নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
রচনায়: তাহেরুন নেসা
সভ্যতার চরম বিকাশের যুগেও নারীর যে অমযাদা ও অবমূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে, তা আরবের আইয়্যামের জাহেলিয়াতের যুগকেও ছাড়িয়ে গেছে। শুধু এদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নারী জাতি এক অসহনীয় মযাদাহীন পরিস্থিতির শিকার। নিযাতন, নারী পাচার, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের বিভৎস অত্যাচার প্রভৃতি নিত্যকার ঘটনা আমাদের আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। অপ্রাপ্ত বয়স্কা কিশোরী, হাসপাতালের অসুস্থ রোগিনী এমনকি মৃতা লাশ পর্যন্ত পাশবিকতার হিংস থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নারী কর্তৃক নারী নিযাতনের ঘটনাও এ সমাজে ঘটছে। বিগত যুগেও নারী জাতি এমনিভাবে বিভিন্ন অজুহাতে ও কলা-কৌশলে নিযাতিত হয়েছে। সে যুগের সমাজ নেতারা এর প্রতিরোধে কিছু কিছু চেষ্টাও নিয়েছিলেন- যা প্রায় সকল যুগেই ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে বিগত সভ্যতাগুলিতে নারীর দেওয়া মযাদার সাথে ইসলামের দেওয়া মৰ্যাদাকে আমরা তুলনামুলক অলোচনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা পাব।
১. গ্রীক যুগে নারীঃ প্রাচীন সভ্যতা সমূহের মধ্যে গ্ৰীক সভ্যতা ছিল সবচেয়ে নামকরা । জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও চিকিৎসা শাস্ত্রে তারা তৎকালীন পৃথিবীর নেতৃত্ব দিত। কিন্তু নারীর মর্যাদা সেখানে ছিল খুবই দূভাগ্যজনক। গ্রীকদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে নারীকে ‘মানুষের দুঃখ কষ্টের মূল কারণ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই নোংরা আকীদা তাদের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ফলে কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ গ্রীক নাগরিকের নিকটে নারীর মর্যাদা ছিল ভূলুষ্ঠিত। অধিকাংশের নিকটে বিয়ে একটি বোঝা স্বরূপ গণ্য হয়েছিল। নারীদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব অতটকুই ছিল যেমন পতিতালয়ের নারীদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব। পতনযুগে গ্রীকরা ‘আফ্রোদিত’ (APHRODITE) নামক প্রেম দেবীর পূজা শুরু করে। ফলে বেশ্যালয়গুলি উপাসনা কেন্দ্রের ন্যায় উচু-নীচু সকলের জন্য সম্মেলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এভাবে নারীত্বের অবমাননার সাথে সাথে গ্রীক সভ্যতার মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে।
২. রোমক সভ্যতায় নারী: গ্রীকদের পরেই ইতিহাসে রোমান সভ্যতার স্থান। তাদের উন্নতির যুগে নারীর সতীত্ব ও সম্মানকে খুবই মযাদার চোখে দেখা হ’ত । সেখানে বিবাহ ও পদাপ্রথা চালু ছিল। বেশ্যাবৃত্তি চালু থাকলেও লোকেরা এটাকে খুবই ঘৃণা করত। কিন্তু বস্তুগত উন্নতির চরম শিখরে উঠে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায় এবং নারীদেরকে ঘরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে স্বাধীনতার নামে বের করে নিয়ে আসে। পুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি তাদেরকে কর্মজগতে নামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বৈবাহিক জীবনে নেমে আসে চরম স্বেচ্ছাচার। দাম্পত্য বন্ধন শিথিল হ’তে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে। বিচ্ছেদের সংখ্যা ভায়াবহভাবে বাড়তে থাকে। বিবাহ এক সময় সামাজিক চুক্তির রূপ ধারণ করে । যা যে কোন সময় ভঙ্গ করা চলে। স্ত্রীরা যে কোন সময় চুক্তি বাতিল করে অন্য করতে শুরু করে। পাদ্রী জুরুম (৩৪০-৪২০ খ্ৰীঃ) বিগত যুগের একজন নারীর কথা বলেন, যে ৩২ জন পুরুষের সঙ্গে বিবাহের চুক্তি করেছে এবং সে তার শেষ স্বামীর ২১তম স্ত্রী ছিল । সমাজের নেতারা এইসব বিয়েকে ভদ্ৰ যেনা বলে গণ্য করতেন। জেনারেল কাতো (CATO) (মৃঃ ১৮৪ খৃঃ পূ) বিষয়টি স্বীকার করেন এবং সমাজে স্বেচ্ছাচারমূলক বহু বিবাহ প্রথাকে ‘মন্দ কাজ নয়’ বলে মন্তব্য করেন। এইভাবে যেনার ছড়াছড়িতে রোমকদের নৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়- যা তাদের সভ্যতার পতন ডেকে আনে ।
৩. ইউরোপীয় খৃষ্টানদের নিকটে নারীঃ রোমকদের পতনের পর ঈসায়ী ধর্ম ইউরোপীয়দের নিকট প্রসার লাভ করে। রোমকদের পতন দশা তাদের উপরে দারুণ প্রভাব ফেলে। সেকারণ তারা নারী সঙ্গ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। পাদ্রীরা ঈসায়ী ধর্মের মুখপাত্রের দাবী নিয়ে ঘোষণা করেন যে, নারী হ’ল ‘সকল পাপের উৎস’ এবং মানব জাতির অভিশাপ। তারতুলিয়ান (TERTULLAN) ক্রিসোসতাম (CHRYSOSTUM) প্রমুখ পাদ্রীনেতারা এই ঘোষণা দিয়ে বিয়েকে যদিও হালাল রাখেন, তথাপি এটাকে ‘বিধিবন্ধ যেনা’ হিসাবে নিন্দনীয় মনে করেন।
খৃষ্টীয় তৃতীয় শতকে প্রচারিত এই চরমপন্থী মতবাদ সমস্ত খৃষ্টান জগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং নারীর প্রায় সকল অধিকার হরণ করে। ১৮শ শতাব্দীতে ফরাসী বিপ্লব পর্যন্ত এই অবস্থা কমবেশী চালু থাকে। কিন্তু এই চরমপন্থী ব্যবস্থা বেশী দিন টেকেনি। ১৯শ শতাব্দীতে এসে আবার আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং নারী স্বাধীনতার পক্ষে তারা পাল্টা চরমপন্থী কিছু নীতি চালু করে। যেখানে নারী পুরূষের অবাধ মেলামেশা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা বিধান নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু উভয় নীতিই ছিল চরমপন্থী এবং মানুষের স্বাভাবধর্ম বিরোধী । ফলে পূবেকার বিধ্বস্ত সভ্যতাগুলির ন্যায় খৃষ্টানী সভ্যতাও যৌন স্বেচ্ছাচারে ধ্বংসের পথে দ্রুত এগিয়ে গেল। আধুনিক প্রযুক্তি তাদেরকে এ ব্যাপারে আর উৎসাহ যোগাচ্ছে। গর্ভপাত সেখানে আইনসিদ্ধ হয়েছে। কুমারী মাতা এখন আর কোন লজ্জার ব্যাপার নয় । ‘কলগার্ল’ সে দেশের সভ্যতার অংশ। তাদের সাহিত্য যৌনতায় ভরে গেছে। নগ্নতা এখন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। বল্লাহীন নারী স্বাধীনতা প্রকারান্তরে নারীত্বের অমর্যাদার শামিল। তাই বলা চলে যে, বর্তমানের খৃষ্টানী বা আধুনিক সভ্যতা তাদের পূর্বসূরী রোমক ও গ্রীকদের ন্যায় ক্রমেই ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে।
