অপসংস্কৃতির বেড়াজালে বন্দী যুবসমাজ
রচনায়: বযলুর রহমান*
সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। আর সভ্যতা হ’ল সেই জাতির দেহ স্বরূপ। প্রাণহীন দেহ সত্তার যেমন কোন মূল্য নেই, দেহহীন আত্নাও তেমনি মূল্যহীন। তাই বলা যায়, সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনেকাংশে পরষ্পরের পরিপূরক। কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে আধুনিক বিশ্বের প্রতিযোগিতার ময়দানে একটি উন্নত জাতির রূপ পরিগ্রহ করার জন্য সংস্কৃতি চর্চা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সংস্কৃতিহীন জাতি প্রাণহীন জড় পদার্থের ন্যায়। যার কোন কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। কোন আত্না যদি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, তাহ’লে সে আত্না যেমন ধীরে ধীরে অপ্রত্যাশিত কিন্তু অপ্রতিরোধ্য গতিতে চিরস্থায়ী বাস্তবতা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, ঠিক তেমনি একটি জাতির আত্না নামক সংস্কৃতি যদি অপসংস্কৃতির মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহ’লে সে জাতিও ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে কিংবা অন্য জাতির উপনিবেশে পরিণত হবে।
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় দেশ। এ দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ একত্রে বসবাস করে। কিন্তু ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণেই স্বাভাবিকভাবে এদেশের গ্রহণীয় সংস্কৃতি ইসলামী ভাবধারার হওয়া উচিত। যার মূল সুর হ’ল তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। যার জন্য মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকৃতিগতভাবে আকাংখিত ও সেদিকেই ধাবমান। কিন্তু ইহুদী-খৃষ্টান ও ব্রাক্ষণ্যবাদীদের খুঁদ-কুড়া চাঁটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমনা কিছু বুদ্ধিজীবীদের প্রহরায় ইসলামী সংস্কৃতি হারিয়ে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের মূল থিম থেকে জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত। অন্যদিকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস দেশে সহজ-সরল মানুষদেরকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে ও সাক্ষাৎ ধ্বংসের মুখে নিপতিত করেছে।
তথাকথিত আধুনিকতা, আপসংস্কৃতি ও সভ্যতা নামের অন্ধকার বেড়াজালে বন্দি মুসলিম জাতি আজ হতাশাগ্রস্ত ও স্তম্ভিত। মুসলিম জাতি হারিয়েছে গৌরবান্বিত ঐতিহ্য, নি:শেষ হয়েছে তাদের উন্নত সংস্কৃতি। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী সাম্রাজ্যবাদ, ইহুদীবাদ ও ব্রাক্ষণ্যবাদী দর্শনের হিংস্র থাবা মুসলিম জাতির সামনে পুজিঁবাদের টোপ ফেলে ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীব বানানোর সুদূরপ্রসারী জালে আটকে ফেলেছে, তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিধ্বংসি হুংকার মুসলিম জাতিকে করেছে পর্যুদস্ত, নির্লিপ্ত ও পরনির্ভরশীল। পুজিঁবাদের ব্যাঘ্র হুংকারে পরনির্ভরশীল বা ঋণের জালে আটকে পড়ে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি বিশ্ব শকুনদের হাতে বন্দী হয়েছে। তেমনি সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ঈর্ষান্বিত গৌরব, ঐতিহ্য ও নির্মল চরিত্র হয়েছে কলুষিত। ডা: লুৎফর রহমান বলেছেন যে, ‘কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে সে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আগে ধ্বংস কর’। অন্যদিকে ইহুদী পণ্ডিতদের প্রোটকলে লেখা রয়েছে, ‘সর্বত্র আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈতিক চরিত্রে ব্যাপক ভাঙ্গন ও বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে’ (সাইয়িদ কুতুব, বিংশ শতাব্দীর জাহেলিয়াত, অনুবাদ: মাওলানা আব্দুর রহীম (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০২), পৃ: ২৩২)।তাইতো প্রগতিবাদীরা মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করার জন্য তাদের উন্নত সংস্কৃতি ও নৈতিক চরিত্রে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য ধীর অথচ দৃঢ়ভাবে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। তাদের এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংস্কৃতির নোংরা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে কিছু মুসলিম নামধারী এদেশীয় দোসর, তল্পিবাহক ও ক্রীড়নকদের। যা আমরা বিভিন্ন লেখকের লেখায় দেখতে পাই। শমসুর রহমান তার কবিতায় মুয়াযযিনের আযানের ধ্বনীকে বেশ্যাদের খদ্দের আহবানের সমতুল্য বলেছেন (নাউযুবিল্লাহ্) (হারুনুর রশীদ, খোলা চিঠি (ঢাকা: ইতিহাস পরিষদ, জুন ১৯৯৩) পৃ: ৯) । দাউদ হায়দার তার ‘চোখেমুখে রাজনীতি’ নামক কবিতায় ‘মুহাম্মাদ তুখোড় বদমাইশ’ বলেছেন। (ঐ)। তাহাজ্জুদের ছালাত পড়ার কারণে তসলীমা নাসরিন তার আপন গর্ভধারিণী মাকেও কঠোর ভাষায় গালাগালি করেন (ঐ)। উপরোক্ত প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বলা যায় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিবাদীদের সংস্কৃতির নামে মুসলিম আক্বীদা-বিরোধী ও চরিত্রহননকারী অপসংস্কৃতির মায়াজালে বন্দী হয়ে মুসলিম সংস্কৃতি তার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। কিন্তু হতভাগা মুসলিম জাতির এখনও নিদ্রা ভাঙ্গেনি।
বলাবাহুল্য, সাম্প্রতি পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ থিংকট্যান্কের (২০০৭) দেড়শতাধিক পৃষ্ঠার রিপোর্ট অসুসারে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পার্টনার মুসলমানদের মধ্যে চারটি দলের নাম উল্লেখ করে শেষে তাদের পোষ্য কিছু মুসলিম নামধারী লোকদের নামের তালিকা প্রদান করা হয়েছে। যারা তাদের মতে অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আহ্বান করে। আহ্বানকারী হিসাবে যে বার (১২) জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে তসলীমা নাসরিন, সালমান রুশদী, মরিয়ম নামাজী, মেহেদী মুযাফফরী, আইয়ান হিরসী আলী প্রমুখ রয়েছে (সম্পাদকীয়, মাসিক আত–তাহরীক, ১২ তম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৮)। মানুষের জীবন সূচী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময় হল যৌবন (১৬-৪০) কাল। আর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুবক। সত্তর দশক থেকে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের যুবসমাজের জ্যামিতিক অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে ২৩.১৯%; ১৯৭৩ সালে ২০.০০%; ১৯৮১ সালে ২৪.৫০% এবং ১৯৯১ সালে ৩০.২০% যুবক ছিল যাদের বয়স ১৬-৪০ বছরের মধ্যে। (তরুণ তোমার জন্য (ওয়ামী মে ২০০৪), পৃ: ৫৯) বর্তমানে বাংলাদেশে যুবকদের সংখ্যা প্রায় ৩৬ মিলিয়ন। যার মধ্যে ২৬ মিলিয়ন গ্রামে বাস করে এবং ১০ মিলিয়ন শহরে বাস করে। এদেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ১২ মিলিয়ন। আর শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা ২২ মিলিয়ন। বর্তমানে যুবকদের মধ্যে ৭৮.২৫% যুবক দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে (ঐ)। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যুবক ৬০% এবং যুবতী ৫০% নেশাগ্রস্ত। শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক জরিপ রিপোর্ট অনৃযায়ী দেখা যায়, নেশাগ্রস্ত ও অবৈধ চোরাচালান ব্যবসার সাথে জড়িত শতকরা ৯০ জন তরুন-তরুণী, বস্তিবাসী ও কর্মসংস্থানহীন।
