দল, ইমারত ও বায়আত সম্পর্কে উলামাগণের বক্তব্য (পর্ব ১২)

দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য (বারতম পর্ব)

আল্লামা সা‘দ ইবনে আব্দুর রহমান আল-হুছাইন(62)

কোনো জামা‘আত, দল বা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা অথবা মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে নামে বিশেষিত করেছেন, সেটি বাদ দিয়ে ভিন্ন কোনো নামে নিজেদেরকে বিশেষিত করে ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া অথবা কুরআন-হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের নীতির বাইরে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত বা আক্বীদা পোষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে আলাদা করে ফেলা অথবা নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বা দলীয় আমীর নিযুক্ত করে তার হাতে বায়‘আত করার অনুমতি যেমন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথাও নেই; তেমনি তা ছাহাবায়ে কেরামের জীবদ্দশাতেও কখনো ঘটেনি। আজ মুসলিমদের মধ্যে এরূপ ঘটার ফলে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। ফলে সারা বিশ্বে তাদের যে শক্তি ও দাপট ছিল, তা তারা হারিয়ে ফেলেছে। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির দোহাই দিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ সংগঠনের কর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং তাদেরকে ভালবাসে। পক্ষান্তরে অন্য সংগঠনের কর্মীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং তাদেরকে ঘৃণা করে। শুধু তাই নয়, একে অন্যের উপর মিথ্যা অপবাদ, গালিগালাজ, এমনকি হত্যা করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। তারা প্রত্যেকে নিজেদেরকে সাধু এবং অন্যদেরকে ভ্রান্ত বলে দাবি করছে। নিজেদের দলের জন্য খয়রাত সংগ্রহে লিপ্ত আছে, অথচ অন্যরা যাতে কিছুই না পায়, সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব দলাদলি ও বিভক্তির মধ্যে কিভাবে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হবে?!(63)

 শায়খ আবু উসামাহ সালীম ইবনে ‘ঈদ আল-হেলালী(64)

তিনি বলেন, এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহর পথে দা‘ওয়াতের নামে গড়ে উঠা সংগঠনগুলি প্রত্যেকে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আছে, অন্যদের দিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকি কোনো কোনো সংগঠনের লোকেরা নিজেদের সংগঠনকে ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাকে ‘ইমামুল মুসলিমীন’ বলে দাবি করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। ফলে তার হাতে বায়‘আত করাকে সকল মুসলিমদের উপর অপরিহার্য বলে মনে করে। কেউ কেউ মুসলিমদের সর্ববৃহৎ অংশকে (السواد الأعظم) কাফের বলে ফৎওয়া প্রদান করে। আবার কেউ কেউ নিজেদের দলকে মূল দল বলে আখ্যায়িত করে অন্যদেরকে এর পতাকা তলে সমবেত হওয়া অপরিহার্য বলে মনে করে।…
মূলতঃ যেসব দল ইসলামের জন্য আজ কাজ করছে, তারা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নয়; বরং তারা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’–এর একটি অংশ মাত্র। কেননা হাদীছে বর্ণিত ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ এবং তাদের ইমাম আজ নেই। হাদীছে ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ বলতে এমন জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে, যার অধীনে সারা দুনিয়ার সকল মুসলিম সুসংগঠিত হবে এবং তাদের একজন ইমাম বা খলীফা হবেন, যিনি আল্লাহ্‌র হুকুম বাস্তবায়ন করবেন। এরকম খলীফা আসলে তার হাতে বায়‘আত করা এবং তার অনুসরণ করা গোটা মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্য অপরিহার্য হয়ে যাবে।
আর যেসব দল রাষ্ট্রীয় খেলাফত পুনরুদ্ধার করার কাজ করছে, তাদের উচিত, নিজেদের মধ্যকার সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা, নির্ভেজাল তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলা এবং নিজেদের দোষ-ত্রুটির জন্য পরস্পর পরস্পরকে নছীহত করা। অনুরূপভাবে একজন সাধারণ মুসলিমের উচিৎ, এসব দলের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া।
ইসলামের হৃত গৌরব, শক্তি আর দাপট ফিরিয়ে আনার জন্য এসব দলের এক হয়ে যাওয়া উচিৎ। তাদের উচিৎ, কর্মীদেরকে হকমুখী করা এবং তাদের মধ্যে সকল মুসলিমকে ভালবাসার মত মানসিকতা তৈরী করা। তা হলেই মুসলিমদের বিভক্তি ও দুর্বলতা লোপ পাবে এবং তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের সকল বাধা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।
অতএব, কোনো ব্যক্তি এসমস্ত সংগঠনের বাইরে থাকলে তাকে মুসলিম জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না। কেননা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’-এর বৈশিষ্ট্য তাদের কারোর মধ্যেই নেই এবং এসব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের নিজেদেরকে ‘ইমাম’ বলে দাবি করার যোগ্যতাও নেই।(65)

তথ্যসূত্র :

( 62) সা‘দ ইবনে আব্দুর রহমান আল হুছাইন ১৩৫৪ হিজরীতে সঊদী আরবের শুকরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষা বিভাগে মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করেন। সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ ১. হাকিকাতুত দা‘ওয়াহ ইলাল্লাহ ২. ফিকরো সাইয়েদ কুতুব বায়না রায়ায়নে ৩. তাছহীহুত তাশায়উ।

(63) সা‘দ ইবনে আব্দুর রহমান আল হুছাইনঃ হাকিকাতুদ দা‘ওয়াহ ইলাল্লাহ, রিয়াদঃ দারুস সালাম লাইব্রেরী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪১৩ হিজরী, পৃষ্টাঃ ৭২-৭৩।

( 64) শায়খ আবু উসামাহ আল-হেলালী ১৩৭৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ধার্মিক ও দ্বীনদার পরিবারে তিনি বড় হন। সিরিয়া, পাকিস্তান এবং সঊদী আরবে পড়াশুনা করেন এই খ্যাতিমান আলেম। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে রয়েছেনঃ আলবানী, হাম্মাদ আল-আনছারী, বাদীউদ্দীন আর-রাশেদী। শায়খ আলবানী, মুক্ববিল আল-ওয়াদেঈ, রবী আল-মাদখালী তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ ১. যুবদাতুল আফহাম বিফাওয়াইদি উমদাতিল আহকাম ২. আল-বিদ‘আহ ওয়া আছারুহাস সাইয়্যে ফিল উম্মাহ, ৩. মাউসূ‘আতুল-মানাহি আশ-শার‘ইয়্যাহ ফী ছহীহিস-সুন্নাহ আন-নাবাবিইয়াহ।

( 65) আবু উসামাহ সালীম আল-হেলালী, আল-জামা‘আত আল-ইসলামিইয়াহ ফি যওইল কিতাবে ওয়াস-সুন্নাহ (তৃতীয় প্রকাশ: ১৪১৭/১৯৯৭) পৃ: ৩৮৪-৩৮৫; আবু উসামাহ সালীম আল-হেলালী, লিমাযা ইখ্‌তারতুল-মানহাজ আস-সালাফী? (দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৪৩০/২০০৯), পৃ: ২৫-২৬।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan