ইসলামী মুআমালাত
রচনায়: এ. কে. এম. নাজির আহমদ
পারিবারিক মুআমালাত
১। বার্ধক্য মানব দেহের প্রত্যংগগুলোকে দুর্বল করে ফেলে, কর্ম-ক্ষমতা কেড়ে নেয়, মেজায বিগড়ে দেয়।
২। বাৰ্ধক্য মানুষের দ্বিতীয় শিশুকাল।
৩। যেই আব্বা-আম্মা অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করে শিশু পুত্র ও কন্যাদেরকে লালন পালন করেন, তাদেরকে মানুষ করেন, দ্বিতীয় শিশুকালে উপনীত হয়ে তারা নিজেরাই অসহায়ত্বের শিকার হন এবং সন্তানের ওপর Dependent হয়ে পড়েন।
৪। সর্বাবস্থায় আব্বা-আম্মার সাথে সদাচরণ করা সন্তানের কর্তব্য, বিশেষ করে তাদের বৃদ্ধাবস্থায়।
৫। কোন অবস্থাতেই আব্বা-আম্মার প্রতি বিরক্তিভাব প্রকাশ করা উচিত নয়।
৬। আব্বা-আম্মার বিশেষ মর্যাদার কথা স্মরণে রেখে তাদের সাথে বিনম্রভাবে কথা বলা কর্তব্য।
৭। আব্বা-আম্মা যেন খাদ্য, পানীয়, ঔষধ-পথ্য, পরিষ্কার পোষাক ও অন্যান্য উপকরণ সঠিক সময়ে পান তা নিশ্চিত করা সন্তানের কর্তব্য।
৮। তবে এই কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে পুত্র সন্তান ও কন্যা সন্তানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কন্যা সন্তান স্বামীগৃহে অবস্থান করে বিধায় তার পক্ষে আব্বা-আম্মার সেবা যত্ন করা সুকঠিন।
৯। আব্বা-আম্মার সেবা-যত্ন করা প্রধানত পুত্র সন্তানের কর্তব্য। তবে পুত্র সন্তানের পক্ষেও তার স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া এই কর্তব্য পালন করা সুকঠিন।
১০। পুত্রের ওপর তার আব্বা-আম্মার সেবা-যত্ন করা অবশ্য কর্তব্য। আর স্বামীর সহযোগিতা করা পুত্রের স্ত্রীর অবশ্য কর্তব্য।
১১। আব্বা-আম্মার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করতে থাকা সন্তানের কর্তব্য।
১২। মনে রাখতে হবে যে আব্বা-আম্মার সেবা-যত্ন করা জান্নাতে যাওয়ার পথ বাধামুক্ত করার অন্যতম উপায়। ১৩। স্বামী পরিবার প্রধান। আর স্ত্রী পরিবারের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্বাহী প্রধান ।
১৪। সুস্ত্রী, সুজননী, সুগৃহিনী, সুআত্মীয়া ও সুপ্রতিবেশিনী হওয়া স্ত্রীর কর্তব্য।
১৫। আল্লাহর না-ফরমানির পর্যয়ে না পড়লে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর কথা মতো চলা।
১৬। অনুরূপভাবে সন্তানদেরকে তাদের আব্বার কথা মতো চলার জন্য অনুপ্রাণিত করা স্ত্রীর কর্তব্য ।
১৭। স্ত্রী স্বামীর জীবন সংগিনী।
১৮। স্ত্রী স্বামীর একান্ত আপনজন।
১৯। স্ত্রী স্বামীর বহুমুখী প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন।
২০। স্ত্রী স্বামীগৃহের তত্ত্বাবধায়িকা।
২১। স্ত্রী স্বামীর সন্তানদের তত্ত্বাবধায়িকা।
২২। স্ত্রী স্বামীর বিশ্বস্ত পরামর্শক ।
২৩। স্ত্রী স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
২৪। অতএব স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক হওয়া চাই মধুর, আচরণ হওয়া চাই সুন্দর।
২৫। স্ত্রীর কোন ক্রটি পরিলক্ষিত হলে কঠোরতা নয়, নম্রতার মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা চালানো প্রয়োজন ।
২৬। স্ত্রীর প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সেইগুলো পূরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো স্বামীর কর্তব্য ।
২৭। স্ত্রী যাতে স্বচ্ছন্দে সাংসারিক বিষয়াদির সুব্যবস্থা করতে পারেন সেইজন্য স্ত্রীর হাতে যথেষ্ট টাকা প্রদান ও তাকে সহযোগিতা করার জন্য কাজের লোকের ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য।