উপরোক্ত চিত্র থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহদাংশ আজ অপসংস্কৃতির মরণ থাবার খোরাকে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন পরিবার, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পিতা-মাতার অসচেতনতা, সমাজ সংস্কার মুক্ত চিন্তাধারা, দারিদ্রের হিংস্র ছোবল, খাম-খেয়ালিপনা সবোর্পরি বিদেশী অপসংস্কৃতি উক্ত করুণ পরিণতির জন্য মূলত দায়ী।
আজ দেশের দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দেখা যায় যে, বিভিন্ন স্থানে খুন-রাহাজানী. ধর্ষণ-চাঁদাবাজী, সন্ত্রাস, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে। পুত্রের হাতে পিতা নৃশংস ও নির্মম মৃত্যুর শিকার হচ্ছে, প্রেমের মোহে কঠিন ভালবাসার আবেগে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ও যৌতুকের ফাঁদে আটকে পড়ে; পরকীয়া প্রেমের হিংস্র ছোবলে দংশিতা যুবতীর লাশ বার বার আঘাত হানে বিবেকের দরজায়; এ্যাকশনী ফিল্মের প্রভাবে আজ ছোট্ট শিশু প্রাণ হারাচ্ছে তারই বন্ধুদের হাতে। সারারাত উপর্যুপরী ধর্ষনের শিকার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অসাবধান রমণী। স্বামীর সামনে সন্ত্রাসীরা সারারাত পালাক্রমে ধর্ষণ করে হত্যা করছে গার্মেন্টস যুবতীকে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এসিড নিক্ষেপে ঝলসে দিচ্ছে তরুণীর মিষ্টি চেহারা। এরকম হাযারো সন্ত্রাস চলছে দেশে। তাছাড়া সন্ত্রাসের জয়জয়কার চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাও। সেখানে দলীয়করণ ও শিক্ষা বাণিজ্যকরণের মাধ্যমে পরস্পর সংর্ঘষে মৃত লাশ হয়ে ফিরছে অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানকেন্দ্রে ছাত্রীরাও জড়িয়ে পড়ছে নেশার জগতে। আর নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য হিসেবে বেছে নিচ্ছে পতিতাবৃত্তিকে। যুবসমাজের অবক্ষয়ের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ আর কি হ’তে পারে?
উপরোক্ত পরিস্থিতি অবলোকন করে একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি সত্যিই তার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেশ এখন ক্রমান্বয়ে রসাতলে যাচ্ছে। ফলে বিবেক পরাহত, চিন্তাশক্তি নিষ্ক্রিয়, পরিবেশ দূষিত, মানবতা স্তম্ভিত। সবোর্পরি দেশের আপামর জনসাধারণ অপসংস্কৃতির অক্টোপাশে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে এখন সত্যের আমোঘ বাণী হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় টিভি চ্যানেল, স্যাটেলাইট, টেলিফোন, মোবাইল প্রভৃতি সহ ইন্টারনেট, কম্পিউটারের মত বিস্ময়কর আবিষ্কার বর্তমান আধুনিকতা ও সভ্যতার জীয়ন কাঠিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। যার নেগেটিভ ও পজেটিভ দু’টি দিকই রয়েছে। আধুনিকতার উৎসাহে ও সংস্কৃতির উদ্দীপনায় অধিকাংশ যুবক নেগেটিভ বা খারাপ দিক সমূহ পিপাসার্ত পাখির ন্যায় গোগ্রাসে গিলছে প্রতিনিয়ত। যার কারণে সাক্ষাৎ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে যুবসমাজ আর বিলীন হয়ে যাচ্ছে জাতির শক্তি ও নিজস্ব সংস্কৃতি।
আজকাল রাস্তা-ঘাটে, শহর-বন্দরে, বাসে-ট্রেনে, লঞ্চ-স্টীমারে আরোহণ করলেই কানে ভেসে আসে নোংরা ও অশ্লীল গান-বাজনার আওয়ায। তরুণ-তরুণীদের হাতে শোভা পাচ্ছে বিকট আওয়াযের গানের রেকর্ডধারী মোবাইল। পিতা-মাতার অগোচরে সন্তানরা গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইলের মাধ্যমে প্রেমের আলাপচারিতা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অশ্লীল ছায়াছবি ও ব্লু ফিল্মের নগ্ন ছবি দর্শনে জীবনপাত করছে।
তরুণ সমাজ কেন আজ এ পথে? কেন দৃঢ়চিত্ত সত্ত্বেও আদর্শ পথ থেকে তারা পদস্খলিত? কেন যৌবনের শক্তিমত্তা আজ অন্যায়-অপরাধমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে? কে এর জন্য দায়ী? কারা এদের পিছনে মদদ দিচ্ছে? কে তাদের লালন করছে? কী তাদের পরিচয়? তাদের শক্তি কি?
সাম্রাজ্যবাদ-ইহুদীবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের চালু করা মুসলিম আক্বীদা ও আখলাক বিরোধী সংস্কৃতির নামে হাযারো অপসংস্কৃতির শৃঙ্খলে বন্দী দেশের যুবসমাজ।
মূর্তি ও ভাস্কর্য সংস্কৃতি:
মূর্তি ও ভাস্কর্য মূলত: বর্বরতা ও অন্ধকার যুগের একটি বস্তাপচা সংস্কৃতি। যার ধারাবাহিকতা আধুনিকতার চমকে ডিজিটাল সেক্যুলারবাদীদের মাঝে প্রতক্ষ্য ও সুদঢ়ভাবে বিদ্যমান। মূর্তি ও ভাস্কর্যের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। তৎকালীন সময়ে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ হ’ত পাথর, মাটি বা কোন ধাতব বস্তু খোদাই করে। বর্তমানে উল্লেখিত উপাদান ছাড়াও আধুনিক নানা ধরনের রঙ্গিন উপাদান দিয়ে তৈরী হচ্ছে। সে যুগে মূর্তি ও ভাস্কর্য তৈরি করা হ’ত উপসনা, আরাধনা করতে। নযর-নেয়াজ পেশ করে, মনের আকাঙ্খিত বিষয় চাইতে। বর্তমানে এ সমস্ত কাযাবলীর চেয়ে আরও ভ্ন্নি ধরনের কাজ করে থাকে। যা দেখে শুধুই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আর এ সমস্ত কাজের শীর্ষে রয়েছে দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। আর এই শিরকের মত জঘন্য অপরাধমূলক কাজে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের যুবসমাজ। অথচ তা সম্পূর্ণ কুআন ও ছহীহ সুন্নাহ বিরোধী। ইসলাম এ ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য ও মর্মন্তুদ শাস্তির কথা বর্ণনা করেছে। ছবি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার জন্য কঠো নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ছা:) আলী (রা:) –কে বলেন, ‘যখনই কোন মূর্তি দেখবে, তা ভেঙ্গে টুকরো না করে ছাড়বে না’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৯৬)। মা আয়েশা (রা:) বলেন, রাসূল (ছা:) স্বীয় গৃহে প্রাণীর ছবিযুক্ত কোন জিনিসই রাখতেন না। দেখলেই ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিতেন (বুখারী, মিশকাত হা/ ৪৪৯১; ঐ বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/ ৪২৯২)। আর মূর্তি নির্মাণ ও তাকে সন্মান ও ভক্তি শ্রদ্ধা করা জঘন্যতম শিরক। আর শিরকের গুনাহ্ আল্লাহ্ কখনও ক্ষমা করেন না (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। পরিতাপের বিষয় হ’ল, পূর্বযুগের মূর্তিপূজারীদের ন্যায় বর্তমানে কিছু নামধারী সেক্যুলার মুসলমান কর্তৃক মূর্তি, ভাস্কর্য বা মৃত ব্যক্তির স্মরণে পাথর নির্মিত পিলারের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে সন্মান প্রদর্শন করাতে যেমন অপসংস্কৃতির বিজয় সাধিত হচ্ছে, তেমনি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের কারণে হাযার হাযার টাকা ব্যয় হচ্ছে। যা দিয়ে দুর্দশা দূর হ’ত বহু গরীব পরিবারের।
ভ্যালেন্টাইন সংস্কৃতি:
ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালবাসা দিবস পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। যা উদ্দাম নৃত্য, সীমাহীন আনন্দ-উল্লাস, তরুণ-তরুণীদের উষ্ণ আলিঙ্গন, আর জমকালো নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়। বস্ত্রহীন দেহ, অসুস্থ মানসিকতা আর যৌন উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ের নগ্ন দৃশ্যাবলীর বহি:প্রকাশ পরের দিন দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রথম পৃষ্ঠায় ঘটা করে প্রকাশ করা হয়। যেন বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে এটাই দেশীয় সংস্কৃতি।
