বিশ্বে ইসলামি আর্থিক প্রডাক্টস ও ব্যবস্থার চাহিদা বাড়ছে

বিশ্বে ইসলামী আর্থিক প্রডাক্টস ও ব্যবস্থার চাহিদা বাড়ছে
লিখেছেন: আবু আহমেদ
এক সময় মনে করা হতো, ইসলামি আর্থিক প্রডাক্টস ও ইসলামি অর্থনৈতিকব্যবস্থা শুধু ধর্ম মানে, এমন মুসলমানদেরই দাবি। আজ কিন্তু বিষয়টি তা নয়। বর্তমানে এটি এক অর্থে, ধর্মনিরপেক্ষ তথা সব ধর্মের মানুষের উপযোগী আর্থিকব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী গৃহীত হচ্ছে। আসলে ইসলামি নামের আর্থিক প্রডাক্টস আর এই ব্যবস্থার সাথে অন্য ধাঁচের ব্যবস্থা বা আমাদের কাছে অধিক পরিচিত সুদভিত্তিকব্যবস্থার কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। এগুলো মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের নির্দেশনা থেকে উদ্ভূত। কুরআন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, ‘তোমরা সুদের কারবার করো না, সুদ তোমাদের আয় বাড়াবে না, বরং তোমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।’ ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ও তাওরাতেও ‘সুদ’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি যখন ধর্ম থেকে দূরে সরে গেল, তখন সুদ নামের ঋণের একটা মূল্যও লেনদেনে এসে পড়ল। যদিও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থেও সুদের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে, তবুও তারা বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর তালাশ করে সুদকে তাদের লেনদেনে একটি বড় উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছে।এক সময়ে বিশ্বে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে দাঁড়াল যে, সুদ ছাড়া আর্থিক লেনদেন সম্ভবই নয়। কিন্তু কিছু মুসলমানের উদ্যোগের ফলে আজ তিন যুগ পর বিশ্বের অনেক পণ্ডিত ও গবেষকই স্বীকার করে নিচ্ছেন, সুদ ছাড়াও আর্থিক লেনদেন ও আর্থিকব্যবস্থা চলতে পারে এবং সেই ব্যবস্থা বরং বেশি স্থিতিশীল। অন্য কথায়, সুদের বদলে লাভ-লোকসানের বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যে ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয় না; লাখ লাখ গ্রাহক ঋণের ভারে হয় না জর্জরিত। সুদের যে কী নির্যাতন, তা যারা সুদে ঋণ নিয়েছেন তারা হাড়ে হাড়ে টের পান। সুদের নির্যাতন নিয়ে ইউরোপেও অনেক নাটক-উপন্যাস লেখা হয়েছে। সুদের উপকারভোগী হলেন বিত্তবানেরা। তারা সুদে অর্থ খাটিয়ে আরো ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সুদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আর্থিকব্যবস্থা গরিবদের স্বার্থপরিপন্থী। সুদের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, ঋণগ্রহীতার লাভ হোক আর লোকসান হোক, চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণবিক্রেতাকে সুদ দিতে গ্রহীতা বাধ্য। এই ব্যবস্থার বদলে অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা উত্তম বলে স্বীকৃত হয়েছে এখন অনেক দেশেই। পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন সুদের বিকল্প আর্থিকব্যবস্থা নিয়ে পড়ালেখা করানো হয়। সুদ দিতে পারেননি বলে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষ মর্টগেজধারীর কাছে তাদের বাড়িগুলো হারিয়েছেন। ঋণবিক্রেতারা প্রথমে বলবেন, ‘এই সুদ আসলে তেমন কিছু নয়। আপনি বাড়ির আয় এবং বাড়ির মূল্যবৃদ্ধি থেকে সুদ-আসল ফেরত দিতে পারবেন।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্য। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ব্যাংকঋণে বাড়ি কিনতে গিয়ে লাখ লাখ মধ্যবিত্ত নাগরিক তাদের স্বপ্নের বাড়িগুলোকে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এর মূল কারণ হলো, অ্যাসেট বা সম্পদের যে মূল্য নয়, ঋণবিক্রেতারা শুধু সুদ পাওয়ার আশায় এর চেয়ে অনেক বেশি ঋণ বাড়ির ক্রেতাদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের ধর্ম ইসলাম এ ধরনের কারবারকে নিষেধ করেছে। আমাদের ধর্মে স্পেকুলেশনের (Speculation) অনুমোদন আছে বটে, তবে একটি স্তর পর্যন্ত। যে বস্তুর উপস্থিতি নেই, আমাদের ধর্ম সেই বস্তুর ওপর লেনদেন করতে নিষেধ করেছে। গত তিন দশকে দেশে দেশে অনেক ইসলামি ব্যাংক গড়ে উঠেছে; কিন্তু কোথাও শোনা যায়নি, কোনো দেশের ইসলামি ব্যাংক গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বা বসে গেছে। অন্য দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক নামীদামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হয় একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছে, নতুবা করদাতাদের অর্থ দিয়ে সেগুলোকে ওই সব দেশের সরকার উদ্ধার করতে বাধ্য হয়েছে। বোধ করি, এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই আজ ইউরোপ-আমেরিকার অনেকেই ইসলামি ধাঁচের আর্থিক ব্যবস্থাপনার মডেলের দিকে নজর দিতে চাচ্ছেন। যদিও ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিকব্যবস্থার মৌলিক দর্শন আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন, তবুও অমুসলমানেরা যখন এই মডেল গ্রহণ করবেন, তখন ওই সব প্রতিষ্ঠানের নাম ইসলামি না-ও হতে পারে। অন্য কথায়, তারা ইসলামি মডেল থেকে অনেক কিছু নেবেন সত্য, তবে তারা নামে কোনো কিছুকে হয়তো ‘ইসলামি’ বলবেন না এবং তাদের মডেলে কিছুটা পরিবর্তনও আনতে পারেন।

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া ইসলামি আর্থিক প্রডাক্টস ও ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থায় অনেক এগিয়ে গেছে। সে দেশের মডেলকে অন্য দেশগুলো অনুকরণ করছে। ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন আইনি কাঠামোও দাঁড় করিয়েছে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছে করলে সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশেও আশির দশকের প্রথম দিক থেকে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছে। এটি শুরু হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দিয়ে; যে ব্যাংক এখন এ দেশে ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। বাংলাদেশে এখন ব্যাংকিংয়ের ২৫-২৮ শতাংশ বাজার ইসলামি ব্যাংকগুলোর অধীনে। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে, এই দেশ অন্তত এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। এর অন্য অর্থ হতে পারে, আমাদের দেশের অনেক লোকই সুদ থেকে দূরে থাকতে চান এবং তারা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের আয়কে হালাল করতে চাচ্ছেন। ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্য অনেক আগেই ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার অনুমোদন দিয়েছে। এখন হাজার হাজার অমুসলিমও এ ধরনের ব্যাংকের গ্রাহক। আসলে ব্যবসায় ও প্রডাক্টসের এই ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ। অর্থাৎ ব্যাংক বা হালাল পণ্যের ব্যবসায় যে শুধু মুসলমানেরা করতে পারবেন, এমন নয়। অন্য ধর্মের লোকেরাও এ পদ্ধতিতে ব্যবসায় করতে পারেন। লন্ডন এখন অন্য আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্র বা Hub হিসেবে গণ্য হওয়ার সাথে সাথে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থারও অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত হতে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য তাদের আইন ও রেগুলেশনগুলোকে পরিবর্তন করছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রডাক্টসের বর্তমান বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই বর্ধিষ্ণু ব্যবসার অংশীদার হতে যাচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানিও। অন্য দিকে বিশ্বে হালাল ফুডের আরেকটি বড় ব্যবসায় শুরু হয়েছে। এতেও অনেক অমুসলিম অংশ নিয়েছেন। হালাল ফুডের বাজার বর্তমানে ৩০০-৪০০ বিলিয়ন ডলারের। এসব ব্যবসায় আগামীতে অনেক বাড়বে বলে সবাই বলছেন।

লেখক : অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

উৎসঃ   নয়া দিগন্ত

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member