সলাতে মুবাশ্শির (পর্ব ১৮)
লেখক : আবদুল হামীদ ফাইযী
সুতরাহ্
নামাযীর সামনে বেয়ে কেউ পার হবে না এমন ধারণা থাকলেও সামনে সুতরাহ্ রেখে নামায পড়া ওয়াজেব। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮২পৃ:) যেমন সফরে, বাড়িতে, মসজিদে,হারামের মসজিদদ্বয়ে সর্বস্থানে একাকী ও ইমামের জন্য সুতরাহ্ ব্যবহার করা জরুরী।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সুতরাহ্ ছাড়া নামায পড়ো না।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮০০ নং)
“যে ব্যক্তি সক্ষম হয় যে, তার ও তার কিবলার মাঝে কেউ যেন না আসে, তাহলে সে যেন তা করে।” (আহমাদ, মুসনাদ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ত্বাবারানী, মু’জাম)
“যখন তোমাদের কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ্ রেখে নামায পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫০, ৬৫১ নং)
পক্ষান্তরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর বিনা সুতরায় নামায পড়ার হাদীস যয়ীফ।
সুতরাহ্ বলে কোন কিছুর আড়ালকে। নামাযী যখন নামায পড়ে তখন তার হৃদয় জোড়া থাকে সৃষ্টিকর্তা মা’বূদ আল্লাহর সাথে। বিচ্ছিন্ন থাকে পার্থিব সকল প্রকার কর্ম ও চিন্তা থেকে। ইবাদত করা অবস্থায় সে যেন মা’বূদ আল্লাহকে দেখতে পায়। কিন্তু তার সম্মুখে যখন এমন কোন ব্যক্তি বা পশু এসে উপস্থিত হয়, যে তার একাগ্রতা ও ধ্যান ভঙ্গ করে দেয়, মনোযোগ কেড়ে নেয়, দৃষ্টি চুরি করে ফেলে এবং কোন ভয় বা কামনা তার মনে জায়গা নিয়ে তাকে আল্লাহর দরবার হতে সরিয়ে পার্থিব জগতে ফিরিয়ে দেয়, তখন তার জন্য জরুরী এমন এক আড়াল ও অন্তরালের, যার ফলে সে নিজের দৃষ্টি ও মনকে তার ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। আর তার পশ্চাতে কোন কিছু অতিক্রম করলেও সে তা ভ্রুক্ষেপ না করতে পারে।
সুতরাং সুতরাহ্ রেখে নামায না পড়া গুনাহর কাজ। পরন্তু ঐ অবস্থায় নামাযীর সম্মুখ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে তার নামাযের সওয়াব কম হয়ে যায়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫৮৪)
সুতরাহ্ কিসের হবে?
আল্লাহর রসূল (সাঃ) কর্তৃক বিভিন্ন প্রকার সুতরাহ্ প্রমাণিত। যেমন, কখনো তিনি মসজিদের থামকে সামনে করে নামায পড়তেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮২পৃ:) ফাঁকা ময়দানে নামায পড়লে এবং আড়াল করার জন্য কিছু না পেলে সামনে বর্শা গেড়ে নিতেন। আর লোকেরা তাঁর পিছনে বিনা সুতরায় নামায পড়ত। (বুখারী ৪৯৪, ৪৯৮নং, মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, সুনান) কখনো বা নিজের সওয়ারী উটকে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে তাকে সুতরাহ্ বানিয়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৫০৭ নং, আহমাদ, মুসনাদ) কখনো জিনপোশ (উটের পিঠে বসবার আসন) কে সামনে রেখে তার কাষ্ঠাংশের সোজাসুজি নামায পড়তেন। (বুখারী ৫০৭নং, মুসলিম, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, আহমাদ, মুসনাদ) তিনি বলতেন, “তোমাদের কেউ যখন তার সামনে জিনপোশের শেষে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত কিছু রেখে নেয়, তখন তার উচিত, (তার পশ্চাতে) নামায পড়া এবং এরপর তার সম্মুখ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে কোন পরোয়া না করা।” (মুসলিম, সহীহ ৪৯৯ নং, আবূদাঊদ, সুনান) একদা তিনি একটি গাছকে সুতরাহ্ বানিয়ে নামায পড়েছেন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) কখনো তিনি আয়েশা (রাঃ) এর খাটকে সামনে করে নামায পড়েছেন। আর ঐ সময় আয়েশা (রাঃ) তার উপর চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতেন। (বুখারী ৫১১ নং, মুসলিম, সহীহ)
সুফয়্যান বিন উয়াইনাহ্ বলেন, তিনি শারীককে কোন ফরয নামায পড়ার সময় তাঁর টুপীকে সামনে রেখে সুতরাহ্ বানাতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৯১নং)
প্রকাশ যে, কিছু না পেলে দাগ টেনে নেওয়ার হাদীস সহীহ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৩৪, যইফ ইবনে মাজাহ্, সুনান ১৯৬, ৯৪৩, যইফ জামে ৫৬৯নং)
সুতরাহ্ হবে উটের পিঠে স্থাপিত জিনপোশের পেছনে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত (কম-বেশী একহাত, আধ মিটার বা ৪৭ সেমি. উঁচু) কোন বস্তু । কোন দাগ সুতরাহ্ বলে গণ্য হবে না। তবে যে বস্তু মাটি বা মুসাল্লা থেকে একটুও উঁচু হয়ে থাকে তাকেই সুতরাহ্ বলে ধরে নেওয়া যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৮৪)
প্রকাশ যে, মুসাল্লা, চাটাই বা কার্পেটের শেষ প্রান্তকে সুতরাহ্ বলে গণ্য করা যাবে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৭)
সুতরাহ্ কতদূরে রাখতে হবে?