৪. কম্যুনিষ্ট ও সমাজতন্ত্রী বিশ্বে নারীর মর্যাদা: বর্তমান যুগে কম্যুনিষ্ট বিশ্বে যে সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা মূলতঃ ইরানের প্রাচীন ‘মাযদাকী’ মতবাদেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। বাদশাহ নওশেরওয়া এর পিতা কোবাদ এর আমলে “মাযদাক” নামক জনৈক চিন্তাবিদ মত প্রকাশ করেন যে, মানব সমাজে সকল অশান্তির মূল কারণ হ’ল নারী ও অর্থ-সম্পদ। অতএব এই দুটি বস্তু ব্যক্তি মালিকানা থেকে বের করে জাতীয় মালিকানায় থাকতে হবে। আগুন, পানি ও মাটিতে যেমন সকলের অধিকার আছে, নারী ও সম্পদেও তেমনি সকলের সমানাধিকার থাকবে । বর্তমান সমাজতন্ত্রী বিশ্বে সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়েছে। নারীর অবস্থা সেখানে মাযদাকী আমলের চেয়ে খুব একটা পৃথক নয়। বিবাহ প্রথাটি যদিও সেখানে চালু আছে, তবুও ঘুনে ধরা কাঠের মতই ক্ষণভঙ্গুর। ফলে নারীর মর্যাদা সেখানে ক্রমেই ভোগ্যপণ্যের অবস্থায় উপনীত হচ্ছে।
৫. ইহুদী, ব্যবিলনীয়, পরিসিক ও হিন্দু সভ্যতায় নারী : ইহুদীদের ধারণামতে মা ‘হাওয়া’ ছিলেন ‘মানব জাতির সকল দুঃখ-কষ্টের মূল’। এই ভূল ধারণাই ইহুদী সমাজ জীবনের সর্বত্র পরিব্যপ্ত। ফলে তাদের সমাজে নারীর মর্যাদা বলতে তেমন কিছুই ছিল না।
গ্ৰীক সভ্যতার চরম অধঃপতন যুগে ব্যবিলনীয় ও পারসিক সভ্যতায় ব্যাপক ধ্বস নামে। ব্যবিলনীয়দের মধ্যে ব্যভিচার সাধারণ রূপ ধারণ করে। পারসিকদের মধ্যে মাযদাকী মতবাদের প্রসার ঘটে। একই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে “বামমার্গী” নামক চরম নোংরা ধর্মীয় মতবাদ চালু হয়। যেখানে নারীরা পরকালীন মুক্তির ধোকায় পড়ে নিজেরা এসে ঐসব বামমাগী সাধুদের বাড়ীতে ও মন্দিরে দেহদানে লিপ্ত হত। হিন্দুদের নিকট গ্রীকদের ন্যায় নারীরা ‘পাপাত্মা’ বলে কথিত ছিল । সেকারণ তাদেরকে সম্পত্তির অধিকার, বিধবা বিবাহের অধিকার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি স্বামীহারা নারীকে ধর্মের নামে মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিধানও চালু করা হয়। যা ‘সতীদাহ প্রথা’ নামে পরিচিত। নারীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ ও ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ নিষিদ্ধ করা হয়। গান্ধব্য বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ, শিবলিঙ্গ পুজা প্রভৃতির মাধ্যমে তারা নারীকে স্রেফ ভোগের সামগ্ৰী হিসাবে ব্যবহার করে। যা কমবেশী আজও চালু আছে।
৬. প্রাক ইসলামী যুগে আরবদের নিকটে নারী : ইসলাম আসার প্রাককালে আরবীয় মহিলা সমাজে দু’টি স্তর ছিল। (ক) উচ্চস্তরের মহিলাঃ এরা ছিলেন কবিতা, বীরত্ব, চিকিৎসা, বক্তৃতা ও জ্ঞানবত্তার দিক দিয়ে সকলের নিকটে শ্রদ্ধার পাত্রী । মা খাদীজা এই স্তরেরই একজন স্বনামধন্যা বিদুষী মহিলা ছিলেন। (খ) সাধারণ স্তরের মহিলাঃ এই স্তরে মহিলারাই ছিলেন সমাজে সংখ্যাগরিষ্ট। তাদের অবস্থা বিগত পতিত সভ্যতা গুলির চাইতে বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আর অধঃপতিত ছিল । যার জন্য কন্যাসন্তানের জন্ম হওয়া বাপ-মায়ের নিকট খুবই দুঃখের কারণ হিসাবে প্রতীয়মান হ’ত। অনেকে এজন্য কন্যা জন্মের সাথে সাথে মাটিতে পুতে বা কুয়ায় ফেলে মেরে ফেলত। (সূরায়ে নাহল ৫৮, তাকভীর ৮,৯)। সামাজে মেয়েদের কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। বিবাহ, তালাক, সম্পত্তির অধিকার সবই ছিল পুরুষের একচেটিয়া। ঠিকা বিবাহ, বহু বিবাহ, বদলী বিবাহ, মা ব্যতীত অন্যান্য সকল মহিলা বিবাহ প্রভৃতি নোংরামি চালু ছিল। অধিকাংশ নারীই সমাজে অধিকারহীন ক্রীতদাসী হিসাবে ব্যবহৃত হত। যেন- ব্যভিচার ব্যাপকহারে চালু ছিল। ফলে সাধারণভাবে নারী ভোগের সামগ্ৰী হিসাবেই ব্যবহৃত হত ।
(৭) ইসলামে নারীর মর্যাদা :
তৎকালীন পৃথিবীর উপরোক্ত সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইসলাম নারীর জন্য স্থায়ী মযাদার গ্যারান্টি দিয়ে ঘোষণা করে যে,
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
(সমাজদেহ পরিচালনার জন্য) নারী ও পুরুষ উভয়ে উভয়ের পোষাক সমতুল্য (বাকারাহ : ১৮৭) ।
একটি গাড়ীতে যেমন দু’খানা চাকার প্রয়োজন। কিন্তু দু’খানা চাকা স্ব স্ব স্থানচ্যুত হ’য়ে একত্রিত হ’লে এ্যাকসিডেন্ট হওয়া স্বাভাবিক, তেমনি নারী ও পুরুষ উভয়ে গতিশীল রাখবে বলা হ’ল তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে অধিকতর তাকওয়ার অধিকারী (হুজুরাত : ১৩)
যেনা-ব্যভিচার, ঠিকা বিবাহ, বদলী বিবাহ সবাই হারাম ঘোষণা করা হ’ল । পুরুষের ন্যায় নারীকেও স্বামী, সন্তান, পিতা ও ভাইয়ের সম্পত্তিতে অংশীদার করা হ’ল । তাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ ফরয ঘোষণা করা হ’ল । ১৪ জন মহিলার সঙ্গে বিবাহ হারাম করে তাদের ইযযতের গ্যারান্টি দেওয়া হ’ল। ক্রীতদাসীকে মুক্তি দিয়ে বিবাহের মাধ্যমে সম্মানিত জীবন যাপন করাকে অধিক ছওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করা হ’ল। বিবাহের ব্যাপারে যাবতীয় জাহেলী রেওয়াজ প্রদান এবং আলী ও সাক্ষীর মাধ্যমে বিবাহ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হ’ল। তাদেরকে খোলা তালাক প্রদান ও বিধবা বিবাহের অনুমতি দেওয়া হ’ল ‘নারী সকল অকল্যাণের মূল’ এই জাহেলী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হ’ল যে,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
আমরা মানব জাতিকে (নারী-পুরুষসহ) সম্মানিত করেছি … এবং অন্যান্য সৃষ্টির উপরে মযাদা দান করেছি (বনী ইস্রাঈল ৭০)।
অতঃপর নারীর উপরে পুরুষের যে কর্তৃত্ব ও মযাদা ইসলাম ঘোষণা করেছে, তা মূলতঃ সামাজিক শৃংখলার ক্ষেত্রে মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (মুসলিম)।
মোটকথা ইসলাম বিগত সভ্যতাগুলির দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে নারীকে সভ্যতার অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য অঙ্গ বলে গণ্য করে। ইসলামের নিকট নারী অকল্যাণকর নয়, ভোগের সামগ্ৰীও নয়; বরং তা সমাজের অগ্রগতিতে ও সুখে-দুঃখে পুরুষের বিশ্বস্ত ও অপরিহার্য সঙ্গিনী ।
এভাবে যে ইসলাম নারী জাতিকে জাহেলিয়াতের জিঞ্জির হতে মুক্ত করে এক অভাবনীয় জীবন বোধের সন্ধান দিল এবং তার ফলে মা, খালা, বোন, কন্যা ইত্যাদি হিসাবে যে মহান আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে পুরুষ সমাজে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করল- সেই ইলাহী বিধানকে দূরে ঠেলে দিয়ে প্রগতির ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে মযাদার পর্দা দূরে ছুড়ে ফেলে