অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ যাতনা ও ধ্বংসের এক আলামত, আল্লাহর অবাধ্য ইউরোপ সমাজ যাতে ভুগছে। পাশ্চাত্য বিশ্বে নাস্তিকতার দর্শন হিসেবে তার খ্যাতি সবচেয়ে বেশি, যদিও তাতে তুলনামূলক অনেক অগ্রগতি বিদ্যমান, যা বাস্তবায়ন করেছে ধ্বংসাত্মক নতুন দর্শন, যার নাম গঠনবাদ অথবা কাঠামোবাদ।

অস্তিত্ববাদ নাম কেন হল?

অস্তিত্ববাদ শব্দটি অস্তিত্ব ধাতু থেকে সৃষ্ট, কারণ তার দর্শনের সারাংশ হচ্ছে: “অস্তিত্ব সারাংশ বা উপাদানের আগে”, তার দাবি ও বিষয় হচ্ছে: মানুষের জন্মের পূর্ব থেকে নির্ধারিত এক স্রষ্টা বা মতবাদ পালন করার জন্য মানুষের অস্তিত্ব বা সৃষ্টি হয় না, বরং তার অস্তিত্বই এমন মতবাদকে নির্ধারণ করে যার উপর ভবিষ্যতে সে চলবে এবং যা সে গ্রহণ করবে, প্রত্যেক ব্যক্তি গ্রহণ ও মনোনয়ন করার ক্ষেত্রে স্বাধীন।

অতএব অস্তিত্ববাদ প্রত্যেক দীন, মূল্যবোধ ও সংস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার নামান্তর, যেমন:

১. খ্রীস্টবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ:

অস্তিত্ববাদ খ্রীস্টবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কারণ খৃস্টবাদ মানুষের জন্য আগাম নীতি ও আদর্শ নির্ধারণ করে, যেমন খ্রীস্টীয় আকিদায় বিশ্বাসী হওয়া, ধর্মীয় ব্যক্তিদের অনুসরণ করা এবং তার ইচ্ছা ও বিবেক সমর্থন করে না তার প্রতিও ঈমান, কেবল আনা ধর্মে আছে তাই তাকে তা মানতে হবে।

২. সামাজিক সংগঠনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ:

অস্তিত্ববাদ সামাজিক সংগঠনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কারণ, সামাজিক সংগঠন জামা‘আত বা একতাবদ্ধ জীবনকে গুরুত্ব দেয়, ব্যক্তির গুরুত্ব খর্ব করে এবং সকল মানুষকে—তাদের বিভিন্ন স্বভাব সত্ত্বেও—এক আদর্শের উপর একত্র করে, যা পূর্ব থেকে নির্মিত, কমিউনিজম বা সাম্যবাদ তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৩. মানসিক মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ:

অস্তিত্ববাদ মানসিক মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কারণ, অস্তিত্ববাদের দৃষ্টিতে মানসিক মতবাদ মানুষের হাকিকত সম্পর্কে গাফিল, অর্থাৎ (গোপন অহং), অধিকন্তু সমাজ সংগঠন ও সাধারণ নীতি নির্ধারণ করে বিবেক, যা অস্তিত্ববাদীরা প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণভাবে। এ জন্য অস্তিত্ববাদীদের লেখনী অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবেগময় ও আপেক্ষিক হয়, চিন্তাগত দর্শন হয় না।

অস্তিত্ববাদের প্রকার:

অস্তিত্ববাদ দু’প্রকার:

১. সূফী অস্তিত্ববাদী: তাদেরকে বিশ্বাসী অস্তিত্ববাদী বলা হয়, এ মতের প্রসিদ্ধ ধারক হচ্ছে, কার্ল য়াসবারজ (যাবরাজ), মৃত ১৯৬৯ই.

২. স্বেচ্ছাচারী অস্তিত্ববাদী: তাদেরকে নাস্তিক অস্তিত্ববাদী বলা হয়, অস্তিত্ববাদী দ্বারা সাধারণত তাদেরকে বুঝানো হয়।

সূফী অস্তিত্ববাদীর উদাহরণ হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। বাস্তব বর্জিত হওয়ার কারণে তারা এক দিকে খ্রীস্টীয় আকিদার উপর বিশ্বাস হারায়, অপর দিকে স্বভাবের টানে ঈমানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান করার মধ্য থেকে সূফী অস্তিত্ববাদ জন্ম লাভ করে, তবে সঠিক ঈমানের হিদায়েত তারা পায়নি। এ মতের ধারকরা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না, তবে তারা গির্জার প্রভূতে পরিতৃপ্ত নয়, ফলে হিন্দু সূফী ও অন্যদের সাধনায় তারা ঘুর-পাক খায়।

