ভূমিকম্পের শিক্ষা
রচনায়: সাবির আলী
ভূমিকম্প মানেই একটা আতঙ্কিত অনুভূতি। শরীর সহ রূহেও কম্পন ধরিয়ে দেয়, আল্লাহর এই অন্যতম নিদর্শন। দ্বীন ইসলামের এক বিস্তীর্ণ ব্যাপার জুড়েই রয়েছে ভূমিকম্পের অবস্থান। একটা আস্ত সুরা রয়েছে ভূমিকম্প শিরোনামে। অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে, যেখানে ভূমিকম্প নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা। কখনো পাপের শাস্তির পরিণামে আল্লাহর গযব হিসাবে, কখনো কিয়ামতের আলামত হিসাবে আলোচিত হয়েছে ভূমিকম্প। এগুলিছাড়াও ভূমিকম্পের একটি বিশেষ দিক রয়েছে, সেটি নিয়েই কিছু বলার আছে-
প্রত্যেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। বন্যা, খরা, ভূমিকম্প এমনকি মহামারীও এই তালিকায় সামিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে মূলত দু’টি কারণে।
এক. পাপাচারের প্রত্যক্ষ শাস্তি হিসাবে,
অথবা
দুই. মানুষকে পরীক্ষা করার উপায় হিসাবে।
দু’টি কারণই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন, সহীহ হাদীসে এসেছে যে, যখন কোন এলাকায় পাপের শাস্তি হিসাবে আল্লাহর গযব নেমে আসে, সেখানকার ভালোমানুষগুলিও সেই গযবের আওতায় পড়ে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ভালোমানুষরা কেন, গযবের শিকার হবেন। জবাব হচ্ছে, ভালো মানুষদের জন্য দুর্যোগটি পাপের শাস্তি নয়, বরং পরীক্ষার অংশ।
আল্লাহ বলেন,
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
আমরা জন্ম ও মৃত্যু তৈরী করেছি যাতে করে পরীক্ষা করতে পারি তোমাদের মধ্যে কে আমলে সবচাইতে উত্তম (সুরা মুলক, আয়াত নং-২)।
এছাড়া আল্লাহ বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ
আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব ভয় দ্বারা, ক্ষুধা দ্বারা, জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা (সুরা বাকারাহ, আয়াত-১৫৫)।
সুতরাং, নিঃসন্দেহে ভূমিকম্প এই সমস্ত পরীক্ষাদির অন্তর্ভুক্ত। তবে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাইতে ভূমিকম্পের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আর তা হল, এর সাথে কিয়ামতের যোগাযোগ রয়েছে। কিয়ামতের অসংখ্য ছোট আলামত সমূহ রয়েছে, যা ইতিমধ্যেই সংঘটিত। ঘন ঘন ভূমিকম্প সেই ছোট আলামত সমূহের অন্যতম। কিয়ামতের একটি বড় আলামত হচ্ছে, বড় বড় তিনটি ভূমিধ্বস, যা এখনও অসংঘটিত। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কিয়ামত শুরুই হবে ভূমিকম্প দিয়ে, যেমনটি আল্লাহ সুরা যিলযালে উল্লেখ করেছেন। তাই ভূমিকম্পের নিঃসন্দেহে অন্যান্য দুর্যোগের চাইতে বিশেষত্ব রয়েছে। সেজন্যই হইতো দেখাযায়, অন্যান্য দুর্যোগে মানুষ যতটা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়, ভূমিকম্পে তার চাইতে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় এলেও দেখবেন, মানুষ তবুও থীতু হয়ে বসে থাকে, কিন্তু ভূমিকম্পে সামান্য টেবিল নড়লেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।