২৮। স্ত্রী যাতে পর্দার বিধান মেনে চলতে পারেন সেই জন্য তাকে সহযোগিতা করা স্বামীর কর্তব্য।
উল্লেখ্য যে পর্দার বিধান অনুসরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (সা) স্ত্রীগণই হচ্ছেন অনুকরণযোগ্য সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
২৯। স্ত্রী যাতে মহিলা অংগনে দীনী চেতনা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারেন সেই জন্য তাকে সহযোগিতা করাও স্বামীর কর্তব্য।
৩০। সম্পদ প্রধানত দুই প্রকার। যথা, অর্থ সম্পদ ও মানব সম্পদ।
৩১। অর্থ সম্পদের চেয়ে মানব সম্পদ অনেক বেশি মূল্যবান।
৩২। সন্তান মানুষের মূল্যবান সম্পদ।
৩৩। সন্তানের আকীকা করা ও সুন্দর নাম রাখা প্রয়োজন।
৩৪। সন্তান হলে আল্লাহ রাববুল আলামীন দুধের কোটা পাঠান না, মাতৃস্তনে দুধের ঝর্ণা সৃষ্টি করেন।
৩৫। মাতৃদুগ্ধ পান করতে পারা সন্তানের অধিকার।
৩৬। দুই বছর পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করা সন্তানের অধিকার। মাতৃদুগ্ধ শিশু দেহে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা সৃষ্টি করে এবং দেহ বলিষ্ঠ করে। অতএব মাতৃদুগ্ধ থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।
৩৭। মাতৃস্নেহ সন্তানের মনস্তাত্বিক প্রয়োজন। মাতৃস্নেহ সন্তানের ভারসাম্য পূর্ণ মন-মানসিকতা গড়ার অপরিহার্য উপাদান। অতএব সন্তানকে আম্মার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত করা সমীচীন নয়।
৩৮। ছোট বেলায় শেখা মূল্যবোধ সারা জীবন মানব মনে ক্রিয়াশীল থাকে। অতএব ছোট বেলাতেই যাতে সন্তান ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সুপরিচিত হয়ে ওঠে সেই দিকে আব্বা-আম্মার সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
৩৯। সন্তান হয় হবে কুররাতুল আইউন নয়তো হবে ফিতনা। সন্তানকে কুররাতুল আইউন বানাবার চেষ্টা করতে হবে, আল্লাহর কাছেও মুনাজাত করতে থাকতে হবে।
৪০। বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য উদারতা, ক্ষমাশীলতা ও ছবরের সাথে চেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
৪১। সন্তানকে আদর্শ মানুষ বানাবার জন্য অতিশয় কড়াকড়ি ও শাস্তিদান নয়, বিজ্ঞ জনোচিতভাবে Persuasion (যুক্তি ও উপদেশ সহকারে বুঝানো) ও Motivation (উদ্বুদ্ধকরণ) পদ্ধতি অবলম্বনই উত্তম পদ্ধতি।
৪২। পুত্র সন্তান ও কন্যা সন্তান উভয়ই আল্লাহর দান। পুত্র সন্তান হলে খুশি হওয়া ও কন্যা সন্তান হলে বেজার হওয়া জাহিলী আচরণ।
৪৩। প্রতিপালন, মেহদান, শিক্ষাদান তথা সকল ক্ষেত্রেই পুত্র সন্তান ও কন্যা সন্তানের প্রতি সমআচরণ করা একজন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য।
৪৪। ছোট বেলা ভাই ও বোনের মাঝে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক থাকে।
৪৫। ভাই ও বোনের বিয়ে হয়ে গেলে উভয়ের স্বতন্ত্র বৃত্ত (circle) গড়ে ওঠে। উভয়ে হন স্বতন্ত্র পরিবারের সদস্য।
৪৬। এরপরও ভাইয়ের কর্তব্য বোনের ও বোনের কর্তব্য ভাইয়ের কাছে যাতায়াত করা, একে অপরের আতিথ্য করা।
৪৭। আব্বার ইন্তিকালের পর ভাইদের মাঝে যেমন পৈত্রিক সম্পত্তি বণ্টিত হয়, তেমনিভাবে হওয়া চাই বোনদের মাঝে।
