সলাতে মুবাশ্‌শির (পর্ব ৩০)

রচনায় : আব্দুল হামীদ ফাইযী

কওমাহ্‌

অতঃপর আল্লাহর রসূল (সাঃ) রুকূ থেকে মাথা ও পিঠ তুলে সোজা খাড়া হতেন। এই সময় তিনি বলতেন,

 سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه।
“সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌।” (অর্থাৎ, আল্লাহর যে প্রশংসা করে তিনি তা শ্রবণ করেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৯ নং)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি এ কথা বলতে আদেশ করে বলেছিলেন, “কোন লোকেরই নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তকবীর দিয়েছে —- অতঃপর রুকূ করেছে — অতঃপর ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলে সোজা খাড়া হয়েছে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং, হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই সময়েও তিনি উভয়হাতকে কাঁধ অথবা কানের উপরিভাগ পর্যন্ত তুলতেন; যেমন এ কথা পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

মালেক বিন হুয়াইরিস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাকবীরে তাহরীমার সময় কান বরাবর উভয় হাত তুলতেন। আর যখন তিনি রুকূ থেকে মাথা তুলতেন ও ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলতেন তখনও অনুরুপহাত তুলতেন।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৫নং)

উক্ত কওমায় তিনি এরুপ খাড়া হতেন যে, মেরুদন্ডের প্রত্যেক (৩৩ খানা)হাড় নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যেত। (বুখারী ৮২৮, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯২নং)

তিনি বলতেন, “ইমাম বানানো হয় তার অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং —সে যখন ‘সামিআল্লাহু —’ বলবে তখন তোমরা ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বল। আল্লাহ তোমাদের প্রশংসা শ্রবণ করবেন। কারণ, আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা তাঁর নবী (সাঃ) এর মুখে বলেছেন, ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ (অর্থাৎ, আল্লাহর যে প্রশংসা করে তিনি তা শ্রবণ করেন)। (মুসলিম, সহীহ ৪০৪, আহমাদ, মুসনাদ, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৯৭২নং)

অন্য এক হাদীসে তিনি উক্ত কথা বলার ফযীলত প্রসঙ্গে বলেন, “—যার ঐ কথা ফিরিশ্‌তাবর্গের কথার সমভাব হবে, তার পূর্বেকার পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে।” (বুখারী, মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৮৭৪নং)

পূর্বের বর্ণনা থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু —’ বললে মুক্তাদী ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বলবে। তবে এখানে এ কথা নিশ্চিত নয় যে, মুক্তাদী ‘সামিআল্লাহু —’ বলবে না। বরং মুক্তাদীও উভয় বাক্যই বলতে পারে। যেহেতু আল্লাহর নবী (সাঃ) উভয়ই বলেছেন। (দেখুন, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, প্রভৃতি, মিশকাত ৭৯৩নং, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩৫-১৩৬পৃ:)

কওমার দুআ

১।  ربَّنَا لَكَ الْحَمْد (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৩, ৭৯৯নং)

২।ربنا وَلَكَ الْحَمْد  (বুখারী ৮০৩ নং, প্রমুখ)

৩।اَللّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْد  (বুখারী ৭৯৬, মুসলিম,  প্রভৃতি, মিশকাত ৮৭৪নং)

৪।  اَللّهُمَّ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْد (বুখারী ৭৯৫নং, মুসলিম,  প্রমুখ)

উচ্চারণ:- রাব্বানা লাকাল হাম্‌দ, অথবা  রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ, অথবা আল্লাহুম্মা  রাব্বানা লাকাল হাম্‌দ, অথবা আল্লাহুম্মা  রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ।

অর্থ:- হে আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে যাবতীয় প্রশংসা।

ربَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْراً طَيِّباً مُّبَارَكاً فِيْه
উচ্চারণ:- রাব্বানা অলাকালহামদুহামদান কাসীরান ত্বাইয়িবাম মুবা-রাকান ফীহ্‌। (বুখারী ৭৯৮, মালেক, মুঅত্তা ৪৯৪, আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০নং)

