বিদআতীদের প্রতি সাহাবাদের আচরণ

ﺑﺴﻢ اﷲ اﻟﺮ ﺣﻤﻦ اﻟﺮ ﺣﻴﻢ
সাহাবাদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তারা রাসূল ﷺ এর সুন্নাহর প্রতি খুবই আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করতেন। রাসূল ﷺ সুন্নাহ’র বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম চোখে পড়লে তারা তা পরিত্যাগ করতেন এবং যারা সুন্নাহ’র বিন্দুমাত্র পরিবর্তন সাধন করতে চাইত তাদের সতর্ক করে দিতেন। দারেমী এবং আবু নাঈমে সহীহ ইসনাদে বর্ণিত বিদআতীদের প্রতি সাহাবারা কিরুপ আচরণ করতেন তার একটি চমৎকার শিক্ষাপ্রদ ঘটনা রয়েছে। সাহাবীদের বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরুপঃ

ফজরের নামাজের পূর্বে আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতাম তার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্যে। আবু মুসা আশআরী আমাদের নিকট আসলেন এবং আমাদের জিজ্ঞেস করলেন:

আবু আব্দুর রহমান (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ) কি চলে গেছেন?

আমরা উত্তর দিলাম: না।

আবু মুসা আশআরী আমাদের সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যখন ইবনে মাসউদ ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন, আমরা উঠে দাড়ালাম এবং আবু মুসা তাকে বললেন:
আমি সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদে এমন কিছু দেখেছি যা কোনভাবেই আমার মন সায় দিচ্ছে না।

ইবনে মাসউদ জিজ্ঞেস করলেনঃ সেটা কি ছিল ?
আবু মুসা বললেনঃ “আপনি জীবিত থাকলে আপনিও এটি দেখতে পাবেন। মসজিদে দেখলাম একদল লোক কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে বৃত্তাকারে বসে নামাজের জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক বৃত্তাকারের জন্যে একটি করে দলনেতা রয়েছে। আর এই বৃত্তাকারের সকলেরই নিকট ছোট ছোট পাথরের নুড়ি রয়েছে”।

বৃত্তাকারের দলনেতা তাদের বলছে: একশ বার আল্লাহু আকবর বল, তারপর তারা একশবার আল্লাহু আকবর বলবে; তারপর দলনেতাটি পুনরায় তাদের বলবে, একশবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল, তারা একশবার লা ইলাহা পড়বে; তারপর দলনেতাটি বলবে, একশ বার সুবহানাল্লাহ বল আর তারা একশবার সুবহানাল্লাহ পড়বে।

তারপর ইবনে মাসউদ বললেনঃ  আপনি তাদের কি বলেছেন?
তিনি (আবু মুসা) বললেনঃ  আমি তাদের কিছু বলেনি। আমি আপনার মতামতের জন্যে অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেনঃ  আপনি কি তাদের গুনাহ সমুহ গোনার জন্যে আদেশ দেন নি এবং তাদের নিশ্চিত করতেন যে তারা তাদের পুরস্কার সমূহ ঠিকই পাবে।

এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আমাদের সামনে এগিয়ে চললেন আর আমরাও তার সাথে সাথে চললাম। তিনি যখন সেই বৃত্তাকারে বসা দলগুলোর একটি বৃত্তের কাছে গেলেন তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা এটি কি করছ?

তারা বললোঃ ওহে আবু আব্দুর রহমান (ইবনে মাসউদ), এগুলো হচ্ছে নুড়ি পাথর আর আমরা এগুলো দিয়ে কতবার আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং সুবহানাল্লাহ পড়লাম তার গণনা করছি।

তিনি (ইবনে মাসউদ) বললেনঃ  তোমাদের পাপসমূহ গণনা কর এবং আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তোমরা তোমাদের পুরস্কারের কোন অংশ থেকেই বঞ্চিত হবে না। তোমাদের উপর লানত, মুহাম্মদের লোকেরা, কত দ্রুতই না তোমরা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছো। আল্লাহর রাসূলের সাহাবীরা এখন পর্যন্ত বর্তমান, রাসূল ﷺ এর কাপড়গুলো এখনো জীর্ণ হয়ে যায় নি, তার আহারের পাত্র এখনো ভেঙ্গে যায়নি। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, তোমরা এমন এক ধর্ম অনুসরণ করছ যেটা হয় রাসূল এর ধর্মের চেয়ে উত্তম আর না হয় তোমরা বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার দড়জা উন্মোচন করছ।

তারা বললোঃ ওহে আবু আব্দুর রহমান, আল্লাহর শপথ, এই কাজটি আমরা সওয়াবের আশা ব্যতীত অন্য কোন নিয়তে করিনি।