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামায পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ্ রেখে নামায পড়ে এবং তার নিকটবর্তী হয়। যাতে শয়তান যেন তার নামাযকে নষ্ট করে না দিতে পারে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫০নং)
একদা তিনি কা’বা শরীফের ভিতরে নামায পড়লে তাঁর ও দেওয়ালের মাঝে ৩ হাত ব্যবধান ছিল। (বুখারী ৫০৬, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান) তাঁর মুসাল্লা (সিজদার জায়গা) ও দেওয়ালের মাঝে একটি ছাগল (অথবা ভেঁড়া) পার হয়ে যাওয়ার মত (প্রায় আধহাত) ফাঁক বা দূরত্ব থাকত। (বুখারী ৪৯৬নং, মুসলিম, সহীহ)
প্রকাশ থাকে যে, সুতরার একেবারে সোজাসুজি না দাঁড়িয়ে তার একটু ডানে বা বামে সরে দাঁড়ানোর হাদীস শুদ্ধ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৩৬নং)
ইমামের সুতরাই মুক্তাদীদের সুতরাহ্
ইমামের সামনে সুতরাহ্ থাকলে মুক্তাদীদের জন্য পৃথক সুতরার দরকার হয় না। মহানবী (সাঃ) ঈদের দিন নামায পড়তে বের হলে তাঁর সামনে বর্শা গাড়া হত। তিনি তা সুতরাহ্ বানিয়ে নামায পড়তেন এবং লোকেরা তাঁর পশ্চাতে (বিনা সুতরায়) নামায পড়ত। (বুখারী ৪৯৪, মুসলিম, সহীহ ৫০১নং)
একদা তিনি বাত্বহায় নামায পড়লেন। তাঁর সামনে (সুতরাহ্) ছিল ছোট একটি বর্শা। আর তাঁর সম্মুখ বেয়ে মহিলা ও গাধা পার হয়ে যাচ্ছিল। (বুখারী ৪৯৫নং, মুসলিম, সহীহ ২৫২নং)
বিদায়ী হ্জ্জের সময় মহানবী (সাঃ) মিনায় নামায পড়ছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) একটি গাধীর পিঠে চড়ে কিছু কাতারের সামনে বেয়ে পার হয়ে এসে নামলেন। অতঃপর গাধীটিকে চরতে ছেড়ে দিয়ে কাতারে শামিল হলেন। তা দেখে কেউ তাঁর প্রতিবাদ করল না। (বুখারী ৪৯৩, মুসলিম, মিশকাত ৭৮০নং)
নামাযীর সামনে বেয়ে পার হওয়া হারাম
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে নামাযীর সামনে বেয়ে পার হয়, সে যদি জানত যে, এতে তার কত পাপ হবে, তাহলে সে ৪০ (বছর বা মাস বা দিন নামাযীর সালাম ফিরার) অপেক্ষা করাকে ভাল মনে করত, তবুও নামাযীর সামনে বেয়ে অতিক্রম করত না।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৭৬ নং)
অবশ্য নামাযীর সামনে সুতরা থাকলে পার হওয়া হারাম বা গুনাহর কাজ নয়। অনুরুপ সুতরাহ্ না থাকলেও যদি নামাযীর সামনে প্রায় ৩ হাত দূর থেকে পার হয়, তাহলেও গুনাহ হবে না। (মাজমূ’ ফাতাওয়া, ইবনে বায ২/২৬৭)
কেউ সামনে বেয়ে পার হলে নামাযীর কর্তব্য
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ সামনে সুতরাহ্ রেখে নামায পড়লে এবং কেউ তার ঐ সুতরার ভিতর দিয়ে পার হতে চাইলে সে যেন তার বুকে ঠেলে পার হতে বাধা দেয় ও যথাসম্ভব রুখতে চেষ্টা করে।” এক বর্ণনায় আছে, “তাকে যেন দু’ দু’ বার বাধা দেয়। এর পরেও যদি সে মানতে না চায় (এবং ঐ দিকেই পার হতেই চায়) তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ, (বাধাদান সত্ত্বেও যে বাধা মানে না) সে তো শয়তান।” (বুখারী, মুসলিম,ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, মিশকাত ৭৭৭নং)
তিনি বলেন, “সুতরাহ্ ছাড়া নামায পড়ো না। কাউকে তোমার সামনে বেয়ে পার হতেও দিও না। (সুতরার ভিতর বেয়ে যেতে) সে যদি মানা না মানে, তবে তার সাথে লড়। কারণ, তার সাথে শয়তান আছে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮০০নং)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) জুমআর দিন একটি থামকে সুতরাহ্ করে নামায পড়ছিলেন। ইত্যবসরে বানী উমাইয়ার এক ব্যক্তি তাঁর ও থামের মাঝ বেয়ে পার হতে গেলে তিনি তাকে বাধা দিলেন। কিন্তু লোকটি পুনরায় পার হওয়ার চে ষ্টা করল। তিনি তার বুকে এক থাপ্পড় দিলেন। লোকটি মদীনার গভর্নর মারওয়ানের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানাল। মারওয়ান আবূ সাঈদ (রাঃ) কে বললেন, ‘আপনি আপনার ভাইপোকে মেরেছেন কি কারণে?’ আবূ সাঈদ (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কিছুকে সুতরাহ্ বানিয়ে নামায পড়ে, অতঃপর কেউ তার ঐ সুতরার ভিতর দিয়ে পার হতে চায়, তবে সে যেন তাকে বাধা দেয়। এতেও যদি সে না মানে, তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ, সে তো শয়তান।” সুতরাং আমি শয়তানকেই তো মেরেছি!’ (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮১৭নং)
শুধু মানুষই নয়, কোন পশুও সামনে বেয়ে পার হতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া উচিত। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (সাঃ) নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একটি ছাগল (বা ভেঁড়া) তাঁর সামনে দিয়ে ছুটে পার হতে চাইল। কিন্তু তিনি তার আগেই তাকে ধরে ফেললেন। এমনকি তার পেটকে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর ছাগল (বা ভেঁড়া)টি তাঁর পিছন দিক হতে পার হয়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৭০৮-৭০৯, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮২৭নং, ত্বাবা,হাকেম, মুস্তাদরাক)
সুতরাং বাধা দেওয়া ওয়াজেব এবং তাতে একটু নড়া-সরা দূষণীয় নয়।
বিনা সুতরায় নামায বাতিল কখন?
সুতরা রেখে নামায পড়লে এবং তার পশ্চাৎ বেয়ে কেউপার হয়ে গেলে নামাযীর নামাযে কোন ক্ষতি হয় না। (বুখারী ৪৯৯, মুসলিম, সহীহ ২৫২নং)
সুতরার ভিতর দিয়েও কোন পুরুষ, শিশু বা পশু পার হয়ে গেলে নামাযীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে ঠিকই, তবে নামায একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না। পরন্তু বিনা সুতরায় নামায পড়লে এবং সামনে দিয়ে সাবালিকা মেয়ে, গাধা বা মিশমিশে কালো কুকুর পার হয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যায়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “(সুতরাহ্ না হলে) সাবালিকা মেয়ে, গাধা ও কালো কুকুর নামায নষ্ট করে ফেলে।” আবূ যার বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! হ্লুদ ও লাল না হয়ে কালো কুকুরেই নামায নষ্ট করে তার কারণ কি?’ বললেন, “কারণ, কালো কুকুর শয়তান।” (মুসলিম, সহীহ ৫১০,আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ)
নাবালিকা মেয়ে অতিক্রম করলে নামায নষ্ট হয় না। একদা বানী আব্দুল মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে তাঁর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। আর এতে তিনি নামায ভাঙ্গলেন না। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, নাসাঈ, সুনান ৭২৭নং)
যেমন নিজের স্ত্রী বা কোন মহিলা নামাযীর সামনে ঢাকা নিয়ে অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। আল্লাহর রসূল (সাঃ) রাত্রে তাহাজ্জুদ পড়তেন, আর আয়েশা (রাঃ) তাঁর সামনে জানাযার লাশের মত শুয়ে ঘুমাতেন। (বুখারী ৫০৮, মুসলিম, সহীহ ৫১২, মিশকাত ৭৭৯নং) যেমন তিনি কখনো কখনো চাদরের ভিতর থেকে পায়ের দিকে চুপে চুপে নিজের প্রয়োজনে বের হয়ে যেতেন। এতেও তাঁর নামাযের কোন ক্ষতি হ্তো না। (ঐ) এক বর্ণনায় আছে, ‘তখন ঘরে বাতি ছিল না।’ (বুখারী ৫১৩, মুসলিম, সহীহ ৫১২নং)
প্রকাশ যে, কোন মহিলা-নামাযীর সামনে বেয়ে (বিনা সুতরায়) কোন (সাবালিকা) মেয়ে পার হলেও নামায নষ্ট হয় না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২৩৫৬ নং, মুহাল্লা ৪/১২, ২০)