![](https://www.waytojannah.net/wp-content/uploads/2017/11/waytojannah-post-bg-islam-quran-hadith-bangla.jpg)
মদীনা সনদ
মদীনার সনদ :
মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা এবং আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মক্কা থেকে মদীনায় এসে সমাজ সংস্কার করতঃ রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন। তখন তিনি পৌত্তলিক, ইহুদী, নাছারা সহ সকল ধর্মের লোকের সমর্থন নিয়ে একটি ঐতিহাসিক সনদ রচনা করেন। যা ‘মদীনা সনদ’ বলে খ্যাত।
পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম লিখিত সংবিধান বা শাসনতন্ত্র। উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, জান, মাল ও ইয্যতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়। এই সংবিধানে বিধর্মী ও সংখ্যালঘুদের সাথে কিরূপ আচার-ব্যবহার করবে তার সুস্পষ্ট ও উত্তম নির্দেশনা দেয়া আছে। সকল ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতাও প্রদান করা হয়েছে। কেউ কারও উপর জবরদস্তি করার কোন সুযোগ নেই।
বলা বাহুল্য এই চুক্তিটি ছিল একটি আন্তধর্মীয় ও আন্তসাম্প্রদায়িক চুক্তি, যার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ স্বার্থে ও একক লক্ষ্যে একটি উম্মাহ বা জাতি গঠিত হয়। আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই চুক্তিনামার ধারা সমূহ লক্ষ্য করলে তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গভীর দূরদৃষ্টি ফুটে ওঠে। উল্লেখ্য যে, চুক্তির বিষয়বস্ত্তগুলিকে জীবনীকারগণ পৃথক পৃথক ধারায় বিন্যস্ত করেছেন। যা কারু কারু গণনায় ৪৭টি ধারায় বিধৃত হয়েছে। বলা বলে যে, এই সনদ ছিল রাষ্ট্র গঠন ও তার সংবিধান রচনায় পথিকৃৎ এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সর্বপ্রথম ভিত্তি স্বরূপ। নিম্নে আমরা উক্ত সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারা সমূহ উল্লেখ করলাম।-
মদীনার সনদের মধ্যে কিছু অংশ ছিল মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে, যাতে ১৫টি ধারা ছিল। কিছু ছিল ইহুদীদের সাথে, যাতে ১২টি ধারা ছিল। এতদ্ব্যতীত মদীনার আশপাশের ছোট ছোট গোত্রগুলির সাথে পৃথক পৃথক চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। যাতে মক্কার কুরায়েশরা এসে তাদের সঙ্গে অাঁতাত করতে না পারে। সব চুক্তিগুলোর ধারা একত্রিত করলে ৪৭টি ধারা হয় বলে বিশেষজ্ঞগণ হিসাব করেছেন। আমরা এখানে চুক্তিনামার প্রধান কয়েকটি ধারা উল্লেখ করলাম।-
১. ‘এটি লিখিত হচ্ছে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে মুমিন ও মুসলমানদের মধ্যে যারা কুরায়শী ও ইয়াছরেবী এবং তাদের অনুগামী, যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করে থাকে’।
২. ‘এরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসাবে গণ্য হবে’।
৩. ‘বনু আওফের ইহুদীগণ মুসলমানদের সাথে একই জাতিরূপে গণ্য হবে। ইহুদীদের জন্য তাদের দ্বীন এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দ্বীন। এটা তাদের দাস-দাসী ও সংশ্লিষ্টদের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য সমভাবে গণ্য হবে। বনু আওফ ব্যতীত অন্য ইহুদীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে’।
৪. ‘এই চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের সঙ্গে কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হ’লে তার বিরুদ্ধে সকলে মিলিতভাবে যুদ্ধ করবে’।
৫. ‘চুক্তিভুক্ত লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে কাজ করবে, পাপাচারের ভিত্তিতে নয়’।
৬. ‘যুদ্ধ চলাকালে ইহুদীগণ মুসলমানদের সাথে ব্যয়ভার বহন করবে’।
৭. وَإِنَّ بِطَانَةَ يَهُوْدَ كَأَنْفُسِهِمْ ‘ইহুদীদের মিত্রগণ হুদীদের মতই গণ্য হবে’।
৮. وَإِنَّهُ لَمْ يَأْثَمْ امْرُؤٌ بِحَلِيْفِهِ ‘মিত্রের অন্যায়ের কারণে ব্যক্তি দায়ী হবে না’।
৯. ‘চুক্তিভুক্ত সকলের জন্য মদীনার অভ্যন্তরভাগ হারাম অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা হিসাবে গণ্য হবে’।
১০. وَإِنَّ النَّصْرَ لِلْمَظْلُوْمِ ‘মযলূমকে সাহায্য করা হবে’।
১১. ‘প্রতিবেশীগণ চুক্তিবদ্ধ পক্ষের ন্যায় গণ্য হবে। তাদের প্রতি কোনরূপ ক্ষতি ও অন্যায় করা হবে না’।
১২. ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর মধ্যে কোন সমস্যা ও ঝগড়ার সৃষ্টি হ’লে এবং তাতে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে নীত হবে’।
১৩. ‘কুরায়েশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেওয়া চলবে না’।
১৪.، ‘ইয়াছরিবের উপরে কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।
১৫. ‘কোন অত্যাচারী ও পাপীর জন্য এ চুক্তিনামা কোনরূপ সহায়ক হবে না’ (সূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম)।
হিজরতের প্রথম বছরেই মদীনাবাসী এবং শক্তিশালী ইহুদীদের সাথে অত্র চুক্তি সম্পাদনের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী খেলাফতের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং মদীনা তার রাজধানীতে পরিণত হয়। শান্তির এলাকা সম্প্রসারণের জন্য নবী করীম (ছাঃ) পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের এলাকা সমূহে গমন করেন ও তাদেরকে এ চুক্তিতে শামিল করেন। যেমন-
(১) ২য় হিজরীর ছফর মাসে মদীনা হ’তে ২৯ মাইল দূরবর্তী ওয়াদ্দান (ودَّان) এলাকায় এক অভিযানে গেলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানকার বনু যামরাহ গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে মানছূরপুরী উক্ত গোত্রের নাম বনু হামযা বিন বকর বিন আবদে মানাফ লিখেছেন।
(২) ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বুওয়াত্ব পাহাড় (جبل بواط) এলাকায় এক অভিযানে গিয়ে তাদেরকেও চুক্তিনামায় শরীক করেন।
(৩) একই বছরের জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইয়াম্বু ও মদীনার মধ্যবর্তী যুল উশায়রা (ذو العشيرة) এলাকায় গিয়ে বনু মুদলিজ (بنو مدلج) গোত্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এভাবে তিনি চেয়েছিলেন, যেন সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধাশংকা দূরীভূত হয়। তিনি চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দাওয়াত ও নছীহতের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে। কিন্তু কাফের ও মুনাফিকদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা তাঁকে অবশেষে তরবারি ধারণে বাধ্য করে। যে কারণে পরে বদর-ওহোদ প্রভৃতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।