কুরবানীর দিনের ফযীলত ও তার ওযীফাহ
কুরবানীর দিন এক মহান দিন। এই দিনকে ‘হজ্জে আকবার’ এর দিন বলা হয়।[1]
এই দিন সারা বছরের শ্রেষ্ঠতম দিন। নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর নিকট মহানতম দিন কুরবানীর দিন। অতঃপর স্থিরতার (কুরবানীর পরের) দিন।[2]
কুরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহা, রোযার ঈদ বা ঈদুল ফিতর অপেক্ষা উত্তম। কারণ, ঈদুল আযহাতে নামায ও কুরবানী আছে। কিন্তু ঈদুল ফিতরে আছে নামায ও সদকাহ। আর কুরবানী সদকাহ অপেক্ষা উত্তম। আবার কুরবানীর দিনে হাজীদের জন্য স্থান ও কালের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা একত্রিত হয়। যেহেতু ঐ সময় পবিত্র কাবাগৃহের হাজ্জ হয়। আর যার পূর্বে আরাফার দিন ও পরে তাশরীকের তিন দিন। আর এই দিনগুলির প্রত্যেকটাই হাজীদের জন্য ঈদ।[3]
এই দিনে কতকগুলি পালনীয় ওযীফাহ রয়েছে যা পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপঃ-
- ঈদগাহের প্রতি বহির্গমনঃ-
এই দিনে সুন্দর পোষাক ও বেশ-ভুষায় সজ্জিত হয়ে উত্তম খোশবু মেখে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। যেহেতু এই দিন সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার দিন। যেমন ঈদের জন্য গোসল করা কিছু সলফ, সাহাবা ও তাবেঈন কর্তৃক শুদ্ধভাবে প্রমাণিত আছে।[4]
খুবই সকাল সকাল ঈদগাহে পৌঁছে ইমামের নিকটবর্তী স্থানে বসার চেষ্টা করবে মুসলিম। এতে নামাযের জন্য প্রতীক্ষার সওয়াব লাভ করবে।
ঈদগাহে যাবার পথে তাকবীর পাঠ করবে। ইমাম বের হওয়া (নামাযে দাঁড়ানো) পর্যন্ত ঐ তাকবীর পড়া সুন্নাত। যুহরী বলেন, লোকেরা ঈদের সময় তাকবীর পাঠ করত, যখন ঘর হতে বের হত তখন থেকে শুরু করে ঈদগাহ পর্যন্ত পথে এবং ইমাম বের হওয়া পর্যন্ত ঈদগাহে তাকবীর পড়ত। ইমামকে (নামাযে দাঁড়াতে) দেখে সকলেই চুপ হয়ে যেত। পুনরায় ইমাম যখন (নামাযের) তাকবীর পড়তেন তখন আবার সকলে তাকবীর পড়ত।[5]
সকলেই এই তাকবীর উচ্চস্বরে পাঠ করবে। তবে একই সঙ্গে সমস্বরে তাকবীর পাঠ বৈধ নয়। উল্লেখ্য যে, ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আযহার তাকবীর অধিকরূপে তাকীদপ্রাপ্ত।[6]
ঈদগাহে পাঁয়ে হেঁটে যাওয়াই সুন্নাত। অবশ্য ঈদগাহ দূর হলে অথবা অন্য কোন ওজর ও অসুবিধার ক্ষেত্রে সওয়ার হয়েও যাওয়া চলে।[7]
ঈদুল আযহার দিন নামাযের পূর্বে কিছু না খাওয়া সুন্নাত। আর ঈদুল ফিতরের দিন ইদগাহে বের হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত।[8]
ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘তিনি ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে (কুরবানী করে) কুরবানীর (গোশত) খেতেন।’[9]
প্রকাশ থাকে যে, ঈদুল আযহার দিনে নামাযের পূর্বে না খাওয়ার নাম হাফ রোযা নয়। আর এই রোযার জন্য ফজরের পূর্বে সেহরী খাওয়াও বিধেয় নয়। পক্ষান্তরে জানা কথা যে, হাফ বলে কোন রোযা শরীয়তে নেই এবং ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম।
- ঈদের নামাযঃ-
এই নামায সুন্নতে মুআক্কাদা। কোন সক্ষম মুসলিমের জন্য তা ত্যাগ করা বা আদায় করতে অবহেলা করা উচিত নয়। শিশুদেরকেও এই নামাযে উপস্থিত হতে উদ্বুদ্ধ করবে। সৌন্দর্য প্রকাশ না হলে, পর্দার রীতি থাকলে এবং পথে ও ঈদগাহে নারী-পুরুষে মিলা-মিশার ভয় না থাকলে মহিলারা জামাআতে শামিল হবে। বরং পর্দার ব্যবস্থা করে ঈদগাহে মহিলাদেরকে উপস্থিত হয়ে নামায পড়ার বন্দোবস্ত করা জরুরী। যাতে ঋতুবতী মহিলারাও নামাযে না হলেও দুআ ও খুশীতে শরীক হবে। এ ছাড়া পৃথকভাবে কেবল মেয়েদের জন্য কোন বাড়িতে বা মসজিদে ঈদের নামাযের কথা শরীয়তে উল্লেখিত নেই।
অনেক ওলামা যেমন, ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল কাইয়েম, শাওকানী, সিদ্দীক হাসান খান প্রভৃতিগণের মতে এই নামায ওয়াজিব।
ঈদের নামাযের জামাআত ছুটে গেলে একাকী দুই রাকআত নামায পড়ে নেবে।[10] ঈদের খুতবাহ শোনা সুন্নাত। তবে উপস্থিত থেকে তাতে লাভবান হওয়া উচিত। খুতবাহ শেষে (যে পথে গিয়েছিল তার) ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে।[11]
৩. কুরবানী যবেহ ও গোশত বিতরণঃ-
পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে কুরবানী যবেহর সময় ঈদের খুতবা শেষ হলে শুরু হয়। কুরবানী দাতার জন্য সুন্নাত যে, সে তা হতে খাবে, আত্মীয়-সবজনকে (তারা কুরবানী দিক, চাই না দিক) হাদিয়া দেবে এবং গরীবদেরকে সদকাহ করবে। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বলেন,
{فَكُلُوْا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيْرَ}
অর্থাৎ, অতঃপর তোমরা তা হতে ভক্ষণ কর এবং নিঃসব অভাবগ্রস্তদেরকে ভক্ষণ করাও।[12]
{وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون}
অর্থাৎ, আর (কুরবানীর) উঁটকে করেছি আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় ওগুলির উপর (নহর করার সময়) তোমরা আল্লাহর নাম নাও। অতঃপর যখন ওরা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা তা হতে আহার কর এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও যাচ্ঞাকারী অভাবগ্রস্তকে। এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।[13]
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, (কুরবানীর গোশত) তোমরা খাও, জমা কর, এবং দান কর।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘তা খাও, খাওয়াও এবং জমা রাখ।’’[14]
উপর্যুক্ত আয়াত বা হাদীসে খাওয়া, হাদিয়া দেওয়া ও দান করার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ বিবৃত হয়নি। তবে অধিকাংশ উলামাগণ মনে করেন যে, সমস্ত মাংসকে তিন ভাগ করে এক ভাগ খাওয়া, এক ভাগ আত্মীয়-সবজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং এক ভাগ গরীবদেরকে দান করা উত্তম।
কেউ চাইলে সে তার কুরবানীর সমস্ত গোশতকে বিতরণ করে দিতে পারে। আর তা করলে উক্ত আয়াতের বিরোধিতা হবে না। কারণ, ঐ আয়াতে নিজে খাওয়ার আদেশ হল মুস্তাহাব বা সুন্নাত। সে যুগের মুশরিকরা তাদের কুরবানীর গোশত খেত না বলে মহান আল্লাহ উক্ত আদেশ দিয়ে মুসলিমদেরকে তা খাবার অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ খাওয়া ওয়াজিবও বলেছেন।[15] সুতরাং কিছু খাওয়াই হল উত্তম।
কুরবানীর গোশত হতে কাফেরকে তার অভাব, আত্মীয়তা, প্রতিবেশ অথবা তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য দেওয়া বৈধ। আর তা ইসলামের এক মহানুভবতা।[16]
তিন দিনের অধিক কুরবানীর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়া সংক্রান্ত হাদীসটি মনসুখ (রহিত) হলেও যেখানে দুর্ভিক্ষ থাকে সেখানে তিন দিনের অধিক গোশত জমা রাখা বৈধ নয়।[17]