স্বেচ্ছাচারী অস্তিত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে জার্মানি ইয়াহূদী দার্শনিক (নিতশাহ), মৃত ১৯০০ই.। ইয়াহূদী সম্পর্কের কারণে স্বভাবত সে খ্রীস্টবাদের শত্রু ছিল। নিতশাহ স্পর্ধা দেখিয়ে বলে (রব মারা গেছেন), তার স্থলে মহান মানব (সুবরমান) স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, যার প্রতিনিধিত্ব করছে দেশ ও সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, সকল মানুষের কর্তব্য তাদের আনুগত্য করা।

সে আরো বলে, খ্রীস্টবাদ হচ্ছে বেড়ি ও জেলখানা, মানুষের মনুষ্যত্ব ও স্বাধীনতা বিধ্বংসী, সে মানুষকে গির্জার কতক ব্যক্তির দাসে পরিণত করে।

বিংশ শতাব্দীর স্বেচ্ছাচারী অস্তিত্ববাদের প্রধান ব্যক্তি (সারতার) ১৯৮০ই. মারা যান। তিনি ফ্রান্সী ইয়াহূদী ছিল, প্রথম সে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বড় হয়, পরবর্তীতে সে তার পূর্বপুরুষ (নিতশার) মতবাদ অস্তিত্ববাদকে জীবিত করে, কিন্তু তিনি বিবেক ও দর্শনকে ব্যবহার করেননি, তবে ব্যবহার করেছেন আদব ও সাহিত্যকে, যেমন আবেগময়তা, ধৈর্যশীলতা ও রূপকথা। এভাবে ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে তার চিন্তাধারা। সে দার্শনিকদের সমালোচনা থেকে সুরক্ষার জন্য দর্শনের ময়দানকে এড়িয়ে চলে, দ্বিতীয়ত দার্শনিকদের সামনে তার টিকে থাকার ক্ষমতাও ছিল না।

ইসলামি বিশ্বে অস্তিত্ববাদীদের ঝুঁকি:

ইসলামি বিশ্বে অস্তিত্ববাদ বিস্তার লাভ করার ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতায় বিশ্বাসী কতক যুবক তা সহজে গ্রহণ করে। মুসলিম সমাজে কাফেরদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের উপকরণের সয়লাব, ইসলামি শিক্ষা ও সচেতনতার দুর্বলতা, যুবকদের সীমালঙ্ঘন, প্রসিদ্ধির মোহ ও বিরোধিতার মনোভাব অস্তিত্ববাদের ময়দানকে প্রস্তুত করে দেয়।

অস্তিত্ববাদীরা এমন ছিদ্র দিয়ে ইসলামি বিশ্বে প্রবেশ করে, যা অনেক মানুষ বুঝে না, যেমন সাহিত্য: (বর্ণনা, কবিতা, নাটক, সমালোচনা)। এ তথ্য আমাদের নিকট স্পষ্ট করে যে, কমিউনিজম বা সাম্যবাদ ও অন্যান্য মতবাদের ধারকরা লেখনী সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে যায় এ জন্যই।

বস্তুত কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদীরা তাদের মতবাদ থেকে পিছু হটেনি, বরং (সারতার) জীবনের শেষে সাম্যবাদ (কমিউনিজম) ও তার মাঝে যেভাবে সমন্বয় করেছিল, তারা সেটার অনুসরণ করে। তারা দেখল সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী শ্লোগান ম্লান হয়ে গেছে, দ্বিতীয়ত ইসলামি সমাজ কখনো স্পষ্ট নাস্তিকতা গ্রহণ করবে না, তাই তারা সাহিত্য কর্মকে আড়াল হিসেবে গ্রহণ করে।

অনুরূপ ‘সারতার’ নাস্তিকতাপূর্ণ নতুন দর্শন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মার্কস, অস্তিত্ববাদ ও অন্যান্য মাযহাবের নির্যাস গ্রহণ করে, যার নামকরণ করা হয় গঠনমূলক মতবাদ অথবা কাঠামোগত মতবাদ। উভয়ের নেতৃত্ব দেয় (ক্লোদ লিফি শাতরাবিস), এটাও মৌলিকত্ব ও হাকিকতের বিবেচনায় অস্তিত্ববাদ থেকে পৃথক কিছু নয়, তবে তার দাবি এ মতবাদ অস্তিত্ববাদ থেকে আরো ব্যাপক ও বিশ্লেষণাত্মক। তার অনুসারীরা দাবি করে (এটাই ভবিষ্যতের দর্শন), অতিশীঘ্র এ নীতি সকল আদর্শ ও বিধানকে বিলুপ্ত করবে এবং তার জায়গায় নতুন নীতি, আদর্শ ও বিধান চালু করবে, অর্থাৎ জগত, মানুষ ও ধর্মের জন্য নতুন দর্শন প্রবর্তন করবে, তাই পাশ্চাত্যে তাকে ‘আধুনিকত্ব’ বলা হয়, কখনো তার অনুবাদ করা হয় (নতুনত্ব)। তাদের এ পরিভাষা প্রতারণামূলক, এর অভ্যন্তরীণ বিষয় না জেনে অনেকে এর জালে আটকা পড়েছে।

