ইবনে খালদুন : সমাজ বিজ্ঞানের জনক

আবু জাইদ আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন। তাকে বলা হয় সমাজ বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জনক। তিনি ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলে মনে করতেন। তাঁর কল্পিত ইতিহাস-বিজ্ঞান ছিল সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের বিজ্ঞান। তিনি এনালস বা গতানুগতিক বর্ষপঞ্জি ও ইপিসোডিক্যাল হিস্ট্রি বা কাহিনীমালার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরেন। তিনি ছিলেন একজন ইতিহাস দার্শনিক। আধুনিক ইতিহাস-দর্শনের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য সাধারণ ও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ইবনে খালদুন নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।

জন্ম ১৩৩২ খৃষ্টাব্দে। মৃত্যু ১৪০৬-এ। আরনল্ড টয়েনবি ও রবার্ট ফ্লিন্ট প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি দেশ, কাল, পাত্রভেদে সর্বাপেক্ষা চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস দর্শনের প্রণেতা এবং প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা অগাস্টিনও তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না।

তিনি ‘কিতাব-আল-ইবার’ নামে লিখে গেছেন উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের ইতিহাস। এ বইয়ের মুখবন্ধে তিনি ইতিহাস জ্ঞানের জটিলতা সম্পর্কে এক জ্ঞানগর্ভ ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করান। এই ভূমিকাটি আজও তাকে এ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় করে রেখেছে।

আলজেরিয়ার ‘কালাত ইবনে সালামাহ’ দুর্গে ১৩৭৫-৭৮৯ সময় পরিধিতে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে তিনি এই ভূমিকা বা মুকাদ্দিমা রচনা শেষ করেন। তাঁর মূল পরিকল্পনা উত্তর আফ্রিকার আরব ও বারবারদের ইতিহাস ‘কিতাব-আল-ইবার’ লেখা শেষ হয় আরও পরে। তা লেখা শুরুর আগে তিনি ইতিহাসের সত্যকে অন্যান্য মিথ্যাচার থেকে আলাদা করার তাগিদ অনুভব করেন। সে তাগিদ থেকেই তিনি ইতিহাস-জ্ঞানের প্রকৃতি ও ধারা পর্যালোচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং উল্লিখিত মুখবন্ধ বা মুকাদ্দিমায় তাঁর অভিমত ও সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন। আরও দেখা যায়, তিনি সমাজ ও সমাজ বিজ্ঞানের প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক নতুন বিজ্ঞান ‘ইলম আল উমরান’ বা সংস্কৃতির বিজ্ঞান বা সায়েন্স অব কালচার আবিষ্কার করেন। এই নতুন বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো মানব সমাজ। আর সমস্যা হিসেবে দেখা যায়, সতত সামাজিক বিবর্তনের বীজ সমাজের প্রকৃতিতেই বর্তমান থাকে।

ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমায় উপস্থাপিত বিষয়াবলী ৬ অংশে ভাগ করে আলোচনা করেন। প্রথম ভাগে সমাজ বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়। এখানে সামাজিক শ্রেণী ও ভৌগোলিকভাবে মানুষের বিভাজন সম্বন্ধে জানা যায়। দ্বিতীয় ভাগে তিনি যাযাবর সমাজ, গোত্র ও অনগ্রসর জাতিসমূহ সম্পর্কে আলোচনায় আসেন। তৃতীয় ভাগের বিষয়বস্তু হিসেবে পাওয়া যায় রাষ্ট্র, আধ্যাত্মিক ও ইহজাগতিক ক্ষমতা এবং রাষ্ট্ৰীয় পদবীসমূহ। চতুর্থ ভাগে স্থায়ী সমাজ, নগর ও প্রদেশের পর্যালোচনা মিলে। পঞ্চম ভাগে মানুষের কারুকাজ, জীবিকা উপার্জনের উপায় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। পরিশেষে ষষ্ঠ ভাগে পাওয়া যায় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা। মোট কথা, এ ছয় ভাগের প্রত্যেক ভাগে সামগ্রিকভাবে সর্বত্র ইতিহাস তত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষা নীতির ওপর বহু জ্ঞানদীপ্ত পর্যবেক্ষণ ছড়িয়ে আছে। অন্যভাবে বলা যায়, এখানে মানব সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের এক অনন্য সুন্দর আলেখ্য বর্তমান।

ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমায় যা কিছু বর্ণনা করেছেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ। এখানে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলে গেছেন, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মাঝামাঝি জায়গাটা মানুষের জন্যে সবচে’ বেশি উপযোগী। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোনও মানুষ একা জীবন ধারণের উপযোগী প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যসামগ্ৰী উৎপাদন করে নিজের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এ জন্যে প্রয়োজন পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা। ইবনে খালদুনের মতে, পরিপূর্ণ সহযোগিতা এক জটিল সামাজিক বিবর্তনের সৃষ্টি করে, যাকে তিনি নগরায়ণ বলে আখ্যায়িত করেন।

ইবনে খালদুন দেখান, রাজবংশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন অধিক সংখ্যায় লোক সমাগম। তাই বিকশিত সভ্যতার মধ্যেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে শাসকবর্গের বড় বড় শহর, নগর ও বন্দরের প্রয়োজন হয়। স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এরা বিলাসিতা আর আরাম-আয়েশের প্রতি নজর দেয়। মানুষকে বিলাস সামগ্রীর তৈরিতে উৎসাহিত করে। এর ফলে কারুশিল্প, বিভিন্ন কলা-কৌশল ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাঁর মতে, অতি বিলাস প্রিয়তা রাজবংশের অবক্ষয় ও পতন নিশ্চিত করে। কারণ, বিলাস-ব্যসনের জন্যে প্রয়োজন হয় অগাধ ধনসম্পদ।

ইবনে খালদুন ছিলেন ব্যাপক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এক মানুষ। তাঁর মা-বাবা ছিলেন ইয়েমানী আরব। তাঁরা স্পেনে গিয়ে স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলেন। সিডেলি’র পতনের পর তারা চলে যান। তিউনিসিয়ায়। ইবনে খালদুনের জন্ম সেখানেই। সেখানে শৈশব ও শিক্ষা জীবন কাটান। এরপর যোগ দেন মিসরীয় সুলতান বারফুকের সার্ভিসে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। খুব শিগগির জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি সে চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি চলে যান মরক্কোর রাজধানী ফেজ-এ। দুর্ভাগ্য তার পিছু নিলো। ফেজ-এ তখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাজ পরিবারের সদস্যরা লিপ্ত ছিল ক্ষমতার জটিল-কুটিল নানা খেলায়। সেখানে শান্তি ও সহনশীলতার ছিল বড়ই অভাব। কিন্তু জ্ঞান অর্জনে ইবনে খালদুনের উৎসাহে ছিল না বিন্দুমাত্র ভাটা। এ সময় তিনি নিরাপদ আশ্রয় পান আলজেরিয়ার ‘কালাত ইবনে সালামত’ দুর্গে। ছোট দুর্গ গ্রামে ৪ বছর নিরাপদে অবস্থান করেই লিখেন আল মুকাদ্দিমা। শিগগিরই বইটি যথারীতি প্রকাশিত হলো। সেখান থেকেই শুরু হলো ইবনে খালদুনের উত্থান যাত্রা। তবে তাঁর চারপাশে ছিল এক অব্যাহত অনিশ্চয়তা। ফিরে এলেন মিসরে। আসীন হলেন এক সম্মানিত পদে। তিনি হলেন মালেকী কানুনের প্রধান কাজী। সেই সাথে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু তার শত্রুরা ছিল সমভাবে ঈর্ষান্বিত ও সক্রিয়। পর পর ৫ মেয়াদের পর তাকে কাজীর আসন থেকে নামানো হলো।

ইবনে খালদুন একজন গণিতবিদও ছিলেন। গণিত বিষয়ে তিনি ব্যাপক কাজ করেছেন। গণিত বিষয়ে তার বইগুলো ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে তাঁর অনেক বইয়ের অনুবাদ হয়েছে। এসব বইয়ের মাধ্যমে ইবনে খালদুনের নাম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

মুককাদ্দিমা ইবনে খালদুনের বাংলা অনুবাদ ডাউনলোড করতে নিচে ক্লিক করুন

১ম খন্ড

২য় খন্ড

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88