শামায়েলে মুহাম্মাদী (সাঃ) (পর্ব-৪)
শামায়েলে মুহাম্মাদী (সা) পর্ব-৪
রচনায় :- মুহাম্মাদ হারুন আযিযী নদভী*
চুল ও দাড়িতে তৈল ও সুগন্ধি ব্যবহারঃ
আয়েশা (রাঃ) বলেন, সর্বোত্তম খুশবু যা আমি পেতাম তা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গায়ে লাগাতাম। এমনকি আমি তাঁর মাথায় ও দাড়িতে খুশবুর চমক দেখতাম’।১১৬
চুল ও দাড়িতে শুভ্রতাঃ
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর মাথায়ও দাড়িতে বিশটি সাদা চুল ও ছিল না’।১১৭
ক্বতাদা (রাঃ) বলেন, ‘আমি আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞে সকরলাম, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি খিযাব (মেহেদি) ব্যবহার করেছেন? তিনি বললেন, না। তাঁর কানের পাশের কয়েকটি চুল সাদা হয়েছিল মাত্র’।১১৮
জাবের ইবনে সামুরা (রাঃ)-কে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভ্রতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৈল ব্যবহার করতেন, তখন কিছু দেখা যেতনা। আর যখন তৈল ব্যবহার করতেন না, তখন সামান্য দেখা যেত’।১১৯
চুল ও দাড়িতে শুভ্রতার কারনঃ
আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে সূরা হূদ ও তাঁর মত অন্য সূরা গুলিবৃদ্ধ হওয়ার পূর্বেই বৃদ্ধ করে ফেলেছে’।১২০
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি তো বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন।তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকে সূরা হূদ, ওয়াক্বিয়াহ, মুরসালাত, আম্মাইয়াতা-সা-আলূনা এবং ইযাশ শামসু ক্যূয়্যিরাত সূরা গুলি বৃদ্ধ করে ফেলেছে’।১২১
এরুপ আরো কয়েকটি হাদীছ পাওয়া যায় । এগুলোর অর্থ হল, এই সকল সূরায় ক্বিয়ামাতের যে দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপর আল্লাহ্র আযাব-গযবের যে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা করে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রভাবিত হয়েছিলেন।ফলে চুল ও দাড়িতে স্বল্প সময়ে শুভ্রতা দেখা দিয়েছিল।
পোশাক-পরিচ্ছেদঃ
উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, আমি মুযায়নাহ গোত্রের কিছু লোকের সাথে বায়’আত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলাম। তখন তাঁর ক্বামিছের বোতাম খোলা ছিল’।১২২
কুররাহ (রা) বেলন, আমি মুযায়নাহ গোত্রের কিছু লোকের সাথে বায়আত গ্রহণের উ্দ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসলাম। তখন তাঁর ক্বামীছের বোতাম খোলা ছিল। ১২৩
জুব্বাহ ব্যবহারঃ
মূগিরা বিন শো’বা (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি জুব্বাহ পরিধান করতেন যার আস্তিন দুটি ছিল অপ্রশস্ত’।১২৪
লুঙ্গী ও চাদরঃ
আবু বুরদাহ (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) আমাদের সামনে একটি মোটা লুঙ্গী যা ইয়ামেনে প্রস্তুত করা হত এবং পরিধেয় ‘মুলাব্বাদ’ নামক একখানা কম্বল বের করে বললেন, এই দুটি কাপড় পরিহিত অবস্থায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছিলেন’।১২৫
আলী (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাদরটি চাইলেন এবং আনা হলে তা গায়ে দিলেন। অতঃপর হেঁটে চললেন’। ১২৬
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আমি একদা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হেঁটে চলছিলাম। এ সময় তাঁর গায়ে চওড়া ডোরাদার একখানা নাজরানী চাদরছিল’।১২৭
সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, একবার এক মহিলা একখানা ‘বুরদা’ নিয়ে আসল।সাহল জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা জান, ‘বুরদা’ কি? তাঁদের একজন বলল হ্যাঁ। তা এমন এক চাদর, যার কাছা ডোরাযুক্ত। মহিলাটি নিবেদন করল, হে আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে পরানোর জন্যই আমি নিজের হাতে এ কারুকার্য করেছি। তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়ে নিলেন। বরং তাঁর এরুপ চাদরের প্রয়োজন ও ছিল। অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ চাদরটি ইজার হিসাবে পরিধান করে আমাদের নিকট আসতেন’।১২৮
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হিবারা’ অর্থাৎ ইয়ামেন দেশীয় সবুজ রংয়ের ডোরা যুক্ত চাদর পরতে অধিক পছন্দ করতেন’।১২৯
পশমী চাদরঃ
আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশমি চাদর গায়ে দিয়ে ছলাত পড়লেন। চাদরটির মধ্যে কারুকার্য করা ছিল। সেই কারুকার্যের প্রতি তাঁর নযর পড়ল। তিনি ছালাম ফিরিয়ে বললেন, আমার এ চাদরটি আবু জাহমের নিকট নিয়ে যাও। এটি এখনই আমাকে সলাতে অমনোযোগী করে দিয়েছে। আর আবু জাহ্মের আম্বেজানি চাদর (অর্থাৎ নকশা বিহীন সাধারন চাদর) নিয়ে এসো’।১৩০
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি একদা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি এক বাগানে অবস্থান করছেন। এ সময় তাঁর গায়ে একখানা হুরাইসিয়া পশমী চাদর ছিল’।১৩১
সাদা পোশাকঃ
আবু যর (রাঃ) বলেন, আমি এক বার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলাম।তখন তিনি সাদা পোশাক পরে ঘুমাচ্ছিলেন’।১৩২
সবুজ পোশাকঃ
আবু রিমছা (রাঃ) বলেন, একদা আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে দেখলাম যে, তাঁর উপর দুইটি সবুজ চাদর আছে’।১৩৩
লাল বর্ণের পোশাকঃ
বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেন, লাল চাদর ওলাল লুঙ্গী পরিহিত, ঘাড় পর্যন্ত প্রলম্বিত কেশ-পাশ ওয়ালা কোন ব্যক্তিকে আমির সুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর দেখি নি’।১৩৪
আবু জুহাইফা (রাঃ) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল চাদর ও লাল লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।১৩৫
আনাস (রাঃ) বলেন, একদা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর উপর ভর দিয়ে বের হন। তখন তাঁর গায়ে একখানা ‘কিতরী’ অর্থাৎ ইয়ামেনে প্রস্তুতকৃত লাল বর্ণের মোটা খসখসে চাদর ছিল। তিনি তা গায়ে জড়িয়ে রেখেছিলেন। অতঃপর তিনি লোকজনকে সলাত আদায় করালেন। ১৩৬
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরনে দু’টি ‘কিতরী’ চাদর ছিল। যখন তিনি বসতেন ও শরীর থেকে ঘাম বের হ’ত তখন কাপড়দ্বয় তাঁর উপর ভারি হয়ে যেত। ১৩৭
কাল পোশাকঃ
আয়েশা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) একদা পশমের একটি কালো চাদর পরিধান করলেন। ফলে তাঁর শুভ্রতা ও কাপড়টির কালো রংয়ের কথা মনে পড়ল। কাপড়টি পরিধান করার পর যখন শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছিল তখন পশমের দুর্গন্ধ পেয়ে কাপড়টি বর্জন করলেন। ১৩৮
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা সকালে বাড়ী থেকে বের হলেন। তখন তাঁর পরনে কাল ছাগচুলের একটি চাদর ছিল।১৩৯
লুঙ্গী পরিধানের নিয়মঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি যে, তিনি যখন লুঙ্গী পরিধান করতেন তখন লুঙ্গীর সামনের ভাগ একটু বাড়িয়ে দিতেন। আর পিছন দিক থেকে লুঙ্গী উঠিয়ে রাখতেন। ১৪০
উবায়েদ ইবনে খালিদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি মদীনায় হাঁটছিলাম। এমন সময় আমার পিছন থেকে একজন লোক বললেন, ‘তোমার কাপড় উচু কর, কেননা তা অধিকতর রক্ষাকারী’। আমি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি হ’লেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটা তো সাদা ডোরাদার কাল রংয়ের কাপড়। তিনি বললেন। আমার মধ্যে কি তোমার জন্য কি উত্তম আদর্শ নেই? তারপর আমি লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর লুঙ্গী উভয় নলার মধ্যভাগ পর্যন্ত রয়েছে’। ১৪১
ঈদের জন্য বিশেষ পোশাক :
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ঈদের দিন লাল চাদর পরিধান করতেন। ১৪২
* খত্বীব, আলী মসজিদ, বাহরাইন।
তথ্যসূত্র :-
১১৬. বুখারী হা/৫৯২৩; মুসলিম হা/১১৯।
১১৭. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭; আহমাদ ৩/২৪০ পৃ:।
১১৮. বুখারী হা/৩৫৫০; “কিতাবুল মানাকিব” মুসলিম হা/২৩৪১।
১১৯. মুসলিম হা/২৩৪৪; তিরমিযী হা/৩৬৪৭; আহমাদ ৪/১০৫ পৃ:।
১২০. সহীহুল জামে আস-সাগীর হা/৩৭২১।
১২১. তিরমিযী, ইবনে সা’দ, হাকেম, আবু নু’আইম, সিলসিলাহ সহীহাহ হা/৯৫৫; সহীহুল জামে আস-সাগীর হা/৩৭২৩।
১২২. আবু দাউদ হা/৪০২৫; তিরমিযী হা/১৭৬২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৭৫; আবু শায়খ, আখলাকুন নবী পৃ: ৯০।
১২৩. আবু দাউদ হা/৪০৮২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৭৮; আহমাদ ৪/৬৯ পৃ: আখলাকুন নবী পৃ: ৯২; শামায়েল হা/৪৮।
১২৪. বুখারী হা/৩১০৮; মুসলিম হা/২০৮০; আবু দাউদ হা/৪০৩৬;আহমাদ ৪/২৫১; নাসাঈ হা/১২৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৯।
১২৫. বুখারী হা/৩১০৮; মুসলিম হা/২০৮০; আবু দাউদ হা/৪০৩৬; আহমাদ ৬/১৩১ পৃ:।
১২৬. সহীহ বুখারী হা/৫৭৯৩।
১২৭. বুখারী হা/৫৮০৯; আরবী-বাংলা ৫/৩৭৫ পৃ: হা/৫৩৮৪
১২৮. বুখারী হা/৫৮১০।
১২৯. বুখারী হা/৫৮১৩; মুসলিম হা/২০৭৯; আবু দাউদ হা/৪০৬০; মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩৪ পৃ:
১৩০. বুখারী হা/৫৮১৭; বুখারী-বাংলা ৫/৩৭৭ পৃ:, হা/৫৩৯২
১৩১. বুখারী হা/৫৮২৩
১৩২. বুখারী হা/৫৮২৭; মুসলিম হা/৯৪।
১৩৩. আবু দাউদ হা/৪২০৬; তিরমিযী হা/২৮১২; আহমাদ ২/২৭৭ পৃ:।
১৩৪. মুসলিম হা/২৩৩৭; আবু দাউদ হা/৪০৭২।
১৩৫. বুখারী হা/২১১; মুসলিম হা/৫০৩; তিরমিযী হা/২৮১২।
১৩৬. তিরমিযী, শামায়েল হা/৪৯; আখলাকুন নবী পৃ: ১১৫; ইবনে হিব্বান হা/৩৪৯।
১৩৭. তিরমিযী হা/১২১৩; নাসাঈ ৭/২৯৪ পৃ:
১৩৮. আহমাদ ৬/১৩২ পৃ: আবু দাউদ হা/২০৭৪; হাকেম ৪/১৮৮ পৃ: হা/৭৩৯৩।
১৩৯. মুসলিম হা/২৭৮১; আবু দাউদ হা/৪০৩২; আহমাদ ৬/১৬২ পৃ: আখলাকুন নবী পৃ: ১০৭।
১৪০. আহমাদ, বায়হাক্বী, তিরমিযী, শামায়েল হা/৯৭; আখলাকুন নবী পৃ: ১০৮।
১৪২. ত্বাবারানী-আওসাত্ব, সিলসিলাহ সহীহাহ ৩/২৭৪ পৃ: হা/১২৭৯
(চলবে)
আগের পর্বের লিংক