কালিমা শাহাদাত ও এর শর্ত (পর্ব-২)
৮. আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যদের অস্বীকার করা :
বান্দার উচিত আল্লাহ তাআলা ব্যতীত ধারণা প্রসূত সকল উপাস্য-মা’বূদ অস্বীকার করা। সাথে সাথে এ বিশ্বাস সুদৃঢ় করা যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ ছাড়া যাদের এবাদত করা হচ্ছে সব অসাড়। যে কেউ এ সমস্ত কাজ করে সে আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপ করে, হোক না সে উপাস্য (মা’বুদ) নৈকট্য প্রাপ্ত ফেরেস্তা, প্রেরিত রসূল, নেককার ওলী, পাথর, গাছ, চন্দ্র, দল, গোষ্টি-জ্ঞাতি, অথবা কোন সংবিধান…ইত্যাদি।
ইরশাদ হচ্ছে-
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে সে ধারণ করে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংগবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।’[i]
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুতকে বর্জন কর।’[ii]
রসূল সা.বলেছেন-
من قال لاإله إلاالله وكفر بما يعبد من دون الله حرم ماله ودمه، وحسابه على الله عز وجل.
‘যে لاإله إلا الله বলেছে এবং আল্লাহ ছাড়া সকল উপাস্যকে অস্বীকার করেছে তার সম্পদ ও জীবন হারাম হয়ে গেছে এবং তার হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত।’
হে মুসলিম ভাই! তুমি ভাল করে জেনে নাও: জান্নাতের সৌভাগ্য লাভ করা, জাহান্নাম হতে মুক্তি পাওয়া এ কালেমার উপর অটল, অবিরাম অবিচল থেকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করা ব্যতিত সম্ভব নয়। এরশাদ হচ্ছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমন ভাবে ভয় করতে থাকএবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না।’[iii]
রসূল সা. বলেছেন:
من ماة لايشرك بالله شيئا دخل الجنة.
‘আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক না করে যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
অন্যত্র বলেন-
ما من عبد قال لاإله إلا الله ثم ماة على ذلك إلا دخل الجنة.
‘যে ব্যক্তি لاإله إلا الله বলেছে অতঃপর এর উপর স্থির থেকে মারা গিয়েছে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এই কালেমা ভিন্ন অন্য কোন নীতির উপর স্থির থেকে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে এবং শিরক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, যে লোক তার সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ- যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন।’[iv]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَار
‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সাথে অংশিদার স্থির করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান জাহান্নাম। অত্যাচারিদের কোন সাহায্যকারী নেই।’[v]
রসূল সা. বলেছেন-
من لقي الله لايشرك به شيئا دخل الجنة، ومن لقيه يشرك به شيئا دخل النار.
‘যে শিরক মুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরকে জড়িত হয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’
محمد رسول الله এর সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ :
محمد رسول الله এর সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ: মৌখিক ভাবে স্বীকৃতির সাথে সাথে অন্তরে অবিচল, অটল ও অগাধ বিশ্বাস রাখা যে, তাদের নিকট আল্লাহর রেসালত বা বাণী পৌঁছানোর জন্য মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ দায়িত্ব প্রাপ্ত, রসূল। এরশাদ হচ্ছে-
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
‘বলে দাও, হে সকল মানব মন্ডলী! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রসূল।’[vi]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল।’[vii]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا
‘পরম করুনাময় তিনি, যিনি তার বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়।’[viii]
‘আল্লাহ তাআলা তাকে শিরকসহ সমস্ত অপসন্দ-পরিত্যাজ্য কার্যকলাপ হতে ভীতি প্রর্দশনকারী, নির্ভেজাল তাওহিদসহ সমস্ত পছন্দনীয়-গ্রহণীয় কার্যকলাপের দিকে আহবানকারী রূপে প্রেরণ করেছেন।’ এরশাদ হচ্ছে-
قُمْ فَأَنْذِرْ ﴿2﴾ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ
‘উঠুন সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মহত্ব ঘোষণা করুন।’[ix]
অর্থাৎ তাদেরকে শিরক হতে এবং মূর্তি পূজা হতে ও আল্লাহ কর্তৃক সমস্ত অস্বীকৃতির জিনিস হতে ভীতি প্রর্দশন করুন। তাওহিদ ও আল্লাহর অনুমোদিত বিধান মতে তার বড়ত্ব বর্ণনা করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
‘আমি আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে।’[x]