৪৮। বোনেরা যদি পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রয় করতে চায়, ভাইয়েরা ন্যায্য মূল্য দিয়েই সেই সম্পত্তি ক্রয় করা উচিত।
৪৯। কোন বোন যদি স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হয় ভাইয়ের উচিত তাকে নিজের সন্নিধ্যে নিয়ে এসে স-সম্মানে রাখা।
৫০। বোনের স্বামী মারা গেলে এবং তার অভিভাবকত্ব করার মতো কেউ না থাকলে ভাইয়ের কর্তব্য তার অভিভাবকত্ব করা।
৫১। কাজের লোক পরিবারের সদস্য নয়। কিন্তু পরিবারের সাথে কাজের লোকের সংশ্লিষ্টতা পরিবার সদস্যের মতো।
৫২। অকারণে কেউ কাজের লোক রাখেন না। এদেরকে না রেখে সারতে পারলে কেউ কাজের লোক রাখতেন না।
৫৩। কাজের লোককে গালাগালি করা কিংবা মারপিট করা উচিত নয়।
৫৪। নিজেরা যা খান কাজের লোককেও তা খেতে দেয়া উচিত।
৫৫। কাজের লোককে নিকৃষ্ট মানের পোষাক পরানো উচিত নয়।
৫৬। কাজের লোকের অসুখ হলে উদাসীন থাকা উচিত নয়।
৫৭। কাজের লোককে হাড় ভাংগা খাটুনি খাটতে বাধ্য করা উচিত নয়। সাধ্যাতীত কোন কাজ তার ওপর চাপানো উচিত নয়।
৫৮। মনে রাখতে হবে যে কাজের লোকেরও বিশ্রাম ও ছুটির প্রয়োজন রয়েছে।
৫৯। কাজের লোকের প্রতি যতো বেশি সম্ভব ক্ষমা সুন্দর আচরণ করা কর্তব্য।
৬০। তাদেরকে দীনী তালিমও দেয়া প্রয়োজন।
৬১। উঠতি তরুণ, উঠতি তরুণী, যুবক কিংবা যুবতীকে কাজের লোক হিসেবে রাখা সঠিক কাজ নয়। ঠেকায় পড়ে যদি রাখতেই হয়, পর্দা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সামাজিক মুআমালাত
১। এক মুসলিমের সাথে আরেক মুসলিমের সাক্ষাত হলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা, জবাবে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ কিংবা ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু বলা, হাসি মুখে মুসাফাহ করা এবং কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য।
২। কেউ কোন সমস্যা নিয়ে সাক্ষাত করতে এলে মনোযোগের সাথে তার কথা শুনা কর্তব্য। সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকলে তা করা, সুযোগ না থাকলে বিকল্প করণীয় সম্পর্কে তাকে পরামর্শ দেয়া কর্তব্য।
৩। কোন প্রয়োজনে কারো কাছে যেতে হলে যেই সময়ে তিনি কম ব্যস্ত থাকেন সেই সময়ে যাওয়া উচিত এবং দীর্ঘক্ষণ তার নিকট অবস্থান করা উচিত নয়।
৪। বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে ঢুকে পড়া সমীচীন নয়।
৫। কেউ দাওয়াত দিলে বিশেষ অসুবিধা না থাকলে দাওয়াত কবুল করা কর্তব্য।
৬। দাওয়াত খেয়ে খোশগল্পে মগ্ন হয়ে বিদায় নিতে দেরি করা উচিত নয়।
৭। নিজের প্রয়োজন সারার জন্য কারো কাছ থেকে কোন সামগ্ৰী এনে থাকলে অনতিবিলম্বে তা ফেরত দেয়া কর্তব্য।
৮। কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সাধার নিলে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা কর্তব্য।
৯। নির্দিষ্ট সময়ে ধার পরিশোধ করতে না পারার আশংকা দেখা দিলে পূর্বাহ্নেই ঋণ দাতার সাথে সাক্ষাত করে সময় বাড়িয়ে নেয়া কর্তব্য।
১০। কাউকে কোন কথা দিলে যেই কোন মূল্যে তা রক্ষা করা উচিত।
১১। কাউকে বিদ্রুপ করা, হেয় করার চেষ্টা করা কিংবা মন্দ নামে আখ্যায়িত করা উচিত নয় ।
১২। আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কারো সম্পর্কে মনে খারাপ ধারণা পোষণ করা সমীচীন নয়।
১৩। কারো ব্যক্তিগত চিঠি পড়া, কারো কথাবার্তা শুনার জন্য কানপাতা, কারো ঘরে চোখ পাতা কিংবা কারো দাম্পত্য জীবনের বিষয়াদি জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।
১৪। কারো দোষ খুজে বেড়ানো উচিত নয়।
১৫। কারো গীবত করা উচিত নয়।
১৬। তৃতীয় ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে দুইজন ব্যক্তি কানাকানি করা উচিত নয়।
১৭। কারো উপস্থিতিতে তার প্রশংসা করা উচিত নয়।
১৮। কেউ কোন কিছু গচ্ছিত রাখলে সঠিকভাবে তা সংরক্ষণ করা এবং তিনি যখন ফেরত চাইবেন সংগে সংগে তা ফেরত দেয়া কর্তব্য।
১৯। যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে প্রত্যেক পাটনার খিয়ানাত করা থেকে বেঁচে থাকা কর্তব্য।
২০। কারো কাছে কিছু বিক্রয় করলে পণ্যদ্রব্যে কোন ক্রটি থাকলে ক্রেতাকে তা জানানো উচিত।
২১। পণ্যদ্রব্যের ওজন ও মাপে কমবেশি করা দৃঢ়ভাবে পরহেয করা উচিত।
২২। ভালো কাজে একে অপরের সহযোগিতা করা এবং মন্দ কাজে কারো সহযোগিতা না করা কতব্য ।
২৩। আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক রাখা কর্তব্য।
২৪। বাড়িতে মেহমান এলে তাদের যথাসাধ্য কদর করা কর্তব্য।
২৫। সমমনা লোকদেরকে নিয়ে সমাজ অংগনে সুকৃতির প্রসার ঘটানো এবং মন্দের প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২৬। প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের মাঝে দীনী চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো কর্তব্য।
২৭। যখনি সম্ভব হবে প্রতিবেশীদেরকে খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল, বই পুস্তক, সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি উপহার দেয়া উচিত।
২৮। প্রতিবেশীর কোন খুশির ব্যাপার ঘটলে তাকে অভিনন্দন জানানো এবং বিপদ ঘটলে তাকে সান্ত্বনা দেয়া কর্তব্য।
২৯। কোন প্রতিবেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যাওয়া এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কর্তব্য।
৩০। কোন প্রতিবেশী মারা গেলে তার সালাতুজ জানাযায় অংশ গ্রহণ করা কর্তব্য।
৩১। কোন প্রতিবেশী মারা গেলে তার ইয়াতীম সন্তানদের খোজ-খবর নেয়া এবং তারা অসচ্ছল হলে তাদের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৩২। অভিভাবকহীন বিধবাদের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা কর্তব্য।
৩৩। সাহায্য প্রার্থীকে ধমকানো কিংবা খালি হাতে ফেরানো উচিত নয়।
৩৪। কেউ হাচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ’ বললে যারা তা শুনবেন তাদের ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা কর্তব্য।
৩৫। সামগ্রিকভাবে বড়দেরকে শ্রদ্ধা করা এবং ছোটদেরকে স্নেহ করা কর্তব্য।
৩৬। উখুয়াত বা ভ্রাতৃত্ব পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সকলেরই স্ব স্ব ভূমিকা পালন করা কর্তব্য।
৩৭। সকলেরই ‘তাওয়াছি বিল হাক’ ও ‘তাওয়াছি বিছ ছাবর’ করতে থাকা কর্তব্য।
সাংগঠনিক মুআমালাত
১। নেতৃত্ব পদ লাভের আকাংখা এক মারাত্মক মনস্তাত্বিক ব্যাধি। ইসলামী সংগঠনের কারো মাঝে যেন এই ব্যাধির সংক্রমন না ঘটে— সেই সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
২। নেতৃত্ব নির্বাচনকালে ব্যক্তির ইসলামী নৈতিকতা, মৌলিক মানবীয় গুণ ও সাংগঠনিক প্রজ্ঞার দিকে নজর রেখে ভোটদান করা ভোটারদের কর্তব্য।
৩। নিজে ভোট না দেয়া সত্ত্বেও যিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে নেতা নির্বাচিত হলেন তাকে বিনা দ্বিধায় নিজের নেতা মেনে নেয়া কর্তব্য।
৪। প্রত্যেক কৰ্মীর উচিত নেতৃত্বের কল্যাণকামী হওয়া। নেতৃত্ব যেন সকল সময়ে ও সকল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন সেই জন্য দুআ করতে থাকা কর্মীদের কর্তব্য।
৫। নেতৃত্ব কোন কাজ সম্পন্ন করার জন্য কর্মীদেরকে অনুরোধ করলে তা নির্দেশ বলে গ্রহণ করা কর্তব্য।
৬। পছন্দ হোক বা না হোক নেতৃত্বের নির্দেশ শুনা ও মানা সকলের কর্তব্য।
৭। নেতৃত্বের কথায় ও কাজে কোন ক্রটি দৃষ্ট হলে ব্যক্তিগতভাবে মুখে বা লিখিতভাবে তাদেরকে জ্ঞাত করা কর্তব্য।
৮। নেতৃত্বের ক্রটির কথা তাদেরকে না জানিয়ে অন্যত্র চর্চা করা সমীচীন নয়।
৯। ক্রটি সম্পর্কে নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে সুন্দরভাবে ও সুন্দর ভাষায়।
১০। কোন বিষয়ে কোন পরামর্শ থাকলে তা নেতৃত্বকে অবহিত করা কর্তব্য।
১১। তবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নেতৃত্বকে চাপ দিতে থাকা এক ধরনের বাড়াবাড়ি।
১২। যথার্থ মেজাযে সাংগঠনিক নিয়ম ও নির্দেশ মানা প্রত্যেক কর্মীর কর্তব্য।
১৩। সঠিক সময়ে কর্মীসভা, শিক্ষা বৈঠক, শিক্ষা শিবির, দাওয়াতী অভিযান, জনসভা, মিছিল ইত্যাদিতে যোগদান করা প্রত্যেক কর্মীর কর্তব্য।
১৪। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রত্যেক কমীর কর্তব্য শোভন পরিমাণ অর্থদান করা।
১৫। ওয়াদাকৃত অর্থ সঠিক সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট পৌছানো প্রত্যেক কৰ্মীর কর্তব্য।
১৬। সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটার যাদের ওপর নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করেন তাদের কর্তব্য আল্লাহর ওপর ভরসা করে এই গুরুদায়িত্ব কাধে তুলে নেয়া।
১৭। নেতৃত্বকে অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে যাতে সাংগঠনিক উচ্চ পদ তাদের মনে বিন্দুমাত্র অহংকার সৃষ্টি করতে না পারে। নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে কর্মীগণ তাদের রায়ত বা প্রজা নন। কর্মীগণ তাদের সহযোগী, সহকর্মী, সহযাত্রী।
১৯। নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে যে কর্মীদের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা সম্পর্কে তাদেরকে আল্লাহর আদালতে জওয়াবদিহি করতে হবে।
২০। নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে যে ন্যায় কথা, ন্যায় সিদ্ধান্ত, ন্যায় নির্দেশ ও ন্যায় আচরণ (আলআদল) তাদেরকে আল্লাহর আদালতে বেড়িমুক্ত করবে।
২১। নেতৃত্বকে হওয়া চাই অমায়িক ব্যবহারের বিমূর্ত রূপ। কারো সাথে রূঢ় আচরণ নেতৃত্বের জন্য শোভনীয় নয়।
২২। রাগতস্বরে কথা বলা, রুক্ষ ভাষায় কথা বলা, বাকা তেড়া কথা বলা এবং আত্মসম্মানবোধে আঘাত হেনে কথা বলা নেতৃত্বের জন্য শোভনীয় নয়।
২৩। নেতৃত্বের কথা হতে হবে পরিশীলিত। তাদের মুখে অশোভন কথা, বাহুল্য কথা ও উসকানীমূলক কথা উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়।
২৪। নেতৃত্বের কর্তব্য কর্মীদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আলাপ করা। সীমার মধ্যে থেকে তারা ক্ষেত্র বিশেষে রসিকতাও করতে পারেন। কিন্তু কর্মীদেরকে হাসাবার জন্য ভিত্তিহীন চুটকি চর্চা করা সমীচীন নয়।
২৫। নেতৃত্বের প্রতিটি পদক্ষেপ হওয়া চাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী।
