সেহরির ফযিলত
আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«السَّحُورُأَكْلُهُبَرَكَةٌفَلاتَدَعُوهُوَلَوأَنْيَجرَعَأحَدُكُمْجُرْعَةًمِنْمَاءٍفَإِنَّاللهَعَزَّوَجَلَّومَلائِكتَهُيُصَلُّونَعَلىالمُتسَحِّرينَ»رَوَاهُأَحْمَد.
“সেহরি বরকতময় খানা, তোমরা তা ত্যাগ কর না, যদিও তোমাদের কেউ একঢোক পানি গলাধঃকরণ করে, কারণ আল্লাহ সেহির ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত প্রেরণ করেন ও ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”।[1]
আব্দুল্লাহ ইব্ন হারেস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবি থেকে বর্ণনা করেন: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেন, তখন তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন, তিনি বললেন:
إِنَّالسَّحُورَبرَكَةٌأَعْطَاكُمُوهَااللهُعَزَّوَجَلَّفَلاتَدَعُوهَا»
নিশ্চয় সেহরির বরকতময়, আল্লাহ তোমাদেরকে তা দান করেছেন, অতএব তোমরা তা ত্যাগ কর না”।[2]
আবু সূআইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اللَّهُمَّصَلِّعَلَىالمُتسَحِّرينَ»
“হে আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন”। উবাদা ইব্ন নাসি বলেন: মুখেমুখে প্রচলিত ছিল: “সেহরি খাও, যদিও পানি দ্বারা হয়। কারণ প্রসিদ্ধ ছিল: সেহির বরকতের খানা”।[3]
ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إنَّاللهَومَلائِكتَهُيُصَلُّونَعَلىالمُتسَحِّرِين»رواهابنحبان.
“নিশ্চয় আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের উপর রহমত প্রেরণ করেন ও তার ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”।[4]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«نِعْمَسَحُورُالمؤْمِنِالتَّمْر»رَوَاهُأَبودَاودَ.
“খেজুর মুমিনদের উত্তম সেহরি”।[5]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সেহরি ফযিলতপূর্ণ, সেহরি আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত ও বরকত, এ জন্য আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করব।
দুই. সেহরির বরকত যেমন আল্লাহ সেহরি ভক্ষণকারীদের ওপর দরূদ প্রেরণ করেন ও তার ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন। আল্লাহর দরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করা, তাদের কর্মের মন্তুষ্টি প্রকাশ করা ও তাদের প্রশংসা করা। ফেরেশতাদের দরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য ইস্তেগফার করা।[6]
তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরি ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন, যা সেহরির গুরুত্ব প্রমাণ করে।
চার. সামান্য বস্তু দ্বারা সেহরি হয়, যদিও তা একঢোক পানি, যেমন হাদিস থেকে স্পষ্ট।
পাঁচ. খেজুর সর্বোত্তম সেহরি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন।
ছয়. মুসলিমদের উচিত এ সুন্নত পালন করা।
আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«تَسَحَّرُوافَإِنَّفيالسَّحُوربَرَكَةً»رواهالشيخان.
“তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে”।[7]
আমর ইব্ন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«فَصْلُمَابَينَصِيامِنَاوصِيَامِأَهْلِالكِتَابِأَكَلَةُالسَّحَر»رواهمسلم.
“আমাদের সওম ও আহলে কিতাবিদের সওমের পার্থক্য হচ্ছে সেহরি ভক্ষণ করা”।[8]
ইরবায ইব্ন সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«دَعَانيرَسُولُاللهﷺإلىالسَّحُورفيرَمَضَانَفقَالَ: هَلُمَّإلىالغَدَاءِالمُباركِ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানে সেহরিতে আহ্বান করে বলেন, বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”।[9]
মিকদাদ ইব্ন মা‘দি কারিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«عَلَيْكُمْبِغَدَاءِالسَّحُور؛فَإِنَّهُهُوَالغَدَاءُالمبَارَك»رواهالنسائي.
“তোমরা সেহরি অবশ্যই ভক্ষণ কর, কারণ তা বরকতপূর্ণ খাবার”।[10]
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সেহরিতে বরকত বিদ্যমান। আল্লাহ যেখানে ইচ্ছা তার মাখলুকে বরকত রাখেন, তন্মধ্যে সেহরি।
দুই. সকল আলেম একমত যে, সেহরি মোস্তাহাব, ওয়াজিব নয়, তবে এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য।[11]
তিন. সেহরির বরকতসমূহ:
(১). সেহরি খাওয়া শরিয়তের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা।কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ দিয়েছেন, এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল ও পরকালের সফলতা।[12]
(২). সেহরিতে আহলে কিতাবের বিরোধিতা রয়েছে, তারা সেহরি খায় না।[13]আর তাদের বিরোধিতা আমাদের দ্বীনের মূল নীতি। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের সাথে মিল রাখা ও তাদের আখলাক, বৈশিষ্ট্য গ্রহণ হারাম।
(৩). সেহরির ফলে সওম ও ইবাদতের শক্তি অর্জন হয়, ক্ষুধা ও পিপাসা থেকে সৃষ্ট খারাপ অভ্যাস দূর হয়।[14]
(৪). সেহরি ভক্ষণকারী দো‘আ কবুলের মুহূর্তে ইস্তেগফার, যিকর ও দো‘আ করার সুযোগ লাভ করে, যা ঘুমন্ত ব্যক্তির নসিব হয় না। সেহরির সময় ইস্তেগফারকারীদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন।
(৫). সেহরি ভক্ষণকারী যথাসময়ে ফজর সালাতে হাজির হয়, অনেক সময় মসজিদে আগে এসে প্রথম কাতার ও ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়ানোর সাওয়াব লাভ করে, আযানের জওয়াব দেয় ও ফজরের দু’রাকাত সুন্নত আদায়ে সক্ষম হয়, হাদিসে এসেছে দুনিয়া ও তার মধ্যে বিদ্যমান সবকিছু থেকে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত উত্তম।
(৬). সেহরি ভক্ষণকারী ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান করে বা সেহরিতে কাউকে অংশীদার করে সদকার সওয়াব লাভ করতে পারে।[15]
(৭). সেহরিতে রয়েছে আল্লাহর নিয়ামতের শোকর ও তার রুখসতের প্রতি সমর্থন, কারণ আল্লাহ আমাদের জন্য সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত পানাহার বৈধ করেছেন, যা পূর্বে হারাম ছিল।[16]
চার. মুসলিমদের কর্তব্য সেহরিতে বাড়াবাড়ি না করা, বিশেষভাবে যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তা ত্যাগ কর না”। নেক নিয়তে সওয়াবের আশায় সেহরি ভক্ষণ করা, শুধু অভ্যাসে পরিণত করা নয়।[17]
পাঁচ. সেহরির দাওয়াত দেয়া ও দাওয়াত গ্রহণ করা বৈধ। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরবায ইব্ন সারিয়াকে তার সাথে সেহরি খেতে ও একত্র হতে আহ্বান করেছেন। এক হাদিসে এরূপ এসেছে: “তোমরা বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”।[18]
ছয়. ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেছেন: “এতে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন সহজ, তাতে কঠোরতা নেই। কিতাবিদের বিধান ছিল, তারা ইফতার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ফজর পর্যন্ত আর সেহরি খেতে পারত না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে তা রহিত করেছেন:
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [البقرة: 187]
“আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়”[19]।[20]আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের জন্য আমরা তার শোকর আদায় করছি।
তথ্যসূত্র :
[1] আহমদ: (৩/১২), জামে সগির: (৪৮০১) গ্রন্থে সুয়ূতি হাদিসটি সহিহ বলেছেন, আলবানি সহিহুল জামে গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলেছেন।
[2] আহমদ: (৫/৩৭০), নাসায়ি: (৪/১৪৫), আলবানি সহিহুল জামে: (১৬৩৬) গ্রন্থে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[3] ইব্ন আবি আসেম ফিল আহাদ ওয়াল মাসানি: (২৭৫৮), বায্যার: (৯৭৪), তাবরানি ফিল কাবির: (২২/৩৩৭), হাদিস নং: (৮৪৫), হাফেয ইব্ন হাজার হাদিসটি হাসান বলেছেন, দেখুন: মুখতাসার যাওয়ায়েদে মুসনাদিল বায্যার: (৬৯১)
[4] সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৪৬৭), আবু নায়িম ফিল হিলইয়াহ: (৮/৩২০), সহিহুল জামে: (১৮৪৪) গ্রন্থে আলবানি হাদিসটি হাসান বলেছেন। সিলসিলাতুস সাহিহাহ: (১৬৫৪)
[5] আবু দাউদ: (২৩৪৫), বায়হাকি: (৪/২৩৬), সহিহ ইব্ন হিব্বান: (৩৪৭৫), আলবানি সহিহ আবু দাউদে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[6] দেখুন: কাসিদা ইবনুল কাইয়েম: (২০), ফাতহুল বারি লি ইব্ন হাজার: (১১/১৫৬), ফায়যুল কাদির: (৩/১৩৭)
[7] বুখারি: ১৮২৩), মুসলিম: (১০৯৫), অনুরূপ হাদিস বর্ণিত আছে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু সায়িদ, জাবের, আয়েশা. আমর ইব্ন আস, হুযায়ফা, ইরবায, আবু লাইলা, তালক, ইয়াশ ইব্ন তালক, ওমর, উতবা ইব্ন আব্দ, আবু দারদা ও সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখদের থেকে। দেখুন: শারহু ইব্ন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৮৯), মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৫৪)
[8] মুসলিম: (১৯৬)
[9] আবু দাউদ: (২৩৪৪), আহমদ: (৪/১২৬), নাসায়ি: (৪/১৪৫), সহিহ ইব্ন খুযাইমাহ: (১৯৩৮), ইব্ন হিব্বান: (৩৪৬৫), আলবানি সহিহ আবু দাউদে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[10] নাসায়ি: (৪/১৪৬), আহমদ: (৪/১৪২), আলবানি সহিহ নাসায়িতে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[11] দেখুন: শারহু ইব্নুল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৮৮), যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৬৬)
[12] দেখুন: ফাতুহুল বারি: (৪/১৪০), তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৫)
[13] ফাতুহুল বারি: (৪/১৪০), তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৫), শারহুন নববী আলা মুসলিম: (৭/২০৭)
[14] ফাতহুল বারি: (৪/১৪০)
[15] ফাতহুল বারি: (৪/১৪০)
[16] আউনুল মাবুদ: (৬/৩৩৬)
[17] তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৬), যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৬৬),
[18] নাসায়ি: (৪/১৪৫), আলবানী সহিহ নাসায়িতে হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[19] সূরাবাকারা: (১৮৭)
[20] মাআলেমুস সুনান: (২/৭৫৭), আউনুল মাবুদ: (৬/৩৩৬)
**** ইবরাহিম ইব্ন মুহাম্মাদ আল-হাকিল রচিত রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদিস : শিক্ষা ও মাসায়েল বই হতে সংগৃহীত।