‘ডে’ বা দিবস সংস্কৃতি:
তথ্য-প্রযুক্তির ও বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ তার প্রিয় দিন, স্মরণীয় ঘটনা, মৃত্যুদিন, জন্মদিন ইত্যাদি স্মরণীয় করে রাখার জন্য মহা ধুমধাম আর জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যার অনেক কিছু রাষ্ট্রীয় খরচে পালিত হয়। এভাবে সুবর্ণজয়ন্তী, রজত জয়ন্তী, ঢাকা দিবস, মা দিবস, নারী দিবস, পোলিও দিবস, ক্যান্সার দিবস প্রভৃতি দিবস আর দিবস। মনে হয় যেন দিবসীয় সংস্কৃতির ভারে বিশ্বের ছোট্ট ব-দ্বীপটি ভারাক্রান্ত। আর এই দিবস পালন করার জন্য লাখ-লাখ টাকা ব্যয়িত হচ্ছে, যা দেশের সাধারণ নিকট থেকে ট্যাক্সের নামে আদায় করা হয়! এমনকি এ দিন সরকারী ছুটিও ঘোষণা করা হয়। যেখানে একদিন উৎপাদন কারখানা বন্ধ থাকলে কোটি কোটি টাকা লোকসান হয় সেখানে অপ্রয়োজনীয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বাস্তবায়েনেও বিশ্ব মোড়লদের সন্তষ্টি কামনার্থে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দিপনায় পালিত হচ্ছে ঐসব অনুষ্ঠান। যার চুড়ান্ত খোরাকে পরিণত হয়েছে দেশের যুবশক্তি। অপরপক্ষে ইসলামে দিবস পালন করার কোন স্থান নেই। অতএব মুসলিম হিসাবে নিজের আস্তিত্ব বজায় রাখতে ইসলামী জীবন-যাপন করা আশু যরূরী।
ফ্যাশন ও বিজ্ঞাপন সংস্কৃতি:
বিংশ শতাব্দির শেষের দশক থেকে মডেলিং, ফ্যাশন ও বিজ্ঞাপন সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটে। দেশে চলমান সরকারী ও বে-সরকারী টিভি চ্যানেলগুলোতে যে সমস্ত বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় তা দেশের কোমলমতি ও উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের হৃদয়-মনকে আকর্ষন করছে। একজন মহিলার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হ’ল তাঁর ইযযত-আবরু। অথচ তাকে উপজীব্য করে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা সংস্থা মহিলাদের নগ্ন-অর্ধনগ্ন করে জনসম্মুখে উপস্থাপন করছে। যাতে যুবচরিত্র ধ্বংস হচ্ছে, জড়িয়ে পড়ছে নানা অশ্লীলতায়।
উপসংহার:
লর্ড মেকলে ১৯৩৬ সালে বলেছিলেন, We must at present do our best to form a class, who may be interpriters between us and millions. Whom we govern a class of persons. Indian in blood and colour, but English in taste, in openion, in moral and in intellect. ‘বর্তমানে আমাদের সর্বাধিক প্রচেষ্টা হবে, এমন একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করা, যারা আমাদের ও আমাদের লক্ষ লক্ষ প্রচার মধ্যে দূত হিসাবে কাজ করতে পারে। এরা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়। কিন্তু মেযাজে, মতামতে, নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ’।