কুরবানীদাতা পশু যবেহ করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটতে পারে। তবে এতে কুরবানী দেওয়ার সমান সওয়াব লাভ হওয়ার কথা ঠিক নয়। যেমন কুরবানী দিতে না পারলে মুরগী কুরবানী দেওয়া বিদআত।
আর দাড়ি কোন সময়কার জন্য চাঁছা বৈধ নয়। কিন্তু বহু মানুষ আছে যারা কুরবানী করার সাথে সাথে নিজের দাড়িও কুরবানী (?) করে থাকে! কেউ কেউ তো নামাযে বের হওয়ার পূর্বেই দাড়ি চেঁছে সাজ-সজ্জা করে। অথচ সে এ কাজ ক’রে তিনটি পাপে আলিপ্ত হয়ঃ (১) দাড়ি চাঁচার পাপ (২) পাপ কাজের মাধ্যমে ঈদের জন্য সৌন্দর্য অর্জন করার পাপ এবং (৩) কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্বে চুল (দাড়ি) কাটার পাপ।[18]
অনুরূপভাবে অধিকাংশ দাড়ি-বিহীন হাজীদেরকে দেখা যায় যে, তারা ইহরামের কারণে দাড়ি কিছু বাড়িয়ে থাকে। অতঃপর যখন হালাল হবার সময় হয়, তখন মাথার কেশ মুন্ডনের পরিবর্তে তারা তাদের দাড়ি মুন্ডন করে থাকে! অথচ রসূলুল্লাহ (সা.) কেশ মুন্ডন করতে উৎসাহিত করেছেন এবং দাড়ি বর্ধন করতে আদেশ করেছেন। অতএব ‘ইন্নালিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজেঊন।’
পরন্তু এই অপকর্মে কয়েকটি বিরুদ্ধাচরণ রয়েছে।
(১) দাড়ি বর্ধনের উপর রসূলের আদেশ উল্লংঘন এবং তাতে তাঁর বিরোধিতা।
(২) কাফেরদের প্রতিরূপ ধারণ। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য ধারণ করে সে তাদেরই শ্রেণীভুক্ত।’’ (৩) নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন। অথচ তিনি নারীদের আকৃতি ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন।
(৪) (আল্লাহর বিনা অনুমতিতে) আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন এবং শয়তানের প্রতিজ্ঞার আনুগত্য। যেহেতু সে আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে;
যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
{لَعَنَهُ اللهُ وَقَالَ لأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيباً مَفْرُوضاً- وَلأضِلَّنَّهُمْ وَلأمَنِّيَنَّهُمْ وَلآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَمَنْ يَتَّخِذْ الشَّيْطَانَ وَلِيّاً مِنْ دُونِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَاناً مُبِيناً}
অর্থাৎ, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেন। সে (শয়তান) বলে, ‘আমি তোমার বান্দাদের একটা নির্দিষ্ট অংশকে (নিজের দলে) গ্রহণ করবই। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবই, তাদের হূদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবই, আমি তাদেরকে নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করবেই, এবং তাদেরকে অবশ্যই নির্দেশ দেব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই।’ আর যে আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, নিশ্চয় সে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।[19]
বলাই বাহুল্য যে, দাড়ি রাখা সকল নবীর সুন্নাত (তরীকা)। আর তা মৌলবী-অমৌলবী ও হাজী-অহাজী প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ওয়াজিব। কেউ দাড়ি না রাখলে, তার কাবীরা গোনাহ হবে।
৪। ঈদের মুবারকবাদঃ-
ঈদের দিন এক অপরকে মুবারকবাদ দেওয়ায় ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে কোন দোষ নেই। যেমন, ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের নিকট থেকে ইবাদত কবুল করেন), ঈদ মুবারক ইত্যাদি দুআমূলক বাক্য বলে এক অপরের সাথে সাক্ষাৎ করা বৈধ। যেহেতু ঈদে ও অন্যান্য খুশীতে মুবারকবাদ দেওয়া, বরকত, মঙ্গল ও কবুলের দুআ করা) ইসলামে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত।
যেমন, সাহাবাগণ ঈদগাহ হতে ফিরার সময় এক অপরকে বলতেন, ‘তাক্বাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।[20]
অন্যান্য খুশীর বিষয়ে মুবারকবাদ দেওয়ার ব্যাপারেও ইসলামে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন আনাস (রা.) বলেন, (বিজয়ের খবর নিয়ে) যখন ‘‘—এ এজন্য যে, তিনি তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের ত্রুটিসমূহ মার্জনা করবেন—’’ এই আয়াতটি[21] হুদাইবিয়া থেকে ফিরার পথে নবী (সা.)-এর উপর অবতীর্ণ হল তখন তিনি বললেন, ‘‘আমার উপর এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যা ধরাপৃষ্ঠে সমগ্র বস্তু থেকে আমার নিকট প্রিয়তম।’’ অতঃপর তিনি তাঁদের (সাহাবাদের) কাছে তা পড়ে শুনালেন। তা শুনে সাহাবাগণ বললেন, ‘যে জিনিস আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন তার উপর আপনাকে মুবারকবাদ—।’[22]
অনুরূপভাবে যখন কা’ব বিন মালেক (রা.)-এর তাওবাহ কবুল হল তখন তাঁকে মুবারকবাদ দেওয়া হয়েছিল।[23]
বিবাহ-শাদীতে আল্লাহর রসূল (সা.) ‘বারাকাল্লাহু লাকা অবারাকা আলাইক—’ বলে বরকে মুবারকবাদের দুয়া দিতেন।[24]
অবশ্য ঈদের খুশীতে মুবারকবাদ দেওয়ার ব্যাপারে নবী (সা.) কর্তৃক কোন হাদীস প্রমাণিত নেই। তবে কিছু সাহাবা ও তাবেয়ীন হতে এ কথা বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত আছে। অতত্রব কেউ এ কাজ করলে করতেও পারে এবং ছাড়লে ছাড়তেও পারে।[25]
শায়খ আব্দুর রহমান সা’দী বলেন, ‘বিভিন্ন উপযুক্ত শুভক্ষণে মুবারকবাদ শরীয়তের এক ফলপ্রসূ বৃহৎ মূলের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কারণ, যাবতীয় কথা ও কাজের দেশাচার ও প্রথার মৌলিক মান হচ্ছে বৈধতা। অতএব কোন আচার বা প্রথাকে হারাম বলা যাবে না; যতক্ষণ না ঐ প্রথা বা আচারকে শরীয়ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথবা তাতে কোন বিঘ্ন বা ক্ষতি প্রকাশিত না হয়েছে। এই মহান মৌলনীতির সপক্ষে কিতাব ও সুন্নাহর সমর্থনও রয়েছে।
সুতরাং লোকেরা এই মুবারকবাদকে কোন ইবাদত বলে মনে করে না। বরং তা একটা প্রচলিত রীতি মনে করে; যাতে শুভক্ষণে খুশির সাথে এক অপরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকে এবং তাতে কোন বাধা বা বিঘ্নও নেই। বরং তাতে উপকারই আছে; যেমন মুসলিমরা এক অপরকে এর মাধ্যমে উপযুক্ত দুআ দিয়ে থাকে এবং তাতে আপোসে সৌহার্দ্য, ভালবাসা ও সম্প্রীতি সঞ্চার ও বৃদ্ধি হয়ে থাকে। তাই রীতির সাথে যখন কোন লাভ ও মঙ্গল যুক্ত হয় তখন তা তার ফল হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[26]
৫। পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎঃ-
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও জ্ঞাতি-বন্ধনের দাবী এই যে, বিশেষ করে ঈদের দিন তাদের যিয়ারত করা। তাদের অবস্থা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা, ঈদের খুশী ও সুখে তাদের শরীক হওয়া। পিতামাতা থেকে পৃথক থাকলে (বা এক বাড়িতে না থাকলে) তাদের যিয়ারত পুত্রের জন্য সুনিশ্চিত হয়। অতঃপর আত্মীয়-স্বজনদের যিয়ারত ও তার পর দ্বীনী ভাই-বন্ধুদের যিয়ারত করা কর্তব্য। সুতরাং বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের যিয়ারতকে পিতা-মাতার যিয়ারতের উপর প্রাধান্য দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
