পূত চরিত্র অবলম্বনের উপায়-উপকারিতা

আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান

সম্পাদনা : আলী হাসান তৈয়ব

মানুষের উত্তম আখলাকের অন্যতম পূত-চরিত্র বা নিষ্কলুষ স্বভাব। পূত চরিত্র অবলম্বন ছাড়া কেউ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। তাই দেখা যায় প্রতিটি মহা-মানবের মধ্যেই এ গুণ ছিল অবধারিতভাবে। আবু সুফিয়ান রা. থেকে বর্ণিত, হিরাকল্ বাদশা তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নবী তোমাদেরকে কি করার আদেশ দেয়?’ আমি বললাম, তিনি বলেন- ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। তোমাদের পূর্ব পুরুষ যা বলতেন তোমরা তা ছেড়ে দাও। আর আমাদেরকে তিনি সালাত, সততা, পূত চরিত্র ও আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার আদেশ করতেন।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম সাহাবাগণকে পূত চরিত্র অবলম্বনের আদেশ করতেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রভুর নিকট দুআ করতেন—

‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট হিদায়াত, তাকওয়া, সচ্চিরত্র ও অভাবমুক্তির প্রার্থনা করছি।’ (মুসলিম : ৪৮৯৮)

পূত চরিত্রের উপাদানগুলো :

(১) হারাম থেকে বিরত থাকা :

হারাম উপার্জন ও হারাম ভক্ষণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা। এর দ্বারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি মেলে। পক্ষান্তরে যে দেহ হারাম দ্বারা লালিত তার ঠিকানা জাহান্নাম। তাছাড়া হারাম খাদ্য থেকে বেঁচে থাকলে দুআ কবুল হয় এবং আল্লাহ্ বিশেষভাবে তাকে হেফাজত করেন।

(২) ভিক্ষা করা থেকে বিরত থাকা :

আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন—

لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا (سورة البقرة : 273)

‘তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না।’ (বাকারা : ২৭৩)

আউফ ইবনে মালেক রহ. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিসহ কয়েকজন সাহাবিকে বললেন, ‘তোমরা কেন বাইয়াত গ্রহণ কর না? সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো বাইয়াত গ্রহণ করেছি। নতুন করে কোন বিষয়ে আপনার হাতে বাইয়াত করব? তিনি বললেন, তোমরা মানুষের কাছে কিছু প্রার্থনা করো না।

তাই কর্তব্য হলো-

  • আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছে আশ্রয় না চাওয়া।
  • তাঁর ওপর সত্যিকারার্থে ভরসা করা।
  • নিজের সম্মান রক্ষা করা।
  • মাখলুকের নিকট ভিক্ষা করার লাঞ্ছনা থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

এক্ষেত্রে মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত। সকলে এক পর্যায়ের নয়। কারো ক্ষেত্রে ভিক্ষা না করা ওয়াজিব। যেমন প্রয়োজন না হলে সম্পদ না চাওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ বাড়ানোর জন্যে মানুষের নিকট ভিক্ষা চায় সে যেন আগুনের জ্বলন্ত চেয়ে বসল। অতএব তা কম করুক বা বেশি করুক সেটা তার ইচ্ছা।’

কারো কারো ক্ষেত্রে ভিক্ষা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব নয়। তাদের ক্ষেত্রে ভিক্ষা ছেড়ে দেয়া মর্যাদার বিষয়। যেমন ইতিপূর্বে উল্লে­খিত আউফ ইবনে মালেকের রেওয়ায়েতে আছে- ‘আমি তাদের কাউকে কাউকে দেখেছি ঘোড়ায় আরোহিত অবস্থায় হাতের লাঠি পড়ে গেলে, তা উঠিয়ে দেয়ার জন্যে অন্য কারও সাহায্য চাইতেন না। (মুসলিম : ১৭২৯)

(৩) লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করা :

অশ্ল­ীল কাজ ও অশ্লীলতার যাবতীয় উপকরণ থেকে লজ্জাস্থানকে হেফাজত করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ نِكَاحًا (سورة النور: 33)

‘যারা বিবাহ করতে পারে না তারা যেন নিজেদেরকে হিফাজত করে।’ (নূর : ৩৩)

তিনি আরো ইরশাদ করেন—

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ (سورة النور : 30)

‘(হে নবী) আপনি মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি নিচু করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হিফাজত করে। এটাই তাদের জন্যে পবিত্র পন্থা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাআলা তাদের কর্ম সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। (নূর : ৩০)

লজ্জাস্থান পবিত্র রাখবেন কেন ?

লজ্জাস্থানের হিফাজতকারীকে আল্লাহ্ তা‘আলা আরশের নিচে ছায়া দিবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সাত প্রকার ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা আরশের নিচে ছায়া দিবেন। (তাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত যাকে কোনো সুন্দরী সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী কু-কর্মের দিকে আহবান করলে সে বলে, আমি আল্লাহ্কে ভয় করি। (বুখারি : ১৩৩৪)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যকার মুখ ও দুই পায়ের মধ্যকার লজ্জাস্থান হিফাজতের জিম্মাদার হলো, আমি তার জান্নাতে প্রবেশের দায়িত্ব নিলাম।’

লজ্জাস্থান হিফাজতের উপায় :

  • সর্বাত্মকভাবে নিজের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা।
  • যৌবনে পদার্পনের পর অনতিবিলম্বে বিবাহ করা।
  • বিবাহে অপারগ হলে সিয়াম পালন করা।
  • নারীর শতভাগ পর্দা রক্ষা করা।
  • অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের না হওয়া।

আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন –

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى. (سورة الأحزاب : 33)

‘আর তোমরা (নারীরা) ঘরে অবস্থান কর এবং জাহেলি যুগের নারীদের মত খোলামেলা চলাফেরা করো না।’ (আহযাব : ৩৩)

  • অপরিচিত নারীর সঙ্গে নির্জনে অবস্থান না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নারীদের নিকট প্রবেশ করার ব্যাপারে সতর্ক থাক।’
  • কোনো নারীর সঙ্গে মুসাফাহা না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি নারীর সঙ্গে মুসাফাহা করি না।’
  • নারী-পুরুষ একসঙ্গে মেলামেশা না করা।
  • অশ্ল­ীলতার দিকে ধাবিত করে এমন সব কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন—

وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا. (سورة بني إسرائيل : 32)

‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’ (বনি ইসরাঈল : ৩২)

অশ্ল­ীল কথা বা কাজের কথা শোনা, অশালীন বস্তুতর প্রতি দৃষ্টিপাত করা, অশ্ল­ীল ছবি বা সিনেমা দেখা, অশ্ল­ীল কিছু পাঠ করা এ সবই আয়াতের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত।

পবিত্রতা ম্লান হয় যেসব কারণে :

  • অভিভাবক ও মুরবিবগণের তারবিয়্যত ও নজরদারি দুর্বল হওয়া।
  • হারাম বস্তুর প্রতি অবাধে দৃষ্টিপাত। এটি ফিতনার সবচেয়ে বড় কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘চোখের ব্যভিচার হলো দৃষ্টিপাত।’

জারির ইবনে আব্দুল্লা­হ রা. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আকস্মিক দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বললেন।

বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে আলী, তুমি প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিও না। প্রথমটি তোমার জন্যে জায়েজ বটে, কিন্তু দ্বিতীয়টির অধিকার নেই।

  • যুবক-যুবতীদের দেরি করে বিবাহ দেয়া।
  • এমন দেশে ভ্রমণ করা- যেখানে বেহায়া ও উলঙ্গপনা সর্বপ্লাবী।
  • অপরিচিত নারীর সঙ্গে মেলামেশা ও নির্জনবাসের ব্যাপারে অবহেলা করা। পূর্বসুরীগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক করতেন। উবাদা বিন সামেত রা. একজন বয়োজেষ্ঠ আনসারি সাহাবি। তিনি বলেন, ‘তোমরা দেখ না আমি অন্যের সাহায্য ব্যতীত দাঁড়াতে পারি না এবং নরম খাবার ব্যতীত খেতে পারি না। আমার সঙ্গী অনেকদিন হল মরে গিয়েছে। তথাপি সারা পৃথিবীর বিনিময়েও কোনো অপরিচিত নারীর সঙ্গে নির্জনে থাকা আমার পছন্দ হয় না। কেননা শয়তান হয়তোবা আমার জিনিসটিকে নাড়া দিতে পারে।
  • যে ব্যক্তি নিজে পবিত্র থাকতে চায় না এবং সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে চায় না এমন লোকের সঙ্গে উঠাবসা করা। অতএব এ ধরনের লোকদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভালো লোকদের সঙ্গ তালাশ করা উচিত।
  • অধিক কর্মহীন ও বেকার সময় হাতে থাকা। তাই দীন-দুনিয়ার উপকার হয়, এমন কাজে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখা উচিত। যাতে শয়তানি চিন্তা-ভাবনা আক্রমণ করতে না পারে।

মোট কথা, শরিয়তের হুকুম আহকাম ছেড়ে দেয়াই চরিত্রে দুর্বলতার সবচেয়ে বড় কারণ।

লজ্জাস্থান হেফাজতের সুফল :

  • চরিত্রবান ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
  • কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তাআলার ছায়ায় আশ্রয় লাভ।
  • ব্যক্তির পবিত্রতা তার পরিবার ও মাহরাম আত্মীয়দের পবিত্রতার কারণ। যে ব্যক্তি হারামে লিপ্ত হয়, তার নিজের ও পরিবারের ওপর যে কোনো সময় এর খারাপ পরিণতি নেমে আসতে পারে।
  • ধ্বংসাত্মক রোগ, ফ্যাসাদ, আপদ-বিপদ ও অনিষ্ট এবং এইডস ইত্যাদি মরণব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
  • সাধারণ ও বিশেষ শাস্তি এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে দূরে থাকার মাধ্যম পবিত্রতা হাসিল হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সব রকমের চারিত্রিক আবিলতা ও কলুষতা থেকে দূরে থাকার তাওফিক দিন। সকলকে পূত-চরিত্রের অধিকারী হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তি ও কামিয়াবি অর্জনের মাধ্যমে ধন্য করুন। আমিন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88