দেশ পরিচিতি : ফিনল্যান্ড

রচনায় : মুহাম্মাদ ইউছুফ

নাম : ফিনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। রাজধানী হেলসিংকি এবং এটি ফিনল্যান্ডের বৃহত্তম নগরী ও প্রধান বন্দর। দেশের দক্ষিণে ফিনল্যান্ড উপসাগর পাড়ে হেলসিংকি অবস্থিত। হেলসিংকি ছাড়া অন্যান্য প্রধান নগরীগুলোর মধ্যে রয়েছে এসপু, টাম্পারে, ভান্তায়া ও তারকু।

ভূ-প্রকৃতি : ফিনল্যান্ড উত্তর ইউরোপে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত একটি দেশ। ফিনল্যান্ডের ভূ-দৃশ্যে হাজার হাজার আকর্ষণীয় হ্রদ জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং দেশের মোট ভূমির দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে ঘন বন। এছাড়া সমুদ্র তীরের অদূরে রয়েছে। হাজার হাজার নৈসর্গিক দ্বীপ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে দেশটির উচ্চতা ৬০০ ফুট বা ১৮০ মিটার।

অবস্থান : ফিনল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে সুইডেন, উত্তরে নরওয়ের সীমান্ত এবং পূর্বে রাশিয়া। বাল্টিক সাগরের দুই শাখা ফিনল্যান্ড উপসাগর ও বোথনিয়া উপসাগর ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। দেশটির সবচেয়ে উত্তরের অংশ ‘ল্যান্ড অব দ্যা মিডনাইট সান’ (মধ্যরাতের সূর্যের দেশ) নামে পরিচিত অঞ্চলের আর্কটিক সার্কেলের অভ্যন্তরে অবস্থিত। ফিনল্যান্ডের এই অঞ্চলে প্রত্যেক গ্রীষ্মে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্য দৈনিক ২৪ ঘন্টা কিরণ দেয়। এসময় প্রায় আড়াই মাস ধরে সূর্য দিগন্ত রেখার উপরে থাকে।

ফিনল্যান্ডের জনগণের বেশিরভাগ দেশের দক্ষিণ অংশে বাস করে। সেখানে আবহাওয়া বেশ সহনীয়। ফিনল্যান্ডবাসীরা উম্মুক্ত স্থানে বেড়ানো ও শিল্পকলা পছন্দ করে। তাদের জীবনযাত্রা উন্নতমানের এবং তারা সরকার থেকে বহু কল্যাণমূলক সুবিধা পায়। ফিনল্যান্ডের সম্পদের বেশিরভাগ আসে তার বিশাল বন থেকে।

আয়তন ও জনসংখ্যা : ফিনল্যান্ডের মোট আয়তন ১,৩০,৫৯৬ বর্গমাইল। ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫২,৬৮,৭৯৯ (২০১৪)। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ মাইলে ৪০ জন। এদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৯.৬৯ বছর।

প্রধান জাতিগত গ্রুপ : ফিনিশ শতকরা ৯১.১৯ ভাগ, সুইডিশ ৫.৯ ভাগ, রোলিয়ান ০.৮ ভাগ, রুশ ০.২ ভাগ এবং অন্যান্য ১.২ ভাগ।

প্রধান ধর্ম : লুথেরান ৭৮.৪ ভাগ, অর্থোডক্স ১.১ ভাগ, অন্যান্য খৃস্টান ১.১ ভাগ, ধর্মে অবিশ্বাসী ১৯.২ ভাগ এবং অন্যান্য ০.২ ভাগ।

প্রধান ভাষা : ফিনিশ ৮৯.৩ ভাগ (অফিসিয়াল), সুইডিস ৫.৩ (অফিসিয়াল) ভাগ, অন্যান্য ৫.৪ ভাগ।

ফিনল্যান্ডে ইসলাম : ১৯৯৯ সালের হিসেবে ফিনল্যান্ডে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাল্টিক তাতাররা ফিনল্যান্ডে ইসলামের সূচনা করেন এবং বর্তমানে তাদের সাথে অভিবাসীরাও যুক্ত হয়েছে। বাল্টিক তাতাররাই ফিনল্যান্ডে বসতিস্থাপনকারী প্রথম মুসলিম গ্রুপ। বাল্টিক তাতাররা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্যবসায়ী কৃষক হিসেবে ফিনল্যান্ডে আসে এবং পরে পরিবারের সদস্যরা তাদের সাথে যোগ দেয়। তারা সংগঠিত হয় এবং ব্যবসা জগতে সফল হয়। ২০ শতকের দিকে ফিনল্যান্ডে অভিবাসনের মাধ্যমে মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ফিনল্যান্ডে এখন কয়েক ডজন মুসলিম কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মত।

ফিনল্যান্ডে হেলসিংকিতে ‘দি ইসলামিক মাল্টিকালচারাল দাওয়া সেন্টার’ নামে একটি সুপরিচিত মসজিদ আছে। যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। এটি আগে চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরে একজন দানশীল মুসলিম কর্তৃক তা ক্রয় করে মুসলিমদের ইবাদাতের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এখানে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায, শুক্রবারে জুমু’আ ও দুই ঈদের নামায পড়া হয়।

শিক্ষা : ফিনল্যান্ডে শিক্ষা সম্পূর্ণ ফ্রি। শিশু এবং সামর্থবান সকল ফুল টাইম শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারীভাবে খাবার সরবরাহ করা হয়। ফিনল্যান্ডে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ডে-কেয়ার পদ্ধতিতে এক বছরের প্রাক-স্কুল শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। এরপর ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের ব্যাপকভাবে বেসিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণের পর পছন্দমত সেকেন্ডারী, ভোকেশনাল, উচ্চ শিক্ষা এবং প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এদেশে সাক্ষরতার হার শতকরা ১০০ ভাগ।

আবহাওয়া ও জলবায়ু : ফিনল্যান্ডের আবহাওয়া বেশ সহনীয়। স্থানভেদে এদেশের তাপমাত্রায় বেশ তারতম্য রয়েছে। গ্রীষ্মকালে এদেশে তাপমাত্রা ১০-১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। ফেব্রুয়ারী ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে ঠান্ডা মাস। এসময় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৩০ থেকে মাইনাস ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উত্তর ফিনল্যান্ডে ভূমি তুষারে ঢেকে যায় এবং উত্তর ফিনল্যান্ড বরফে আবদ্ধ হয়ে যায়। এসময় বরফ কাটার বিশেষ নৌকার সাহায্যে বরফ সরিয়ে ফিনিশ বন্দরগুলো চালু রাখা হয়। শীতকালে ফিনল্যান্ড বেশিরভাগ সময় অন্ধকারে থাকে। এসময় দেশের সবচেয়ে উত্তর এলাকায় প্রায় দু’মাস ধরে সূর্য কখনই দিগন্ত রেখার উপরে ওঠে না। দক্ষিণ ফিনল্যান্ড প্রতিদিন কিছু আলো পায়, তবে মধ্যশীতকালে এ এলাকা দৈনিক মাত্র ৬ ঘন্টা দিনের আলো পায়।

প্রধান কৃষি : জব, গম, আলু, মাছ, সুগারবিট ইত্যাদি।

প্রাকৃতিক সম্পদ : কাঠ, আয়রন অরি, কপার, লেড, জিঙ্ক, ক্রোমাইট, গোল্ড, সিলভার, লাইমস্টোন ইত্যাদি।

প্রধান আমদানি-রফতানি পণ্য : বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, অন্যান্য যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল, খনিজ জ্বালানি, অটোমােবাইল, কাগজ ও কাগজজাত পণ্য, কাঠ ও কাঠজাত পণ্য।

প্রধান ব্যবসায়ীক অংশীদার : জার্মানী, সুইডেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, চায়না, যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্ক।

প্রতিরক্ষাবাহিনী : ফিনল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী মিলিয়ে ৪০ হাজার। ১৮ বছর বয়সী পুরষ নাগরিককে ৬ থেকে ১২ মাসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কিংবা ১২ মাসের সিভিল প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ফিনল্যান্ডে প্রতিরক্ষা বাজেট ২.৮ বিলিয়ন ইউরো যা মোট জাতীয় আয়ের ১.৩ ভাগ।

ইতিহাসঃ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো থেকে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ফিনল্যান্ডে প্রায় এক লাখ বছর আগে থেকে মানুষ বাস করে আসছে। সম্ভবত খৃস্টপূর্ব প্রায় ৭০০০ সালের দিকে ফিনল্যান্ড সামি জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের উপস্থিতি ছিল। বর্তমান কালের ফিনদের পূর্বপুরুষরা খৃস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে ফিনল্যান্ড উপসাগরের দক্ষিণ সৈকত থেকে আসে। একাদশ শতাব্দীতে এলাকাটি ক্রমান্বয়ে খৃস্টান অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সুইডেন ও রাশিয়া ফিনল্যান্ডে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। তবে ১৩২৩ সালের মধ্যে সুইডেন দেশটির বেশিরভাগ শাসন করতো। ১৭২১ সালে রাশিয়া ফিনিশ ভূখন্ডের একাংশ বিচ্ছিন্ন করে নেয়। ১৮০৮ সালে রাশিয়ার আলেকজান্ডার প্রথম ফিনল্যান্ডে আগ্রাসন চালায়। ফলে ১৮০৯ সালে ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভবে রাশিয়ার অংশে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে এই এলাকায় ফিনিশ জাতীয়বাদ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় এবং ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যায়। ফিনল্যান্ড ১৯১৭ সালে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতা দিবস ৬ ডিসেম্বর।

১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডে হামলা করলে দুই দেশের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরাজিত হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফিনল্যান্ড সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে জার্মানীর চাপে ১৯৪১ সালে নাৎসীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় এবং তার হারানো ভূখন্ড আবার ফেরত পায়। ১৯৪৪ সালে অগ্রসরমান সোভিয়েতদের কাছে আবার পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে ফিনল্যান্ড তার ভূখন্ডের কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে এবং ক্ষতিপূরণ দিয়ে সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক ইউনিয়নের সাথে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে। ফিনল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ফিনল্যান্ড ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করে। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ফিনল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের ন্যায় মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু করে। ফিনল্যান্ডের এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টারজা হ্যালোনিন ২০০০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।

ফিনিশ সেলুলার-ফোন কোম্পানী নোকিয়া এবং তার জার্মান প্রতিদ্বন্দ্বি সিমেন্স কোম্পানী ঐ বছর জুনে তাদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা একীভূত করার ঘোষণা দেয়। আগস্টে রাশিয়া ফিনল্যান্ডকে ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো পরিশোধ করে এবং পণ্য ও সেবা আকারে আরো আড়াই-তিন কোটি ইউরো দিতে সম্মত হয়। বিনিময়ে ফিনল্যান্ড রাশিয়াকে দেয়া তার অবশিষ্ট ঋণ মওকুফ করে।

সরকার পদ্ধতিঃ

ফিনল্যান্ডে সরকারের ধরন ২০০ সদস্যের এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টসহ বহুদলীয় গণতন্ত্র। পার্লামেন্টের নাম ইডুসকুনটা, মেয়াদ ৪ বছর। এটি ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। প্রেসিডেন্ট যে কোনো সময় সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন ঘোষণা করতে পারেন। ১৮ বছর বয়সী একজন নাগরিক যিনি সামরিক কোনো কর্মকর্তা নয় তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। ফিনল্যান্ডের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট সাউলি ভেইনামে নিনিসটো এবং প্রধানমন্ত্রী জোওহা পেট্রি সিপিলা।

যোগাযোগ ব্যবস্থা : ফিনল্যান্ডে মোট রেলপথ আছে ৫৯৪৪ কি. মি. (২০১৩), সড়ক পথ ৭৮ হাজার কি. মি. (২০১২), জলপথ ৮০০০ কি.মি. (২০১৩)। প্রধান সমুদ্রবন্দর-হেলসিংকি, কটকা, নানটালি, পোরবো, রায়াহি, রাওয়ামা। বিমানবন্দর আছে ১৪৮টি (২০১৩)।

তথ্যসূত্র :

১. http://www.infoplease.com/country/finland.html

২. https://en.wikipedia.org/wiki/finland

লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে ‘মাসিক পৃথিবী’ পুরনো সংখ্যা থেকে।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88