অর্থাৎ আমি তাকে তওহীদ, আনুগত্য ও অধিক সওয়াবের সুসংবাদ দানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি সাথে সাথে শিরক, গুণাহ ও কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শকও করেছি। অধিকন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে শুধু পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এখানেই যথেষ্ট করতে বলেছেন। এর পর কে মানলো আর কে মানলো না এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। এরশাদ হচ্ছে-
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
‘হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না।’[xi]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
مَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ
‘রসূলের দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া।’[xii]
তিনি আমৃত্যু তার উপর প্রেরিত ওহী সংযোজন-বিয়োজন ব্যতীত হুবহু আমাদের পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন। যার আদিষ্ট হয়েছেন তা পঙ্খানুপুঙ্খু আদায় করেছেন। উম্মতের কল্যাণ কামনার সর্বশেষ উদাহরণটুকু পেশ করেছেন। এ জন্য আয়েশা রা. বলেছেন-
من حدثك أن محمدا صلى الله عليه وسلم كتم شيئا مما أنزل الله فقد كذب. ولوكان كاتما شيئا لكتم عبس وتولى. ليس لك من الأمر شيئ.
‘যদি কেউ তোমাকে বলে, মুহাম্মাদ (সা) ওহীর কিয়দংশ গোপন করেছেন, সে মিথ্যুক। কারণ যদি রসূল সা. কোন জিনিস গোপন করতেন, তাহলে অবশ্যই অত্র আয়াত দু’টি গোপন করতেন :
(১) عَبَسَ وَتَوَلَّى ‘তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন।’[xiii]
(২) لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ ‘এ ব্যাপারে আপনার কোন করণীয় নেই।’[xiv]
রসূল সা. আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যা পৌঁছিয়েছেন তাই সর্ম্পূণ দ্বীন। কোনো ধরনের কমতি রাখেননি, যেখানে সংযোজন প্রয়োজন হবে। কোন ধরণের জটিলতা রাখেননি, যা দূরভীত করতে হবে। আবার এমনো সংক্ষিপ্ত সাড় করেননি, যেখানে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। এরশাদ হচ্ছে-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।[xv]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ
‘আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি সেটি এমন যে, তা প্রত্যেক বস্ত্তর সুস্পষ্ট বর্ণনা।’ [xvi]
অতএব যে কোন ব্যক্তির এতে সংযোজন বিয়োজন বা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এ ঘোষণা শুনার পর যদি কেউ তাতে কোন রকম পরিবর্তন করে, তবে পরিবর্তনকারীর উপর এর পাপ বর্তাবে। আল্লাহ তাকে সময় মত পাকড়াও করবেন।
محمد رسول الله এর সাক্ষ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক শর্তসমুহ:
যে কোন বান্দার محمد رسول الله এর সাক্ষ্য প্রদান করার ফলে কয়েকটি জিনিস অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। তন্মেধ্যে গুরুত্ব পূর্ণ হলো :
১. ইহকাল ও পরকালের ব্যাপারে অতীত ও ভবিষ্যত সংক্রান্ত যে সব সংবাদ রসূল সা. দিয়েছেন সে ব্যাপারে সত্যারোপ করা। এরশাদ হচ্ছে-
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ
‘ রসূল সা. তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর।’[xvii]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
فَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقُلْ رَبُّكُمْ ذُو رَحْمَةٍ وَاسِعَةٍ وَلَا يُرَدُّ بَأْسُهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ
‘যদি তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে বলে দিন- তোমার প্রতিপালক সুপ্রশস্ত করুনার মালিক। তার শাস্তি অপরাধীদের উপর থেকে টলবে না।’[xviii]
২. রসূল সা. এর আদেশ পালন করে ও নিষেধ হতে বিরত থেকে যথাযথ তার অনুসরণ করার প্রমাণ দেয়া। এরশাদ হচ্ছে-
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
‘যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমূখতা অবলম্বন করল, আমি তোমাকে (হে মুহাম্মদ) তাদের জন্য রক্ষক নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’[xix]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
‘যে কেউ আল্লাহ ও তার রসূলের অমান্য করে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নামের অগ্নি। তথায় তারা চিরকাল থাকবে।’[xx]
৩. একমাত্র তার আনুগত্য করা অন্য কারো পথ বা পদ্ধতির অনুকরণে না চলা। এরশাদ হচ্ছে-
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম অন্বেষণ করে, কস্মিন কালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’[xxi]
রসূল সা. বলেছেন:
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد.
‘যে এমন আমল করল যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা পরিত্যক্ত, পরিত্যাজ্য ও প্রত্যাখ্যাত।’ অন্যত্র বলেন-
كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى، قالوا: ومن أبى يارسول الله ؟ قال: من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني فقد أبى.
‘আমার উম্মতের প্রত্যেকেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে প্রত্যাখ্যানকারী ব্যতীত। তারা জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহর রসূল সা. প্রত্যাখ্যানকারী কে? তিনি বললেন, যে আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে অবাধ্য হবে সেই প্রত্যাখ্যানকারী।’
৪. পরিপূর্ণ রূপে রসূল সা. এর আদর্শে আদর্শবান হওয়া। এরশাদ হচ্ছে-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।’[xxii]
এতে সন্দেহ নেই যে রসূল সা. ইসলামের জীবিত নমুনা। প্রতিটি কাজে ও কর্মে তিনিই উত্তম পথিকৃত। যে তার আনুগত্য করবে সৌভাগ্যশীল হবে। যে তার আদর্শ ও নীতি হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে পথভ্রষ্ট ও দিকভ্রান্ত হবে।
৫. সমস্ত বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রসূল সা. এর মীমাংসার শরনাপন্ন হওয়া, সে মীমাংসাতে সন্তুষ্ট থাকার সাথে সাথে ন্যায় ও ইনসাফের বিশ্বাস রাখা। এরশাদ হচ্ছে-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো ঈমানদার হতে পারবে না, যে পর্যন্ত তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মেনে না নেয়। তৎপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করে এবং ওটা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে।’[xxiii]
৬. রসূল সা. এর ব্যাপারে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত না হওয়া এবং অবজ্ঞা ও অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা : আল্লাহ যতটুকু সম্মান দান করেছেন, ততটুকু সম্মান তাকে প্রদান করা। ইশাদ হচ্ছে-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
‘মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী।’[xxiv]
সুতরাং এমন কোন ধারনা পোষণ করবে না যা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের সাথে শিরকের শামিল। যেমন- রসুল সা. এর জন্য আল্লাহর ন্যায় কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে এমন বিশ্বাস পোষণ করা। যেমন- তিনি গায়েব জানেন, দুনিয়ার আবর্তন ও বিবর্তনের অধিকার রাখেন, উপকার ও ক্ষতি করার সামর্থ রাখেন, কিছু দিতে পারেন, বঞ্চিত করতে পারেন ইত্যাদি।
অথবা এমন বিশ্বাস পোষণ করা যাবে না, যা আল্লাহর উলুহিয়্যাতের সাথে শিরকের শামিল, যেমন- কুরবানী, মান্নত, সাহায্যের আবেদন, সুপারিশ প্রার্থনা, ভরসা, ভয় ও আশা ইত্যাদির ব্যাপারে তার শরনাপন্ন হওয়া। উল্লিখিত যাবতীয় এবাদত একমাত্র আল্লা্হ তাআলার জন্য। যে নবী সা. এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে সে প্রকারন্তরে তার বিরোধীতায় ও অবধ্যতায় লিপ্ত হবে। যেমন তিনি বলেছেন-
لاتطروني كما أطرت النصارى ابن مريم، فإنما أنا عبد فقولوا عبد الله ورسوله.
‘তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন নাসারারা মরিয়ম তনয় ঈসার ব্যাপারে করেছে। নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে তার বান্দা এবং রসূল বলো।’
যেহেতু আল্লাহ তাআলা জানতেন যে, কতিপয় লোক রসূল সা.কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে। তাই তিনি উম্মতকে স্বীয় সাধ্য ও সামর্থ্যের কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য রসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে-
قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ
‘আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তা ছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেস্তা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরন করি, যা আমার কাছে আসে।’[xxv]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান, আর আমি যদি গায়েবের কথা জানতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতাম এবং কোন অমঙ্গল আমাকে কখনও স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো শুধু মাত্র ঈমানরদের জন্য একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদ দাতা।’[xxvi]
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে-
قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا قُلْ إِنِّي لَنْ يُجِيرَنِي مِنَ اللَّهِ أَحَدٌ وَلَنْ أَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا إِلَّا بَلَاغًا مِنَ اللَّهِ وَرِسَالَاتِهِ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
‘বলুন, আমি তোমাদের ক্ষতি কিংবা কল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি না। বলুন, আল্লাহর কবল থেকে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। এবং তিনি ব্যতীত আমি কোন আশ্রয়স্থল পাব না। কিন্তু আল্লাহর বাণী পৌঁছানো ও তার পয়গাম প্রচার করাই আমার কাজ। যে আল্লাহ ও তার রসূলের অমান্য করবে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নামের অগ্নি। তথায় তারা চিরকাল থাকবে।[xxvii]
তদ্রুপ তাকে ঐ সমস্ত বৈশিষ্টহীন মনে করা, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাকে ভুষিত করেছেন, এটাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। যেমন আল্লাহ তাআলা তাকে সমস্ত সৃষ্টি জীবের উপর শ্রেষ্টত্ব দান করেছেন, রেসালাতের দায়িত্ব, সুসংবাদদান ও সতর্করণের দায়িত্ব প্রদান করেছেন, অলৌকিক ঘটনাবলীর দ্বারা স্বীয় নবুয়্যতের সত্যতা প্রমান করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। কতিপয় অদৃশ্য জ্ঞানের ইলম এবং হাওযে কাউসার প্রভৃতি দান করেছেন। এ সকল নেয়ামত ও পুরুস্কারের প্রতি বিশ্বাস রাখা, অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন হতে- যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দুনিয়া-আখেরাতে ধ্বংসের ঘাটে নিয়ে যাবে- বিরত থাকা।
এখানে আমরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক তার রসূল সা.কে প্রদত্ত্ব কতিপয় স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করছি, যা পূর্বের কোনো নবীকে দেয়া হয়নি। যার ব্যাপারে রসূল সা. স্বয়ং বলেছেন, এরশাদ হচ্ছে-
فضلت على الأنبياء بست : أعطيت جوامع الكلم . ونصرت بالرعب، وأحلت لي الغنائم، وجعلت لي الأرض مسجدا وطهورا، وأرسلة إلى الخلق كافة، وختم بي النبيون.
‘আমাকে ছয়টি জিনিসের মাধ্যমে অন্যান্য নবীদের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
১. পরিপূর্ণ অর্থবহ সংক্ষিপ্ত বাক্যবিন্নাশ ।
২. শত্রুপক্ষের অন্তরে আতংক।
৩. আমার জন্য গণীমতের সম্পদ বৈধ।
৪. সকল যমিন আমার জন্য মসজিদ ও পত্রিতা অর্জন করার মাধ্যম।
৫. আমাকে সকল মানষের নিকট প্রেরণকরা হয়েছে।
৬. এবং আমার দ্বারা নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।
উম্মতের উপর রসূল সা. এর কতিপয় অধিকার :
১. রসূল সা. এর মহববত অবশ্য কর্তব্য, অতীব আবশ্যক। ধন-সম্পদ, নিজের জীবন, পিতা-মাতা, সন্তান, পরিবার-পরিজন ও সমস্ত মানুষের মহববতের উপর তার মহববতকে অগ্রাধিকার দেয়া। রসূল সা. বলেছেন:
لايؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من أهله وماله والناس أجمعين.
‘ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার নিকট পরিবার-পরিজন, সম্পদ ও সমস্ত মানুষ হতে অধিক প্রিয় না হবো।’
২. তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা। এরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘আল্লাহ তাআলা ও তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর উপর রহমত প্রেরণ করে। হে মুমিন গণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের দোয়া কর এবং তার প্রতি সালাম প্রেরণ কর।’[xxviii]
৩. তার কল্যাণ কামনা করা। অর্থাৎ তার সুন্নত ও শরীয়তের হেফাজত ও রক্ষণা বেক্ষণ করা যাতে এর ভিতর কোন ধরনের সংযোজন-বিয়োজন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন না হতে পারে। রসুল সা. বলেছেন,
الدين النصيحة ثلاثا قلنا: لمن يارسول الله؟ قال: لله عزوجل، ولكتابه، و لرسوله، ولأئمة المسلمين، وعامتهم.
‘দ্বীন কল্যাণ কামনার নাম: তিন বার বলেছেন, আমরা পশ্ন করলাম: কার জন্য কল্যাণ কামনা হে আল্লাহর রসূল? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রসূলের জন্য, মুসলমানদের প্রতিনিধিদের জন্য এবং সমস্ত মানুষের জন্য।’
৪. রসূল সা. এর আহলে বায়তের ব্যাপারে তার উপদেশ যথাযথ পালন করা। আহলে বায়ত অর্থাৎ হাশেম ও আব্দুল মুত্তালিব এর বংশধর ও রসূল সা.এর স্ত্রীগণ।
মুসলমান মাত্রই তার বংশধর এর পবিত্রতা এবং রসূল এর সাথে নৈকট্যতার প্রতি বিষেশ দৃষ্টি দিবে। অর্থাৎ তাদের অভাব মোচন করবে, মহববত করবে, তাদের সম্মান রক্ষা করবে। যেহেতু গাদিরে খুম এর দিন রসূল সা. স্বীয় পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে বলেছেন-
أذكركم الله في أهل بيتي.
‘আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’
৫. তার সাহাবাদের মহববত করা এবং তাদের বিশ্বস্ততার উপর আস্থা রাখা: প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব রসূল সা. এর সাহাবাদের মহববত করা। তাদের বিশ্বস্ততার উপর আস্থা রাখা। তাদের সকলের শ্রেষ্টত্বের ঘোষণা দেয়া। তাদের মাঝে সংঘটিত হয়ে যাওয়া বিরোধ নিয়ে সামালোচনা হতে বিরত থাকা। তাদের নামের সাথে رضي الله عنهم বলা। তাদের ব্যাপারে অন্তর পরিচ্ছন্ন রাখা। তাদের কারো প্রতি বিদ্বেষ না রাখা। তাদের অপবাদ, গালি, কুৎসা রটনা ইত্যাদি হতে নিজের মুখ নিরাপদ রাখা।
রসূল সা. বলেছেন-
لاتسبوا أصحابي، فوالذي نفسي بيده لو أن أحدكم أنفق مثل أحد ذهبا ما بلغ مد أحدهم ولا نصيفه.
‘তোমরা আমার সাহাবাদের গালি দিও না। তোমরা আমার সাহাবাদের গালি দিও না। যার হাতে আমার জান তার শপথ করে বলছি: তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমান দান করলেও তাদের এক অঞ্জলী বা তার অর্ধেকর সমানও হবে না।’
তথ্যসূত্র :
[i] সূরা : আল বাক্বারা-২৫৬
[ii] সূরা : আন নাহল- ৩৬
[iii] সূরা : আলে ইমরান-১০২
[iv] সূরা : নিসা-৪৮
[v] সূরা : আল মায়েদা-৭২
[vi] সূরা : আরাফ-১৫৮
[vii] সূরা : মুহাম্মদ:২৯।
[viii] সূরা : আল ফুরকান-১
[ix] সূরা : আল মুদ্দাসি্সর-২-৩
[x] সূরা : ফাতের-২৪
[xi] সূরা : আল মায়েদা- ৬৭
[xii] সূরা : আল মায়েদা-৯৯
[xiii] সূরা : আবাসা-১
[xiv] সূরা : ইমরান-১২৮
[xv] সূরা : আল মায়েদা-৩
[xvi] সূরা : আন নাহল-৮৯
[xvii] সূরা : আল হাশর-৭
[xviii] সূরা : আল আন আম-১৪৭
[xix] সূরা : নিসা-৮০
[xx] সূরা : জিন-২৩
[xxi] সূরা : আলে ইমরান-৮৫
[xxii] সূরা : আল আহযাব-২১
[xxiii] সূরা : আন নিসা-৬৫
[xxiv] সূরা : আল আহযাব-৪০
[xxv] সূরা : আল আন আম-৫০
[xxvi] সূরা : আল আরাফ- ১৮৮
[xxvii] সূরা : জিন:২২-২৩
[xxviii] সূরা : আল আহযাব- ৫৬