তারা যে বাণীর দিকে আহ্বান করে সেটা শুধু ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—তাতে ধ্বংস ও বিপদ যা থাকার তা তো আছেই—তবে প্রকৃত অর্থে সেটা হচ্ছে জীবন, আচরণ, ধর্ম ও প্রত্যেক বস্তুর জন্য এক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সকল আদর্শ, পরিবেশ ও মতামতকে পরিবর্তনকারী, বাহ্যিক অথবা আভ্যন্তরীণ প্রত্যেক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

অস্তিত্ববাদ ও তার আকিদা ধারণকারী ব্যক্তিদের প্রতি সামান্য দৃষ্টি দিলেই তার পশ্চাতে থাকা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও গোপন ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে যাবে। আরও বুঝা যাবে যে, এর পিছনে তাদের একটি গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে। তাদের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ নিম্নরূপ:

এডোনিস: নুসাইরি (মতবাদ বিশ্বাসী)।

বদর শাকির আসসাইয়াব: সে ছিল কমিউনিস্ট (সাম্যবাদী) , পরবর্তীতে সবকিছুতে অবিশ্বাসী হয়ে হতাশার জীবন যাপন করে।

সামীহুল কাসিম: দ্রুয মতবাদে বিশ্বাসী, আবার কমিউনিস্টও। নাযার ক্বাব্বানী: স্বেচ্ছাচারী অস্তিত্ববাদী।

আব্দুল ওয়াহহাব আল-বায়াতি: কমিউনিস্ট (তথাকথিত সাম্যবাদী)।

আরেকটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা জরুরি যে, এদের মতবাদে বিশ্বাসী সব জায়গার লোকদের মধ্যে এক ধরনের আঁতাত পরিলক্ষিত হয়। ইসলামি বিশ্বে সমকালীন সাহিত্যের উপর বিশ্লেষণকারী তা অতি সহজেই দেখতে পাবে।

অধ্যয়নের জন্য মূল পাঠ:

এডোনিস[1] বলেন:

কবিতা অথবা নাটক অথবা ঘটনা আরব জনগণ যার মুখাপেক্ষী, এমন বস্তু নয় যা তাকে তৃপ্ত করবে কিংবা তার সামনে ধ্বংসাত্মক বস্তু পেশ করবে, এমন বস্তুও নয় যা তাকে চলমান জীবনে নেতৃত্ব দিবে, তবে তা এ জীবনকে আটকে দিবে, অর্থাৎ তার অবস্থান থেকে তাকে বের করবে, তার পৈতৃক আদর্শ সম্পর্কে তাকে ভাবিয়ে তুলবে এবং তার নফসের বাইরে তাকে নিক্ষেপ করবে। নিশ্চয় এটা প্রতিরোধ করবে তার রাজনীতি, তার ধর্মীয় সংস্থা, তার পারিবারিক সংস্থা, তার পৈতৃক রীতি, তার সংস্থা ও তার সামাজিক ভিত্তি, তার সকল নিদর্শন ও তার প্রতিষ্ঠানসহ। আর এটা করা হবে তাকে সর্বতোভাবে ধ্বংস করার নিমিত্তে, অর্থাৎ নতুন আরব মানব তৈরি করার লক্ষ্যে।

এভাবেই বিপ্লব ঘটাতে হবে আমাদের: নাটকের পরিবর্তে নাটক, কবিতার পরিবর্তে কবিতা, ঘটনার পরিবর্তে ঘটনা। আমাদের কাজ ঐতিহ্য ধ্বংস করা, কারণ এখানেই তো বিপ্লবের প্রথম শত্রু আত্মগোপন করে আছে।

লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


[1] তার প্রকৃত নাম আলি আহমদ সায়িদ, সে তার নিজের নাম রেখেছে এডোনিস। এটা মূলত ফিনিকিয়াদের এক উপাস্যের নাম।

সৌজন্যে : ionlinemedia

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member