মৃত ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ করা নাজায়েয ও বিদ’আত

ইতিপূর্বে ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের করণীয়সমূহ শিরোনামে যেসব করণীয় উপস্থাপন করা হয়েছে তা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা পর্যন্ত জীবিতদের করণীয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর সুন্নাত। এসব সুন্নাত ছাড়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর থেকে দাফন করা ও দাফনোত্তর যতসব কাজ বিভিন্ন এলাকা ওঅঞ্চল ভিত্তিক কালক্রমে নতুন নতুন উদ্ভাবিত হয়েছে তা সবই বিদ’আত ও নাজায়েয ।

যেমন:

  1. মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত কামনার নামে তাহলীল পড়ানো,
  2. কুরআন খতম পড়ানো মত ব্যক্তির চার পাশে বসে কুরআন পাঠ করা
  3. গোসলের জন্য গরম পানি দেওয়ার জন্য পাক ঘরের চুলা বাদ দিয়ে বাইরে চুলা করেগরম পানি দেয়া
  4. মৃত ব্যক্তিকে যেখানে গোসল দেওয়া হয় সে স্থান ৪দিন কিংবা ৪০দিন পর্যন্ত বেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করা এবং রাতের বেলায় সেখানে মোম‌, হ্যারিকেন বা বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে আলোকিত করে রাখা,
  5. জানাযা নিয়ে যাওয়ার সময় আল্লাহু রাব্বী, মুহাম্মাদুন নবী কিংবা কালিমা শাহাদাৎ পাঠ করা,
  6. জানাযা কবর স্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় খাটিয়ার উপর আগর বাতি জ্বালানো এবং জানাযার যাত্রীদের উপর গোলাপ জল ছিটানো,
  7. কবর স্থানে জানাযা নেয়ার সময় খাটিয়াকে ছাতা বা কোনো আচ্ছাদন দিয়ে ছায়াদান করে নিয়ে যাওয়া,
  8. জানাযার ছালাত শেষে “এ মানুষটি কেমন ছিল “উপস্থিত সবাই “বেশ ভালো ছিল ” একথা বলা,
  9. জানাযার ছালাতের পূর্বে মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেয়া,
  10. জানাযা পড়ানোর সময় ইমামের একখন্ড সাদা কাপড় জায়নামায হিসেবে ব্যবহার করা -যা মূলত কাফনের কাপড়ের অংশ বিশেষ,
  11. জানাযার ছালাত পড়ার পর পুনরায় খাটিয়ার সামনে দু’আ করা ঐ সময় ক্বিয়াম করা ছালাত ও সালাম পেশ করা,
  12. জানাযার ছালাতের পর মত ব্যক্তিকে শেষ বারের মত দেখার জন্য মুখের কাফনখোলা,
  13. কাফনের উপর যে কোনো রকমের দুআ লিখে দেয়া কিংবা দুআ লিখিত কাপড় খন্ডকাফনের সাথেলাগিয়ে দেয়া,
  14. কোনো কাপড় খন্ডের উপর কালিমা লিখে ঐ কাপড় খন্ড কবরের ভেতর মৃতের ডান পাশেমুখ বরাবর কবরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দেয়া,
  15. কবরের উপর পুস্পস্তবক অর্পণ করা,
  16. দাফন করার সময় প্রথম তিন অঞ্জলি মাটি দেওয়ার ক্ষেত্রে মিনহা খালাকনাকুমওয়া মিনহা …… ” কুরআন মাজীদের এ আয়াত পাঠ করা,
  17. দাফনের পর দুআ করার পূর্বে একবার সূরা ফাতিহা তিনবার সূরা ইখলাছ্ব. একবারসূরা ফালাক্ব একবার সূরা না -স এভাবে কুরআন মাজীদ থেকে কোনো সূরা বা আয়াতপাঠ করা,
  18. দাফন ও দুআ শেষে সবাই চলে আসার পর একজন বসে কবর তালক্বীন করা, * কবর পাকা করা ও তাতে মৃত ব্যক্তির নাম ফলক করা,
  19. কবরের উপর ঘর তৈরি করা বা মাযার নির্মাণ করা,
  20. মৃত্যুর পর চার দিন পর্যন্ত কিংবা চল্লিশ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন ফাতিহাপড়ানো,
  21. মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিন দিন পর্যন্ত আত্মীয় -স্বজন কত্রিক পালা ক্রমেখানা পাঠানো,
  22. মৃত্যুর পর চার দিন বা চল্লিশ দিন পর্যন্ত মোল্লা – মৌলভী দিয়ে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে কবর পাহারা দেয়া,
  23. মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিন পর্যন্ত চুলা না জ্বালানো ও খানা পাক না করা,
  24. মৃত ব্যক্তি রাস্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা জাতীয় নেতা-নেত্রী হলে অথবা সামরিক ব্যক্তি হলে দাফনের সময় তোপধ্বনি করা ও যুদ্ধের বাজনা বাজানো,
  25. জানাযার ছালাতের সময় জুতা -স্যান্ডেল পাক থাকলেও খুলে রাখা (সুন্নাত হল জুতা -স্যান্ডেল খুলে না রাখা ),
  26. জানাযার ছালাতে প্রথম তাকবীরের পর ‘ছানা পড়া, (সুন্নাত হল ‘ছানা না পড়ে সূরা ফাতিহা পড়া ),
  27. মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সময় আযান দেয়া,
  28. নেককার বা বুযুর্গ ব্যক্তি হিসেবে কোনো কবরে বিছানা-বালিশ দেয়া,
  29. মৃত্যুর পূর্বেই কবর খনন করে রাখা,
  30. মৃত ব্যক্তির কাযা নামায থাকলে কিংবা মৃত ব্যক্তি বেনামাযী হলে তার নামাযের আর্থিক কাফফারা হিসাব করে কাফফারা আদায় করা এং এ মৃত ব্যক্তি গরীব লোক হলে কাফফারার পরিবর্তে একটি কুরআন মাজীদ কাউকে হাদীয়া প্রদান করে কাফফারা এসক্বাত্ব (দূরীভূত করা) ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

উল্লেখিত কাজসমূহ বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক সম্পূর্ণ নব উদ্ভাবিত। এসব কাজের কোন শারঈ ভিত্তি নেই। অর্থ্যাৎ আল্লাহর যেমন এসব কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম এসব কাজ করেছেন বলে কোন ভিত্তি নেই। উল্লেখ্য, যে কাজ আল্লাহর রাসূল কিংবা তার সাহাবাগণ হতে পাওয়া যাবে না। তা কোন শরঈ কাজ বলে গণ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :

যে কেউ এমন কোন কাজ করলো যে কাজ করার জন্য আমাদের কোন হুকুম নেই তা প্রত্যাখাত অর্থ্যাৎ অগ্রহণযোগ্য। (মুসলিম হা/৪৩৪৪)

তিনি আরো বলেছেন :

যে ব্যক্তি আমাদের শরীয়তে নতুন কোন কিছু প্রবর্তন করবে তা প্রত্যাখাত বা অগ্রহণযোগ্য। (বুখারী, হা/২৫০১)।

তিনি জুমার খুতবায় বলতেন :

অত:পর সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হলো মুহাম্মাদের হিদায়াত। নিকৃস্ট কাজসমূহ হলো বিদআত (নব উদ্ভাবিত) আর সকল বিদ’আতই গোমরাহী অর্থ্যাৎ পথভ্রষ্টতা। ( মুসলিম হা/১৮৮৩)।

নাসায়ীর বর্ণনায় অতিরিক্ত রয়েছে :

আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী হবে জাহান্নামী ( হা/১৫৭৮)।

ইতোপূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ নাজায়েজ ও বিদআত বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ (ছ্বঃ)-এর এই ছ্বহীহ হাদীছ অনুযায়ী সত্যিই নাজায়েয এবং বিদা’ত। আর বিদা’ত হলো – গোমরাহী যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য । মৃত ব্যক্তির জন্য যেসব কাজ করা নাজায়েয ও বিদা’ত তন্মধ্যে মৃত ব্যক্তির চারপাশে বসে কুরআন পাঠ করা, তার জন্য কুরআন খতম পড়া কিংবা কুরআন খতম পড়ানো এবং কবরের পাশে কুরআন পড়ার মাধ্যমে চারদিন পর্যন্ত কবর পাহারা দেয়া বিদা’ত ও নাজায়েয তো বটেই, অধিকন্তু তা কুরআন মাজীদের অপব্যবহার এবং কুরআন অবমাননারও শামিল । কেননা, কুরআন মজীদ কোন মৃত ব্যক্তির জন্য নাযিল হয় নি । বরং কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে জীবিতদের জন্য ।

আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنبَغِي لَهُ ۚ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌلِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ

এ তো এক উপদেশ মাত্র এবং সুস্পষ্ট কুরআন; যেন সে সতর্ক করতে পারে জীবিতদেরকে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা যেন সত্য প্রমাণিত করতে পারে। (সূরা ইয়াসীন ৬৯-৭০)

এছাড়া মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে যদি কোন ফায়দা বা কল্যাণ হতো, তাহলে আল্লাহর রাসূল (ছ্বঃ) তাঁর জীবদ্দশায় কোন মৃত ব্যক্তির জন্য কোন কুরআন পড়লেন না কেন কিংবা পড়ার জন্য কাউকে বললেন না কেন অথবা মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে যে ফযীলত আছে তা বর্ণনা করলেন না কেন ? অথচ মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কোন ফায়দা বা কল্যাণ হবে কিনা সে ব্যাপারে জ্ঞাত হওয়ার কথা রাসূল (ছ্বঃ)-এরই । শুধু তাই নয়, ছ্বাহাবা কিরামের দীর্ঘ ইতিহাসেও কেউ কোন মৃত ব্যক্তির জন্য কোন কুরআন পড়েছেন বলে কোন প্রমাণ নেই ।

এ কথার জবাবে যারা বলে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কিংবা পড়ানো হলেতাতে অবশ্যই ফায়দা আছে, যদিও আল্লাহর রাসূল (ছ্বঃ) কিংবা ছ্বাহাবা কিরামগণ তা করেননি । তাহলে এ কথার অর্থ দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন পড়া হলে কিংবা পড়ানো হলে তাতে যে ফায়দা আছে হয় তা আল্লাহর রাসূল (ছ্বঃ) জানতেন না । (না’উজুবিল্লাহি মিন জালিক), নতুবা রাসূলুল্লাহ (ছ্বঃ)-এর যুগে দীনের সব আমল পূর্ণতা লাভ করে নি। তাই এখন তা পূর্ণাঙ্গ করার দায়িত্ব আমাদেরই । অথচ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দীন একথা রাসূলুল্লাহ (ছ্বঃ)-এর বিদায় হজ্জের দিনই আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেনঃ

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

“আজ আমি তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামততোমাদের প্রতি পূর্ণ করে দিলাম । আর তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম ।” (সূরা মায়িদা-৩)

রাসূলুল্লাহ (ছ্বঃ)-এর উপর নাযিলকৃত এই পূর্ণাঙ্গ দীন তিনি উম্মতের কাছে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। ঐ বিদায় হজ্জের দিনই তিনি উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ “তোমরা লক্ষ্য করো,আমি কি (আমার উপর প্রদত্ত সবকিছু) তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত সবাই বললো, হ্যাঁ (পৌঁছে দিয়েছেন)। এ সময় তিনি বললেন, হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো । আর তোমরা যারা উপস্থিত আছো তাদের উচিত অনুপস্থিত তথা অনাগত উম্মতদের কাছে এ বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া ।” (বুখারী হাঃ নং ১৬২১)

সুতরাং আল্লাহর রাসূল (ছ্বঃ) জীবিতদের কল্যাণের ন্যায় মৃতদের আত্মার শান্তির জন্য যেসব আমল করেছেন কিংবা করতে বলেছেন তা-ই উম্মতের জন্য যথেষ্ট। এ আক্বীদা এবং বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি মুসলমানের। তাঁর প্রদর্শিত পথব্যতীত অন্য সব কিছুই গোমরাহী এবং ভ্রান্ত। তিনি বলেছেনঃ

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ

তোমরা (দীনী আমলের ব্যাপারে) নতুন নতুন কোন কিছু উদ্ভাবন করা থেকে দূরে থাকো । কেননা, (কোন আমলের ও ইবাদতের ব্যাপারে) প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত কাজই হল বি’দাত আর প্রত্যেক বি’দাতই হল গোমরাহী বা ভ্রান্ত । (আবু দাউদ হাঃ নং ৪৬০৭)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member