কুরআনের তেলাওয়াত : আমল ও গবেষণা
রচনা: মাকছুদ
সম্পাদনা: আলী হাসান তৈয়ব
হিদায়াতের আলোকবর্তিকা হিসেবে আল্লাহ তাআলা কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন আল্লাহর বাণী, মানুষের বাণী এর মত অকাট্য নয়। এর সকল বিষয় সত্য। মিথ্যা এর ধারে কাছেও আসতে পারে না। প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। সংরক্ষণের দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে বাড়ানো-কমানোর কোনো অবকাশ নেই। লওহে মাহফুজে তা হুবহু লিপিবদ্ধ। মানুষের অন্তরে সংরক্ষিত ও মুখে মুখে বার বার পঠিত। কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করা অত্যন্ত সহজ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
‘আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য অতএব কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?’ (আল-কামার : ১৭)
ছোট বাচ্চারাও কুরআন মুখস্থ করতে ও মনে রাখতে পারে। অনারবদেরও কোনো সমস্যা হয় না কুরআন পড়তে। কুরআনের তেলাওয়াত যতবার করা যায় ততই তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। গবেষকদের নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা চালিয়ে যেতে বিরক্তিবোধ হয় না। দিন দিন কুরআনের নতুন নতুন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অর্থ আবিষ্কার হচ্ছে এবং তার আবিষ্কার আরো বেড়ে চলেছে। কুরআন সেই শুরু থেকেই নিজের সত্য হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এ পর্যন্ত মানুষ ও জিন বা তাদের সমন্বিত প্রয়াসে সম্ভব হয়নি এর সবচেয়ে ছোট একটি সূরার মত সূরা উপস্থাপন করা। আর কখনও তারা তা পারবেও না। কুরআন একটি শাশ্বত অলৌকিক গ্রন্থ এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক জীবন্ত প্রমাণ। আল্লাহ তাআলা কুরআনকে মহিমান্বিত করেছেন এবং এর তেলাওয়াত ও গবেষণার আদেশ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গহণ করে।’ (সোয়াদ : ২৯)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে তার জন্য একটি পূণ্য আর প্রত্যেকটি পূণ্য দশগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, আমি বলব না আলিফ-লাম-মিম একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর ও মিম আরেকটি অক্ষর।’ (তিরমিজি)
যারা কুরআন শিখে আমল করে আল্লাহ তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা দান করেছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি সেই যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (বুখারি)
তিনি আরো বলেছেন, যে মুমিন কুরআন পড়ে সে মালটার ন্যায় যার সুগন্ধি ও স্বাদ উভয়টি ভালো আর যে মুমিন কুরআন পড়ে না সে খেজুরের ন্যায় যার সুগন্ধি নেই তবে মিষ্টি স্বাদ আছে এবং মুনাফিক যে কুরআন পড়ে সে ফুলের ন্যায় যার সুগন্ধি ভালো ও স্বাদ তিক্ত এবং যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না সে তিক্ত ফলের ন্যায় যার গন্ধ ও স্বাদ উভয়টি তিক্ত।’ (বুখারি ও মুসলিম)
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসসমূহে কুরআন শিক্ষা, গবেষণা ও আমল করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
কুরআন শিক্ষা, গবেষণা ও আমল করা হিসেবে মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত
তাদের মধ্যে এক শ্রেণি যারা কুরআনের যথাযথ তেলাওয়াত করে এবং কুরআন অধ্যয়ন করে কার্যে পরিণত করে, তারা সৌভাগ্যবান এবং তারাই বস্ত্তত আহলে কুরআন। আরেক শ্রেণি যারা কুরআন শিখে না এবং শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে না আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে কঠিন শাস্তির বাণী উচ্চারণ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ
‘ আর যে পরম করুণাময়ের জিকির থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে হয়ে যায় তার সঙ্গী।’ (যুখরুফ-৩৬)
তিনি আরো বলেন : ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমর নিদর্শনাবলি এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। আরেক শ্রেণির যারা কুরআন শিখে তবে তেলাওয়াত করে না তারা তেলাওয়াতের বিশাল পূণ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং কুরআন ভুলে যায়। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘এবং যে আমার স্মরণ থেকে বিরত থাকে’ অর্থাৎ তেলাওয়াত থেকে বিরত থাকে আর যে তেলাওয়াত থেকে বিরত থাকে এবং ভুলে যায় তার ক্ষতি অপরিমেয়, তার ওপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করে ও তার অন্তর কঠোর হয়ে যায়।
আরেক শ্রেণি আছে যারা শুধু কুরআন তেলাওয়াত করে তবে উপদেশ গ্রহণ বা গবেষণা করে না। শুধু তেলাওয়াতে বেশি উপকার হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
‘আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর, তারা মিথ্যা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে।’ (বাকারা : ৭৮)
তাই তেলাওয়াত করার সময় যথাসম্ভব বুঝা ও শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করা উচিত।
আরেক শ্রেণি যারা কুরআন তেলাওয়াত পেশা হিসেবে গ্রহণ করে বিনিময় তলব করে। আনন্দ-শোক ও নানা উপলক্ষে কুরআন তেলাওয়াত করে বিনিময় নেয়। নানাভাবে এমনকি গানের সুরে লোক দেখানোর জন্য পড়ে। তারা নিম্নোক্ত একাধিক অপরাধের সমন্বয় করে :
এক. কুরআন বিদআত ও গোনাহের স্থানে পড়া যেমন শোকের স্থানে, ব্যঙ্গ ও গর্হিত বিষয় সম্বলিত সভা-সেমিনারে ইত্যাদি।
দুই. দুনিয়া অর্জনের লক্ষে কুরআন তেলাওয়াত। কুরআন তেলাওয়াত আল্লাহর ইবাদত। এর দ্বারা দুনিয়া অন্বেষণ করা বৈধ নয়। এর দ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পূণ্য অন্বেষণ করতে হবে।
তিন. অশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা বা গানের সুরে বা অবাঞ্চিতভাবে তেলাওয়াত করা।
তাদের একশ্রেণি এমন আছে যারা ভালোভাবে কুরআন তেলাওযাত করে লোক দেখানো ও সুখ্যাতি অর্জনের জন্য অথচ তার প্রতি বিশ্বাস রাখে না। তারাই বিশ্বাসগত মুনাফিক তাদের সম্পর্কে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘যে মুনাফিক কুরআন পড়ে সে ফুলের ন্যায় যার গন্ধ ও স্বাদ উভয়ই তিক্ত।’ তারা কুরআন পড়ে যুক্তি- তর্ক করা ও সন্দেহপূর্ণ আয়াত অনুসন্ধানের জন্য। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে।’
আর যে কুরআন পড়ে এবং কুরআনে বিশ্বাস রাখে তবে তার সুন্দর কণ্ঠে মানুষের স্ত্ততি ও প্রশংসা কামনা করে। এটা তার কার্যত নিফাক ও ছোট শিরক। এ কারণে তার পূণ্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং শাস্তি পেতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজদের সালাতে অমনোযোগী, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে এবং ছোট-খাট গৃহ সামগ্রী দানে নিষেধ করে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাঁর মহিমান্বিত কুরআন শুদ্ধ পড়ার, এর অর্থ বুঝার ও এ নিয়ে গবেষণা এবং সব সময় এর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন।