রোহিঙ্গারা বাঁচতে চায়

রোহিঙ্গারা আমাদের প্রতিবেশী ও মুসলিম ভাই। তাদের উপর যে অত্যাচার নেমে এসেছে তা মানুষ হিসাবে কারো কাম্য নয়। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের টার্গেট একমাত্র মুসলিম জাতি। রোহিঙ্গাদের কোন অপরাধ নেই। তাদের একটি মাত্র অপরাধ তারা মুসলিম। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর মাধ্যমে সারা দুনিয়াতে গোত্র, ভাষা ও বর্ণের বিভাজনে সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وُّأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْباً وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ. ‘হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বহু সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হ’তে পার। তবে আল্লাহর নিকটে সেই শ্রেষ্ঠ, যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩) এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, النَّاسُ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ ‘মানুষ আদমের সন্তান, আর আদম মাটির তৈরী’।[1]

সম্প্রতি পত্রপত্রিকা এবং স্যোসাল মিডিয়াতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর যে মর্মান্তিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে তাতে প্রতিটি হৃদয়বান ব্যক্তির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কারণ তারা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও মুসলিম ভাই। তারা আমাদের কাছে কিছুই চায় না, চায় শুধু আশ্রয়। আমরা কি তাদেরকে মাথা গোঁজার সুযোগ করে দিতে পারি না? রোহিঙ্গারা চাতক পাখির মত আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে দু’হাত উঠিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে ফরিয়াদ করছে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য। অথচ তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসছে না। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসিও নীরব-নিশ্চুপ। সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে। ভাবখানা এমন যে, রোহিঙ্গারা মানুষ নয়। আসলে এই রোহিঙ্গারা কারা? তাদের প্রতি আমাকে কতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত আলোচনা।-

রোহিঙ্গাদের পরিচয় : রোহিঙ্গা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। ২০১২ সালে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫ লাখ সঊদী আরব ও মালয়েশিয়াতে বাস করে বলে ধারণা করা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। বর্তমান মায়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালী, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণে উর্দূ, হিন্দি, আরবী শব্দের প্রভাব রয়েছে। রাখাইনে দু’টি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে মগদের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহায থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।

সবচেয়ে প্রসিদ্ধতম মতামত হ’ল, রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যের আদি বাসিন্দা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরবে যখন থেকে ইসলামের আবির্ভাব হয়, তখন থেকে চট্টগ্রামের ন্যায় এখানেও ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে।[2] অনেকে ছূফীদের কথা বলেন। কিন্তু এটা ভুল। কেননা ইসলামের প্রাথমিক ও স্বর্ণযুগে কথিত ছূফীবাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের বহু পরে তিববত হয়ে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ ঘটে। অতঃপর আরাকান হ’ল টেকনাফের পূর্বে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১০০ মাইল দীর্ঘ নাফ নদীর পূর্ব পাড়ে ৭২ মাইল দীর্ঘ দুর্লংঘ্য ও সুউচ্চ ইয়োমা (Yoma) পর্বতমালা বেষ্টিত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রায় ১৫ হাযার বর্গমাইল ব্যাপী একটি সমতল ভূমি। এটাকে প্রাচীন রাহমী (رحمي) রাজ্যভুক্ত এলাকা বলে ধারণা করা হয়। যাকে এখন ‘রামু’ বলা হয়। তৎকালীন রাহমী রাজা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য এক কলস আদা উপঢৌকন হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। যা তিনি ছাহাবীগণকে বণ্টন করে দেন (থিসিস, পৃঃ ৪২৫)। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, তখন থেকেই এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং স্থানীয় রাজাসহ সাধারণ অধিবাসীরা ইসলামকে সাদরে বরণ করেছে। জাহায ডুবির কারণেও বহু আরব এখানে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ে-শাদী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ইসলাম আগমনের বহু পরে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে বিতাড়িত হয়ে বৌদ্ধরা তাদের আদি বাসভূমি ভারত ছেড়ে থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, তিববত, মিয়ানমার, চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে অভিবাসী হয়। ভারত এখন প্রায় বৌদ্ধশূন্য বলা চলে। অথচ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। মধ্যযুগে আরাকানের রাজধানীর নাম ছিল ম্রোহাং। সেটারই অপভ্রংশ হ’ল রোহাং বা রোসাঙ্গ এবং সেখানকার অধিবাসীরা হ’ল রোহিঙ্গা। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৫ খ্রিঃ পর্যন্ত সাড়ে তিনশ’ বছরের অধিক সময় আরাকানের রাজধানী ছিল রোসাঙ্গ। এখানকার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী মুসলমান। আর মুসলিমদের শতকরা ৯২ জন হ’ল রোহিঙ্গা। ১৪৩৪ থেকে ১৬৪৫ খ্রিঃ পর্যন্ত দু’শ বছরের অধিক কাল যাবৎ কলিমা শাহ, সুলতান শাহ, সিকান্দার শাহ, সলীম শাহ, হুসায়েন শাহ প্রমুখ ১৭ জন রাজা স্বাধীন আরাকান রাজ্য শাসন করেন। তাদের মুদ্রার এক পিঠে কালেমা ত্বাইয়িবা ও অন্য পিঠে রাজার নাম ও সাল ফারসীতে লেখা থাকত। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বাংলা ভাষার চরমোন্নতি সাধিত হয়। কবি আলাওল, দৌলত কাযী, মরদান শাহ প্রমুখ কবিগণ আরাকান রাজসভা অলংকৃত করেন। আজকে যেমন বাংলা ভাষার রাজধানী হ’ল ঢাকা, সে যুগে তেমনি বাংলা ভাষার রাজধানী ছিল রোসাঙ্গ। এক সময় আকিয়াবের চাউল বন্যা উপদ্রুত বাংলাদেশের খাদ্যাভাব মিটাতো। মগদস্যুদের দমনে শায়েস্তা খাঁকে তারাই সাহায্য করেছিল। যার ফলে মাত্র ৩৬ ঘণ্টায় তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম জয় করা ও মগমুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তাই রোহিঙ্গাদের নিকট বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের ঋণ অনেক বেশী।[3]

রোহিঙ্গা আমাদের ভাই ও প্রতিবেশী : রোহিঙ্গারা আমাদের মুসলিম ভাই ও উত্তম প্রতিবেশী। শুধু রোহিঙ্গা কেন সারা পৃথিবীর মুমিন-মুসলমান আমাদের একে অপরের ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে আবদ্ধ। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إخوة  ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই (হুজুরাত ৪৯/১০)। মুমিন মুসলিমরা আমাদের ভাই তাদেরকে অন্যায়ভাবে কেউ অত্যাচার করলে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে। পক্ষান্তরে তাদের প্রতি যুলুম করা যাবে না এবং যালিমরা তাদেরকে ফেরত চাইলে ফেরত দেয়া যাবে না। এমর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اَلْمُسْلمُ أَخُوْ الْمُسْلم لاَ يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ ‘মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। তার উপর সে যুলুম করবে না এবং (কাফেরদের নিকট) তাকে সোপর্দ করবে না…’।[4] আর প্রত্যেক মুমিন পরস্পর এক দেহের মত। দেহের একস্থানে ক্ষত হ’লে যেমন অন্য পাশের্ব ব্যথা অনুভব করে, ঠিক তেমনি মুমিনদের সম্পর্ক। এসম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,اَلْمُؤْمِنُوْنَ كَرُجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشْتَكَي عَيْنُهُ اشْتَكَي كُلُّهُ وَإِنِ اشْتَكَي رَأْسُهُ اشْتَكَي كُلُّهُ-  ‘সকল মুমিন এক অখন্ড ব্যক্তির মত। যদি তার চক্ষু ব্যথিত হয় তাহ’লে সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়। আর যদি তার মাথা ব্যথিত হয় তাহ’লে পুরোটাই ব্যথিত হয়’।[5]

প্রতিবেশী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিবরীল (আঃ) যেভাবে অছিয়ত করতেন সে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا زَالَ يُوصِينِي جِبْرِيلُ بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ ‘জিবরীল (আঃ) আমাকে সব সময় প্রতিবেশী সম্পর্কে অছিয়ত করে থাকেন। এমনকি আমার মনে হ’ল যে, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিছ বানিয়ে দিবেন।[6] প্রতিবেশী যে ধর্মাবলম্বী হোক না কেন তারা যদি অভুক্ত থাকে তবে যতই ইবাদত করি না কেন আমরা মুমিন হ’তে পারব না। আমরা যেমন পেটপুরে খাব তাদেরকেও তেমনি খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এসম্পর্কে হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِى يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِه  ‘ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, সে মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে’।[7]

যে ব্যক্তি পরিতৃপ্তি সহকারে খেয়ে রাত্রী যাপন করেন। তার জ্ঞাতসারে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রীযাপন করে সে মুমিন নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا آمَنَ بِيْ مَنْ بَاتَ شَبْعَانًا وَجَارُهُ جَائِعٌ إلَى جَنْبِهِ وَهُوَ يَعْلَمُ بِهِ ‘সে আমার প্রতি ঈমান আনেনি, যে ব্যক্তি পরিতৃপ্ত হয়ে রাত্রি যাপন করে, অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে এবং এ কথা সে জানে’।[8] ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করা ইসলামে উত্তম কাজ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এমর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَىُّ الْإِسْلاَمِ خَيْرٌ قَالَ: تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتُقْرِئُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَّمْ تَعْرِفْ- ‘এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন্ কাজ উত্তম? (জবাবে) তিনি বললেন, অভুক্তকে খানা খাওয়ানো এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম করা’।[9] একজন ভাই অপর ভাইকে এবং একজন প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে কিভাবে ভুলে থাকতে পারে? আরাকানীরা আমাদের প্রতিবেশী। তারা আমাদের কাছে বাঁচার জন্য আশ্রয় চাচ্ছে। আমরা কি তাদেরকে আশ্রয় ও খাবার দিতে পারি না? আমাদের মাঝে কি সামান্যতম ঈমানী চেতনা নেই?

রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা যরূরী : রোহিঙ্গাদের প্রতি যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে তাতে তাদের সাহায্য করা আমাদের জন্য আবশ্যিক হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا ‘তোমাদের কি হ’ল যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না? অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা প্রার্থনা করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই অত্যাচারী জনপদ হ’তে মুক্ত কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে অভিভাবক প্রদান কর এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে সাহায্যকারী প্রেরণ কর’ (নিসা ৪/৭৫)

ইসলামী শরী‘আতে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক হ’ল একটি দেহের ন্যায়। দেহের একটি অঙ্গ যেকোন ধরনের বিপদে পড়ার সাথে সাথে অন্য অঙ্গ তাকে সাহায্যের জন্য তৈরী হয়। অনুরূপ কোন মুসলমান ভাই যখন কোন প্রকার বিপদে পড়ে, তখন অপর মুসলমান ভাইয়ের কর্তব্য তাকে সাহায্য করা। কেননা যে মুসলিম ভাইকে সাহায্য করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। এসম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ فِى الدُّنْيَا يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ عَلَى مُسْلِمٍ فِى الدُّنْيَا سَتَرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ-

‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’।[10] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের অভাব মোচনে সাহায্য করবে আল্লাহ তা‘আলা তার অভাব মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন।[11]

অপর এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর ছাদাক্বা করা ওয়াজিব। একজন প্রশ্ন করলেন, যদি কারো সে সামর্থ্য না থাকে, তবে কি হবে? … ছাহাবাদের পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায় তিনি বলেন, فَيُعِيْنُ ذَا الْحَاجَةِ الْمَلْهُوْفَ ‘তাহ’লে কোন দুঃখে বা বিপদে পতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করবে’।[12] ক্ষুধার্তকে খাবার দেয়া, রুগ্ন ব্যক্তিকে সাহায্য করা এবং বন্দীদেরকে মুক্ত করা ইসলামে সর্বোত্তম কাজ। এসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَفُكُّوا الْعَانِىَ-  ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রুগ্ন ব্যক্তির দেখাশুনা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর’।[13] আজ রোহিঙ্গারা ক্ষুধার্ত, রুগ্ন ও বন্দী। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা ইসলামের সর্বোত্তম কাজটি কি করতে পারি না?

শেষকথা : মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব হ’ল, প্রতিবেশী মুসলিম ভাইদের পাশে দাঁড়ানো। বার্মা সরকার যেভাবে আরাকানের মুসলমানদেরকে পশুর মত যবেহ করে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করছে, জীবন্ত মানুষগুলোকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করছে, নারীদের ধর্ষণসহ অসংখ্য নারী-পুরুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করছে এবং বাংলাদেশের সীমানায় তাদেরকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, এ সমস্ত অসহায় মুসলিম ভাই-বোনদের সাহায্য-সহযোগিতা করার মত কি কোন মুসলিম এদেশে নেই? প্রতিবেশী ভাই হিসাবে বাংলাদেশের মুসলিম ভাইদের কি কোন দায়িত্ব নেই? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকটে আবেদন মুসলিম হিসাবে প্রতিবেশী মুসলমান ভাইদের আশ্রয় দিন এবং তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। হে আল্লাহ! মাযলূম রোহিঙ্গা মুসলমান ভাই-বোনদেরকে রক্ষা করুন এবং যারা মারা গিয়েছেন তাদেরকে শহীদ হিসাবে কবুল করুন-আমীন!

– লিলবর আল-বারাদী


[1]. আহমাদ হা/৮৯৭০; তিরমিযী হা/৩৯৫৬ হাদীছ হাসান

[2]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ, থিসিস পৃঃ ৪০৩

[3]. সম্পাদকীয় : রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কাম্য, আত-তাহরীক, ১৫তম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০১২।

[4]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/৪৯৫৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৪।

[6]. বুখারী হা/৬০১৪-১৬

[7]. বায়হাকী, মিশকাত, হা/৪৯৯১; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১২, হাদীছ হাসান।

[8]. ছহীহুল জামে হা/৫৫০৫

[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৬২৯

[10]. মুসলিম, তিরমিযী হা/১৯৩০; আবুদাঊদ হা/৪৯৪৬

[11]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৮।

[12]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২২৫; মিশকাত হা/১৮৯৫

[13]. বুখারী, মিশকাত, হা/১৫২৩

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88