হাজরে আসওয়াদের ইতিকথা ও মূল শিক্ষা
লেখক: এম. এ. হান্নান
অনুলিখন: মাহমুদুল হাসান বিন এমদাদ
হজ্ব সম্পাদনকারীগণ প্রতি বছর হজ্বের বিশ্ব সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে হজ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। তার মধ্যে হাজরে আসওয়াদ অর্থাৎ কালো পাথরে হাত স্থাপন ও চুম্বন তত্ত্বও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। কাবা ঘরের পূর্ব কোণে ভূমি হতে প্রায় ৫ ফুট উপরে দরজায় অনতিদূরে দেওয়ালের মধ্যে কালো পাথর গাথা আছে। এই কালো পাথরের ইতিহাস সুদূরপ্রসারী।
বিশ্বনাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) বলেনঃ হাজরে আসওয়াদ নামে পাথরখানা জান্নাত হতে এসেছিল। দুধের চেয়েও পাথর খানা সাদা ছিল। আদম বংশের পাপরাশি তাকে কালো করে ফেলেছে (আহমাদ, তিরমিযী)।
প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়াকে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় পাথর খানা সাথে দেওয়া হয়েছিল। তারপর মানবের পাপের ফলে দুধের মত সাদা পাথরখানা কালো হয়ে যায় (ইবনে কাসীর)।
জননেতা ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) ও পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) কাবার প্রাচীর তৈরি করতে করতে যখন রুকনের স্থানে পৌঁছান তখন ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর নিবেদিত প্রাণপুত্র ইসমাঈলকে বলেনঃ “একটি সুন্দর পাথর খুঁজে নিয়ে এসো। পাথরখানা এখানে রাখবো। তাহলে মানুষের কাবা প্রদক্ষিণের চিহ্নের কাজ দেবে”। পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) পিতাকে বলেনঃ “পিতা! আমি অত্যন্ত ক্লান্ত”। তিনি বলেনঃ “তবুও যাও”। তারপর পুত্র পাথরের সন্ধানে বের হলেন। এমন সময় জীবরাঈল (আলাইহিস সালাম) হিন্দুস্থান থেকে পাথরখানা নিয়ে আসেন (তারিখে মক্কা-ইবনে কাসীর)।
কাবা ঘর বহু ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তার সাথে হাজরে আসওয়াদ ও স্থানচ্যুত হয়েছে। এই কালো পাথরের সাথে বিশ্বনাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) এর সম্পর্ক জড়িত। বিশ্বনাবীর নবুয়্যাত প্রাপ্তির অর্থাৎ নাবীরূপে আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে কাবা ঘরের নির্মাণ কাজ চলছিল। কালো পাথরখানা দেওয়ালে স্থাপনের চিন্তা-ভাবনাও হচ্ছিল। তবে কে স্থাপন করবে? কোন গোত্র করবে? এ নিয়ে মক্কার অমুসলিমদের মধ্যে চরম অশান্তি, গোলযোগ, বিবাদ দেখা দেয়। কারণ তারাও পাথরখানার গুরুত্ব বুঝত।
আবু উমাইয়া ঘটনার পরিণতি উপলব্ধি করে বললেনঃ তোমরা শান্ত হও। যে লোক আজ সর্বপ্রথম কাবা ঘরে প্রবেশ করবে তার উপরেই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব অর্পণ করবো। তোমরা কি এতে সম্মত আছো? বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধের প্রস্তাবে সবাই সম্মত হল। দেখা গেল আরবের আল অামীন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়া সাল্লাম) কাবা ঘরে প্রথম এলেন। ঘটনা বলে সবাই তাঁর কাছেই সমাধান চাইলো। বিশ্ব সমস্যা সমাধানকারী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক গোত্রের একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পাথরের কাছে গেলেন। বিশ্ব নাবী চাদর বিছিয়ে স্বহস্তে হাজরে আসওয়াদখানা তুলে চাদরের মধ্যস্থলে রাখলেন। এবার গোত্রের প্রতিনিধিদের বললেন, সবাই চাদরখানা ধরে পাথরটি যথাস্থানে নিয়ে যান। নাবীর চমৎকার পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট হয়ে সবাই তাই করল।
হাজরে আসওয়াদ জান্নাতের পাথর। তাই পাথর ফেরেশতাদের স্পর্শও আদম, ইব্রাহীম, ইসমাঈল (আলাইহিমুস সালাম) দের স্পর্শ জড়িত আছে। অতএব এই পবিত্র পাথর ভাবী বিশ্বনাবীর পবিত্র হাতেই যথাস্থানে স্থাপিত হওয়া উচিত। তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাদরের উপর থেকে তুলে পাথরখানা যথাস্থানে স্থাপন করলেন।
