ইবনু’ল-জাওযী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

‘আবদুর-রাহমান ইবন আবি’ল- হাসান ইবন ‘আলী ইবন মুহাম্মাদ (হাজী খালীফায় ‘আবদুল্লাহ) আবূল-ফারাজ (আবূল-ফাদা’ইল) জামালুদ-দীন আল-কুরাশী আত-তামীমী আল-বাকরী আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী, প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফাকীহ, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক, ধর্ম প্রচারক, বহু গ্রন্থের প্রণেতা, ৫১০/১১২৬ সালে বাগদাদে জন্ম (জন্মসাল সম্পর্কে মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। কারণ ইবনু’ল-জাওযীর নিজেরই তাঁহার সঠিক জন্মসাল জানা ছিল না। এই সম্পর্কে তাঁহাকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি অনেকটা অস্পষ্ট জবাব দিতেন)। তবে তিনি সম্ভবত হিজরী ৫০৮-৫১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ করেন (ইবন রাজাব, যাযল ‘আলী তাবাকাতি’ল-হানাবিলা, পত্ৰক ১৩১ খ.)। সিবত ইবনু’ল-জাওযী তাঁহার জন্মসাল ৫১০ হি. বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (মির’আতুয-যামান, পৃ. ৪৮৩)।

তাঁহার নিসবা (সম্বন্ধবাচক নাম) আল-জাওযী সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রহিয়াছে। সঠিক বর্ণনা এই যে, বসরার একটি মহল্লা জাওযা-র সহিত নিসবা-টি সম্পর্কিত (জাওযী, শাযারাতু’য-যাহাব, কায়রো সংস্করণ, ৪খ, ৩৩০) এবং তাঁহার একজন পূর্বপুরুষ জা’ফার সেই মহল্লার অধিবাসী ছিলেন (ইবন রাজাব আল-হাম্বালী, যায়ল ‘আলা তাবাকাতিল-হানাবিলা, কোপরূলূ পাণ্ডু, ইস্তাম্বুল, নং ১১১৫, পত্ৰক ১৩০ক; ইবনু’ল-ইমাদ, শাযারাতু’য- যাহাব, পূ. স্থা.; মির’আতুয-যামান, পৃ. ৪৮১)।

তিন বৎসর বয়সে তিনি পিতৃহীন হন। অতঃপর তাঁহার মাতা ও ফুফু তাঁহার শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা গ্ৰহণ করেন এবং সমসাময়িক প্রসিদ্ধ ‘আলিমগণের নিকট শিক্ষালাভের উদ্দেশে তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হয়। তাঁহার উস্তাদগণের তালিকায় ৭৮ জন ‘আলিমের নাম উল্লেখ করা হইয়া থাকে। তন্মধ্যে ইবনু’য-যাগূনী (মৃ. ৫২৭/১১৩৩), আবূ বাকর আদ-দীনাওয়ারী (মৃ ৫৩২/১১৩৭-৩৮), আবূ মানসূর আল-জাওয়ালীকী (মৃ. ৫৩৯/১১৪৪-৪৫), আবূ’ল-ফাদল ইবনু’ন-নাদির (মৃ. ৫৫০/১১৫৫), আবূ হাকীম আন-নাহরাওয়ানী (মৃ. ৫৫৬/১১৬১) ও কা’দী আবূ ইয়ালা ইবনু’ল-ফাররা’-এর পৌত্র আবূ ইয়ালা (৫৫৮/১১৬৩)-এর নাম সবিশেষে উল্লেখযোগ্য। তাঁহাদের মধ্যে আবূ বাকর আদ-দীনাওয়ারীর নিকট ফিকহ ও তৰ্কশাস্ত্ৰ (তু. ইবন রাজাব আল-হাম্বালী, কিতাবু’য-যায়ল, সম্পা. H. Laoust ও সামী দাহহান, দামিশক ১৯৫১ খৃ. Institut Francais, দামিশক, ১খ, ২২৮-৩০) এবং আবূ মানসূর আল-জাওয়ালীকীল নিকট বিশেষত ‘আরবী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা করেন (দ্র. ইবন রাজাব, পূ. গ্র., ১খ, ২৪৪-২৪৬; Brockelmann, ১খ, ২৮০; পরিশিষ্ট, ১খ, ৪৯২)। যেহেতু তাঁহার বংশের লোকেরা তামার ব্যবসায় করিতেন, এইজন্য প্রাচীন নামের সংরক্ষণের সময় তাঁহার নিসবা আস-সাফফার-ও উল্লেখ করা হয়।

