সূরা নাস -এর সংক্ষিপ্ত তাফসীর

সূরা নাস

(মানব জাতি)

সূরা ১১৪, আয়াত ৬, শব্দ ২০, বর্ণ ৮০।

সূরা ফালাক্ব-এর পরে মদীনায় অবতীর্ণ।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
(২) মানুষের অধিপতির
مَلِكِ النَّاسِ
(৩) মানুষের উপাস্যের
إِلَهِ النَّاسِ
(৪) গোপন কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হ’তে
مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
(৫) যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তর সমূহে
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
(৬) জ্বিনের মধ্য হ’তে ও মানুষের মধ্য হ’তে।
مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ

বিষয়বস্তু :

প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি ছিফাত বর্ণনা করে পরের তিনটি আয়াতে জ্বিন ও মানবরূপী শয়তানের কুমন্ত্রণা হ’তে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তাফসীর :

(১-৩) قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ، مَلِكِ النَّاسِ، إِلَهِ النَّاسِ ‘বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার, মানুষের অধিপতির, মানুষের উপাস্যের’।

উপরে বর্ণিত তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি ছিফাত বর্ণনা করা হয়েছে।- রুবূবিয়াত, মালেকিয়াত ও উলূহিয়াত তথা লালন-পালন, আধিপত্য ও উপাসনা গুণের একচ্ছত্র মালিকানা আল্লাহর। মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই মর্মে যে, তার সঙ্গে সদা নিযুক্ত শয়তানের কুমন্ত্রণা হ’তে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে যেন উপরোক্ত তিনটি গুণে গুণান্বিত মহান সত্তা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবী রাখে।

প্রথম গুণ হিসাবে বলা হয়েছে رَبِّ النَّاسِ ‘মানুষের পালনকর্তা’। সকল মানুষ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মানে। কিন্তু পালনকর্তা হিসাবে মানতে অনেকে আপত্তি করে। যেমন ফেরাঊন সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নিজেকেই أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى ‘আমি তোমাদের বড় পালনকর্তা’ বলে দাবী করেছিল (নাযে‘আত ৭৯/২৪)। পৃথিবীতে ফেরাঊনী স্বভাবের অসংখ্য ধনী, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা রয়েছেন, যারা পরোক্ষে অনুরূপ দাবী করতে চান। তাই আল্লাহ এখানে তাঁর ‘পালনকর্তা’ গুণটিকেই শুরুতে এনেছেন। একইভাবে সূরা ফাতিহার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা’ হিসাবে।

দ্বিতীয় গুণ : مَلِكِ النَّاسِ ‘মানুষের অধিপতি’। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ পৃথিবীকে কব্জায় নিবেন আর বলবেন, أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ؟ ‘আমিই বাদশাহ। পৃথিবীর রাজা-বাদশাহরা কোথায়’?[1]

পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্রনেতা সাধারণতঃ এই অহংকারে বুঁদ হয়ে থাকেন যে, সবার উপরে তারাই সত্য, তাদের উপরে নেই। তারা যা বলেন বা করেন, সেটাই চূড়ান্ত। আইন ও বিধানদাতা তারাই। তাদের বানোয়াট আইনে আদালতগুলিতে বিচার হচ্ছে। আর সে আইনেই নিরীহ মানুষের জেল-ফাঁস হচ্ছে। বাদী-বিবাদী বা তাদের প্রতিনিধিকে আদালতে নির্বাক দাঁড় করিয়ে রেখে উভয় পক্ষের উকিলের আইনী বিতর্কের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী বানানো অথবা অপরাধীকে নিরপরাধ বানানোর প্রহসনকে প্রত্যক্ষ বিচার ব্যবস্থা বলা হচ্ছে। এরপরেও রয়েছে ন্যায়বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রিতা। বাদী ও বিবাদীর হায়াত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বিচার শেষ হয় না। এটাই হ’ল আধুনিক যুগের উন্নত বিচার ব্যবস্থার নমুনা। অন্যদিকে হাজতের নামে মেয়াদবিহীনভাবে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মারা হচ্ছে। কথিত আইন ও বিচারের দোহাই দিয়ে এভাবে স্বাধীন মানুষকে ঘানির গরুর মত দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করে তিলে তিলে নিঃশেষ করা হচ্ছে। যদি চূড়ান্ত বিচারে সে বেকসূর খালাস হয়ে যায়, তখন তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি সে আর কখনোই ফিরে পায় না। মানুষের উপরে মানুষের এই মেকী প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আল্লাহ তাঁর একাধিপত্য ও একক সার্বভৌমত্বের গুণ প্রকাশ করে বলেছেন مَلِكِ النَّاسِ ‘মানুষের অধিপতি’। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের অধিপতি মানুষ নয়, বরং আল্লাহ। আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান।

তৃতীয় গুণ : إِلَهِ النَّاسِ ‘মানুষের উপাস্য’। স্রেফ ধারণা ও কল্পনার বশবর্তী হয়ে কিছু ব্যক্তি ও বস্ত্তর উপরে অলৌকিক ক্ষমতা আরোপ করে মানুষ তাদের উপাসনা করে থাকে। তাদের কবর, মূর্তি, ছবি ও প্রতিকৃতিকে পূজা করে। একইভাবে নবী-অলি, ফেরেশতা, সূর্য-চন্দ্র, আগুন-পাহাড়-নদী, গাছ-পাথর এমনকি মাছ-কবুতর ও তুলসী গাছ পর্যন্ত মানুষের পূজা পাচ্ছে। সৃষ্টির সেরা মানুষ নিজেদের হাতে গড়া বেদী, মিনার, কবর, ভাষ্কর্য ও সৌধের সামনে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। জীবন্ত মানুষ যখন ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় প্রাণ হারাচ্ছে, তখন এইসব নিষ্প্রাণ মূর্তি ও মিনারের পিছনে মানুষ অকাতরে জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করছে। অথচ যাকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে, যাকে পূজা দেওয়া হচ্ছে, সে না দেখতে পায়, না শুনতে পায়। সে না কোন ক্ষতি করতে পারে, না কোন উপকার করতে পারে। এরপরেও মানুষ যাচ্ছে সেখানে দলে দলে মিথ্যা ধারণা ও কল্পনার বশবর্তী হয়ে। সেযুগের নমরূদ নিজেকে মানুষের হায়াত-মঊতের মালিক দাবী করে বলেছিল, أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ ‘আমি বাঁচাই ও আমি মারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)। ফেরাঊন নিজেকে জনগণের ‘ইলাহ’ দাবী করে কওমের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي… ‘আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না’ … (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)। সে আরও বলেছিল, مَا أُرِيْكُمْ إِلاَّ مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ ‘আমি তোমাদের জন্য যেটা কল্যাণ বুঝি, সেটাই বলি। আর আমি তোমাদের কেবল সৎপথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফির ৪০/২৯)। এযুগের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের অনেকে অঘোষিতভাবে অনুরূপ দাবী করেন। কুরআন-হাদীছের কল্যাণপথ তারা দেখতে পান না। ফলে তাদের জীবদ্দশায় সরাসরি এবং মৃত্যুর পরে তাদের ছবিতে ও কবরে পূজা হয়ে থাকে।

মূলতঃ এসবই শয়তানী ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে যে, পূজা-উপাসনা ও ইবাদতের একক হকদার ও হক মা‘বূদ মাত্র একজন- তিনি আল্লাহ ও তিনিই মাত্র إِلَهِ النَّاسِ ‘মানুষের উপাস্য’। তিনি ব্যতীত আর কোন প্রকৃত উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র ‘রব’ হিসাবে মানুষ ও সৃষ্টিজগতের লালন-পালন করেন, ‘মালেক’ বা অধিপতি হিসাবে সৃষ্টি জগতের সকল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেন এবং ‘ইলাহ’ হিসাবে অসহায় বান্দার সকল প্রার্থনা শ্রবণ করেন ও তা মনযূর করেন। এভাবে রুবূবিয়াত, মালেকিয়াত ও উলূহিয়াতের একচ্ছত্র অধিকারী হিসাবে আল্লাহ অত্র সূরার শুরুতে নিজের প্রধান তিনটি গুণের পরিচয় পেশ করেছেন।

(৪-৬) مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ، الَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِيْ صُدُوْرِ النَّاسِ، مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ ‘গোপন শয়তানের কুমন্ত্রণার অনিষ্টকারিতা হ’তে’। ‘যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে’। ‘জ্বিনের মধ্য হ’তে ও মানুষের মধ্য হ’তে’।

বর্ণিত তিনটি আয়াতে শয়তানের কুমন্ত্রণার অনিষ্টকারিতা হ’তে বাঁচার জন্য মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। কেননা শয়তান মানুষের নিত্য সঙ্গী এবং সে কাউকে ভয় পায় না আল্লাহ ব্যতীত। বান্দা যখনই আল্লাহর নাম নেয়, তখনই সে পিছিয়ে যায়। এমনকি আযান শুনলে সে বায়ু নিঃসরণ করতে করতে দৌড়ে পালায়…।[2] শয়তান মানুষের রগ-রেশায় চলাফেরা করে।[3] একে আটকানোর ক্ষমতা মানুষের নেই। অথচ এর প্ররোচনাতেই মানুষ সমস্ত পাপ করে। তাই একে দমন করার একমাত্র কৌশল হিসাবে মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।