কালো পাথর আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়-বিশ্বনাবী কালো পাথর কাবা ঘরে স্থাপনের সময় কুরাইশ অমুসলিমদের যেভাবে মীমাংসা করেছিলেন তেমনিভাবে আমাদের সমাজের, গ্রামের, সংগঠনের, ঝগড়া, কলহ, বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির মীমাংসা করতে হবে ঐ কালো পাথরের দিকে তাকিয়ে।
কালিমাময়, বিদ্বেষপরায়ণ, কলহপ্রিয় অন্তরকে, মানসিকতাকে পূর্বের সাদা পাথরের ন্যায় সুন্দর ও সাদা করে তুলতে হবে। তবেই কালো পাথর স্পর্শ করার স্বার্থকতা বজায় থাকবে।
কালো পাথর চুম্বনের তাৎপর্য হচ্ছে-আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও ভালবাসার নিদর্শন। পাথর চুম্বনের দ্বিতীয় তাৎপর্য হচ্ছে-একই পাথরে একই স্থানে লাখ লাখ হাজীর চুম্বনে ভেঙ্গে যায় রাজা-প্রজার, মালিক-শ্রমিকের, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের, আরব-অনারবের, কালো-সাদার,ধনী-নির্ধনের, ছুত-অছুতের বিভেদের জঘন্য প্রাচীর। এই শুভ লগ্নে বিশ্বের হাজীরা বিশ্বভ্রাতৃত্বে একত্রিত হয়। মালেকী, হাম্বলী, হানাফী, শাফেয়ী, শিয়া-সুন্নী বিভিন্ন মাজহাবের প্রাচীর খান খান হয়ে ভেঙ্গে সবার মুখ, হাত-এক মুখ, হাত হয়ে যায়। কেউ কাউকে ঘৃণা করে না। একজনের চুম্বনের জায়গায় অন্যজন চুম্বন দিতে অস্বীকার করে না।
মুসলিম বিশ্বের কোন মুসলিমও মানুষকে ঘৃণা করে না। সারা বিশ্ব তাদের স্বদেশ। তাই আল্লামা ইকবাল বলেনঃ “মুসলিম হ্যাঁয় হাম ওয়াতান হ্যাঁয় সারা জাঁহা হামারা” (আমি মুসলিম, সারা পৃথিবী আমার স্বদেশ)। এধরনের অন্তরের সম্প্রসারণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে হজ্বের তথা বিশ্ব সম্মেলনের লক্ষ্য।
একমুখ হাতের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এসে হাজীরা এক মাযহাবের লোক অন্য মাযহাবের লোককে গালি দেয়, এক সংগঠনের কর্মী অন্য সংগঠনের কর্মীর অহেতুক সমালোচনা করে এবং মুখ ও হাতের দ্বারা আঘাত করে।
এই পাথর স্পর্শ ও চুম্বনে হাজীরা আরো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে যে তারা দেশে ফিরে এসে আল্লাহর উপযুক্ত প্রতিনিধি হয়ে আল্লাহর হাত শক্ত করার জন্য পৃথিবীর বুকে জানমাল সব উৎসর্গ করে বাতিলের মেরুদন্ড গুঁড়িয়ে দেবার জন্য সংগ্রাম করবে। বাতিলের সাথে কোনদিন করমর্দন করবে না। বাতিলের হাতে হাতও মিলাবে না। বাতিল মতবাদের ঝান্ডা হাতে নিয়ে আল্লাহর অদৃশ্য হাতে হাত রেখে যে শপথ করেছে সে হাতকেও বাতিলের স্লোগান দিয়ে মুখকে আর অপবিত্র করবে না।
বিশ্বের ও দেশের মুসলিমকে সব সময় এক ও অভিন্ন মনে করে একতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তুলবে।
হাজরে আসওয়াদ স্বর্গ থেকে আসার সময় দুধের মত সাদা ছিল। আমাদের পাপের ফলে কালো তথা বিকৃত হয়েছে। পাথর স্পর্শ ও চুম্বনে হাজীরা একেবারে পাপমুক্ত হয়ে যায়, যদি সত্যিকারের চুম্বন ও স্পর্শ হয়ে থাকে। পাপমুক্ত হাজীরা যেন স্বদেশে ফিরে এসে পাপের পথে আর পা না বাড়ায়।
বিশ্বনাবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম)বলেনঃ আল্লাহর শপথ করে বলছি সত্যই আল্লাহ শেষ বিচারের দিন হাজরে আসওয়াদ পাথরটি পাঠাবেন। পাথরের দুটো চোখ হবে এবং দেখবে। একটি জিহবা হবে এবং কথা বলবে। যে লোক সঠিকভাবে পাথরে চুম্বন করবে ঐ পাথর সাক্ষ্য প্রদান করবে (তিরমিযী)।
অনেকে হাজরে আসওয়াদের ব্যাপারে বলে, “মূর্তি ও পাথর পূজার সাথে মিল রয়েছে”। এটা ঠিক নয়। কারণ হিন্দুরা দেব-দেবী পাথরের কাছে গিয়ে ভালমন্দ লাভ লোকসানের চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু মুসলমানরা কালো পাথরকে ভালমন্দের মালিক ভাবে না। উমারের(রাযি আল্লাহু আনহু) কথাটি বললেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তিনি বলেনঃ “আমি স্পষ্টই জানি যে তুমি একটি পাথরমাত্র। তুমি আমাদের ভালো মন্দের, লাভ লোকসানের মালিক নও। বিশ্বনাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম)কে চুম্বন দিতে না দেখলে আমি তোমায় চুম্বন দিতাম না” (বুখারী)।
হাজরে আসওয়াদের কাছ থেকে আমরা যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশিক্ষণকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া আমাদের কর্তব্য।