দল, ইমারত ও বায়আত সম্পর্কে উলামাগণের বক্তব্য (পর্ব ১০)

দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য (দশম পর্ব)

শায়খ ছালেহ ইবনে মুহাম্মাদ আল-লুহায়দান([1])

প্রশ্নঃ বর্তমান যুগে অনেক ইসলামী সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের ক্ষেত্রে মুসলিম যুবকদের ভুমিকা কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

উত্তরঃ ইসলামের প্রথম বালা-মুছীবতই ছিল মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি ও দলাদলি সৃষ্টির। কেননা সকল মুসলিম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরবর্তী দুই খলীফার যুগে এক জামা‘আতেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু উছমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর আমলে কিছু সংখ্যক লোক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় দূরীকরণের খোঁড়া অজুহাত দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে। আর এটিই ছিল ইসলামের প্রথম গোলযোগ, যার ফলে মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয় এবং ফিৎনা সৃষ্টিকারী দা‘ঈদের পথ উন্মুক্ত হয়।

সকল মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধভাবে হাতে হাত মিলিয়ে এক দল হয়ে থাকতে হবে। কোনো মুসলিমের জন্য কোনো দল, জামা‘আত বা সংগঠনে যোগ দেওয়া শোভনীয় নয়। এটিই হচ্ছে আল্লাহ নির্দেশিত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত সরল সঠিক পথ। এ সোজা পথ ছেড়ে এখানে সেখানে যোগ দেওয়ার অর্থই হলো নিজেকে এমন পথে পরিচালিত করা, যার শেষ গন্তব্য ধ্বংস বৈ কিছুই নয়। সেজন্য যুব সমাজের প্রতি আমার নছীহত হলো, তারা শর‘ঈ জ্ঞান অর্জন করবে এবং কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা হলে যোগ্য ও অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করবে।([2])

শায়খ রবী ইবনে হাদী আল-মাদখালী([3])

প্রশ্নঃ কেউ কেউ মনে করেন, সংগঠন ছাড়া সালাফী দা‘ওয়াত প্রসার লাভ সম্ভব নয়। আবার কেউ কেউ এ মতের বিরোধিতা করেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানিয়ে বাধিত করবেন?

উত্তরঃ সালাফে ছালেহীনের অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সার্বিক কল্যাণ। পক্ষান্তরে পরবর্তীদের সৃষ্ট বিদ‘আত অনুসরণের মধ্যে রয়েছে সার্বিক অকল্যাণ। সালাফে ছালেহীন দ্বীন প্রচার করেছেন এবং সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিতে একে অন্যকে সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব জয় করেছেন। তারা নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জিহাদ করেছেন এবং বিজয় লাভ করেছেন; কোনো সংগঠনের মাধ্যমে নয়। পরবর্তীতে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী আলেমগণ মসজিদে মসজিদে দারস প্রদানের মাধ্যমে শর‘ঈ জ্ঞানের পতাকা উত্তোলন করেছেন। এভাবে আলেম-উলামার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অনেক ছাত্র তৈরি হয়েছে, যারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ নির্দেশিত একক পথের উপর পরিচালিত হয়েছেন। ফলে তাঁদের প্রচেষ্টার ফলাফল এসব সংগঠনের চেয়ে অনেক গুণ ভাল প্রমাণিত হয়েছে; যেখানে আলেম-উলামা তৈরিতো দূরের কথা এসব সংগঠন একজন মানসম্পন্ন ছাত্রও তৈরি করতে পারেনি। আমরা এখানে শায়খ মুক্ববিলকে দৃষ্টান্ত হিসাবে উপস্থাপন করতে পারি, যিনি এসমস্ত সংগঠন ও কর্মপদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে তিনি ছাত্রদেরকে শর‘ঈ জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি ছাত্রদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছেন এবং এক ঝাঁক আলেম তৈরী করতে পেরেছেন, যারা নিজ নিজ দেশে ফিরে দা‘ওয়াতী কাজ করেছেন এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে একটি সুন্দর প্রজন্ম তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন।

পক্ষান্তরে সারা দুনিয়ায় ছড়ানো-ছিটানো প্রচলিত এসব সংগঠন আমাদেরকে কি উপহার দিয়েছে? কয়জন আলেম তৈরি করতে পেরেছে? কিছুই করতে পারেনি। অথচ এই দুর্বল ও নিঃস্ব মানুষটি ইখলাছ এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা দ্বারা এমন কিছু করতে সক্ষম হয়েছেন, যার ১০০ ভাগের এক ভাগও তারা করতে পারেনি। তারা পেরেছে শুধু দলাদলি ও বিভক্তি সৃষ্টি করতে। নিজ সংগঠনের কর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং অন্যদের সাথে শত্রুতা পোষণের মাধ্যমে কিছু কিছু দেশের সালাফীদেরকে টুকরো টুকরো করে ভাগ করতে পেরেছে। ইসলামকে বিপদগ্রস্ত করেছে, সালাফী পরিচয় দিয়ে সালাফী মূলনীতির বারোটা বাজিয়েছে এবং সালাফীদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, চাঁদা উঠিয়ে মুসলিমদের পকেট খালি করে তারা সূদান, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া , পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সালাফীদের উপর আক্রমণ করছে এবং বিভিন্ন উপায়ে সালাফী মূলনীতিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। মূলতঃ তারা শুধু ভালোভাবে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সালাফে ছালেহীনের আদর্শের উপর কাউকে গড়ে তুলতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং আমি আলেমদের উদ্দেশ্যে বলব, যাকে আল্লাহ দ্বীনের জ্ঞান দান করেছেন, সে কোনো মসজিদে সৎ ও দ্বীনি জ্ঞানার্জনে আগ্রহী ছাত্রদেরকে শিক্ষাদান করুন। আমি মনে করি, আপনারা যদি দশজন আলেম তৈরি করতে পারেন, তাহলে তা হাযার হাযার সংগঠন এবং তাদের তৈরি হাযার হাযার  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে বহুগুণে ভাল।([4])