২৬। কর্মীদেরকে ক্যাডার পদ্ধতি, আন্দোলনের মাক্কী ও মাদানী যুগের কর্ম-পদ্ধতি এবং ব্যর্থতা ও সফলতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয়া নেতৃত্বের কর্তব্য।
২৭। নেতৃত্বের কর্তব্য ফোরাম সম্পর্কে সচেতন থেকে বক্তব্য দেয়া। পরামর্শ সভা, কর্মী সভা, শিক্ষা শিবির, সুধী সমাবেশ, সেমিনার-সিমপোজিয়াম, দাওয়াতী জনসভা ও রাজনৈতিক জনসভার সম্বোধন, টোন ও অ্যাপ্রোচে যে পার্থক্য রয়েছে, সেই সম্পর্কে তাদের সজাগ থাকা কর্তব্য।
২৮। নেতৃত্বের বক্তৃতা-ভাষণ শ্রোতাদের মাঝে আবেগ-উচ্ছাস সৃষ্টিকারী হওয়ার পরিবর্তে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে আলোড়িত করার মতো হওয়া উচিত।
২৯। কর্মীদের প্রশ্ন ও সমালোচনায় বিচলিত হওয়া, বিব্রত বোধ করা কিংবা বিরক্ত হওয়া নেতৃত্বের জন্য শোভনীয় নয়।
৩০। নেতৃত্বকে হতে হবে খাটি আমানতদার। সংগঠনের অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণ করা ও সদ্ব্যবহার করা তাদের কর্তব্য।
কর্মীগণও নেতৃত্বের নিকট আমানাত। নেতৃত্বের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ করা তাদের অধিকার।
বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন বিষয়ে তাদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া নেতৃত্বের কর্তব্য।
৩১। নেতৃত্বের ইলম, আমল, ব্যবহার ও কর্ম তৎপরতা কর্মীদের জন্য অনুকরণযোগ্য ও প্রেরণার উৎস হওয়া প্রয়োজন।
৩২। নেতৃত্বকে হওয়া চাই জ্ঞানের খনি। তাদের কর্তব্য যথেষ্ট সময় নিয়ে অধ্যয়ন করে জ্ঞান সমৃদ্ধ হতে থাকা যাতে তাদের জ্ঞান-গৰ্ভ আলোচনা শুনে শ্ৰোতাগণ বিপুলভাবে উপকৃত হতে পারেন।
৩৩। নেতৃত্বের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন নেতৃত্ব ও কর্মীদের মাঝে মনস্তাত্বিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের অনাড়ম্বর জীবন কর্মীদেরকে নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। অতএব অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা নেতৃত্বের কর্তব্য।
৩৪। কর্মীদের ছোট খাট ক্রটি ক্ষমা-সুন্দর চোখে দেখা নেতৃত্বের কর্তব্য।
৩৫। ধমক দিয়ে নয়, রাগ দেখিয়ে নয়, Persuasion (যুক্তি ও উপদেশ সহকারে বুঝানো) ও Motivation (উদ্বুদ্ধকরণ)-এর মাধ্যমে কর্মীদের দ্বারা কাজ করিয়ে নেয়া নেতৃত্বের কর্তব্য।
৩৬। নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে যে নেতৃত্বের সান্নিধ্যে এসে সাত্ত্বনা লাভ-কর্মীদের অন্যতম মনস্তাত্বিক চাহিদা ।
৩৭। নেতৃত্বের কর্তব্য হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একা এক সিদ্ধান্ত না নিয়ে, পরামর্শ সভার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া।
৩৮। পরামর্শ সভায় আহুত ব্যক্তিগণ মুক্ত মন নিয়ে সভায় উপস্থিত হওয়া এবং অকপটে নিজের মত প্রকাশ করা উচিত।
৩৯। পরামর্শ সভার প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অধিকতর যুক্তিপূর্ণ ও শক্তিশালী অভিমতের নিকট নিজের অভিমত কুরবানী করা।
৪০। পরামর্শ সভার প্রসিডিংস আমানাত। সভার বাইরে অন্যদের নিকট প্রসিডিংস প্রকাশ করা খিয়ানাত। কারোই এমনটি করা উচিত নয়।
৪১। আল কুরআন ও আস-সুন্নাহকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য চেষ্টা চালানো পরামর্শ সভার সকল সদস্যের কর্তব্য।
Source: Monthly Magazine “Prithibi”