অলিখিত যৌতুক

লিখেছেন: নায়লা নুজহাত

বিয়েতে মেয়েদের শখঃ

আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। বিয়েটা হচ্ছে ছেলে মেয়েদের নিজেদের পছন্দে। বাবা মায়েরা তখনি বিয়ে দেয়ার জন্যে তৈরি ছিলেন না। মেয়ের বাবার হাতে তেমন একটা টাকা পয়সাও ছিল না। বহু কষ্টে মেয়েকে গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন এক সেট। দুই পক্ষের কোনও পক্ষই যৌতুকের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। বিয়েও যৌতুক ছাড়াই হবে— তখনকার দিনে তাঁরাই আধুনিক– ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত, শহরে থাকেন সবাই। কিন্তু ফার্নিচারটা? আহা ওটাতো যৌতুক না! মেয়ের বাবা মা শখ করে দেন মেয়ের জন্য। তা এক্ষেত্রে মেয়ের বাবা ছেলের বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন। “বেয়াই সাহেব, ঘরের আসবাবপত্র আমরা বিয়ের কটা দিন পরেই দিই, কেমন? এখন পেরে ওঠাটা কষ্টকর।” ছেলের বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, “আমার আত্মীয় স্বজনের কাছে মান মর্যাদার একটা ব্যাপার আছে।”
বিয়ে সম্পন্ন হল। খুব কষ্টে যোগাড় করা টাকায় ফার্নিচারও দেয়া হল।


আমার বাবা বা চাচারা কেউই সিলেটী হওয়া সত্ত্বেও সিলেটী বিয়ে করেননি। একজন ছাড়া। তিনিও নিজেদের বংশের “মান” রেখে বিয়ে করেননি, বিয়ে করেছেন সিলেটের তথাকথিত “নিচু বংশের” একজন মসজিদের ইমামের মেয়েকে। এতে আমাদের অনেকের আত্মীয় স্বজন রাগ করে বিয়েতেই আসেননি! সে যাই হোক। মেয়ের মামারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। সবাই মিলে যখন পরামর্শ করে ঠিক করেছেন কে কী দিবেন মেয়েকে যেন শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা সম্মান নিয়ে যেতে পারে, তখন তাঁদের কাছে পৌঁছুল এক অদ্ভুত সংবাদ। ছেলের বড় ভাই, মানে আমার বাবা, ঘোষণা দিয়েছেন যে মেয়ের বাড়ি থেকে একটা সূতাও যেন না দেয়া হয়। অর্থাৎ, সিলেটী প্রথা অনুযায়ী মেয়ের বাড়িতে ফার্নিচার থেকে শুরু করে ঢেঁকীটা পর্যন্ত যাবে– এসব চলবে না!

অনেক ভালো মানুষ ছিলেন আমার সেই চাচীর বাবা। তাই হয়ত সিলেটের মত জায়গাতেও মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে তাঁর পথে বসতে হয়নি! আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের বাড়িতে যখন আসতেন, তাঁর সেই আনন্দে ঝলমল মুখটা দেখলে আমাদের মন ভরে যেত! মনে হত ইশ! সিলেটের প্রতিটা টানাটানির সংসারে যদি মেয়ে বিয়ে দেয়া নিয়ে এই প্রশান্তিটা থাকতো!
মেয়ের বাবার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে যাক, তবু ফার্নিচার ছাড়া বিয়ে হওয়া যে অসম্ভব ব্যাপার!


আমার ভাইয়ের বিয়ে। ভাবী অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। মাতৃহীনা। ভাইদের অনেক শখ, বোনকে বিয়েতে ভরে জিনিস দিবেন। আমার বাবা ভাবীর ভাইকে বুঝিয়ে বললেন। তাঁদের শখ তাঁরা তো পূরণ করতেই পারেন। কিন্তু আমার বাবা চাননা যে ঘরের সামগ্রী বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে আসুক! কারণটা খুব সিম্পল। এই প্রথাটা আমাদের ভাংতে হবে, যে মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিতে হবে মেয়ের বাবার! আজকে ভাবীর পরিবার তা অনায়াসে করতে পারেন। কিন্তু সেটা দেখে আরও অনেকে ভাববেন “আমাদের মেয়েকেও এভাবেই দিতে হবে” অথবা, “আমাদের বউ আসলেও এমনটাই চাই।” এটা কি হতে দেয়া ঠিক? আমরা, যারা অনায়াসে দিতে পারি, তারা যদি এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, তাহলে যারা খুব কষ্ট করে প্রতিটি রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও এই প্রথা মেনে চলছেন, তাঁরা যে প্রাণে বেঁচে যান!

অবশেষে তাঁরা বুঝেছিলেন! কেবল ছেলেকে কাপড় জামা দিয়েছেন, যা কিছুতেই আটকানো যায়নি! খুব আনন্দের একটি বিয়ে ছিল সেটা। আলহামদুলিল্লাহ।


এবার আমার পালা। অল্প কথায় বলি, বিয়েতে আমার বাবা আমাকে কিছু দেননি। বিয়ের শর্তই ওটা ছিল, যে ফার্নিচার দেয়া, তারপর প্রথা অনুযায়ী গরমের সময় ভ্যান ভর্তি ফল পাঠানো, আর রোজার দিনে ভ্যান ভরে ইফতার, এসব হবে না। না, আমার যাত্রা মোটেই নিষ্কণ্টক ছিল না! কিন্তু, নিষ্কণ্টক পার হব, এমন আশা তো করিনি! প্রথা যারা ভাঙে, প্রথা ভাঙার মূল্য তাদের অবশ্যই দিতে হয়! মূল্য দেয়ার জন্য তৈরি না থাকলে আর কিসের প্রথা ভাঙার সংকল্প?? কিন্তু, যদি আমার উদাহরণ দেখিয়ে একজন মেয়ের বাবাও বলতে পারেন যে “মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ের বাড়িতে গৃহ সামগ্রী যায়নি, আমি একজন চাষি, আমি কেন দিবো?”– তাহলে আমার সেই মূল্য দেয়াটাই আমার অমূল্য পাওয়া!
——————
আমি বলছি না যে মেয়েকে শখ করে কিছু দেয়া যায়না! নিশ্চয়ই যায়! কিন্তু শখের সংজ্ঞা কী? শিরদাঁড়া ভেঙ্গে গেলেও মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিতে হবে– সেটা শখ? ধার করে হলেও মেয়ের ঘর সাজাতে হবে– সেটা শখ?? নাকি ধার করার সামর্থ্য না থাকলে প্রয়োজনে আত্মীয় স্বজনের কাছে হাত পেতে অর্থ সাহায্য চেয়ে হলেও মেয়ের সংসার সাজিয়ে দিতে হবে, হবেই হবে– সেটা শখ???

শখের সংজ্ঞা কি শখের জিনিসটা মেয়ের বাড়িতে না গেলে মেয়ের শ্বশুরের মুখ কালো হওয়া? শখের সংজ্ঞা কি শখ কেনার সামর্থ্য না থাকায় সংসারে মেয়ের কথা শুনতে হওয়া?? নাকি শখের সংজ্ঞা হল শখের জিনিসটার অভাবে মেয়ের সংসারে অশান্তি হওয়া?! এমন তো প্রতিদিনই দেখি পেপার খুললে, যৌতুক না দেয়াতে এই অশান্তি, সেই অশান্তি! শখের পূরণ না হলেও কেন এই অশান্তি আর সেই অশান্তি লেগে থাকে? নাকি চেয়ে নিলে যৌতুক আর “না চেয়ে” নিলে শখ? যেই না চেয়ে নেয়া শখটা বাড়িতে না এলে কথা শোনানো যায় নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর একটা মেয়েকে? শখ আর যৌতুকে তবে তফাৎটা কী? ও হ্যাঁ, আছে একটা তফাৎ। যৌতুকের কারণে মেয়েদের প্রাণ যায়। শখের কারণে বড়জোর কিছু কথা শুনতে হয়। মেয়ের বাবা মায়ের অন্তর যে মেয়েকে সেটুকু কোথাও শুনতে দিতে চান না, সে খবর রাখছে কে?! সেজন্যই যে সামর্থ্য না থাকলেও “শখ” করে তাঁরা মেয়েকে ভরে জিনিসপত্র দেন! তাই তো বলে শুনি ছেলে পক্ষ, “বেয়াই শখ করে দিয়েছেন!”

আর মেয়ের বাবাও মেয়ের বিয়েতে হওয়া “লস” পুষিয়ে নেন ছেলের বিয়েতে পাওয়া বেয়াইয়ের শখ করে দেয়া সামগ্রীর মাধ্যমে! এই চক্র চলতেই থাকে, কেবল দুঃখের কথা তাহলে একটাই– মানুষের তো সমান সমান ছেলে মেয়ে থাকে না বেশীরভাগ সময়ই, যে এক মেয়ে প্রতি লসের হিসাব একটি করে ছেলে পূরণ করবে!!

অনেক সময় যা কিছু আমরা করতেই পারি, অনায়াসে পারি, সেটাও না করাতেই সমাজের কল্যাণ থাকে! মেয়েকে ঘর সাজিয়ে বিদায় করার ব্যাপারটাও তাই! আপনি আমি হয়ত পারবো মেয়েকে ওভাবে দিতে। কিন্তু যেই স্ট্যান্ডার্ড আমরা এতে করে তৈরি করে দিবো, আরেকজনের পক্ষে হয়ত তা দেয়াটা সম্ভব নয়! কেন আমরা একটা অলিখিত নিয়ম বানিয়ে ফেলবো, যে দিতেই হবে? আচ্ছা, আমারা যারা জানি যে আমাদের পক্ষে ওভাবে দেয়াটা কষ্টকর, কেন আমরা দেই তাহলে? মেয়ের শান্তির জন্য? যারা জিনিস না পেলে অশান্তি করবে, তাঁরা কি জিনিস পেলেও শান্তি দেয়ার মত মানুষ? ওভাবে কি শান্তি আসে? নাই বা করলাম আমরা ধার করে, হাত পেতে, শখ পূরণ? মেয়ে কথা শুনবে? হ্যাঁ, সেটা খুব কষ্টের। কিন্তু যদি এই কষ্টের বিনিময়ে একদিন এই কুৎসিত কর্তব্যের– না মানে শখের বাঁধন ছিঁড়তে পারে সমাজ– তাহলে সেই কষ্টটা স্বীকার করা কি খুব কঠিন?

আর ছেলের পক্ষ যদি সত্যই নিজ আদর্শে অটল থেকে বেয়াইকে না করতে পারেন “শখ” করে কিছু দেয়ার ব্যাপারে, দেখবেন সমাজের চিত্র বদলে গিয়েছে ইনশাআল্লাহ। না করেছি, শোনেননি, কি করবো বলুন– এধরণের নিষেধ করে না। নিব না, কিছুতেই না, শুধু মেয়ে নিব– এভাবে নিষেধ করা! কে জানে, মেয়েকে এভাবে বিয়ে দিয়ে তাঁরাও হয়ত শিখবেন কিভাবে অন্য বাড়ির মেয়েকেও ওভাবে আনা যায়!

আমি জানি না। আমি কিছুই বলছি না! শুধু ভাবতে বলছি। চোখ বুজে সবাই যা করে, করতে হবে বলে তাই করে যাওয়ার মাঝে কোনও সার্থকতা নেই! একটা বার ভাবুন আমরা কী করছি, কোন পথে চলেছি, মানুষের জন্য কী উদাহরণ তৈরি করছি। যেই পথ তৈরি করে নিজেরা খুব আরামে আছি, নিজেদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে, সে পথের দাবী মেটাতে আমাদেরই আত্মীয় স্বজনদের কী অবস্থা হচ্ছে?!

প্রসঙ্গটা খুব স্পর্শকাতর। আমি জানি। আর এ নিয়ে লেখার জন্য যে আমাকেও মূল্য দিতে হবে, সেও জানি। ইনশাআল্লাহ, তার জন্য আমি তৈরি

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88