অন্য এক বর্ণনায় নিম্নের শব্দগুলো বাড়তি আছে,

উمُبَارَكاً عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى।

‘—মুবারাকান আলাইহি কামা য়্যুহিব্বু রাব্বুনা অয়্যারযা। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৩, তিরমিযী, সুনান ৪০৫, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৯২-৮৯৩নং) অবশ্য উক্ত বর্ণনায় হাঁচির কথাও উল্লেখ আছে। যাতে মনে হয় যে, বর্ণনাকারী রিফাআহ্‌ বিন রাফে’ (রাঃ) এর হাঁচিও ঐ সময়েই এসেছিল। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩৪)  নামায শেষে নবী (সাঃ) বললেন, “নামাযে কে কথা বলল?” রিফাআহ্‌ বললেন, ‘আমি।’ বললেন, “আমি ত্রিশাধিক ফিরিশ্‌তাকে দেখলাম, তাঁরা দুআটিকে (আমলনামায়) প্রথমে লিখার জন্য আপোসে প্রতিযোগিতা করছে!”

পূর্ণ দুআটির অর্থ:- হে আমাদের প্রভু! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা, অগণিত পবিত্রতা ও বর্কতময় প্রশংসা (যেমন আমাদের প্রতিপালক ভালোবাসেন ও সন্তুষ্ট হন।)

উক্তহাদীসকে ভিত্তি করে অনেকে মনে করেন যে, কওমার দুআ সশব্দে পড়া চলবে। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। তাইতো রিফাআহ্‌ ছাড়া আর কেউউক্ত দুআ সশব্দে বলেছেন বা ঐ দিন ছাড়া অন্য দিনও কেউবলেছেন কি না তার কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং কওমার দুআ সশব্দে পড়া বিধেয় নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/৯৮)  বড়জোর এ কথা বলা যায় যে, কেউকেউকোন কোন সময় সশব্দে পড়তে পারে। কিন্তু শর্ত হ্‌লো, যেন অপর নামাযীর ডিস্টার্ব না হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩৫) কারণ, পরস্পর ডিস্টার্ব করে কুরআন পাঠও নিষেধ। (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৬, ৪/৩৪৪) সুতরাং উত্তম হ্‌লো নিঃশব্দে পড়াই।

৬।رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّماوَاتِ وَ مِلْءَ الأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَىْءٍ بَعْدُ

  উচ্চারণ:- রাব্বানা অলাকালহামদু মিলআস সামা-ওয়া-তি অমিলআল আর যি অ মিলআ মা শি’তা মিন শাইয়িন বা’দ।

  অর্থ- হে আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে যাবতীয় প্রশংসা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ভরে এবং এর পরেও তুমি যা চাও সেই বস্তু ভরে।

এক বর্ণনায় এই দুআও বাড়তি আছে,

اَللَّهُمَّ طَهِّرْنِيْ بِالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَالْمَاءِ الْبَارِدِ، اَللَّهُمَّ طَهِّرْنِيْ مِنَ الذُّنُوْبِ وَالْخَطَايَا

كَمَا يُنَقَّي الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَس।

উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা ত্বাহ্‌হিরনী বিষষালজি অলবারাদি অলমা-ইল বা-রিদ। আল্লাহুম্মা ত্বাহ্‌হিরনী মিনায যুনূবি অলখাত্বায়্যা কামা য়্যুনাক্বাষ ষাওবুল আবয়্যায্বু মিনাদ্‌ দানাস।

অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে বরফ, শিলাবৃষ্টি ও ঠান্ডা পানি দ্বারা পবিত্র করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে গুনাহ ও ত্রুটিসমূহ থেকে সেইরুপ পবিত্র কর, যেরুপ সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পবিত্র করা হয়। (মুসলিম, সহীহ ৪৭৬নং, প্রমুখ)