ইবনু’ল-জাওযী প্রখর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁহার উসতাদ ইবনু’য-যাগুনী (ইবন রাজাব, পূ. গ্র. পূ, সং, ১খ, ২১৬-২০) লোকদেরকে ধর্মোপদেশ দান করিতেন। তৎকালে ইহা একটি বিশেষ মর্যাদার বিষয় ছিল। উস্তাদের মৃত্যুর পর ইবনু’ল-জাওযী তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু অল্প বয়স্ক হওয়ার দরুন তিনি এই মর্যাদা লাভ করিতে পারেন নাই। তবে পরে তাঁহার ওয়ায শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে জামিউল-মানসূর-এ ওয়ায করিবার অনুমতি দেওয়া হয়। অতঃপর জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে তাঁহার সাধনা আরও তীব্র হয়। যেহেতু তাঁহার নিকট উত্তম নফল ইবাদাত ছিল জ্ঞানার্জন, সেহেতু যুহুদ (কৃচ্ছ্রসাধনা)-এর প্রতি তাঁহার কোনরূপ অনুরাগ ছিল না; বরং তিনি পানাহার ও স্মরণশক্তি বর্ধক খাদ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করিতেন এবং পোশাক-পরিচ্ছেদের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দিতেন।

ইবনু’ল-জাওযী তাঁহার ওয়াযের জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এই সকল ওয়াযে তাঁহার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও আলংকারিক বাক্যবিন্যাস চতুর্দিকে আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। খলীফা আল-মুকতাফীর শাসনামলে (৫৩০-৫৫/১১৩৬-৬০) ইবনু’ল-জাওযী তাঁহার উযীর ইবন হুবায়রার বিশেষ সমর্থন ও অনুগ্রহ লাভ করেন। ইবনু’ল-জাওযী প্রতি শুক্রবার ইবুন হুবায়রার গৃহে অনুষ্ঠিত ওয়ায মাহফিলে ওয়ায করতেন (যায়ল, ১খ, ৪০২)। খলীফা আল-মুসতানজিদের শাসনামলে (৫৫৫-৬৬/১১৬০-৭০) ইবনু’ল-জাওযী শাহী মসজিদে ওয়ায করিবার অনুমতি লাভ করেন। খলীফা বাগদাদের অন্যান্য শায়খ ও ‘আলিমগণের সঙ্গে তাঁহাকেও খিল’আত প্ৰদান করিয়াছেন। খালীফা আল-মুসতাদী’র শাসনামলেও (৫৬৬-৭৪/১১৭১-৯)  তিনি তাঁহার বিশেষ অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তিনি খলীফার নামে আল-মিসবাহুল-মুদী ফী দাওলাতিল-মুসতাদী নামক একখানি গ্ৰন্থ রচনা করেন। অতঃপর হি. ৫৬৮ সালে মিসরে ফাতিমীদের পতন এবং ‘আব্বাসী নামক অপর একখানা গ্ৰন্থ রচনা করেন এবং উহা খলীফার দরবারে প্রেরণ করেন। খলীফা তাঁহাকে বহু পুরস্কার প্রদান ছাড়াও বাবুদ-দারুবি-এ ওয়ায করার অনুমতি দান করেন।

বিভিন্ন খলীফা ও উযীরের সঙ্গে ইবনু’ল-জাওযীর এই সম্পর্ক সম্পদ লাভ বা কোনরূপ পার্থিব সুবিধা লাভের উদ্দেশে ছিল না, বরং ইহা ছিল জ্ঞান আবূল-কাসিমের জন্য রচিত গ্ৰন্থ ‘লিফতাতু’ল-কাবিদ কী নাসীহাতি’ল- ওয়ালাদ’ (ফাতিহ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডু, ইস্তাম্বুল, নং ৫৭৯৪; তাহা ছাড়া কায়রোতে প্রকাশিত ১৩৫৯ হি.)-এ তিনি বর্ণনা করেন, “জীবিকার্জনের জন্য আমি কখনও কোন আমীরের তোষামোদ করি নাই।”

হি. ৫৭০ সালে ইবনু’ল-জাওযী বাগদাদের দারব দীনার-এ একটি মাদারাসা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সেখানে দারস দেওয়া শুরু করেন। সেই বৎসরই তিনি তাঁহার ওয়াযসমূহ সম্পূর্ণ কুরআনের তাফসীর সমাপ্ত করেন। মুসলিম বিশ্বে তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি ওয়ায অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে কুরআনের তাফসীর সমাপ্ত করেন (ইবন রাজাব, পূ, পাণ্ডু, পত্রক-১৩৩ ক)। ইহা ছিল সেই সময়, যখন ইবনু’ল-‘আরাবীর খ্যাতি শীর্ষে আরোহণ করিয়াছিল। সমকালীন খলীফা কেবল ইবনু’ল-জাওযীর ওয়ায অনুষ্ঠানে যোগদান করিতেন। বাগদাদের অধিকাংশ লোক নিয়মিতভাবে তাঁহার পাঁচ হাজার হইতে দশ হাজার লোকের সমাগম হইত বলিয়া কথিত এবং ওয়ায মাহফিলে প্রায় এক লক্ষ লোক উপস্থিত হইত (ইবন রাজাব, পৃ. পাণ্ডু, পত্রক ১৩৪ খ; ইবন জুবায়র, রিহলা, ২য় সংস্করণ, পৃ. ২২০ ও ৪)। জনগণের উপর তাঁহার ওয়াযের এত অধিক প্রভাব ছিল যে, প্ৰায় লক্ষাধিক লোক তাঁহার হাতে তাওবা করিয়াছিল। তিনি নিজেও স্বীয় গ্ৰন্থ “কিতাবুল কুসসাস ওয়াল-মুয়াক্কিরীন’-এ ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়াছেন। প্রায় বিশ হাযার ইয়াহুদী ও খৃষ্টান তাঁহার হাতে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। অধিকাংশ বরাতে উল্লেখ রহিয়াছে যে, শেষ বয়সে ইবনু’ল-জাওযী বিশেষ বিপদের সম্মুখীন হইয়াছিলেন। বিপদের কারণ এই ছিল যে, শায়খ আবদুল-কাদির জীলানী (র)-র পুত্র ও তাঁহার মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হইয়াছিল। কারণ ইবনু’ল-জাওযী তাঁহার পিতার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। ইহা ছাড়া অন্যান্য কিছু কারণও ছিল, যাহার ফলে ইবনু’ল-জাওযী ওয়াসিত শহরে গ্রেফতার হন এবং পাঁচ বৎসর কারারুদ্ধ থাকেন। পরে খলীফার মাতার হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তিলাভ করেন [আর-রাফি’ঈ, মিরআতু’য-যামান ওয়া ‘ইবরাতু’ল-য়াকজান, হায়দরাবাদ (দাক্ষিণাত্য) ১৩৩৮ হি. ৩খ. ৪৭৭-৭৮]। অতঃপর তিনি বাগদাদে ফিরিয়া আসেন এবং রামাদান ৫৯৭/১২০০ সালে মামুলী রোগ ভোগের পর ইনতিকাল করেন। সেইদিন বাগদাদের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং সমস্ত শহরে মাতম পড়িয়া গিয়াছিল। জানা যায় যে, ইবনু’ল-জাওযীর অধিকতর উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ওয়ায-নসীহত। তিনি তাঁহার এই সকল ওয়াযে, উহা মসজিদেই অনুষ্ঠিত হউক অথবা গৃহে, রাস্তায় চলমান অবস্থায় অপ্ৰস্তুত পরিবেশে হউক অথবা নিয়ম মাফিক প্রস্তুতির মাধ্যমেই হউক, সর্বাবস্থায় হাম্বালী মাযহাবের পৃষ্ঠপোষকতা করিয়াছেন। তিনি বিদ’আতের অনুসারীদের এত কঠোর সমালোচনা করিতেন যে, খোদ তাঁহার মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যেই ফিতনার আশংকা দেখা দেয়। তাহারা তাঁহাকে অনুরূপ সমালোচনা হইতে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তিনি ইমাম গাযালী (র) রচিত ইহয়া’ ‘উলূমি’দ-দীন গ্রন্থটিকে দুর্বল হাদীছ হইতে মুক্ত করিবার উদ্দেশে গ্রন্থটির নূতন পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেন।

রচনা-সংকলনেও ইবনু’ল-জাওযীর অসাধারণ আগ্রহ ছিল। তিনি যে গতিতে ওয়ায করিতেন, একই গতিতে রচনার কাজেও ব্যাপৃত থাকিতেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেন যে, তিনি তিন শত গ্ৰন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। এইগুলির কয়েকটি একাধিক খন্ডে বিভক্ত। এইজন্য অধিক গ্রন্থের প্রণেতা হিসাবেও তাঁহার বিশেষ খ্যাতি রহিয়াছে। তাঁহার সময় পর্যন্ত অন্য কোন মুসলিম লেখক এত অধিক সংখ্যক গ্ৰন্থ রচনা করেন নাই। ইবনু’ল-জাওযী নিজে তাঁহার গ্রন্থাবলীর যে তালিকা সংকলন প্ৰস্তুত করিয়াছেন, ইবন রাজাব প্রণীত যায়লু’ত-তাবাকাতি’ল-হানাবিলা-য় ইহার উল্লেখ রহিয়াছে (পূর্বোক্ত পাণ্ডু. পত্ৰক ১৩৫খ-১৩৮খ)। সিবত ইবনু’ল-জাওযীও মিরআতু’য-যামান-এ বিষয়ানুসারে একটি তালিকা পেশ করিয়াছেন। ইহাতে প্রায় আড়াই শত পুস্তকের উল্লেখ রহিয়াছে। এইসব গ্রন্থের মধ্যে বর্তমানে পাওয়া যায়, এইরূপ গ্রন্থের সংখ্যা এক শতের কাছাকাছি (তু, Brockelmann, ১খ, ৫০১; পরিশিষ্ট, ১খ, ৯১৪ প.; হাজ্জী খলীফা, ৫খ, ৫২০-২৩)।

নিম্নে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম দেওয়া হইলঃ

১। আল-মুনতাজম কী তা’রীখি’ল-মুলুক ওয়া’ল-উমাম : ইহা একটি সাধারণ ইতিহাস গ্রন্থ। গ্রন্থটির অধ্যায়সমূহে ইবন জারীর আত-তাবারী। রচিত তারীখুর-রুসুল ওয়া’ল-মুলুক-এর সারসংক্ষেপ দেওয়া হইয়াছে। শেষাংশকে, যাহাতে ৫৭৩/১১৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলীর বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে, ইবনু’ল-জাওযীর সময়ের সংশ্লিষ্ট বিবরণের মূল বরাতরূপে গণ্য করা হয়। গ্রন্থটিতে বিশেষত খুরাসানের সালজূকদের অবস্থা ও ‘আব্বাসী খলীফাদের সঙ্গে তাঁহাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে বর্ণনা পাওয়া যায়।

এখানে এই বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গ্রন্থটিতে রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলী অপেক্ষা ব্যক্তি জীবনের ঘটনাপঞ্জীর বর্ণনার প্রতি অধিক দৃষ্টি দেওয়া হইয়াছে। সময়ে সময়ে বাগদাদে যে সকল ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে উহার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়া সেই সমস্ত ব্যক্তির, বিশেষত মুহাদ্দিছ ও ‘আলিমগণের অবস্থার বর্ণনা দিয়াছেন, যাঁহারা সেই বৎসরসমূহে ইনতিকাল করিয়াছেন। অতএব ইহা স্বীকার করা অপরিহার্য যে, আল-মুনতাজাম একটি প্রকৃত ইতিহাস গ্রন্থ হওয়ার ব্যাপারে অর্থাৎ যে অর্থে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসকে বুঝিয়া থাকেন, তৎপরিবর্তে জীবনী সম্বলিত এমন একটি গ্রন্থ বলা যায়, যাহাতে সালের ক্রমানুসারে ঘটনা বিন্যন্ত করা হইয়াছে। নিম্নলিখিত স্থানসমূহে ইহার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিতঃ

(১) প্যারিস, জাতীয় গ্রন্থাগার, বেলাশা শেফার সংগৃহীত পাণ্ডু-র তালিকা, নং ৫৯০৯;

(২) লন্ডন, বৃটিশ মিউজিয়াম, নং Add. 7320; তু. Amedroz, JRAS, 1906, পৃ. ৮৫১; পূর্বোক্ত সাময়িকী, ১৯০৪ খৃ., পৃ., ২৭৩ প.;

(৩) দামিশক, হাবীব যায়্যাত, খাযাইনু’ল-কুতুব ফী দিমাশক, পৃ. ৭৮, নং ৬২;

(৪) ইস্তাম্বুল, Horovitz, Mitt. Sem. Or. Spr., ১০খ, ৬; আয়া সোফিয়া (ইস্তাম্বুল)-এর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি (নং ৩০৯৬) যাহা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি, ইহার অনুসরণে গ্ৰন্থটি দশ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে, হায়দারাবাদ (দা’ইরাতু’ল-মা’আরিফ আল-‘উছ’মানিয়্যা), ১৩৫৫-৫৭ হি.।

(২) সিফাতুস-সাফওয়া : (সাফওয়া, তু, আয-যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ), চারি খণ্ডে সমাপ্ত, হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য) হইতে মুদ্রিত (দা’ইরাতু’ল-মা’আরিফ আল-‘উছ-মানিয়্যা), ১৩৫৫-১৩৫৭ হি.; এই গ্রন্থটি মূলত আবূ নু’আয়ম ইসফাহানীর হিলিয়াতু’ল-আওলিয়া’-র সমালোচনাসহ সারসংক্ষেপ। ইহাতে স্তরানুসারে সূকীদের জীবনী ও উক্তিসমূহকে একত্র করা হইয়াছে।

(৩) তালবীসু ইবলীস (কায়রো ১৯২৮ খৃ.), একটি ওয়ায গ্ৰন্থ। ইহাতে তিনি জনসাধারণের ইসলামী শারী’আত বিরোধী ক্রিয়াকর্মকে শয়তানী প্রভাবের ফল বলিয়া উল্লেখ করেন এবং জনসাধারণকে অনুরূপ ক্রিয়াকর্ম হইতে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। ইহাতে, তিনি দার্শনিক, নুবুওয়াত অস্বীকারকারী, খারিজী, অধ্যাত্মবাদী এবং বিভিন্ন প্রকার সূফীদের মতবাদের ভুল-ভ্ৰান্তি প্রমাণের চেষ্টা করেন এবং তাহাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তাহা ছাড়া উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন ইসলামী দলের চিন্তাধারা ও সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিক বিবরণের উল্লেখ রহিয়াছে। গ্রন্থটি সর্বদিক দিয়া উত্তম ও উপকারী।

(৪) কিতাবুল-আয্-কিয়া (কায়রো ১৩০৪ ও ১৩০৬ হি) : গ্রন্থটি মেধার স্বরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুরু করা হইয়াছে। অতঃপর সমাজের প্রতিটি স্তরের মেধাবী ব্যক্তিদের মেধা সম্পর্কিত ছোট ছোট কাহিনী নকল করা হইয়াছে।