যেমন, এই যিয়ারতে বেগানা নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীর অবাধ মিলামিশা, পর্দাহীনতা, নারীদের নানান সাজ-সজ্জা ও অঙ্গরাগে সুগন্ধ মেখে গায়ের মাহরাম (গম্য) পুরুষদের সাথে সাক্ষাৎ ও মুসাফাহা করা, খেলা, ছবি তোলা ইত্যাদি হারাম।
জ্ঞাতি-বন্ধন জাগরূক রাখার জন্য ঈদ এক বড় শুভপর্ব। যেদিন প্রায় সকলের মুখে হাসির ফুলকুঁড়ি ফুটে ওঠে। কিন্তু এমন অনেক মানুষ থাকে, যাদের সে হাসি ওষ্ঠাধরে পৌঁছনোর পূর্বে হূদয় মাঝেই বিলীন হয়ে যায়। তারা খুশীর সবাদ অনুভব করতে সক্ষম হয় না। বরং মনঃকষ্টে অনেকের চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়। এমন লোকদেরকে বেছে তাদের হাসি ফুটিয়ে তুলতে সহযোগিতা করা এক মহান কাজ। ঐ দিনে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর কোন অনাথ, এতীম, দুঃস্থ, দাস-দাসী, বিধবা অভাগিনীদের কথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। এ উপলক্ষে তাদেরকে কিছু উপহার দিয়ে সান্তক্ষনা দান মহৎ লোকের কাজ।
৬। ঈদের দিন সৎকাজ করা ও তার শুকর (কৃতজ্ঞতা) আদায় করার দিন। অতএব ঐ দিনকে গর্ব, অহংকার, নজরবাজি, তাসবাজি, আতশবাজি ও অন্যান্য অবৈধ খেলা, সিনেমা বা অবৈধ ফ্লিম্ দর্শন, গান-বাজনা করা ও শোনা, মাদকদ্রব্য সেবন প্রভৃতির মাধ্যমে অবৈধ হর্ষোৎফুল্ল দিন বানানো কোন মুসলিমের জন্য আদৌ উচিত নয়। নচেৎ নেক আমলের শুক্রিয়া আদায়ের বদলে কৃত আমলের ফলই নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য এই পবিত্র খুশির দিনে ছোট শিশু কন্যারা ‘দুফ’ (ঢপঢপে আওয়াজবিশিষ্ট একমুখো ঢোলক) বাজিয়ে মার্জিত বৈধ গজল ইত্যাদি গাইতে পারে।
সতর্কতার বিষয় যে, বিশেষ করে ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর পিতামাতা বা কোন আত্মীয়-সবজনের কবর যিয়ারতের প্রথা ইসলামে নেই। এ অভ্যাসটিকে কর্তব্য মনে করলে নিঃসন্দেহে তা বিদআত হবে।[27]
[1] (আবূ দাঊদ ৫/৪২০, ইবনে মাজাহ ২/১০১৬)
[2] (আবূ দাঊদ ৫/১৭৪, মিশকাত ২/৮১০)
[3] (লাতায়েফুল মাআরিফ ৩১৮পৃঃ)
[4] (ফাতহুল বারী ২/৪৩৯, মুগনী ৩/২৫৬)
[5] (ইবনে আবী শাইবাহ ২/১৬৫, ইরওয়াউল গলীল ৩/১২১)
[6] (মাজমূ ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৪/২২১)
[7] (মুগনীঃ ৩/২৬২)
[8] (তিরমিযী ৩/৯৮, ইবনে মাজাহ ১/২৯২)
[9] (যাদুল মাআদ ১/৪৪১)
[10] (ফাতহুল বারী ২/৪৭৪)
[11] (বুখারী ৯৪৩নং)
[12] (সূরা হাজ্জ ২৮ আয়াত)
[13] (সূরা হাজ্জ ৩৬ আয়াত)
[14] (মুসলিম ১৯৭১নং)
[15] (তাফসীর ইবনে কাসীর ৩/২৯২, ৩০০, মুগনী ১৩/৩৮০, মুমতে ৭/৫২৫)
[16] (মুগনী ১৩/ ৩৮১, ফাতহুল বারী ১০/৪৪২)
[17] (ফাতহুল বারী ১০/২৮, ইনসাফ ৪/১০৭)
[18] (সালাতুল ঈদাইন, আলবানী ৪০পৃঃ)
[19] (সূরা নিসা ১১৮-১১৯)
[20] (হাবী ১/৮২, ফাতহুল বারী ২/৪৪৬, তামামুল মিন্নাহ ৩৫৪পৃঃ)
[21] (সূরা গাশিয়াহ, আয়াত নং ২)
[22] (বুখারী ৩৯৩৯, মুসলিম ১৭৮৬নং)
[23] (বুখারী ৪১৫৬, মুসলিম ২৭৬৯নং)
[24] (বুখারী ৪৮৬০, মুসলিম ১৪২৭নং)
[25] (মাজমূ ফাতাওয়া ২৪/২৫৩)
[26] (ফাতাওয়া সা’দিয়্যাহ ৪৮৭পৃঃ, হাবী ১/৭৯)
[27] (আহকামুল জানায়েয, আলবানী ২৫৮পৃঃ)