চেষ্টা করি। রুকুতে তাসবীহগুলো তিনবার করে পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং তারও বেশী সংখ্যক পড়ার চেষ্টা করি। মনে রাখতে হবে রুকুতে কুরআন পড়া নিষেধ।
৪) রুকু থেকে খুবই ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াই এবং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় নেই এবং দাড়ানো অবস্থায় দু’আ পড়ি। রুকু থেকে উঠে সাথে সাথেই যেন তাড়াহুড়ো করে সিজদায় চলে না যাই।
৫) এবার সিজদায় যাবো খুবই ধীরে ধীরে। সিজদায় অবশ্যই দীর্ঘ সময় কাটাবো এবং তাসবীহগুলো খুবই ধীরে ধীরে পড়বো, সেইসাথে অর্থগুলোও অনুধাবন করতে থাকবো। এখানে খেয়াল করি আমাদের মালিক, আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে দেখছেন এবং আমার যা-যা প্রয়োজন তা তার কাছে আকুল আবেদনের মাধ্যমে বলছি। মনে রাখবো, সিজদায় রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভাষায় দু’আ করাই উত্তম। এখানেও সতর্ক থাকতে হবে যে সিজদায় কুরআন পড়া নিষেধ।
৬) দুই সিজদার মাঝে বসে যথেষ্ট সময় নিই এবং দু’আ পড়ি, এই দু’আতে রিযিক বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সিজদা শেষ করে সরাসরি উঠে যেন না দাঁড়াই, একটু বসে তারপর দাঁড়াই।
৭) শেষ বৈঠকে আরাম করে বসি, আমাদের দৃষ্টি ডান হাতের শাহাদত আঙুলের উপর রাখি। এখানেও খুবই ধীরে সুস্থে সব কিছু পড়ি, তাড়াহুড়ো না করি এবং যা পড়ছি তার অর্থগুলো অনুধাবন করি। শেষ বৈঠকে শেষের দিকে নিজের ভাষায়ও মহান আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে পারি বা দু’আ করতে পারি।
৮) সলাত শেষে যখন সালাম ফিরাবেন তখন অন্তর থেকে সত্যিকার অর্থেই আমাদের ডানে-বামে সকলের জন্য শান্তি কামনা করবো।
৯) ফরয সলাত শেষ করে সাথে সাথেই সুন্নাত সলাত পড়া শুরু করে দেবো না যদি কোন জরুরী কাজ না থাকে। রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফরয সলাত আদায়ের পরে কিছু তাসবীহ পাঠ করতেন। আমরাও ফরযের পর আরাম করে বসবো এবং ধীরে ধীরে তাসবীহগুলো পাঠ করবো এবং সেই সাথে অর্থগুলোও অনুধাবন করতে থাকবো। তোতা পাখির মত তাড়াহুড়ো করে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা শেষ করার জন্য তাসবীহ পাঠ করবো না বা গুনবো না। তাসবীহ পাঠ করার সময় মনে মনে খেয়াল করবো যে, আল্লাহ সত্যিই মহান, আল্লাহ সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সত্যিই পবিত্র, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য অবধারিত। আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।
১০) শয়তান সলাতের মধ্যে চেষ্টা করবে আমাদের মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকবো। আমরা যখন সচেতন থাকবো তখন শয়তান হয়ত অন্য পলিসি গ্রহণ করবে, সে আমাদের মনের মধ্যে ভালো চিন্তার বিষয় এনে দেবে। যেমন : আমাদের দান-সাদাকা, আমাদের পরোপকার, আমাদের ইসলামের কাজ ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়গুলো ভাল হলেও সলাতের মধ্যে এগুলোও চিন্তা করা যাবে না।
১১) যদি সলাতে কোন ভুল হয়েই যায়, যেমন কয় রাক’আত পড়েছি ঠিক মনে করতে পারছি না, তখন সলাত শেষ করার আগে অবশ্যই দু’টো সহু সিজদাহ দিতে হবে। যখন সহু সিজদাহ দেয়া হয় তখন শয়তান খুব কষ্ট পায়, কারণ তার শেষ হাতিয়ারটাও আমরা নষ্ট করে দিলাম।
আরো কিছু টিপস
১. ক্ষুধার্ত অবস্থায় সলাতে না দাঁড়ানোই ভাল যদি হাতে সময় থাকে।
২. সলাতের আগে খাবার সামনে এসে গেলে খাবার আগে খেয়ে নেয়া।
৩. খুব ভরা পেটেও সলাতে না দাঁড়ানোই ভাল যদি হাতে সময় থাকে।
৪. পায়খানা-প্রস্রাবের বেগ থাকলে সলাতে দাঁড়াবো না, ওটা আগে সেরে নেবো।
৫. দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সলাতে দাঁড়াবো না।
৭. সলাতের মধ্যে অযথা নড়া-চড়া করবো না। সলাতে অযথা এদিক ওদিক তাকাবো না, দৃষ্টি রাখবো সিজদার স্থানে।
৮. সলাতের মধ্যে নাক, কান বা শরীর চুলকাবো না এবং সলাতের মধ্যে কাপড় ঠিক করবো না যদি সতর বের হয়ে না গিয়ে থাকে।
৯. সলাতের মধ্যে ‘হাই’ না দেয়ার চেষ্টা করবো। ‘হাই’ এসে গেলে হাত দিয়ে মখু চেপে ধরবো, কারণ এটা আসে শয়তান থেকে এবং হা করলে শয়তান মুখের মধ্যে ঢুকে পরে।
১০. অপরিষ্কার কাপড় পরে বা ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে সলাতে দাঁড়াবো না। প্রয়োজনে সলাতের জন্য এক সেট পরিষ্কার কাপড় আলাদা করে রাখতে পারি।
১১. খুব দ্রুত সূরা কিরাআত পড়বো না এবং খুব দ্রুত সলাত শেষ করবো না। সবই করবো ধীরে ধীরে।
১২. আওয়াল ওয়াক্তেই সলাত পড়া উত্তম অর্থাৎ যখন সলাতের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং ওয়াক্ত শেষের দিকে সলাত রেখে দিবো না।
১৩. ফরয সলাতগুলো অবশ্যই জামাআতে পড়ার চেষ্টা করবো।
১৪. সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে ইমামের আগে রুকু সিজদায় যেন চলে না যাই এবং সালামও যেন না ফিরাই।
১৫. গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদ সলাত পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি।
রচনা ও প্রকাশে: Institute of Social Engineering, Canada