নারী আজ বাইরে পরিয়ে আসছে । আল্লাহ প্রদত্ত নিজের গোপন সৌন্দর্যকে স্বাধীনতা ও ফ্যাশনের নামে পুরুষের সামনে মেলে ধরছে । ফলে আগুন আর মোমের যে অবস্থা আজকের সমাজে স্বাভাবিকভাবে তাই-ই ঘটে যাচ্ছে। রোম সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, হেলেনীয় সভ্যতা প্রভৃতি বিগত সভ্যতাগুলি ধ্বংসের মূল । বীজ হিসাবে নারী যে ভাবে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল, আজকের আধুনিক সভ্যতা ধ্বংসের জন্য তথাকথিত প্রগতিবাদী নারীরাই যে দায়ী হবে, তার লক্ষণ প্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পর্দাহীন নারী রাস্তায় চলবে, পাশাপাশি চেয়ারে বসে চাকুরী করবে, আর পুরুষ সহকর্মী তার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকাবে না- এটা নিতান্তই বাস্তব বিরোধী কথা । আর সে কারণেই সমাজে ঘটছে যত অঘটন, আধুনিক যুগে নারী এখন সাধারণ পণ্যের চেয়েও সস্তা। সে আজ বিজ্ঞাপনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির হাতিয়ার, সার্কাস, সিনেমা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ । নারী এখন বাংলাদেশের নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও নারীই আজ চরম নিযাতনের শিকার ।
এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য দূরদর্শী পুরুষ আত্ম মযাদাহীন চলন্ত শোকেস সদৃশ বেপর্দা নারী সমাজকে আত্মমযাদাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া সর্বাধিক যরুরী। ইসলাম নারীকে আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছে ও সেই মোতাবেক তাকে সমাজ জীবনে চলার জন্য কিছু স্থায়ী নিয়মপদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। সেই শিক্ষা ও নিয়ম পদ্ধতির কঠোর অনুশীলন ও বেঁচে থাকা অসম্ভব । শুধু যে কঠোর আইন রচনা দ্বারা নারী নিযাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়, বিগত এরশাদ আমলে ও বেগম জিয়ার আমলে তার বাস্তব প্রমাণ দেখা গেছে |
সুতরাং যতদিন নারী তার নিজস্ব গন্ডির মধ্যে বিচরণ করার মানসিকতা অর্জন করতে না পারবে, যতদিন কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজেদের জীবন গড়ে তোলার মাধ্যমে চরিত্রে, ব্যবহারে, আচার-আচরণে, গভীর আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় দিতে না পারবে, যতদিন সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ, উভয়ের কর্মস্থল পৃথক, রেডিও-টিভিতে ও পত্র-পত্রিকা-চলচ্চিত্রে চরিত্র বিধ্বংসী প্রচারণা বন্ধ না হবে, ততদিন নারী তার সম্মানজনক অবস্থানে পৌছতে পারবে না ।
অতএব আসুন, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করি, এবং ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে তার কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলি। আমরা যেন আমাদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করে প্রাথমিক যুগের মুসলিম নারীদের ন্যায় শক্তিমান আদর্শ নারী হিসাবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি আল্লাহর নিকটে কায়মনোচিত্তে সেই প্রার্থনা করি- আমীন।
সূত্র: মাসিক আত-তাহরীক ১৯৯৭ সালের প্রথম দুই সংখ্যা থেকে সংকলিত।