(৫) কিতাবু’ল-হাছছি আল হিফজি’ল-ইলম : (কোপরোলূ গ্ৰন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডু, ইস্তাম্বুল, নং ৪/১১৫৭; আরও দ্র. GALS, ১খ, ৯১৭, নং ৭৮)। এই গ্রন্থে কুরআন-হাদীছ হিফজ-এর উপকার সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে। ইবনু’ল-জাওযী দাবি করেন যে, মুসলিম জাতি স্বীয় গ্রন্থাবলী হিফজ-এর মাধ্যমেই অন্যান্য জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছে। অতঃপর তিনি সেই সকল মৌল ও আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন যাহা হিফজ করার জন্য অপরিহার্য। তিনি স্মরণশক্তি বর্ধক খাদ্য ও ঔষধেরও বিবরণ দিয়াছেন। পরিশেষে বর্ণানুক্রমিকভাবে প্ৰসিদ্ধ হাফিজদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণও পেশ করিয়াছেন।

(৬) কিতাবুল-হুমাকা ওয়া’ল-মুগাফফিলীন (দামিশক সংস্করণ ১৩৪৫ হি., শহীদ ‘আলী পাশার গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডু., ইস্তাম্বুল, নং ২১৪০, তু. GALS, ১খ., ৯১৬)। গ্রন্থটিতে আহাম্মক ও অলসদের কাহিনী বর্ণনা করা হইয়াছে।

(৭) আল-মাওদূ’আতুল-কুবরা মিনাল-আহাদী ছিল-মারফুআত (দ্র, GALS, ১খ, ৯১৭, সংখ্যা ২৬); ইহার আলোচ্য বিষয় প্রক্ষিপ্ত হাদীছের সমালোচনা । ইহাতে সেই সকল হাদীছই উল্লিখিত হইয়াছে, যাহা জনসাধারণ কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জল করা হইয়াছিল। ইহা চারি খণ্ডে সমাপ্ত একখানি বৃহৎ গ্রন্থ।

(৮) যাম্মুল-হাওয়া (দ্র. GALS, পূ. স্থা. নং ৬০)। ইহাতে প্রবৃত্তি, প্রেম ও অনুরাগের ক্ষতিসমূহের বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা হইতে মুক্তির বিষয়সমূহও আলোচিত হইয়াছে।

(৯) কিতাবুল-কুসসাস ওয়াল-মুযাক্কিরীন (দ্র. GALS, ১খ, ৫০৩, নং ১০)। ইহা ইবনু’ল-জাওযীর একটি উন্নত মানের মনোরম গ্রন্থ। ইহাতে খ্যাতনামা ধর্মীয় কাহিনীকারদের উল্লেখ রহিয়াছে এবং তাঁহারা যে ভিত্তিহীন ও হাস্যকর কাহিনীর অবতারণা করিয়াছিলেন ইহার আলোচনা করিয়াছেন। যেমন একদিন একজন কাহিনীকার ওয়ায করিতেছেন, যে ব্যাঘ্রটি ইউসূফ (আ)-কে ভক্ষণ করিয়াছিল ইহার নাম ছিল অমুক। উপস্থিতদের একজন বলেন যে, ইউসূফ (আঃ)-কে তো কোন ব্যাঘ্র খায় নাই। তৎক্ষণাৎ কাহিনীকার বলেন, যে ব্যাঘ্রটি ইউসূফ (আঃ)-কে খায় নাই, উহার নাম ছিল এই। গ্রন্থটির বিশেষ গুরুত্বের কারণ এই যে, গ্ৰন্থকার ইহাতে তাঁহার সময়ের সকল নিরর্থক ভিত্তিহীন ‘আকা’ইদের বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন। ইহাদের অধিকাংশ বর্তমান কাল পর্যন্ত জনসাধারণের মধ্যে প্ৰচলিত রহিয়াছে।

এখানে তাঁহার ওয়ায ও খুতবাসমূহের সেই সকল গ্রন্থের উল্লেখ করা যায়, বর্ণনা রীতির বিচারে যেইগুলি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এই গ্রন্থাবলীর মাধ্যমে উক্ত ক্ষেত্রে তাঁহার অবদানের বিষয়টি বিশেষভাবে অনুমিত হয়।

গ্রন্থগুলি নিম্নরূপঃ

(১) কিতাবু আজাবি’ল-খুতাব (ফাতিহ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডু. ইস্তাম্বুল, নং ৪/৫২৯৫)। ইহাতে তেইশটি খুতবা রহিয়াছে। প্রথম খুতবাটির অন্ত্যমিলের বর্ণ ‘আলিফ’, দ্বিতীয়টির ‘বা’, তৃতীয়াটির ‘জিম’…। শেষের খুতবাসমূহে কেবল নুকতাবিহীন বৰ্ণবিশিষ্ট বাক্য ব্যবহৃত হইয়াছে;

(২) কিতাবুল-য়াকতা ফিল-ওয়ায অথবা য়াকূতাতুল-ওয়া’ইয ওয়াল-মাও’ইযা, দ্র, কাশফু’জ-জুনূন; ‘উছ’মান আতহারী প্রণীত রাওনাকু’ল-মাজালিস-এর সঙ্গে মুদ্রিত হইয়াছে (দ্র. GALS, ১খ, ৯১৯, নং ৪৭)। ইহাতে নমুনাস্বরূপ বিন্যস্ত খুতবাসমূহ রহিয়াছে;

(৩) আনু-নুতকুল-মাফিহূম মিন আহলিস-সামতিল-মা’লূম (দ্র, GALS, নং ২২)। ইহাতে উদ্ভিদ, পদার্থ ও জীবজন্তু, ইহাদের ভাষা বা অবস্থা দ্বারা মানুষকেও উপদেশ প্রদানের উল্লেখ রহিয়াছে। এই প্রসঙ্গে ধর্মীয় কাহিনী ও হাদীছেরও উল্লেখ আছে;

(৪) আখবারু আহলির-রুসূখ বি-মিকদারি’ন-নাসিখ ওয়াল-মানসূখ, ইবন হাজারের ‘মারাতিবু’ল- মুদাল্লিসীন গ্রন্থের সঙ্গে প্রকাশিত, মিসর ১৩২২ হি;

(৫) কিতাবুল- আয’কিয়া’, মিসর ১৩০৪ হি;

(৬) তালকীহ ফাহূম আহলি’ল-আছার ফী মুখতাসারি’স-সিয়ার ওয়া’ল-আখবার, ইহার একটি খণ্ড লাইডেন-ব্ৰাসেলস হইতে মুদ্রিত, ১৮৯২ খৃ., সম্পা. Brockelmann;

(৭) তানবীহুন-না’ইমিল-গামার;

(৮) রূহুল-আরওয়াহ, মিসর ১৩০৯ হি;

(৯) রু’উসুল-কাওয়ারীর ফিল-খুতাব…, মিসর ১৩৩২ হি;

(১০) সীরাতু ‘উমার ইবন আবদিল-আযীয, মিসর ১৩৩১ হি;

(১১) মানাকিবু উমার ইবন ‘আবদি’ল-‘আযীয, সম্পা. C. H. Beeker, Leipzig-Berlin 1899–1900;

(১২) মুলতাকাতু’ল-হিকায়াত, মুখতাসারু, রাওনাকিল- মাজালিস-এর হাশিয়ায় মুদ্রিত, ১৩০৯ হি;

(১৩) মাওলিদুন-নাবিয়্যিা (স) (লিথো.), মিসর ১৩০০ হি, বৈরূত ১৩৩০ হি;

(১৪) আল-ওয়াফা কী ফাদাইলি’ল-মুস্তাফা, সম্পা. Brockelmann.

যদি আরবী সাহিত্যে ইবনু’ল-জাওযীর স্থান নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়, তাহা হইলে বলা যায় যে, ওয়াযে ও খুতুবায় তিনি ছিলেন অনন্য। এই বিষয়ে রচিত তাঁহার গ্রন্থাবলী দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁহার খুতবা ও ওয়াযসমূহ ভাষা ও বর্ণনারীতির বিচারে মাকামাত-ই হারীরীর সহিত তুলনীয়। কারণ তিনি ইহাতে সহজ ও সাবলীল শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন। তাঁহার বাক্যবিন্যাসে কোনরূপ কৃত্রিমতা নাই। ইহা ছাড়া এই সকল ওয়াযে তিনি এমন সব গল্প-কাহিনীর উল্লেখ করেন, যাহা ধর্ম ও চরিত্র সম্বন্ধীয় নসীহতগুলিকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। পাঠকগণ এই সকল খুতবা পাঠে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু ইবনু’ল-জাওযীর অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে এই কথা প্ৰযোজ্য নয়। কোন কোন ‘আলিমের মতে তাঁহার সকল রচনা প্ৰশংসার যোগ্য। তথাপি ইবনু’ল ইবনু’ল-জাওযী নিজেই স্বীকার করেন যে, তিনি এই সকল বিষয়ের রচয়িতা নন, সংকলকমাত্র (ইবন রাজাব, যায়ল, পূর্বোক্ত পাণ্ডু, পত্ৰক ১৩৫ খ)। এই কারণে স্বয়ং তাঁহার মাযহাবের অনুসারিগণ তাঁহার গ্রন্থাবলীর সমালোচনা করিয়াছেন। তাঁহাদের অধিকাংশের অভিমত এই যে, ইবনু’ল-জাওযী হাদীছ শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করিলেও তিনি কালামশাস্ত্রবিদদের জটিলতার মীমাংসা করিতে জানিতেন না। কিন্তু ইহা বলা অপরিহার্য যে, অনুরূপ সমালোচনা তাঁহার হাদীছ শাস্ত্ৰ বিষয়ক রচনাবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যথায় তাঁহার অন্যান্য রচনা উন্নততর ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই সকল রচনার প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ব্যাপক আলোচনা রহিয়াছে। ইহার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তাঁহার এই সকল গ্ৰন্থ স্বীয় বিষয়ে মূল বরাতের যোগ্য।

গ্ৰন্থপঞ্জী : প্রবন্ধে উল্লিখিত বরাতসমূহ ছাড়াঃ

(১) ইবন খাল্লিকান, ওয়াফিয়াতু’ল-আয়ান (বূলাক ১২৯৯ হি), ১খ ৩৫০ প;

(২) আয-যাহাবী, তাবাকাতু’ল-হুফফাজ, সম্পা. Wustenfeld, ৩খ, ৪৫;

(৩) আয-যাহাবী, তাযকিরাতু’ল-হুফফাজ, হায়দরাবাদ (দাক্ষিণাত্য) হইতে মুদ্রিত, ৪খ, ১৩৫-১৪১;

(৪) আল-য়াফি’ঈ, মিরাআতু’ল-জিনান, ৩খ, ৪৮৯-৯১;

(৫) আসূ-সুয়ূতী, তাবাকাতু’ল-মুফাসসিরীন, পৃ. ১৭, নং ৫০;

(৬) সিবত ইবনু’ল-জাওযী, মিরআতুয-যামান, হায়দরাবাদ (দাক্ষিণাত্য) ১৯৫২ খৃ, ৮খ, ২য় অধ্যায়, পৃ. ৪৮১, ৫২৪;

(৭) আল-খাওয়ানসারী, রাওদাতু’ল-জান্নাত, পৃ. ৪২৭;

(৮) তাশ কোপরূওযাদাহ, মিফতাহু’স-সা’আদা, ১খ, ২৬০;

(৯) ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩খ, ২৮;

(১০) ইবনু’ল-ইমাদ শাযারাতু’য-যাহাব, মিসর ১৩৫০ হি, ৪খ, ৩২৯;

(১১) খায়রু’দ-দীন আয-যিরিকলী, আল-আ’লাম, ২খ, ৪৯৯;

(১২) Brockelmann, ১খ, ৬৫৬-৬৬ এবং পরিশিষ্ট ১খ, ৯১৪-২০;

(১৩) ‘আবদু’ল-হামীদ আল-‘আলূসী, মু’আল্লাফাত ইবনি’ল-জাওযী, বাগদাদ ১৩৮৫/১৯৬৫;

(১৪) E.I.2 III, Leiden 1979;

(১৫) হাজ্জী খালীফা, কাশফু’জ-জুনূন, দারু’ল-ফিকর, ১৪০২/১৯৮২, ৫খ, ৫২০-২৩।

[ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর ইসলামী বিশ্বকোষ বই থেকে সংকলিত]

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88