আটপৌরে

‘সাজিয়ার জন্য একটা ভালো হুজুর খুঁজে দাও না ভাবী।’ আবদারের সুরে বলে উঠল মুনিয়া। ‘মেয়েটা অবশ্য পড়ার চাপেই কাহিল। এখন আবার হুজুর দিলে নিতে পারবে কিনা তাও বুঝতে পারছি না। এদিকে ওর দাদা প্রতিদিন ফোন করে রাগারাগি- ঢাকায় থাকি বলে আমরা দ্বীন ইসলাম খুইয়ে বসেছি হেন তেন নানান কথা!’

‘ওহ, আচ্ছা আমি যাইমার বাবাকে বলে দেখব।’ খানিকটা অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসে সুপ্তি। মোবাইলটা বের করে সময় দেখে। যাইমার ছুটির আরও আধা ঘণ্টা বাকি। মা-কে একটা ফোন করবে নাকি? গত কয়েকদিন ধরেই ফোনটা খুব বেয়াড়াপনা করছে, ডানপাশের বাটনগুলো কাজ করে না। যাইমার বাবাকে বলেও খুব একটা লাভ হয়নি।

‘চালিয়ে নাও।’ সেই এক দায়সারা উত্তর।

নাহ, ম্লান হয়ে ওঠা ডিসপ্লেতে মায়ের নম্বরটা কিছুক্ষণ তলব করে মিলিয়ে গেল। মা আজকাল খুব ভুলোমনা হয়ে গেছে, যেখানে সেখানে ফোন রেখে বিস্মৃত হয়ে যায়- ততক্ষনে হয়ত দশ বারোটা কল মা-কে ডেকে ডেকে ক্ষেমা দিয়েছে।

‘অ্যাই ভাবী,’ মুনিয়ার ডাকে মুখ তোলে সুপ্তি। ‘ভালো একজন খুঁজবা। কম বয়স না। হুজুরগুলার খাসিলত তো জানই। মানে, সবার কথা বলছি না। তোমরা তো অন্যরকম। কিন্তু এই মাদ্রাসায় পড়া হুজুরগুলার চোখের দৃষ্টি এমন খারাপ!’

‘একদম!’ রাফির মা যোগ দেয় এবার ওদের আলোচনায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের সামনের চেয়ার দখল করে বসেন, হাতব্যাগটা মেঝেতে আছড়ে ফেলেই। মোটাসোটা মহিলা এই মৃদুমন্দ শরতের বাতাসেও গলদঘর্ম। ‘উফ, ড্রাইভারটা জীবনেও একটা ভালো পারকিং স্পট পায় না। বলদটাকে মন চায় লাত্থি মেরে ভাগায় দেই।’

সুপ্তি চটজলদি নিজের চটের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আগিয়ে দেয়। তাও মুখটা একটু বন্ধ হোক!

ছিপি খুলে এক ঢোক পানি গিলেই আবার কথার রেলগাড়ি চালু, ‘আরে, এখনো মনে আছে, আমি আর বড় আপা ছোটবেলায় পড়তাম এক হুজুরের কাছে, মাসুম নাম। আমার বড় আপা দেখতে যা, কি বলব। মানে, আমার মতনই। আমরা আবার সবাই ফর্শা, এলাকায় হায়দার বাড়ির সুন্দরীদের এক কথায় সবাই চিনে। দিয়া টিয়া দুই বোন বলতে পাড়ার সব ছেলে অজ্ঞান! তো, এক মাস পড়াতে না পড়াতেই বড় আপার জন্য সেই ব্যাটা বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় তার হজুর দিয়ে, মানে সে যেই মাদ্রাসায় পড়ত সেখানকার শিক্ষক। দেখেন কেমন সাহস!’ গোলাপি রং মাখানো ঠোঁট বঁকিয়ে বিচিত্র মুখভঙ্গি করে টিয়া ভাবী।

কিছু বলবে না বলবে না করেও সুপ্তি মুখ খোলে, ‘তাতে দোষের কি ভাবী? বিয়ের আলাপই তো দিয়েছে, কোন কুপ্রস্তাব তো নয়!’

চোখ কপালে তোলে টিয়া ভাবী, ‘কি যে বল তুমি সুপ্তি ভাবী! কোথাকার কোন এতিম ছেলে, মাদ্রাসার হুজুর, এইগুলা সব অজাত কুজাত কেমনে সাহস পায় ভালো ঘরের মেয়ের দিকে নজর দেয়ার?’

গোপনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুপ্তি। রিক্সার হুডে ঘষা লেগে লেগে আবায়ার বাম হাতার কনুইয়ের কাছে সুতা উঠে গেছে, বেশী ব্যবহারের ফলে যা হয়। আনমনে সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আল্লাহ্‌ যিনাকে করেছেন হারাম আর বিয়েকে করেছেন হালাল। আমরা সব কিছু কঠিন করে ফেলি খুব। রসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে…’

‘তখনকার যুগ অন্যরকম ছিল ভাবি। তখন কি কেউ ডক্টর ইনজিনিয়ার হত?’ মুনিয়া যুক্তি দেয় এবার সুপ্তিকে থামিয়ে। ‘দেখ, তখনকার মহিলাদের কি আমাদের মতন বাজার সদাই করে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে ছুটতে হত? সারাদিন বাসায় থাকো আর নামাজ কালাম কর, এই ছিল কাজ। আমাদের মতন দশ পদও রান্না করে স্বামীর মুখের সামনে দিতে হতোনা। সেই শুকনা খেজুর আর রুটি মাংস, হয়ে গেল।’

‘আসলে ব্যাপারটা এরকম না মোটেই।’ মৃদু হাসে সুপ্তি, ‘আমরা ইঁদুরদৌড় করতে চাই বলেই করতে হয়। তবে কঠিন পরীক্ষা উম্মুল মুমিনিনদেরও দিতে হয়েছে। আমাদের কষ্ট সেই তুলনায় কিছুই না।’

‘ভাই, এদের সাথে আমাদের তুলনা হবে না। মুনিয়া ভাবী ঠিকই বলেছে, সেই সময় আর এখনকার সময়ে আকাশ পাতাল তফাৎ। এই যুগে যদি তারা থাকতেন, তাইলে আর এত সব নিয়ম কানুন দিয়ে রাখতেন না।’মাথা নাড়লেন টিয়া ভাবী।

আঁতকে উঠল সুপ্তি। আসলে এদের কথার প্রতিউত্তর করাই ঠিক হয়নি, নিজেকে দুষল। ‘আস্তাগফিরুল্লাহ, বাদ দেন ভাবী। কি যেন বলছিলা মুনিয়া ভাবী? বাসায় কুরআন পড়ানোর টিচার লাগবে, না?’

‘হ্যাঁ ভাবী। আবার কত টাকা নিবে, দেখো। দু হাজারের বেশী যাতে না হয়। তোমাদের তো সুবিধা, বাসায় হুজুর। যাইমার আব্বুই তো পড়ায় ওকে, না?’

‘উম, মাঝে মাঝে। আবার কখনো আমি। আমি নিজেও তো শিখছি এখনও। তাজওয়ীদ এখনো পুরোপুরি আয়ত্তে আসেনি।’ একটু থেমে ব্যাখ্যা করল সুপ্তি, ‘তাজওয়ীদ হলো সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলওয়াতের নিয়মকানুন। কারণ আরবি ভাষায় উচ্চারনের সামান্য একটু ভুলে অর্থের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, মানেটাই বদলে যায় আয়াতের।’

‘এত শত জেনে আর কি হবে ভাবী? এগুলো আসলে আলেম ওলামাদের পড়ার বিষয়।আমার কথা হল, ঠিক মতন কুরআন খতম দিতে পারলেই হল। তোমাদেরও বাবা এনার্জি আছে, সময়ও। আরেকটা বাচ্চা হোক, বুঝবা ঠ্যালা।’ টিয়া ভাবির টিপ্পনী খানিকটা হুল ফোটালো সুপ্তির চামড়ায়। হটাৎই চোখে জ্বালা ধরালো গত বছরের এ সময়টার কথা ভেবে।

‘সুপ্তি, অফিস করে এসে এসব ভালো লাগে না আর। এটা তো নতুন কিছু না, এর আগেও তো একবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু সহ্য কর, কালকে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে। এত রাতে কই দৌড়াব?’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলেছিল সাজিদ, যাইমার বাবা। ‘বাচ্চা নষ্ট’ কথাটায় প্রচণ্ড আপত্তি সুপ্তির, সাজিদকে আগেও বলেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বাচ্চা নষ্ট হয় কীভাবে? সাজিদ চমৎকার ইংরেজি জানে, মিসক্যারেজ বলতে তার সমস্যা হবার কথা নয়।

‘কিন্তু এবার তো ৩ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এখন গেলে যদি কিছু করা যায়?’ তীব্র ব্যথার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে বলেছিল সে।

‘দেখো, আল্লাহ্‌ রাখলে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ্‌ যদি নিয়ে যেতে চান, তুমি আমি কিছু করার ক্ষমতা রাখি? না পারবে ওই ডাক্তার?’ খানিকটা নরম সুরে সাজিদ বুঝিয়েছিল। ‘আর একটু ব্যথা সহ্য করা শিখ, দুনিয়ার ব্যথা কষ্ট কিছুই না। এত অল্পতে ধৈর্যহারাদের তাকদিরে দুঃখ ছাড়া কিছুই নেই।’ সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সে। পরের দিন সকালে সুপ্তি গিয়েছিল, একাই। ততক্ষনে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে। এর পরের বহু রাত নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে সুপ্তি তার হালাকার নোটবুকে লেখা প্রথম পাতার হাদিসটি পড়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে।

মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! গর্ভপাত হওয়া সন্তানের মাতা তাতে সওয়াব আশা করলে (ধৈর্যের মাধ্যমে) ঐ সন্তান তার নাভিরজ্জু দ্বারা তাকে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে।”

ছুটির ঘণ্টা বাজতেই গেটের সামনে হুড়মুড়িয়ে গার্জিয়ানদের আবির্ভাব – কে কার আগে যেতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা। কিচির মিচির কথার হুল্লোড় তুলে নীল সবুজ চেক-কাটা জামার ঢল নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। গেট পর্যন্ত এসে সারিবদ্ধ হয়ে থেমে যাবে, গার্জিয়ানরা অনুমোদন কার্ড দেখালেই বুঝে পাবে যার যার সন্তানকে। প্রতিদিন একই নিয়ম, তবুও কেনো যেন সঙ্কোচ হয় সুপ্তির প্রতিবার কার্ডটি বের করার সময়; নিজেকে খুব পর পর লাগে। মনে হয় অন্য কারো মেয়েকে নিতে এসেছে। স্কুল গেটের উল্টো পাশে রাখা এলোমেলো চেয়ারগুলোর যে কোন একটিতে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে, ভিড় কিছুটা কমলে এগিয়ে যায়। টিয়া ভাবী আর মুনিয়া ভাবী এর মাঝেই উধাও, দায়সারা এক বিদায় জানিয়ে। আচ্ছা, যাইমা কি মন খারাপ করে তার মা অন্যদের মতন প্রথম দিকেই অধীর আগ্রহে ছুটে আসেনা বলে? মন খারাপ হলেও বলবে না, প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের মেয়েটা সুপ্তির। গেলো টার্মেই তো, প্রচণ্ড পেট ব্যথা নিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে বাসায় ফিরল সুপ্তির সাথে। সুপ্তি ভেবেই তটস্থ- কি দিয়েছিল গত কয়েকদিনের টিফিনে- সাজিদ ঘরে ফিরেই জেরা শুরু করবে।

‘আবার দিয়েছ ফ্রোযেন খাবার? আরেকটু সকালে উঠতে পারো না? বাসায়ই তো বানানো যায় কত কিছু। আমার মা কি আমাকে কেনা খাবার দিত? সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে ভাজি ভর্তা করে বক্স গুছিয়ে রাখত। আমরা জানতেও পারতাম না কখন উঠল, কখন এতসব করে ফেলল।’ এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলবে, হয়ত ভ্রূকুটিও করবে না সুপ্তির শুকিয়ে আমশি হয়ে যাওয়া মুখের দিকে। তুখোড় ডিবেট করত সুপ্তি কলেজ পড়াকালীন, এখন কেন যেন অল্পতেই কথার খেই হারিয়ে ফেলে।

‘আম্মু, ভাত খাবো।’ গুঙিয়ে উঠেছিল যাইমা। কি আশ্চর্য, যে মেয়ে কোনদিন নিজে থেকে খাবার নাম নেয় না, তার মুখে খাবারের আবদার, তাও সবকিছু ছেড়ে ভাত!ফ্রিজ থেকে ভাত তরকারী বের করে তড়িঘড়ি গরম করে মেয়ের মুখে তুলে দিয়েছিল সুপ্তি। তখনই না বুঝতে পারলো, না খেয়ে এ অবস্থা মেয়ের। অনেক ঝুলাঝুলির পর যাইমা স্বীকার করেছিল, দিনের পর দিন পেছনের সিটে বসা সাফা তার টিফিন জোর করে কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। কখনো বিন্দুমাত্রও রাখে না যাইমার জন্য।

‘ওর আম্মু টিফিন দেয়না?’ কিছুটা রাগত স্বরেই সুপ্তি জিজ্ঞেস করে। ভাগাভাগি করতে সে বরাবরই যাইমাকে উৎসাহ দেয়, কিন্তু প্রতি সকালে এত কষ্ট করে বানানো মেয়েটার মনের মতন টিফিন অন্য কারো পেটে চলে যায়, এটা মেনে নিতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল।

‘দেয় তো এক প্যাকেট এনার্জি বিস্কুট…every day!’ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে পাঁচে পা দেয়া গম্ভীর স্বভাবের যাইমা। ‘আমাকে খেতে বলেছিল ওটা কয়েকদিন, আমি নেইনি।’ হাঁ করে আরেক গ্রাস ভাত মুখে তুলে দেবার জন্য।

‘আগে বল নি কেন?’ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনি সুপ্তি। কি লাভ হবে? মেয়ে তো এমনই। সেই ছোট থেকেই বুঝে তার বাবা কিছুটা মেজাজি, বাচ্চা সামলানো বা বাচ্চাকে সঙ্গ দেয়া সাজিদের ধাঁচে নেই। তারপরেও বাবা তার অতি প্রিয়। বাবা অফিসের কাজ করলে বা তাফসিরের কোন বই পড়তে থাকলে মেয়ে সামনে বসে থাকত, অপ্রয়োজনেই ছোট ছোট হাত দিয়ে খামচি মেরে বই খাতার পাতা উল্টিয়ে দিত- যদি বাবার সাহায্য হয়!

ক্লাস টিচারকে বলে কৌশলে ব্যাপারটা সুরাহা করেছিল সুপ্তি, যাইমাকে না জানিয়েই। শিশুতোষ নরম মনে হয়ত আঘাত লাগবে, মা তার বন্ধুর নামে অভিযোগ করেছে।

ভিড় পাতলা হতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ওই যে, গুটি গুটি পায়ে মেয়ে এগুচ্ছে। দূর থেকেও চিবুকের খাঁজ স্পষ্ট বোঝা যায়, সাজিদের মতন। সহজেই দেখা যায়, ওর ক্লাসে ও ছাড়া আরেকটা মেয়ে শুধু হিজাব পরে, অন্য সেকশানে যদিও। সুপ্তি জানে, মেয়ে কোনদিন ছুটে আসবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে নিজে গিয়ে হাত ধরে।

‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম!’ যাইমাকে বুকে চেপে ধরার ইচ্ছা প্রবলভাবে চাপা দেয় সুপ্তি। মেয়েটাকে কয়েক ঘণ্টা না দেখলেই বুকটা কেন যে ফাঁকা ফাঁকা লাগে! অথচ ওর খুব ইচ্ছা ছিল প্রথম সন্তানটা ছেলে হোক।কিন্তু জন্মের পর হিম শীতল পোস্ট অপারেটিভ রুমে যখন তোয়ালে মুড়ানো ফুটফুটে মুখটা দেখেছিল, তখনই মনের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেলো। ‘আমার?’ ভয়ে ভয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করেছিল সুপ্তি।

‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম আম্মু।’ ফিক করে হেসে দেয় যাইমা। ‘ম্যাডাম ডাকো কেন? মিস-রা শুনে ফেলবে!রাগ করবে।’

‘শুনলে কি আমাকে কান ধরে দাড়িয়ে রাখবে? নাকি সোজা প্রিন্সিপালের রুমে নিয়ে যাবে? কি বলবে? হে মহিলা, তোমাকে আর তোমার মেয়েকে এই মহান স্কুল থেকে বিদায়?’

‘যাও আম্মু, তুমি একটুও সিরিয়াস না!’

‘হুম, দুনিয়ার তাবৎ সিরিয়াসনেস তুই আর তোর বাবা গলঃধকরন করেছিস, আমার জন্য কিছুই রাখিস নি।’

‘What is গ-ল-ধ-রনন?’

‘ওরে আমার ইংলিশ ওম্যান রে! গলধরনন না, যা তোর বুঝা লাগবে না। তুই ফুং ফাং ইংলিশ শিখতে থাক।’ গেট থেকে বের হয়ে কথা বলতে বলতেই সুপ্তি মেয়ের টিফিন বক্স বের করে ঝাঁকায়। নাহ, খেয়েছে ঠিক মতন।

‘আম্মু শোন না, আজকে চল আইস্ক্রিম খেয়ে তারপর বাসায় যাই।’ মুখ তুলে তাকায় যাইমা, চোখগুলোতে একরাশ দুষ্টুমি। ‘আর তোমাকে না বলেছি, আমাকে তুই করে বলবে না। সামিয়ার আম্মু, লুপার আম্মু, কারো আম্মু ওদেরকে তুই বলে না।’

‘ঠিক আছে, তোকে এখন থেকে আপনি বলে ডাকব। যাইমা, আপনাকে আইসক্রিম খাওয়ানো যাবে না, আপনার আব্বুজান রাগ করিবে। আর আপনার বেয়াড়া টনসিল যখন আবার ফুলিবে, তখন আপনি কু কা করিতে থাকবেন আর স্কুল মিস হইবে।’ হাত তুলে রিকশা ডাকে সুপ্তি। এ সময়টায় রিকশাওয়ালাগুলো মওকা বুঝে গলাকাটা ভাড়া চেয়ে বসে- জানে যে ছোট বাচ্চা নিয়ে হেঁটে হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। ব্যাগে আছে ২০০ টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা।যাইমাকে আইসক্রিম খাওয়ালে কি বাজারের টাকা থাকবে? সুপ্তি মনে মনে হিসাব কষে।

রিকশায় উঠে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে যাইমা, জানে মা তার আবদার পূরণ করবে তাই খুব একটা চাপাচাপি করে না। ‘আচ্ছা আম্মু, আমার বার্থ ডে কবে?’

‘কেন? হটাৎ বার্থ ডের খোঁজ কেন?’সতর্ক স্বরে উল্টা প্রশ্ন করে সুপ্তি।

‘আজকে মাইশা এত্ত বড় একটা কেক নিয়ে এসেছিল ক্লাসে।’ হাত ছড়িয়ে দেখায় যাইমা। রোদের আঁচে গালগুলো লালচে হয়ে আছে। সুপ্তি রিকশার ঝাঁকুনির মাঝেই রুমাল বের করে ঘর্মাক্ত ছোট মুখটা মুছিয়ে দেয়। ‘ওর নাকি আজকে বার্থ ডে- মানে ও আজকে জন্ম হয়েছিল। এই দিন সবাইকে খাওয়াতে হয়, আর কেক কাটতে হয়। আর জানো আম্মু, তুমি যদি চোখ বন্ধ করে কিছু চাও মোমবাতি নিভিয়ে, তাহলে তোমার ইচ্ছা ইয়ে হবে…মানে, সত্যি হবে। মিস বলছিল, Make a wish!’

মেয়ের উত্তেজনা দেখে অল্পক্ষণের জন্য অসহায় বোধ করে সুপ্তি। কীভাবে বোঝাবে?

‘মা,’ নরম স্বরে মেয়েকে ডাকে সে, ‘জন্মদিন কি খুব ইম্পরট্যান্ট কিছু? দেখো, জন্ম তো তুমি হয়েই গেছো, আলহামদুলিল্লাহ্‌। সুস্থ আছো, আল্লাহ্‌ সবগুলো আঙুল দিয়েছে, চোখ দিয়েছে- এটাই তো আনন্দের ব্যপার। তার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে গ্রেটফুল থাকব আমরা, কেক কাটা কি জরুরী?’

রিকশা থামিয়ে মেয়েকে কোলে করে নামায় সুপ্তি। চেনা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে যাইমার পছন্দের ইগলু আইসক্রিম দোকানীকে বের করতে বলে কোনার এক টেবিল দখল করে বসে। বিয়ের পর পর প্রায়ই এ দোকানে আসত সাজিদ আর সে। মানুষটা কোনদিন আইসক্রিম ফুচকা মুখে না তুললেও সুপ্তিকে আগ্রহের সাথেই নিয়ে আসত। আজ রাতে বলবে নাকি সাজিদকে যাইমাকে ভালো করে জন্মদিনের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে?

‘কিন্তু আম্মু, এক দিন মজা করলে কি হয়? জানো, মাইশা নাকি বাসাতেও আবার কেক কাটবে, অনেক গিফট পাবে। ওর কাজিনরা, খালারা সবাই গিফট দিবে। ওর নতুন চাচী ওকে বারবি দিবে, ও জানে। ও বলেছে সানডে স্কুলে আনবে আমাদের দেখাতে।’

‘যাইমা সোনা, ধর যে আমরা হই চই করে তোমার জন্মদিন পালন করলাম। দেখো, কত্তগুলো টাকা নষ্ট করে কেক, জামা, গিফট কেনা হল। এগুলোর তো তোমার দরকার নেই, তোমার তো সব আছেই। এর বদলে…উমম, মনে কর সে টাকাগুলো আমরা ওই যে ছোট ছেলেটা, মায়ের পাশে বসে আছে যে কাপড় ছাড়া, ওকে দেই যদি? তাতে ও ভালো একটা জামা পড়ল, পেট ভরে খেলো,ওর আম্মুরও একটা শাড়ি হয়ে গেলো, তাহলে কেমন হয়? আর তাছাড়া আম্মু, এগুলো আমাদের উৎসব না। এগুলো তো অন্য ধর্মের। ওদের দেখে দেখে কি আমাদের নকল করা উচিত?’

উত্তর করে না যাইমা। আইসক্রিমের কাঠি চাটতে চাটতে কি এক ভাবনায় আনমনা হয়ে যায়।

‘ভাবী, তুমি আর ভাইয়া একবারও ঢাকায় এলে না। যাইমা তোমাদের চেহারাই ভুলে গেছে। তিতির আর ইফতি ছাড়া ওর আর কোন ভাই বোন আছে, বল?’ খাটের নিচ থেকে পুরাতন ট্রাঙ্ক বের করে ঝাড়া মুছা করতে করতেই মুঠোফোনে মৃদু অনুযোগের ঝড় তুলল সুপ্তি। ও পাশের কথা শুনতে শুনতে ট্রাঙ্কের ডালা খুলল, একরাশ ধুলো জমে আছে। যাইমা সাজিদের সাথে দাওয়াতে গেছে, পাড়ার এক দ্বীনী ভাইয়ের নিকাহ-র অনুষ্ঠান, কাছাকাছি এক মসজিদে। এ সুযোগে ঘর সাফাইয়ের কাজ চলছে, মেয়েটা থাকলে এটা সেটা ধরে বড়ই বিরক্ত করে।

‘উঁহু, আমি যাচ্ছিনা আর চিটাগং। গতবার কি কি সব বলে পতেঙ্গা নিয়ে গেলে, ইন্নালিল্লাহ, মানুষের ভিড়ে পা ফেলা যায় না। এ ধাক্কা দেয় তো আরেকজন পা মাড়ায়। তার মাঝে যাইমার কান্না। যাইমার বাবা পরে বাসায় এসে যে কটমটে চাহনি দিয়েছিল!’

‘ইস রে তোর কটমটে চাহনির খটমটে জামাই রে!’ ওপাশ থেকে কলকলিয়ে উঠল ভাবির কণ্ঠস্বর। ‘রসকষহীন ছেলেটা কবে শুধরাবে বল দেখি? এত করে বললাম গত ঈদে সবাই মিলে কক্স বাজার ঘুরে আসি তোর ভাইয়াদের কলিগদের সাথে। তার এক কথা, ‘‘ভাবী, এসব জায়গায় অনাত্মীয় মানুষজনের সাথে গেলে পর্দার হেফাযত হয় না।’’ আর কি কি জানি মেইনটেন করা যায় না। কেন রে, হুজুররা কি সমুদ্রে যায় না, নাকি যাওয়া মানা?’

‘ভাবী, তুমিও না!’ সুপ্তি হেসে ফেলে। ভাবীকে তার খুব পছন্দ, একমাত্র ভাইটার চেয়েও বেশী। একই পাড়ার মেয়ে ছিল, ছোটবেলা থেকেই তাই সুপ্তির সাথে তুই তুমির সম্পর্ক। প্রাণোচ্ছল মানুষটা এত সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমান সুপ্তির অমিশুক বাবা। স্বভাবসিদ্ধ মুখচোরা মানুষটি বৌমা বলতে অজ্ঞান। শোভন সুপ্তি যে বাবার ভয়ে থরথর করে কাঁপত প্রতি সন্ধ্যায় পড়া দেবার আগে, সে মানুষটাই আমুল বদলে গেল ভাবী আসার পর।

‘এবার তোমরাই এসে বেড়িয়ে যাও, ভাবী। আম্মু আব্বুকে বলে বলেও হয়রান হয়ে গেলাম, তোমাদের ছাড়া আসবে না। কতদিন সবার একসাথে হওয়া হয় না। তিতিরটার কয়টা দাঁত পড়ল? ফোকলা মেয়েটাকে দেখতে বড়ই মন চায়।’ আগের কথার রেশ ধরে সুপ্তি বলল।

‘পাঁচ পাঁচটা। এক একটা দাঁত পড়ে আর উনি পাকামিতে আরেক ধাপ বাড়েন। সেদিন কি বলে জানিস? রাস্তার ছেলেরা নাকি আমার কোমরের দিকে তাকিয়ে থাকে আমি হেঁটে গেলে!’

‘তাকাবেই তো!’ হালকা সুরে সায় দেয় সুপ্তি, ‘তুমি তো এখনো সেইরকম সুন্দরী ভাবী। এলাকায় ফিতনা হয়ে যাবার কথা তোমাকে নিয়ে।কতদিন ধরে বলছি পর্দা করা শুরু কর। আচ্ছা, কমসে কম কামিজের উপর বড় ওড়না দিয়ে মাথা তো ঢাকতে পারো।’

‘ধুর, পারি না রে। গরম লাগে, আর তিরিশ পেরিয়ে গেছে তিন চার বছর হয়ে গেল, এখন আর কে দেখবে আমাকে? ছুড়িগুলোই আজকাল প্রেমিক পায় না, আর আমাকে নজর দিবে কোন দুঃখে!তুই যে কেমনে এত হাবিজাবি পরে থাকিস গরমে, আমার হাঁসফাঁস লাগে দেখলেও।’

টুকটাক আর কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেয় সুপ্তি। মনটা খারাপ হয়ে যায় খানিকটা। ভাবীর সবকিছুই ভালো, কিন্তু এই একটা দিকে কিছুতেই তাকে বুঝানো যায় না। নামাজও পড়ে নিয়মিত, কিন্তু মাথায় কাপড় শুধু আযান দেবার সময়টুকুই থাকে। আবার কখনো সখনো নামাজ বাদ গেলেও খুব একটা তোয়াক্কা করেনা। ভুবন ভোলানো হাসির অধিকারী তার ভাইয়ের বউটির হেদায়েতের আবদার করে সুপ্তির অনেক দুয়া বরাদ্দ থাকে।সাত বছর আগে সুপ্তির নিজের যখন পরিবর্তন হয়, তখন খুব উৎসাহের সাথে রিমিকে বুঝিয়েছিল,

‘আচ্ছা ভাবী, এই যে আমরা সুন্দর সেজেগুজে ঘরের বাইরে যাই, শত শত চোখ আমাদের দেখে- না জানি কত কু চিন্তা করে আমাদেরকে নিয়ে, তাতে আমাদের কি লাভ, বল?অন্যদের জন্য না সেজে আপনদের জন্য সাজো, ঘরের ভিতরে।’

সদ্য জন্ম হওয়া তিতিরের ঘর ভর্তি উপহারগুলি গুছাতে গুছাতে ভাবী ননদে কথা হচ্ছিল। রিমির বিয়ের তখন তিন বছর পার হয়ে গিয়েছে, এর মাঝেই মাস্টার্স কমপ্লিট। ভালো ভালো দু একটা চাকরীর অফারও ছিল হাতের মুঠোয়, তিতিরের আগমনে সে উদ্যোগে আপাতত ভাঁটা পড়েছে।

‘অ্যাই,’ দুষ্টুমি করে চোখ পাকালো রিমি, ‘তোকে কে বলেছে আমি অন্যের জন্য সাজি? আমি নিজের জন্যই সাজি, বুঝলি? আর বাসায় সাজি না এটাও ডাহা মিছে কথা!তোর ভাইয়া অফিস থেকে আসলেই আঁখিতে পরি কাজল, দেহপল্লবে জড়াই বেনারসি…আরও শুনবি?’

ক্ষান্ত দেয় না সুপ্তি, ‘সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, রিমি আপু, সরি, ভাবী। কিন্তু বাইরের মানুষদের সামনে আমাদের পর্দা করা ফরজ, ওরা কেন আমাদের সৌন্দর্যের দর্শক হবে, বল? তোমার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তারা যদি তাদের বৌদের উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে?’

‘ইশ,’ মুখ ঝামটা দেয় রিমি, ‘নিজেদের চোখ সামলে রাখতে পারে না, আর সে নাকি পুরুষ। ঝাঁটা দেই এগুলোর মুখে।’

‘আরে বাবা, জনে জনে ঝাঁটা দেয়ার চেয়ে নিজে সাবধান হওয়া ভালো না?’ ঘুমন্ত তিতিরের গালে আলতো হাত বুলায় সুপ্তি।মুখ হা করে ঘুমুচ্ছে মেয়েটা। এত মায়া নিয়ে জন্মায় কেন বাবুগুলো? কত বছর পর তাদের পরিবারে নতুন সদস্যের আবির্ভাব, সবার কাড়াকাড়ি এই পুতুল সাইজের মানুষটাকে নিয়ে।‘পুরুষদের জন্য তো ইসলামে বিধান আছেই দৃষ্টি সংযত করার। আমাদেরটুকু তো আমাদের করতেই হবে?’

‘করব, বাবা, করব। দেখিস, এক্কেবারে আটঘাট বেঁধে তোর মতন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যাবো।মন থেকে আসুক আগে।’আদর করে সুপ্তির গাল টেনে দেয় রিমি।

সেই করব করব করে সাত বছর পার।তিতিরের দেড় বছর হতেই ইফতির জন্ম, সুপ্তির বিয়ের পর পরই। ভাইয়ার পোস্টিং হয়ে চিটাগাং হবার পর ভাবীও সেখানকার নামকরা এক স্কুলে কো অর্ডিনেটর পদে কাজ বাগিয়ে নিল। চমৎকার বেতন, তিতির ইফতিও সেই স্কুলে পড়ছে। বন্ধুবৎসল রিমিও নিজস্ব এক সার্কেল গড়ে তুলেছে সেখানে।রিমির আর ‘মন থেকে’ হিজাব শুরু করা হয়ে উঠেনি। প্রথম প্রথম হতাশ হলেও সুপ্তি হাল ছাড়েনি, তবে বুঝেছে ইসলাম নিয়ে আরও লেখাপড়ার প্রয়োজন আছে, নাহলে জ্ঞানের স্বল্পতার কারনেই অন্যদের বুঝানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ট্র্যাঙ্কের ডালা বন্ধ করতে গিয়েও কি মনে করে নেড়েচেড়ে দেখে ভেতরের জিনিসগুলি সুপ্তি। সেই কবেকার গ্রিটিং কার্ডগুলো, বান্ধবীদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপলক্ষে পাওয়া- বহু বছরের সংগ্রহ। নিজের কবিতার ডায়েরি। শেষ কবে কবিতা লিখেছিল সে, মনে করার চেষ্টা করে।পাঁচ বছর? উঁহু, যাইমা হবারও আগে হবে বোধহয়।মাঝের এক পাতা খুলে ধরল, বিড়বিড় করে লাইনগুলো আউড়ালো,

“What a terrible deception,

Such wicked, wicked lies;

To make me fall in love with you,

And then leave me behind.

You said you’d take me home,

To the pine trees where I belong.”

নাহ, খারাপ লিখতো না সে, সুপ্তি নিজেকেই হালকা বাহবা দিল। ইকোনমিক্সের ছাত্রী হলেও বরাবর কবিতা তার খুব প্রিয় বিষয়।বাবাটা রাজী হলে হয়ত লিটারেচার নিয়েই পড়ত সে। কি ছাই লাভ হল ইকনমিক্স পরে? না হাতে আসল গাদাখানেক অর্থ, না কাজে আসল নীতি!চেষ্টা করে দেখবে নাকি দু এক পঙক্তি লেখার? কবিতার পাঠক কে হবে? সাজিদ? ও বাবা, তাহলেই হয়েছে। নিচু স্বরে হেসে উঠল সে। বিয়ের পর দু একটা কবিতা শোনানোর চেষ্টা করেছে সুপ্তি, নিজের লেখা না, বড় মাপের লেখকেরই। নিরস চেহারা করে তার স্বামী পথ্য গেলার মতন হজম করে গেছে, এই যা।বেল বেজে উঠলে ত্রস্ত পায়ে দরজা খুলতে গেলো সে। যাইমা এমন অস্থির স্বভাবের, দরজা খুলতে একটুখানি দেরি হলেই দশ বার বেল টিপে বিল্ডিং মাতিয়ে ফেলবে।

সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে সাজিদ খানিকটা বিব্রত হাসি দিল সুপ্তির দিকে তাকিয়ে, কাঁধে ঘুমন্ত মেয়ে।

‘জাবির ভাই, রাহাত, আরিফ ভাই ওরা সবাই ছেলে মেয়ে নিয়ে এসেছিল, বুঝছ? সবাই মিলে এত খেলা, এত দৌড়াদৌড়ি। কাহিল হয়ে রিক্সায়ই ঘুম।’

‘হুম। কি খেলে বল?’ মেয়ের জন্য বিছানা ঝেড়ে সাজিদ কোল থেকে যাইমাকে নিল সুপ্তি।

‘মসজিদে নিকাহ পড়ানো শেষে জামিলের বাসায় গেলাম।চাচি নিজেই পঞ্চাশ ষাট জনের আয়োজন করেছেন।পোলাউ, মাছের কালিয়া, রোস্ট, গরুর ভুনা, আরও অনেক কিছু।’ কাপড় ছাড়তে ছাড়তে সাজিদের উত্তর।

‘আনলে না আমার জন্য কিছু?’ লঘু স্বরে সুপ্তির অনুযোগ। মানুষটা আজ ফুরফুরে মেজাজে আছে, বোঝা যাচ্ছে।

‘বাহ, তুমি তো আমি না থাকার খুশীতে নিশ্চয়ই জঘন্য গন্ধ ছড়ানো শুঁটকি রান্না করে সেলিব্রেশন করে ফেলেছ!পোলাউ কোরমা কি আর সেই শুটকি সুবাসিত মুখে রুচবে?’ সাজিদ হাসতে হাসতে বলে।

গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলে সুপ্তি। ‘হ্যাঁ, আমি তো সকাল সন্ধ্যা শুধু শুঁটকিই খাই!’

আলগা হাসি ছুড়ে সাজিদ তোয়েলে টেনে নিল, রাতে গোসল তার বরাবরের অভ্যাস।

‘আজকে ভাবী খুব করে বলছিল যাইনার উইন্টার ভেকেশনে চিটাগাং যেতে। মা বাবাও এখন ওখানে। অনেকদিন মা-কে দেখি না। ওরা যাইমাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে।’ থেমে থেমে বলল সুপ্তি, দৃষ্টি আনত।

‘আমার ভালো লাগে না, সুপ্তি, বহুবার বলেছি তোমাকে। রিমি ভাবী সন্ধ্যা হলেই হারমোনিয়াম টেনে ছেলে মেয়েকে গান শেখাতে বসেন, যাইমা কি শিখবে বলো? আর বাবাও তো তাল মিলাতে থাকেন বসে বসে। এই পরিবেশে মেয়েকে টানতে চাও তুমি?’ রাগত সুরে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে সাজিদ বাথরুমের দিকে পা বাড়াল।

কাঁদবে না কাঁদবে না করেও ঠোট কামড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুপ্তি। আহ, ত্রিশ বছর বয়স হতে চলল তার, তাও এত আবেগ কোথা থেকে আসে? নিজেকে বকুনি দিলো সে। আচ্ছা, বিয়ের আট বছরে কি সব কিছু খুব বদলে গেছে? ঠিক কতদিন আগে শেষ বার সাজিদের প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনেছে সে মনে করতে পারল না। এক সাথে বারান্দায় চা খাওয়া হয়েছে, সেও বছর খানেকের কম হল না। অথচ এ বাসাটা ভাড়া নেয়ার সময় বেডরুম লাগোয়া বারান্দাটা দেখে মনে মনে কত জল্পনাকল্পনা করেছিল সে। যাইমা ঘুমালে তারা বারান্দায় বসে চা টোস্ট খাবে, সারাদিনের গল্প করবে, সাজিদ আগের মতন তরল গলায় রসিকতা করবে আর সে মুখ চেপে হাসির আওয়াজ ঠেকাবে।

ভেজা চোখেই খাবার গুছাতে লাগল সুপ্তি। হালকা পাঁচ ফোড়নের বাগাড় দিয়ে আমড়া ডাল করেছিল আজকে, সাথে লাল আলু দিয়ে পাবদা মাছ। মেয়েটা বড় ভালোবাসে।সাজিদের কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল কাজ করতে করতে। কেন জানি রাগ লাগছে না ওর উপর। আজকাল অভিমানগুলোও শরতের মেঘের মতন খাপছাড়া,পুঞ্জিভূত হবার আগেই অজানায় পাড়ি দেয়। সেদিনও যখন সাজিদের মা তাকে ফোনে বার বার প্রতিদিন ডিম খাওয়ার কথা তুলে খোঁচা দিচ্ছিল, তখনো কেমন যেন অনুভূতিশুন্য লাগছিল। যেন সে অন্য কেউ, যেন আম্মা অন্য কোন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘তোমরা তো ইচ্ছামতন ডিম, কাড়ি কাড়ি মাংস প্লেটে তুলে নাও, আমরা তো জামাইয়ের কিভাবে দুইটা টাকা বাচাব সে চিন্তায় থাকতাম। মেয়েমানুষ কি বাইরে পরিশ্রম করে নাকি যে ডেইলি কা ডেইলি ডিম খাওয়া লাগে?’

উত্তরে মৃদু সায় জানিয়েছিল সে, অপমানের হুলটা গায়ে ফুটতে দেয় নি। সমবয়সী খালাতো বোন প্রিতির উক্তি মনে পড়ছিল খুব, ‘আচ্ছা, এরা কি ভাবে বল তো? আমরা বানের জলে ভেসে আসছি? হায়রে, মায়ের বাড়ী গেলে এখনো মুরগির রানটা, দুধের সরটা তোলা থাকে আমাদের জন্য। আর এদের কথা শুনলে মনে হয় খেয়ে খেয়ে জামাইগুলার কলিজা পর্যন্ত ভুনা করে গিলে ফেলসি। এই কারনে, নিজে কামাই করে নিজের টাকায় খাই, বুঝছিস? খাইলাম না তোমাদেরটা, যাও!’

‘চা দেব?’ বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলে সে, গলা স্বাভাবিক। একটু আগের ঝরা কান্নাগুলো হাতের চেটোতে মুছে ফেলেছে।

‘হুম। কফি?’

‘হবে। তুমি চুল মুছে নাও, এর মাঝে হয়ে যাবে।’

কফির ঘ্রানটা দারুন লাগে সুপ্তির। কি ভেবে নিজের জন্যও কড়া এক কাপ কফি বানিয়ে ফেলে সে। সাজিদের হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে বারান্দায় রাখা মোড়া টেনে বসে, এক হাতে কফির মগ, আরেক হাতে তার কবিতার ডায়েরি। কফির মগটা আলতো করে মেঝেতে রেখে ডায়েরি খুলে বসে। বেডরুমের আলো চুইয়ে এসে বেশ পড়া যাচ্ছে প্যাঁচানো লেখাগুলো।

যদিও আবৃত্তি কোনকালেই ভালো না তার, তবুও টেনে টেনে পড়া শুরু করল মাঝের এক পাতা থেকে,

‘Were you to hold my hand tonight,

I’d tell you, stop there,

whoever you are.

For night is not when you court a lady,

not the one that has yet to blossom.

Someone as fine as me,

so much sass and grace

only walks over hearts,

picks up after herself

to leave no trace.’

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়েই সতর্ক হয়ে গেল সে, ঝট করে ডায়েরিটা মোড়ার নিচে আলগোছে চালান করে দিল। যাইমার ঘুম আজকাল খুব পাতলা হয়েছে, কতক্ষণ পিছে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে!

‘থামলে কেন? ভালোই তো হচ্ছিল।’

সাজিদের গলা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সুপ্তির। কি আশ্চর্য, সে এত ভয় পাচ্ছে কেন, নিজেই ভেবে পেল না। সাজিদ কি ব্যাঙ্গ করল তাকে?

যেন মনের কথা বুঝতে পেরেই আবার বলল সাজিদ, ‘আরে, সত্যি বেশ ভালো লাগছিল। কার লেখা? শেলি? নাকি রবার্ট ফ্রস্ট? আর কারো নাম ধাম তো জানি না।’ বলতে বলতে ওর পাশে মেঝেতে বসে পড়ল সে। সুপ্তি মোড়া থেকে উঠে জায়গা দিতে গেলে সাজিদ হাত ধরে থামাল, ‘মেঝেতেই ভালো লাগছে।’

হাতটা অবচেতনে ছাড়িয়ে নিল সুপ্তি, বেশ অবাক হয়েছে হুট করে সাজিদের এখানে এসে বসায়।

‘বাকিটা পড়ে শুনাও তো?’ সুপ্তির দিকে চেয়ে বলল সাজিদ, চেহারা বেশ প্রসন্ন। টিটকারি করছে নাকি? আড়চোখে একবার দেখে নিলো সুপ্তি। সাজিদ অবশ্য খোঁটা দিয়ে কথা বলার মানুষ না, অন্তত এ দোষে ওকে অভিযুক্ত করা যাবে না।

‘আর নেই, এতটুকুই।’ হালকা গলায় প্রতিউত্তর দিলো সে।

‘বাহ।’ কিছুক্ষণ চুপ করে আগের কথার জের টানল সাজিদ, ‘বললে না কার লেখা?’

‘উম্মু যাইমার লেখা!’ একটু ভয়ে ভয়েই বলে ফেললো সুপ্তি। ‘অনেক আগের অবশ্য, ১০-১২ বছর তো হবেই।’

‘মানে তোমার লেখা! সুবহানাল্লাহ, ভুলেই গিয়েছিলাম সুপ্তি, তুমি চমৎকার লিখতে।’

‘আমিও ভুলে গিয়েছিলাম।’ ছোট করে সুপ্তি জবাব দেয়।

‘আবার লিখো।’

অবাক হয়েই হেসে ফেলে সুপ্তি, ‘আমি লিখবো? কেনো? এসব লিখে কি হবে?’

‘কিছু হওয়ার জন্যই কি আমরা সব কিছু করি?’ নরম সুরে সাজিদ বলল। ‘আর তোমাকে আল্লাহ্‌ এত সুন্দর প্রতিভা দিয়েছে, নষ্ট কেন করবে? রাজিব আজকেও বলছিল ওর লিটল উম্মাহ পত্রিকার জন্য কন্টেন্ট রাইটার খুঁজে দিতে। আমি ওকে কালকেই তোমার কথা বলব। ভাবীর সাথে যোগাযোগ করে নাহয় তুমি সাব্জেক্টগুলো বুঝে নিবে।’

মাথায় কেউ বাড়ি দিলেও সুপ্তি এত অবাক হত না। কি বলবে ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে সাজিদের দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘আরে, কিছু বল না কেন? ফ্রি ফ্রি না তো, আট দশ হাজার পাবে শুরুতে। আমাকে মাঝেমধ্যে চটপটি আইস্ক্রিম খাওয়ালেই হবে। বেতন বাড়লে পিযযা। তবে যাইমার আবদারের হিসাব কিন্তু আলাদা।’

দিনের পর দিন শুকতলার নিচে পিষে যাওয়া ঘাসপাতা কি মনে মনে মাথা উঁচু করার স্বপ্ন বুনে? উত্তর দখিনের বাতাসে আবার দোল খেয়ে ঘাসফুল ফোটানোর আশা কি যুগ গড়িয়ে বেঁচে থাকে? সীমাহীন আকাশের নিচে যে ক্ষুদ্র ফুলগুলো নির্ভয়ে শরতের ভেজা বাতাসে হেসে খেলে হুটোপুটি দেয়? সুপ্তির চোখ জ্বালা করে উঠে।

‘এতদিন পর কি আর ওসব আসবে? বহুদিন কিছু লিখিনি, অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে।’

‘তুমি পারবে, আমি জানি।’

‘পারব? তুমি বলছ?’

‘আরে, কি মুশকিল! আচ্ছা, দোয়া করে দেই, আল্লাহ্‌ যেন তোমার লেখনীতে বারাকাহ দেন, খায়ের রাখেন এবং সমস্ত ত্রুটি থেকে তোমাকে হেফাযত করেন!’

মানুষটাকে কি খুশীতে জড়িয়ে ধরবে নাকি ভেবে পেলো না সুপ্তি।।আবেগের আতিশয্যে সাজিদের দুহাত নিজের হাতের মাঝে চেপে ধরল, টপ টপ পানি পড়ছে চোখ থেকে।

আহ, ত্রিশ বছর বয়স হতে চলল তার, তাও এত আবেগ কোথা থেকে আসে?

আটপৌরে

নাবিলা নোশিন সেঁজুতি

[Collected from Facebook Page]

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member