তিনি (ইবনে মাসউদ) বললেনঃ  তাই কি হয়েছে?  কত লোকই তো সওয়াবের আশায় ভাল কাজ করতে চায় কিন্তু তারা কি কখনো করতে পারে? আল্লাহর রাসূল আমাদের ঐ ধরণের লোকদের কথা বলেছেন যারা কোরআন পড়বে ঠিকই কিন্তু কোরআন তাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করবে না। আল্লাহর শপথ, আমি প্রায়ই নিশ্চিত তোমরাই হচ্ছ সেই ধরণের লোক।

তারপর তিনি তাদের নিকট থেকে সরে গেলেন।

আমর ইবনে সালামাহ বলেনঃ  বৃত্তাকারে বসা ঐ লোকগুলোর অধিকাংশকে আন-নহরের যুদ্ধে খারেজীদের পক্ষ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছি।

– আদ-দারেমী এবং আবু নাঈমে সহীহ ইসনাদে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবর এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়া নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ কিন্তু এই পড়াটাকে ভিন্ন একটা নিয়মে আবদ্ধ করে প্রতিষ্ঠিত করলে যেভাবে রাসূল ﷺ শিক্ষা দেননি, তখন তা বিদআত হয়ে যাবে।

রাসূল ﷺ বলেছেনঃ পর পর আগত কিছু এমন কালেমা রয়েছে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর যার উচ্চারণকারী অথবা আমলকারী ব্যর্থ হবে না। ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদু লিল্লাহ’ ও ৩৪ বার ‘আল্লাহ আকবর’। (মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী)

রাসূল আলী (রা) এবং ফাতেমা (রা) কে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই কালেমাগুলো ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদু লিল্লাহ’ ও ৩৪ বার ‘আল্লাহ আকবর’ পড়তে বলেছিলেন যা আলী (রা) সব সময়ই আমল করতেন। (বুখারী)

এখন কেউ যদি অন্য সময়ও এই কালেমাগুলো পড়তে চায় সে পড়তে পারে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সেটাকে যদি একটি নিয়মে আবদ্ধ করে প্রতিষ্ঠিত করা হয় যেমনঃ প্রতিদিন ফরজ নামাজের আগে গোল হয়ে বসে ১০০ বার পড়া বা সপ্তাহে সকলে একত্রিত হয়ে এভাবে সমস্বরে পড়া।
***যে কেউ সবসময় এই কালেমাগুলো পড়তে চায় সে পড়তে পারবে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু উপরে উল্লিখিত ধরণের কোন নিয়মের আওতায় আনা যাবে না।

তোমরা নিজেদেরকে নবউদ্ভাবিত বিষয় (ইবাদত) সমূহ থেকে দূরে রেখ, কেননা প্রত্যেক নবউদ্ভাবিত (দ্বীনি) বিষয়ই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত হচ্ছে ভ্রান্তি বা ভুল পথ” (তিরমিযী)

ইমাম মালিক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ বলেন,

যে ব্যাক্তি ইসলামের মধ্যে কোন একটি বিদআতের প্রচলন করবে এবং সে বিদআতটিকে খায়ির(ভালো) বলে মনে করবে তাহলে সে আল্লাহর রাসূল এর নিন্দা করল, বিষয়টি এমন দাড়াল যে রাসূল তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেন নি” (যার মানে হলো, তিনি ঠিকমতো আমাদের কাছে ইসলাম পৌছে দেননি)

এখানে লক্ষ্য করুন, মালিক ইবনে আনাস মাত্র একটি বিদআতের কথা বলেছিলেন অনেকগুলো বিদআতের কথা বলেন নি। সুতরাং, বুঝা গেল বিষয়টি অনেক গুরুতর। মালিক ইবনে আনাসের এই কথা শুনে মানুষজন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,ওহে ইমাম, আপনার এই কথার প্রমাণ কি?

ইমাম মালিক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ বললেন,

আপনার ইচ্ছা হলে পড়ে দেখুন,
আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম” (সূরা মায়িদাঃ৩)
ইমাম মালিক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ বলেন,
এমনকিছু যা ঐদিন দ্বীন ইসলামে ছিল না সুতরাং তা আজকেও দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়।

আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন,
আমি তোমাদের যা কিছু করতে বলেছি সেই সব ব্যতীত আর কোন কিছুই তোমাদের জান্নাতের নিকটবর্তী করবে না, এবং যে সকল বিষয়ে সতর্ক করেছি সেগুলো ব্যতীত কোন কিছুই তোমাদের জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে না” (মুসনাদে আস শাফেয়ীই এবং অন্যান্য)

বর্তমান সময়ে অনেককেই দেখা যায় ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে, বিভিন্ন রকম পন্থার কথা বলতে যা ঐদিন দ্বীন ইসলামে ছিল না সুতরাং তা আজকেও দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়।”

মৌখিক, শারীরীক ও আর্থিক সর্বপ্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। রাসূল ﷺ এর উপর আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দাহদের উপর শান্তি বর্যিত হোক। আমীন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button