মানুষ তার ইচ্ছার স্বাধীনতার কারণে আল্লাহর আইনের বিরোধিতা করে সত্য, কিন্তু নিজের অজান্তেই যে তারা মহান আল্লাহর নিকটে তাদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় এটিই। এবারে শুরুর কথায় ফিরে আসি। বলছিলাম, আল্লাহ আমাদের ভূমিকম্পের মাধ্যমে হয় আযাবের স্বাদ আস্বাদন করান অথবা পরীক্ষা নেন। কিন্তু এই আযাব বা পরীক্ষার মধ্যে তিনি আসলে কি বোঝাতে চান? আসলে কিন্তু তিনি আমাদের শিক্ষা দিতে চান। শিক্ষা ঐ সমস্ত আত্মরম্ভী মানুষের জন্য যারা আজও আদ জাতির মত ‘আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে?’ অথবা ফিরাউনের মত ‘আনা রাব্বুকুমুল আলা’ জাতীয় অহংকারী উক্তির উপরে ভর দিয়ে দুনিয়ায় কতৃত্ব ফলাতে সচেষ্ট। শিক্ষা ঐ সমস্ত নিরেট মূর্খদের জন্য যারা আজও আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করে। শিক্ষা ঐ দাম্ভিক বিজ্ঞানীদের জন্য যাদের একফোঁটা অক্সিজেন তৈরীর ক্ষমতা নেয় অথচ আল্লাহর অস্তিত্বকে নস্যাৎ করার দুঃসাহস দেখায়। শিক্ষা ঐ মুশরিকদের জন্য যাদের ‘ক্ষমতাবান’ বিগ্রহরা আজ ধূলিধূসরিত। শিক্ষা ঐ মুনাফিকদের জন্য, যারা আল্লাহ ও মু’মিনদের উপহাসের পাত্র বানায়।
আগামীকাল থেকে খাঁটি মুসলিম হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ঐ সমস্ত বংশীয় মুসলিমদের জন্য শিক্ষা। শিক্ষা ঐ যুবক ছেলেটির জন্য যে, সন্ধ্যের পরে ক্রিকেটের ব্যাট বল বা নগ্ন চিয়ার লিডারদের দেহ প্রদর্শনে মগ্ন থেকে আল্লাহর আরশের ছায়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঐ কর্মচঞ্চল ছেলেটির জন্যই শিক্ষা যে, কাজকেই ধর্ম মনে করে দিব্যি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ। ঐ তরুণ, ঐ রিটায়ারের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া অথবা রিটায়ার্ড মানুষটির জন্যই শিক্ষা যে আজও হারাম দিয়ে (সুদ, ঘুষ ইত্যাদি) তার দেহ গঠন করে চলেছে। তার জন্যই রয়েছে শিক্ষা যে লোকসভা, পুরসভার ভোটে নিজের দলের পক্ষে অস্ত্র ধরতেও কুন্ঠিত হচ্ছেনা। শিক্ষা এটাই যে আজও সময় আছে।
আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেন তাঁর ক্ষমতার মাত্রা। যে ক্ষমতার রাশের অধিকারী তিনি নিজেই। তাঁর কাছে কোন বিরোধীপক্ষ নেই। তিনিই হাইকোর্ট, তিনিই সুপ্রিমকোর্ট, তিনিই বিচারক। পালাবার পথ নেই। তাঁর নিকটেই অবশ্যম্ভাবী প্রত্যাবর্তন। কোন ধর্মঘট, কোন ধরনা কোন কাজে আসবে না। পরাক্রমশালী স্রষ্টা নেহাতই দয়ালু এবং করুণাময়, তাইতো তিনি সুযোগ দিচ্ছেন। সময় দিচ্ছেন তাওবা করার। তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করার।
আরেকবার আল্লাহ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নশ্বর এই পৃথিবীতে নশ্বর মানুষের অবিনশ্বরী মনোভাব মোটেই মানানসই নয়। তাই আসুন, সেদিন পৃথিবী আপনার আমার কৃতকর্ম সম্পর্কে কিছু বলে দেওয়ার আগেই (সুরা যিলযাল) আমরা আল্লাহর নিকটে ধরা দিই। আকুল ভাবে কাঁদি। চোখের পানিতে আমাদের গুনাহ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাক। তাওবা করি।যে আগামীকাল থেকে আমরা খাঁটি মুসলিম হওয়ার নিত্য প্রতিশ্রুতি দিই, আজ এই মুহূর্ত হয়ে উঠুক সেই আগামীকালের শুভক্ষণ। আল্লাহর দেওয়া সুযোগকে হাতছাড়া করার বোকামী যেন আমরা না করি। ঐ শুনুন আল্লাহর বাণী-
وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১০২)।
যে রাসুল(সা) কে গালি দিলে আপনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তাঁর কথাটা ঐ শুনুন: “আল্লাহ্ এই নিদর্শনসমূহ কারও জন্ম বা মৃত্যু উপলক্ষে পাঠান না। তিনি এগুলো পাঠান তার বান্দাদের সন্ত্রস্ত করতে। তাই তোমরা যখন এরকম কিছু দেখো তখনই আল্লাহ্র স্মরণে, তার কাছে দু’আ করতে ও তার কাছে ক্ষমা চাইতে ছুটে যাও”। [বুখারী ও মুসলিম]