৭।رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَ مِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَىْءٍ بَعْدُ، أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ أَحَقُّ  مَا قَالَ الْعَبْدُ وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ: اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَمُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدِّ।

উচ্চারণ:- রাব্বানা লাকালহামদু মিলআস সামা-ওয়া-তি অল আরযি অমিলআ মা শি’তা মিন শাইয়িন বা’দ, আহ্‌লাস সানা-য়ি অলমাজদ। আহা ক্কু মা ক্বা-লাল আব্দ, অকু ল্লু না লাকা আব্দ, আল্লা-হুম্মা লা মা-নিআ লিমা আ’ত্বাইতা অলা মু’ত্বিআ লিমা মানা’তা অলা য়্যানফাউযাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দ্‌।

অর্থ- হে  আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পূর্ণ এবং এর পরেও যা চাও তা পূর্ণ যাবতীয়  প্রশংসা। হে প্রশংসা ও গৌ রবের অধিকারী! বান্দার সব চেয়ে সত্যকথা -এবং আমরা প্রত্যেকেই তোমার বান্দা, ‘হে আল্লাহ! তুমি যা প্রদান কর তা রোধ করার এবং যা রোধ কর তা প্রদান করার সাধ্য কারো নেই। আর ধনবানের ধন তোমার আযাব থেকে মুক্তি পেতে কোন উপকারে আসবে না।’ (মুসলিম, সহীহ ৪৭৭)

উক্ত দুই প্রকার দুআর শুরুতে ‘আল্লাহুম্মা—’ শব্দও কিছু বর্ণনায় বাড়তি আছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৪৬, ৮৪৭নং)

৮।لِرَبِّىَ  الْحَمْدُ لِرَبِّىَ الْحَمْدُ।

উচ্চারণ- লিরাব্বিয়ালহামদ, লিরাব্বিয়ালহামদ।

অর্থ- আমার প্রভুর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা, আমার প্রভুর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা।

তাহাজ্জুদের নামাযে তিনি বারবার এটি পাঠ করতেন। যার ফলে এই কওমাহ্‌ তাঁর কিয়ামের সমান লম্বা হয়ে যেত; যে কিয়ামে তিনি সূরা বাক্বারাহ্‌ পাঠ করতেন! (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৩৫নং)

কওমায় স্থিরতার গুরুত্ব

আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর এই কওমাহ্‌ প্রায় তাঁর রুকূর সমান হত। বরং তিনি কখনো কখনো এত লম্বা দাঁড়াতেন যে, অনেকে মনে করত, তিনি হয়তো বা সিজদায় যেতে ভুলে গেছেন। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৭নং)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি এই কওমায় স্থিরতা অবলম্বন করতে আদেশ করে বলেছেন, “—অতঃপর মাথা তুলে সোজা খাড়া হবে; যাতে প্রত্যেক হাড় তার নিজের জায়গায় ফিরে যায়।”

অন্য এক বর্ণনায় আছে, “যখন (রুকূ থেকে পিঠ) উঠাবে তখন পিঠ (মেরুদন্ড) কে সোজা কর। মাথাকে এমন সোজা করে তোল, যাতে সমস্ত হাড় নিজ নিজ জোড়ে ফিরে যায়।” (বুখারী, মুসলিম,  দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী)

তিনি আরো বলেনে, “আল্লাহ তাআলা সেই বান্দার নামাযের প্রতি তাকিয়েও দেখেন না, যে তার মেরুদন্ড (পিঠ)কে রুকূ ও সিজদার মাঝে সোজা করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/৫২৫, ত্বাবা কাবীর)

সুতরাং যাঁরা রুকূ থেকে সম্পূর্ণ খাড়া না হয়ে বা আধা খাড়া হয়ে হাঁটু ভেঙ্গে চটপট সিজদায় চলে যান তাঁদের নামায কেমন হবে তা সহজে অনুমেয়।

(চলবে)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88