বর্তমান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে আমরা যেন সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ হ’তে হবে। হে যুবক! তুমি কি জান? তুমি কোন জাতির বংশধর? তুমি কি জান পৃথিবীর মানচিত্রে প্রথম আর্কিটেক্ট কে? ইউরোপের গর্বিত বিজ্ঞান ও সভ্যতার উৎকর্ষতার পিছেনে কাদের অবদান? আধুনিক চিকিৎসার প্রথম আবিষ্কারক কোন বংশধরের মানুষ ছিলেন? তারা তো আর কেউ নয়, তারা হ’ল মুসলিম জাতি। সে জাতির মাঝে আবু বকর (রা:) –এর মতো যেমন ন্যায়পরায়ণ মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল, তেমনি ভারতগুরু শাহ ওলীউল্লাহ ও ২২২ খানা গ্রন্থের প্রণেতা নওয়াব ছ্দ্দিীক্ব হাসান খান ভূপালী (রহ:) –এর মতো জন্ম হয়েছে তোমরই বংশে! যে জাতির আঙ্গুলি হেলনে প্রবল পরাক্রান্ত রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের রাজ মুকুট খসে গেছে। সেই একই জাতির মধ্যে ইমাম আবূ হানীফ, ইমাম বুখারী, মুসলিমের মত শত সহস্র ও ফক্বীহ মুহাদ্দিছ জন্ম হয়েছিল।
হে যুবক! তুমি কি জান! তোমার শরীরে মহাবীর ওমর, আলী, হামযা, খালিদ বিন ওয়ালীদ, তারিক বিন যিয়াদ, মূসা বিন নুসায়ের, মুহাম্মাদ বিন কাসিম, ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর আপোষহীন তেজদীপ্ত খুন প্রবাহিত! তাহ’লে তুমি কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
এরূপ ঈর্ষান্বিত ক্ষমতা, গৌরবান্বিত ঐতিহ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানরে দিগ্বিজয়ী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কেন ইসলামী সংস্কৃতি থেকে অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনে নিজেকে নিক্ষেপ করেছ? কেন আজ ইহুদী ও ব্রাক্ষবাদীদের ক্রীড়নক হয়ে তাদের গোলামে পরিণত হয়েছ? এর জবাব কে দিবে হে মুসলিম জাতির অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিহত শক্তির অধিকারী! তুমি না আল্লাহর বান্দা, তাঁরই গোলাম, তুমি না দুনিয়া কাঁপানো শ্লোগান ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্’ স্বীকৃতিদাতা মুসলমান? তাহ’লে কেন তোমার এই বেহাল দশা?
অতএব হে অবুঝ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিমনা ভাই ও বোনেরা! সময় থাকতে সময়ের মূল্যায়ন কর। যাবতীয় অপসংস্কৃতির বেড়াজাল মুক্ত হয়ে এগিয়ে চল জান্নাতের পানে। জান্নাতুল ফেরদাউস তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হে যুবক! তোমার প্রতি ফোঁটা রক্ত আল্লাহর দেয়া পবিত্র আমানত। আর তা ব্যয় করতে হবে নির্ভেজাল তাওহীদের পথে। গৌরবান্বিত ঐতিহ্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও স্থায়িত্ব দেওয়ার মানসে সর্বোপরি পরকালীন মুক্তির স্বার্থে দল-মত ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় আবারও দৃঢ় পদক্ষেপ অতি সন্তর্পণে সামনে অগ্রসর হই। তাহ’লে দেশ থেকে অপসংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হবে। মুসলিম সংস্কৃতি জাগ্রত হবে। ইসলামী ঐতিহ্য ফিরে আসবে। যদি যুবসমাজ তাদের তেজদীপ্ত শক্তিমত্তা কাজে লাগায়, তাহ’লে ইসলামী খেলাফতের পথ সুগম হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন- আমীন!!
*ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: পুরনো তাহরীক