الْوَسْوَاسِ মাছদার যা اسم فاعل অর্থে এসেছে الْمُوَسْوِسُ ‘কুমন্ত্রণাদাতা’ অর্থাৎ শয়তান। কুরতুবী বলেন, আসলে ছিল من شر ذى الوسواس কিন্তু ذى মুযাফকে বিলুপ্ত করে مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ করা হয়েছে। الْوَسْوَسَةُ অর্থ الصوت الخفى ‘নীরব খটকা’ যা মনের মধ্যে উত্থিত হয় (তানতাভী)। অথবা حديث النفس ‘মনের মধ্যেকার কল্পকথা’ (কুরতুবী)।

خَنَسَ يَخْنُسُ خَنْسًا وَخَنُوْسًا وَخِنَاسًا অর্থ পিছে আসা, লুকিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে خَنَّاسٌ অর্থ ‘গোপন শয়তান’। কেননা আল্লাহর নাম শুনলে শয়তান পিছিয়ে যায় ও লুকিয়ে যায়। আবার যেমনি বান্দা বেখেয়াল হয়ে যায়, অমনি সামনে চলে আসে ও কুমন্ত্রণা দেয়। আকাশের মিটিমিটি নক্ষত্রকে এজন্য الْخُنَّس বলা হয়েছে (তাকভীর ৮১/১৫)। কেননা এগুলো এই দেখা যায়, এই মিলিয়ে যায়। শয়তান অনুরূপ আল্লাহর নাম স্মরণ করলেই পালায়। আবার আল্লাহকে ভুললেই সামনে চলে আসে। এই লুকোচুরি স্বভাবের জন্য শয়তানকে অত্র আয়াতে ‘খান্নাস’ বলা হয়েছে। আর এটা হ’ল শয়তানের প্রথম বৈশিষ্ট্য।

(৫) اَلَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِيْ صُدُوْرِ النَّاسِ ‘যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে’- এটা হ’ল শয়তানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ وَقَدْ وُكِّلَ بِهِ قَرِيْنُهُ مِنَ الْجِنِّ قَالُوْا وَإِيَّاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ وَإِيَّاىَ إِلاَّ أَنَّ اللهَ أَعَانَنِىْ عَلَيْهِ فَأَسْلَمَ فَلاَ يَأْمُرُنِىْ إِلاَّ بِخَيْرٍ- ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সঙ্গী হিসাবে শয়তানকে নিযুক্ত করা হয়নি। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও। তবে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। সেজন্য সে অনুগত হয়ে গেছে। ফলে সে আমাকে নির্দেশ করে না ভাল ব্যতীত’।[4]

একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে ই‘তেকাফে ছিলেন। স্ত্রী ছাফিয়া কোন প্রয়োজনে সেখানে গিয়েছিলেন। অতঃপর কথা শেষ হ’লে তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ) তার সাথে কিছু দূর হেঁটে আসেন। এ সময় দু’জন আনছার ছাহাবী তাঁদের দেখে দ্রুত সরে যান। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের ডেকে বললেন, থামো। ইনি হ’লেন ছাফিয়া বিনতে হুয়াই। তখন দু’জন বিস্ময়ে বলে উঠলো, সুবহানাল্লাহ ইয়া রাসূলাল্লাহ ! জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِىْ مِنِ ابْنِ آدَمَ مَجْرَى الدَّمِ وَإِنِّىْ خَشِيْتُ أَنْ يَّقْذِفَ فِى قُلُوْبِكُمَا شَيْئًا- ‘নিশ্চয় শয়তান বনু আদমের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে যা দিয়ে রক্ত চলাচল করে। আমি ভয় করেছিলাম যে আমাদের দেখে তোমাদের অন্তরে কোন কিছুর উদয় হ’তে পারে’।[5]

(৬) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ ‘জ্বিন ও ইনসানের মধ্য হ’তে’। এখানে শয়তানকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জ্বিন শয়তান যা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় এবং মানুষ শয়তান, যা প্রকাশ্যে মানুষকে কু-পরামর্শ দেয় ও পথভ্রষ্ট করে।

আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِيْنَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا وَلَوْ شَآءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُوْنَ ‘আর এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি মানুষের মধ্য থেকে ও জিনদের মধ্য থেকে। তারা একে অপরকে মনোমুগ্ধকর কথা দিয়ে প্ররোচিত করে থাকে। যাতে তারা ধোঁকায় পতিত হয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহ’লে তারা এগুলি করতে পারত না। অতএব তুমি এদেরকে ও এদের মিথ্যা রটনাগুলিকে দূরে নিক্ষেপ কর’ (আন‘আম ৬/১১২)। নবীদের যখন এই অবস্থা তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হবে, তা সহজেই বোধগম্য।

তবে মনের মধ্যে শয়তানী চিন্তা উদয় হ’লেই বান্দা গোনাহগার হিসাবে বিবেচিত হবে না, যতক্ষণ না সে মুখে বলবে বা লিখবে অথবা কাজে পরিণত করবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِىْ مَا وَسْوَسَتْ بِهِ صُدُوْرُهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ بِهِ أَوْ تَتَكَلَّمْ- ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আমার উম্মতের ঐসব বিষয় ক্ষমা করেছেন, যেসব বিষয় তাদের অন্তরে উদয় হয়। যতক্ষণ না তারা সে অনুযায়ী কাজ করে অথবা কথা বলে’।[6]

মনোচিকিৎসা :

সূরা ফালাক্ব ও নাস কুরআনের অন্যতম সেরা মু‘জেযা স্বরূপ। এর মধ্যে রয়েছে অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের অমূল্য উৎস। যা আধুনিক পাশ্চাত্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ সূরা দ্বারা একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষের উপরে তার মানসিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যা ভাল ও মন্দ উভয় প্রকারে পরিদৃষ্ট হয়। যেমন লাবীদ বিন আ‘ছাম-এর করা জাদু রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে ক্রিয়া করেছিল মন্দভাবে। পক্ষান্তরে সূরা ফালাক্বব ও নাস তাঁর উপর শুভ প্রতিক্রিয়া বিস্তার করে। যাতে তিনি সুস্থ হয়ে যান। এতে প্রমাণিত হয় যে, বস্ত্তগত ঔষধ ছাড়াও মানসিক ঔষধ মানব দেহে অধিকতর দ্রুত কাজ করে। এমনকি অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যে কোন রোগের আরোগ্য ৮০ শতাংশ নির্ভর করে রোগীর মানসিক শক্তির উপর। এমনকি ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতেও বেদনার উপশম হয় রোগীর জোরালো মানসিক শক্তির উপরে। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন রোগীকে মানসিক ঔষধ দেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, তুমি বার বার বলো ‘আমার কোন অসুখ নেই, আমি সুস্থ’। এভাবে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানসিকভাবে শক্তিশালীগণ দ্রুত আরোগ্য লাভ করে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন।

কুরআন বহু পূর্বেই মনোচিকিৎসার পথ দেখিয়েছে। বরং পুরা কুরআনকেই আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য ‘শিফা’ ও ‘রহমত’ তথা ‘আরোগ্য’ ও ‘অনুগ্রহ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮২)। সূরা ফালাক্বব ও নাস তার মধ্যে পরীক্ষিত, সহজপাঠ্য ও সুপরিচিত দু’টি অনন্য সূরা। সূরা দু’টি এদিক দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অভ্রান্ত পথ নির্দেশক ও মানব কল্যাণের এক অফুরন্ত উৎস হিসাবে গণ্য হবে। যদি না কি মানুষ আল্লাহর উপরে দৃঢ় বিশ্বাসী হয় ও তাঁর উপরে গভীরভাবে আস্থাশীল হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন!

সারকথা :

শয়তানী ধোঁকা হ’তে বাঁচার একমাত্র পথ হ’ল আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করা।


[1]. বুখারী হা/৬৫১৯, মুসলিম হা/২৭৮৭, মিশকাত হা/৫৫২২।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৫৫ ‘আযানের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮; বুখারী হা/২০৩৫; ইবনু মাজাহ হা/১৭১৯।

[4]. মুসলিম হা/২৮১৪ ‘ক্বিয়ামতের বর্ণনা’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৬৭ ‘শয়তানের কুমন্ত্রণা’ অনুচ্ছেদ।

[5]. বুখারী হা/২০৩৫; ইবনু মাজাহ হা/১৭৭৯।

[6]. বুখারী হা/২৫২৮, মুসলিম হা/১২৭, মিশকাত হা/৬৩ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘শয়তানের কুমন্ত্রণা’ অনুচ্ছেদ।

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member