‘সামাজিক কল্যাণে খরচ হোক কুরবানীর অর্থ’ এর জবাবে দু’টি কথা

রচনায় : মুহাম্মদ হাবীবুর রাহমান ফাইযী

কর্মরত সউদ আরব

১৪/১১/১০ এর প্রতিদিন এর সংবাদ পত্রে ‘সানোয়াজ খান’ এর লেখা ‘সামাজিক কল্যাণে খরচ হোক কুরবানীর অর্থ’ প্রবন্ধটি পাঠ করলাম। তিনি এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে মুসলিমদের ব্যাপারে কিছু অসংগত কথা লিখে বাড়াবাড়ি করেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

অতএব আমি একজন মুসলিম ভাই হিসাবে দু-কলম লিখে মুসলিম সমাজকে সতর্ক করতে প্রয়োজন বোধ মনে করলাম। ‘ওয়ামা তাওফীকী ইলাহ বিল্লাহ’।

আসলে পেটে ইসলামী বিদ্যা না থাকলে, যা হয়। আমি প্রথমে বলতে চাই যে, যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তার সে বিষয়ে কিছু লিখা বা কিছু বলা একেবারে বোকামী ছাড়া কি হতে পারে? আর আল্লাহ এ থেকে কঠোরভাবে নিষেধও করেছেন।

অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ের পিছনে পড়ো না।(সূরা ইসরা-৩৬ নং আয়াত)

এইজন্যই তো মহান আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথমে আমাদের ধর্মের নেতা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ‘ইকরা’ অর্থাৎ, ‘পড়’ বাণী দ্বারা সম্বোধন করেছিলেন। কেননা, সমাজকে কোন কিছু বোঝাতে গেলে সর্বপ্রথম সঠিক বিদ্যার অতি প্রয়োজন আছে, নচেৎ হিতে বিপরীত হতে পারে। কুষ্ঠ-ব্যাধি দূর করতে গিয়ে আরো অন্যান্য রোগের জন্ম হতে পারে।

আপনি তো না-জেনেই দেখছি বিষাক্ত তীর মেরেছেন। তারপরে মুসলিম সমাজে কি কুপ্রভাব পড়বে তা আগে-পিছে কিছু ভেবেও দেখলেন না!

কুরবানীকে নিয়ে মুসলিম সমাজকে বেশ কয়েকটি কথার খোঁচাও মেরেছেন দেখছি, যা অসমীচীন মনে করি।

আপনি ‘কুরবানীর অর্থ সামাজিক কল্যাণে খরচ’ করার শ্লোগান গেয়েছেন। তার সাথে শুরুর দিকে কুরবানীকে উদ্দেশ্য করে মুসলিম সমাজের জন্য বেশ কিছু অবান্তর বাক্যও ব্যবহার করেছেন। আসলে আপনি এ বিষয়ে অজ্ঞ। যেমন লিখেছেন, “এটা হল অপ্রয়োজনীয়, অকেজো, অন্ধানুকরণ, কুসংস্কার, সেকেলেপনা, ইত্যাদি। তারপর আরো কিছু আবোল-তাবোল কথা লিখেছেন যে, মানুষের ন্যায়-নীতি ও কেবল আতিক দিক নয় সামাজিক প্রেক্ষাপটও চিন্তা করা প্রয়োজন, ইসলাম ধর্মের কোরবানী সেই রকমই একটি ধর্মীয় আচার যার মধ্যে ত্যাগের থেকে আবেগই বেশি, কোরবানী কেবল আচার পালন আর অন্ধানুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়’ ইত্যাদি লিখে দেখছি বেশ সমালোচনা করেছেন।

বছরান্তে মাত্র একবার কুরবানী করা কি আপনার মত বিদ্বান লেখকের নিকটে অন্ধত্ব, কুসংস্কার, সেকেলেপনা মনে হয়? অথচ, এর প্রমাণ হল আল্লাহর প্রত্যাদেশ ও তদীয় রসূলের বাণী!!

আল্লাহ পাক ইব্রাহীম (আঃ)-কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি প্রিয় বৎস ইসমাঈলকে তাঁর জন্য যবেহ করছেন। তিনি এ কথা নিজ পুত্র ইসমাঈলের কাছে ব্যক্ত করলেন। তখন পুত্র ইসমাঈল (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, নবীর স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারে না; বরং তা নিশ্চয় আল্লাহর অহী। তখন পুত্র ইসমাঈল (আঃ) স্বীয় পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-কে বললেন, হে আব্বাজান। আপনি আল্লাহর আদেশমত আমাকে কুরবানী করুন, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন, ইনশাআল্লাহ’।

তিনি আল্লাহর আদেশক্রমে স্বীয় পুত্রকে কুরবানীর জন্য পেশ করলেন। আকাশবাণী হল, ‘ওহে ইব্রাহীম! তুমি নিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে ইসমাঈলের পরিবর্তে আসমান হতে দুম্বা পশু পাঠিয়ে ইব্রাহীমকে বিরাট পরীক্ষা থেকে উদ্ধার করলেন। (সূরা স্বাফফাত, ১০২-১০৭ নং আয়াত)

এই ঘটনাটি এখনো পর্যন্ত কুরআনে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। আর কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে, যা কস্মিন কালেও আপনি কি, আপনার থেকে আরো বড় বড় পন্ডিতরা তা মুছে ফেলতে পারবে না।

কুরবানী হল সম্পূর্ণ ত্যাগের বিষয়, আত্মিক বিষয় কোন দিন হতে পারে না। যা ইব্রাহীম (আঃ) মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়’। (মুসনাদে আহমাদ)

কুরবানীর গুরুত্ব আছে বলেই তো নবী (সাঃ) এমন ব্যক্তির ব্যাপারে বলেছেন যে, ক্ষমতা থাকার পরেও যে কুরবানী করবে না, সে আমাদের ঈদগাহে আসবে না। আর আপনার কাছে নবীর কথার কোন মূল্যই নেই? ভাবতে আশ্চর্যই লাগে!

কুরআনের উক্ত ঘটনা ও নবী (সাঃ)-র হাদীস দ্বারা কি প্রমাণিত হয় না যে, কুরবানীর বিধান হল আল্লাহ ও তদীয় রসূলের? যদি তা আল্লাহ ও তদীয় রসূলের বিধান হয়, তাহলে এ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ করার মানে বোকামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করার পরিণামটা জানা আছে তো? ইতিহাসের পাতা উল্টালেই জানতে পারবেন যে, পূর্ববতী অসংখ্য মানুষ আল্লাহর বিধানের বিরোধিতার কারণে পৃথিবীতেই ধংস হয়ে গেছে। তারপর তে পরকালে তাদের জন্য শাস্তি নির্ধারিত আছেই।

আপনি যদি মনে করেন, এ ব্যাপারে ইজতিহাদ করেছি। তাহলে বলব যে, ইজতিহাদ করবেন কারা? বড় বড় মুহাদ্দিসীনরা। আপনি আবার কোন মুহাদ্দিস যে, আল্লাহর অহীতে কলম চালিয়েছেন? এমন কটুক্তি করে আল্লাহর ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছেন। কোন মুহাদ্দিসকে শরীয়তের কোন ব্যাপারে রদ-বদল করার অধিকার দেওয়া হয় নি। আপনি কোন সাহসে এ বিষয়ে কদম বাড়িয়েছেন?

আচ্ছা আপনি চিন্তা করে দেখুন তো, কুরবানীর দিনে কি সমাজের দরিদ্র-মিসকীনের উপকৃত হয় না? আমার তো মনে হয়, সে দিনে তাদের ঘরে এত পরিমাণে মাংস পৌছায় যে, সে দিনটাতে তারা আপাতত মন ভরে মাংস ভক্ষণ করে। এমনকি অনেক বিধর্মীও সেদিনে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষীর-পিঠা খেয়ে উপকৃত হয়। তাছাড়াও কুরবানীর পশুর চামড়ার পয়সাও গরীব-মিসকীন বিধবা অনাথদের মাঝে এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানের জন্য বিতরণ করা হয়। এটা কি আপনার দৃষ্টিতে সামাজিক উপকার বা কল্যাণমূলক কর্ম মনে হয় না? আপনি তো অহী ও ইলাহী বিধানের দরজাকে বন্ধ করে স্বীয় বিধান তৈরী করে খেয়াল-খুশির সাধারণ দরজা উন্মুক্ত করতে চেয়েছেন। এটা তো প্রকাশ্য আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ। আর যারা তার আইনের বিরোধিতা করে, তাদের অবস্থা বা শাস্তি কি হতে পারে—তা অনুমেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার যে, ফিতনা তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে মৰ্মন্তদ শাস্তি। (সূরা নূর ৬৩ নং আয়াত)

অতএব এই কথাকে মাথায় রেখে কোন বিষয়ে কলম ধরা উচিত। নচেৎ হাম-বড়ামির মালগাড়ির রাস্তায় পাল্টি খাওয়া অবশ্যম্ভাবী। আর আল্লাহর কঠিন আযাবে পতিত হতে হবে, কেউ পরিত্রাণ পাবে না।

আমরা বলি, কুরবানীর অর্থটা সাধারণ সামাজিক কাজে ব্যয় হবে কেন? আর কিছু আপনার নজরে পড়ল না? বহু জিনিস আছে, তা দিয়ে সামাজিক কল্যাণমূলক তহবিল তৈরী করুন ও সমাজের উপকার করুন না দেখি। এত শত পথ থাকতে সোজা নজর পড়ল কুরবানীতে মুসলিমদের এমন অবস্থা দেখে করুণাই হয়। বর্তমানে বহু বিষয়ে মুসলিমদের মাঝে বেহিসাব পানির মত টাকা অপচয় হয়ে চলে যাচ্ছে। সেই অপব্যয়গুলি বন্ধ করে সামাজিক কাজে ব্যয় করার প্রচেষ্টা করুন না, তাহলে জানব যে, বিরাট বুদ্ধিমানের কাজ করে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করছেন।

‘মানুষের ন্যায়-নীতি ও বিচার বুদ্ধি জাতির চূড়ান্ত ফয়সাল ধর্মের নিয়মাবলী পালনের ক্ষেত্রে কেবল আত্মিক দিক নয় সামাজিক প্রেক্ষাপটও চিন্তা করা প্রয়োজন’।

হ্যাঁ, জনাবে আলী! মনে হচ্ছে যেন আল্লাহ ও তদীয় রসূল ন্যায়-নীতির বিধান মানুষকে দেননি? আর এত দিনেই মনে হচ্ছে যেন আপনিই ন্যায়-নীতির মূর্ত প্রতীক। নিজ বুদ্ধি ও বিচার দ্বারা নতুন বিধান তৈরী করে সমাজে চালু করতে চান। অথচ এমন কাজ তো কোন নবীর দ্বারাও সম্ভব হয়ে উঠে নি। শুনুন আল্লাহ আমাদের নবী (সাঃ)-এর ব্যাপারে কি বলেন,

وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ

لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ

ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ

فَمَا مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ

অর্থাৎ, যদি সে কোন কথা বা বিধান বানিয়ে বলতো, তাহলে আমি তাকে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরতাম। অতঃপর আমি তাঁর কণ্ঠনালীকে ছিড়ে ফেলতাম। আর তখন পৃথিবীর কোন শক্তি তাকে বাঁচাতে পারত না। (সুরা হাককাহ, ৪৪-৪৭ নং আয়াত)

তাহলে জানা গেল যে, ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে কারো কোন কথা বানিয়ে বলার অধিকার নেই।

আরো জেনে রাখুন যে, ধর্মীয় বিষয়ে কারো মত ও রায় চলে না। আর আপনি কোন সাহসে এ কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন? এমন দুঃসাহস করতে গিয়ে আপনার হৃদয় কাপল না!?

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘ধর্মীয় কোন বিধান যদি কারো রায় মোতাবেক হত, তাহলে পায়ের মোজার মাসাহর বিধানটা পায়ের উপরের দিকে না হয়ে তলদেশে (নীচে)র দিকে হত’।

যেহেতু ব্যাপারটা একেবারে আমাদের বুদ্ধির বিপরীত। আসলে মোজার উপর দিকেই মাসাহ করার শরীয়তে বিধান আছে।

তাহলে বোঝা গেল যে, শরীয়তের বিধানে বা মাসল-মাসায়েলে কারো ব্যক্তিগত বিবেক বুদ্ধি ও রায় খাটে না, বরং তা অচল।

অতএব আল্লাহ ও তদীয় রসূল যা বলেছেন, কোন রকম প্রশ্ন না করে বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না পড়ে এবং অহংকারের বশীভূত না হয়ে, তা চক্ষু বন্ধ করে মেনে নেওয়া আমাদের একান্ত কাম্য। এতেই আমাদের মঙ্গল নিহিত আছে।

তাই আপনাকে বলি যে, আপনি শরীয়ত প্রসঙ্গে অধিকাধিক বইপুস্তক অধ্যয়ন করুন, তাহলে শরয়ী জ্ঞানের বহর বাড়বে এবং কল্যাণ-অকল্যাণ অনায়াসে জানতে পারবেন। আর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস দেখবেন পরহেযগার হবেন, আর সত্য গ্রহণ করার তওফীক হবে, ইনশাআল্লাহ। আর যা কিছু হয়ে গেছে, তা হতে প্রভুর নিকট তাওবা করুন, তার প্রতি প্রত্যাবর্তন করুন, তিনি হলেন তওবা গ্রহণকারী ও ক্ষমাশীল।

পরিশেষে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা যে, তিনি যেন আপনাকে, আমাকে ও সকল মুসলমানদেরকে হক ও সত্য বোঝার সুমতি দান করেন। আর অসত্যকে বর্জন করার তাওফীক দেন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!

ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা নাব্যিইনা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলিহী ওয়াসাহবিহী আজমাঈন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88