 শায়খ মুহাম্মাদ আমান ইবনে আলী আল-জামী([5])

বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন ও দলে যোগদান সম্পর্কে বেশী বেশী প্রশ্ন হতে দেখা যায়। অবশ্য আমাদের যুবসমাজ যখন এ সমস্ত সংগঠনগুলির পক্ষে বিপক্ষে অবস্থানের ক্ষেত্রে গোলকধাঁধায় পড়বে, তখন তাদের এ বিষয়ে জানতে চাওয়ার অধিকার আছে। কারণ, এসব সংগঠন ও দলাদলি নবাবিষ্কৃত এবং বিদ‘আত। মূলতঃ বিভিন্ন জামা‘আত না থেকে একটিমাত্র জামা‘আত থাকবে। সেজন্য আমাদের সালাফে ছালেহীনের সময়ে এতোসব জামা‘আত ছিল না। বরং তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেখে যাওয়া একমাত্র জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পথের উপর রেখে যাচ্ছি। যে ব্যক্তি এ পথ থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হবে’।

স্বচ্ছ ও সরল এপথ কোনো দ্বীনের জ্ঞানপিপাসুর অজানা নয়। তবে যারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে গবেষণা করে না, সালাফে ছালেহীনের ইতিহাস জানে না এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনীত দ্বীনের মর্মার্থ উপলদ্ধি করে না, শুধুমাত্র তাদের নিকটই এপথ অস্পষ্ট। যে ব্যক্তির ইসলাম  সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আছে, প্রচলিত সংগঠনগুলি যে নবাবিষ্কৃত, সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে যার জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে, যে নিজের প্রবৃত্তির কাছে হার মেনেছে এবং বিহরাগত কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যার বিবেক-বুদ্ধি পরিবর্তন হয়েছে, শুধুমাত্র সে এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে পারে।([6])

 তথ্যসূত্র :

([1]) শায়খ ছালেহ আল-লুহায়দান একজন খ্যাতনামা আলেম। ১৩৫০ হিজরীতে কাছীমের বুকায়রিয়াহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৭৯ হিজরীতে রিয়াদে শারী‘আহ বিভাগে অনার্স শেষ করেন। এক সময় সঊদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতী মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীমের সেক্রেটারী হিসাবে কাজ করতেন। ১৩৮৩ হিজরীতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডেপুটি হিসাবে নিয়োগ পান। পররর্তীতে ১৩৮৪ হিজরীতে প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত হন। এমনিভাবে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদগুলি অলংকৃত করতে থাকেন। ১৩৯১ হিজরীতে সঊদী আরবের খ্যাতনামা আলেমগণের নিয়ে গঠিত সংস্থা ‘হায়আতু কিবারিল উলামা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তিনি এর সদস্য। রেডিও, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সহ দা‘ওয়াতী কাজে তাঁর ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। তিনি মসজিদে হারামে পাঠদান করতেন।

([2]) ‘ফাতাওয়াল উলামা ফিল জামা‘আত’ ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত, মিনহাজুস-সুন্নাহ রেকর্ডিং সেন্টার, রিয়াদ।

([3]) বিশিষ্ট আলেম ও মুহাদ্দিছ রবী ইবনে হাদী আল-মাদখালী ১৩৫১ হিজরীতে সঊদী আরবের ছামেতা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ শহরে এবং মদীনা মুনাওয়ারায় পড়াশুনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে ইবনে বায, আলবানী, আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ, মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীতী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে ১. মানহাজুল আম্বিয়া ফিদ-দা‘ওয়াহ ইলাল্লাহ, ২. মাকানাতু আহলিল হাদীছ, ৩. মাতা‘ইনু সাইয়্যেদ কুতুব ফী আছহাবি রাসূলিল্লাহ a ৪. জামা‘আহ ওয়াহেদাহ লা জামা‘আ-ত ওয়া ছিরাত ওয়াহেদ লা আশারা-ত প্রসিদ্ধ।

([4]) ‘সালাফিইয়াতুনা আক্বওয়া মিন সালাফিইয়াতিল আলবানী সংশয়ের জবাব’ ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত, আছালাহ রেকর্ডিং সেন্টার, জেদ্দা।

([5]) শায়খ মুহাম্মাদ আমান ১৩৪৯ হিজরীতে ইথিওপিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। শায়খ ইবনে বায তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ ১. আযওয়া আলা ত্বরীক্বিদ্‌-দা‘ওয়াহ ইলাল ইসলাম ২. আল-মুহাযারাহ আদ-দিফা‘ইয়াহ আনিস-সুন্নাতিল মুহাম্মাদিইয়াহ ৩. হাক্বীক্বাতুদ-দেমুক্বরাতিইয়াহ ওয়া আন্নাহা লায়সা মিনাল ইসলাম।

([6]) ‘আন্-নুছ্‌হু বিতারকিল জামা‘আত’ ক্যাসেট থেকে সংগৃহীত, আল-ইবানাহ আস-সাম্‌ইয়াহ রেকর্ডিং সেন্টার।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan