মসজিদে নববীর খুতবা : মানুষের আমলনামা
মসজিদে নববীতে প্রদত্ত আজকের জুমার খুতবার বঙ্গানুবাদ।
তারিখ: ০৬|০৮|২০২১ ইং
বিষয়: মানুষের আমলনামা ।
প্রথম খুতবা:
الحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه،، أما بعد:
সময় অতিবাহিত হয়, বছর কেটে যায়, আর আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ও শেষ হতে থাকে। দ্রুত বেগে চলা সময়, যামানার নিকটবর্তীতা, নানাবিধ অবস্থা ও একের পর এক ঘটনা এবং জীবনাবসানের সামনে মানুষ হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়; তবে বিগত দিন ও বছরগুলোতে মানুষের কথা ও কর্মকে সময় কখনও মুছে ফেলে না, কালের আবর্তনে তা ভুলে যায় না এবং বাতাসের তালে তা বিলীনও হবে না।
এ বিষয়টি একজন মুসলিমকে গভীরভাবে ভাবতে ও শিক্ষা নিতে উৎসাহ যোগায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: [ কাজেই আপনার রবের শপথ! আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে প্রশ্ন করবই,* সে বিষয়ে, যা তারা আমল করত। ] সূরা হিজ্র: ৯২-৯৩। আবু বারযা আসলামী রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( কোন বান্দার পা-দ্বয় এতটুকুও সরবে না যতক্ষণ না তাকে এ বিষয়গুলো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে: কীভবে তার জীবনকাল অতিবাহিত করেছে? তার জ্ঞান অনুযায়ী কী আমল করেছে? কোথা থেকে তার ধন-সম্পদ উপার্জন করেছে ও কোন খাতে তা ব্যয় করেছে? এবং কী কাজে তার দেহ ক্ষয় করেছে? ) সুনান তিরমিযি।
শরয়ী প্রমাণাদি একটি চরম সত্যকে জোড়ালোভাবে সাব্যস্ত করেছে যা কোন মুসলিমের কাছে অস্পষ্ট নয়। সেটি হল: তার প্রত্যেক কথা লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়, তার সকল কর্ম পর্যবেক্ষণ করা হয়, তার গোপনীয়তা আল্লাহ জানেন এবং তার নির্জন মোনাজাত আল্লাহ শুনেন।
এ সবই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আমলনামায় নথিভুক্ত করে রাখা হয়; সেখানে ব্যক্তির আমলসমূহ ও জীবনী চিত্রায়িত হয়। আমলনামা তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে; ফলে সে প্রত্যেক মুহুর্তে ও যথাসময়ে আমলসমূহ নিবন্ধিত করে রাখে, কোন রকম দেরি করে না। সে অবিরাম ও সু²ভাবে কাজ করে। নিয়মিত প্রত্যেক দিনের আমলনামাসমূহ রাতের আগমনের আগেই পেশ করে, তেমনি রাতের আমল সূর্যোদয়ের আগে পেশ করে। আবু মুসা আশয়ারী রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একবার রাসূল সাঃ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচটি কথা বললেন: (আল্লাহ কখনো নিদ্রা যান না, নিদ্রায় যাওয়া তাঁর সাজেও না, তিনিই মীযান -দাঁড়িপাল্লা- নামান ও উঠান, দিনের আগেই রাতের সব আমল তাঁর কাছে পেশ করা হয়, অনুরূপভাবে রাতের পূর্বেই দিনের আমল তাঁর কাছে পেশ করা হয়।)” সহীহ মুসলিম।
যখন বান্দার মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন দুনিয়ার সবকিছু তার সঙ্গ ত্যাগ করে, তবে তার আমলগুলো সঙ্গে থাকে। এগুলোই তার সাথে কবরে প্রবেশ করবে এবং পূনরুত্থানের সময়, কেয়ামতের দিনে, পুলসিরাতে ও মীযানে তার সঙ্গে থেকে উপকার দিবে।
কেয়ামত সংঘটিত হলে আমলনামাগুলো উন্মুক্ত করা হবে, নথিপত্র মেলে ধরা হবে এবং মীযান বা দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন: [ আর আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার ঘাড়ে সংযুক্ত করে দিয়েছি এবং কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত।* তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসেব-নিকেশের জন্য যথেষ্ট। ] সূরা বনী ইসরাঈল: ১৩-১৪।
সেদিনে আমলনামা প্রকাশস্থলের দৃশ্য হবে খুবই ভয়ংকর, উদ্বেগজনক ও ভীতি সঞ্চারক; এমন দৃশ্য যা হৃদয় ও আত্মাকে ভীত-বিহŸল করবে। মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন: [ আর আপনি প্রত্যেক জাতিকে দেখবেন ভয়ে নতজানু; প্রত্যেক জাতিকে স্বীয় আমলনামার দিকে আহবান করা হবে, (এবং বলা হবে) আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে যা তোমরা আমল করতে।* এটা আমার লেখনি (আমলনামা), যা তোমাদের ব্যাপারে সত্য সাক্ষ্য দিবে। নিশ্চয় তোমরা যা আমল করতে তা আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম। ] সূরা আল জাসিয়া: ২৮-২৯।
সেই মহাসমাবেশের দিনে মানুষ অপেক্ষমান থাকবে- তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তার জন্য; তারা তাদের নিজ নিজ আমলনামা গ্রহণ করবে, এতেই ইঙ্গিত মিলবে এবং সুস্পষ্ট ধারণা দিবে তার পরবর্তী গন্তব্য সম্পর্কে; হয় আনন্দ ও উল্লাস নতুবা দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট! যে ব্যক্তি স্বীয় আমলনামা ডান হাতে পাবে, সেই ব্যক্তির আত্মা প্রশান্ত হবে, হৃদয় শান্ত হবে এবং আনন্দ ও উচ্ছলতা তাকে ঘিরে ধরবে। পক্ষান্তরে যাকে তার আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, তার অবস্থা পরিতাপের এবং দুঃখ-কষ্ট ও ধ্বংসের হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: [ অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে,* তার হিসেব-নিকেশ সহজেই নেয়া হবে।* এবং সে তার স্বজনদের কাছে প্রফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে।* আর যাকে তার আমলনামা তার পিঠের পিছনদিক থেকে দেয়া হবে,* সে অবশ্যই তার ধ্বংস ডাকবে;* এবং জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হবে। ] সূরা ইনশিকাক: ৭-১২।
কেয়ামত দিবসের মীযান বা পাল্লা হবে ইনসাফ ও ন্যায়ের মাপকাঠি; বংশীয় পরিচয়, আভিজাত্য ও মর্যাদা বিবেচনা করা হবে না, কারো শরীরিক গঠন বা ওজন মাপা হবে না। বরং মানুষের আমলগুলোই মীযানে পরিমাপ করা হবে। তা আনুগত্যশীল বান্দার সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করবে, আর অবাধ্য ও পাপীকে অপদস্থ ও লাঞ্চিত করবে; যে ব্যক্তি আল্লাহর ফরজ বিধান পালন করবে ও হারাম থেকে বেঁচে থাকবে, তাকেই এই মীযান সমুন্নত করবে। আর যে ব্যক্তি তার রবের অবাধ্যতা করবে ও হারামে জড়িত হবে তাকেই অপদস্থ করবে। আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( কেয়ামতের দিন বৃহত মোটা-তাজা মানুষ আসবে, কিন্তু সে আল্লাহর কাছে মশার ডানার সমানও ওজন হবে না। তারপর তিনি বললেন: তোমরা পাঠ করো: “সুতরাং আমরা তাদের জন্য কেয়ামতের দিন কোন ওজনের ব্যবস্থা রাখব না।” ) সহীহ বুখারী।
উপরোক্ত বিষয়টি যখন মানুষ জানবে, তখন একজন মুসলিম তার জীবনে যা ঘটে গেছে এবং যেসব কৃতকর্ম আমলনামায় যোগ হয়েছে সে সম্পর্কে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে যে, সুযোগ আছে কি ঘাটতি পূরণ করার? নিজের কৃতকর্ম ও গোনাহ মোচন করার? সে কি পারবে তার গোনাহগুলোকে নেকীতে পরিণত করতে?
যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন করে সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যে, আরশের উপরে একজন প্রতিপালক রয়েছেন, যিনি পরম করুনাময় ও দয়ালু এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল; তিনি আশার দ্বার উন্মুক্ত রাখেন এবং পাপ মোচনকারী আমলের মাধ্যমে মৃত্যু আসার আগেই ঘাটতি পূরণের ও ভবিষ্যত কর্তব্য পালনের আহবান জানান।
মহান প্রতিপালক বছরজুড়ে তাঁর বান্দাদের জন্য একের পর এক কল্যাণের মৌসুম নিয়ে আসেন এবং এতে তাদের জন্য বিশাল প্রতিদান রাখেন। তিনি রাতের বেলা দু’হাত প্রসারিত রাখেন যেন দিনে অন্যায়কারীরা তাঁর কাছে তওবা করে ফিরে আসে। অনুরূপভাবে দিনের বেলায় হাত প্রসারিত করেন যেন রাতের অপরাধীরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কোন বান্দা যখন সৎকাজ করে তখন পরম দয়ালু রব এর বিনিময়ে দশটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন, এমনকি তা বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। কিন্তু কোন পাপকাজ করলে ততটুকুই প্রতিদান দেয়া হয় যতটুকু সে অপরাধ করেছে। দয়াময় আল্লাহ বলেন: [ তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে; আল্লাহ তাদের গোনাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ] সূরা ফুরকান: ৭০। এ বিষয়ে অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। যেমন:
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। ) বুখারী ও মুসলিম।
আবু কাতাদাহ হারেস বিন রিবয়ী রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( আরাফার দিবসের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। আর আশুরার রোযার ব্যাপারে আল্লাহর নিকটে আশা করি যে, তিনি এর মাধ্যমে পূর্বের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দিবেন। ) সহীহ মুসলিম।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( যে ব্যক্তি দিনে একশত বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি’ পাঠ করবে, তার পাপসমূহ মোচন করা হবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। ) সহীহ মুসলিম।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে আরো বর্ণিত যে, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( যখন ক্বারী ‘আমীন’ বলে তখন তোমরাও ‘আমীন’ বলো। কারন এ সময় ফেরেশতারাও ‘আমীন’ বলে। সুতরাং ফেরেশতাদের ‘আমীন’ বলার সাথে যার ‘আমীন’ বলা মিলে যাবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। ) সহীহ বুখারী।
উসমান রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( যে ব্যক্তি সুন্দর করে অযু করবে এবং সালাত আদায় করবে, পরবর্তী সালাত আদায় করা পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ) সহীহ বুখারী।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( যখন কোন মুসলিম বা মুমিন বান্দা অযু করে; যখন সে মুখমন্ডল ধৌত করে তখন তার দু’চোখের দৃষ্টি দ্বারা অর্জিত সকল গোনাহ চেহারা থেকে পানির সাথে বা পানির শেষ ফোটার সাথে ঝড়ে পড়ে। সে যখন দু’হাত ধৌত করে তখন দু’হাত দ্বারা যা কিছু অন্যায় করেছে তা পানির সাথে বা পানির শেষ ফোটার সাথে বের হয়ে যায়। অনুরূপ সে যখন দু’পা ধৌত করে তখন পায়ে হেঁটে যা কিছু অন্যায় করেছে তা পানির সাথে বা পানির শেষ ফোটার সাথে বের হয়ে যায়। এভাবেই অবশেষে সে পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়। ) সহীহ মুসলিম।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছেন: ( তোমাদের কারো বাড়ীর দরজার সামনে যদি একটি নদী থাকে আর সে ঐ নদীতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তাহলে তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে কি? এ ব্যাপারে তোমরা কী বলো? তারা বলল: না, তার শরীরে কোন ময়লা থাকবে না। তখন তিনি বললেন: এ হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের উদাহরণ; এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা গোনাহসমূহ মিটিয়ে দেন। ) সহীহ মুসলিম।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে আরো বর্ণিত যে, নবী সাঃ বলেছেন: ( পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমা থেকে আরেক জুমা, এক রমযান থেকে আরেক রমযান; উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের সব গোনাহের জন্য কাফফারা হয়ে যায় যদি সে কবীরা গোনাহে লিপ্ত না হয়। ) সহীহ মুসলিম।
জমহুর আলেমগণের মতে হাদিসগুলোতে উল্লেখিত গোনাহ মোচনের বিষয়টি ছগীরা গোনাহ (ছোট ছোট অপরাধ) এর সাথে সম্পৃক্ত। আর কবীরা গোনাহ (বড় বড় পাপ ও অপরাধ) এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা কবীরা গোনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য অবশ্যই তওবা করতে হবে। তবে রাসূল সাঃ এর এই উক্তি: “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্জ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও ফাসেকী কাজ থেকে বিরত থাকল, সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এল যেদিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিল।” এই হাদিসের বাহ্যিক ভাষ্য অনুযায়ী আলেমগণের মত হল: হজ্জে মাবরুর বা কবুল হজ্জ কবীরা গোনাহকেও মিটিয়ে দেয়।
কুরআনুল কারীম একটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা সেই ব্যক্তির বক্ষকে প্রসারিত করে, হৃদয়কে প্রশান্ত করে এবং স্পৃহা জাগায়- যে তার পাপসমূহ মোচন করতে চায়; আল্লাহ তায়ালা বলেন: [ আর তুমি সালাত কায়েম কর দিনের দু প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। নিশ্চয় সৎকাজ অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়। ] সূরা হুদ: ১১৪। অর্থাৎ নেকী গোনাহকে মিটিয়ে দেয়; নামাজ, রোযা, দান সদকা, যিকির আযকার, কুরআন পাঠ, তাসবীহ, তাহলীল, সৃষ্টির প্রতি দয়া, আল্লাহর পথে আহবান, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ইত্যাদি সবই নেকীর কাজ।
আল্লাহর চমৎকার অনুগ্রহ ও সুন্দর ইহসানের কথা চিন্তা করে দেখুন, তিনি তাঁর বান্দার যে কোন মসিবতকে -তার কষ্ট যতই কম হোক না কেন- তার গোনাহ মোচনের উন্মুক্ত ময়দান ও মাধ্যম বানিয়েছেন। আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। ) সহীহ বুখারী।
এর চেয়েও বিশাল ব্যাপার হল: বলা মসিবত যত দীর্ঘ হবে, এর সাথে সাথে তার গোনাহ মাফের প্রতিদানও দীর্ঘায়িত হতে থাকে। অবশেষে মসিবতগ্রস্থ মুসলিম ব্যক্তিটি গোনাহমুক্ত অবস্থায় তার রবের সাথে সাক্ষাত করে। এ মর্মে আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( মুমিন নর-নারীর দেহ, সম্পদ ও জানের উপর বালা-মসিবত লেগেই থাকে। অবশেষে সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাত করে যে, তার কোন গোনাহই অবশিষ্ট থাকে না। ) সহীহ ইবনে হিব্বান।
ভাষালংকারের অধিকারী রাসূল সাঃ এর উক্তি হতে আপনাদের কাছে একটি অলঙ্কারপূর্ণ দৃশ্য উল্লেখ করছি, যা গোনাহ ঝড়ে পড়ার অর্থকে বোধগম্য করে উপস্থাপন করেছে; আবু যার রাঃ হতে বর্ণিত, “শীতের সময় একদিন রাসূল সাঃ বের হলেন, আর তখন গাছের পাতা ঝড়ে পড়ছিল। তিনি একটি গাছের দু’টি ডাল ধরলেন, তাতে গাছের পাতা ঝড়তে লাগল। তারপর তিনি বললেন: ( হে আবু যার! আমি বললাম: আমি উপস্থিত হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন: নিশ্চয় কোন মুসলিম বান্দা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সালাত আদায় করে, তাহলে তার জীবন থেকে তার গোনাহগুলো এভাবে ঝড়ে পড়ে যেভাবে এই গাছ থেকে তার পাতাগুলো ঝড়ে পড়ে।)” মুসনাদে আহমাদ, সনদ হাসান পর্যায়ের।
আল্লাহর অন্যতম করুণা ও অনুগ্রহ যে, অজ্ঞ ব্যক্তির ভুল, ভুলে যাওয়া ব্যক্তির ত্রæটি ও নিরুপায় ব্যক্তির কাজ- সর্বসম্মতিক্রমে ক্ষমার যোগ্য এবং এর কোন জবাবদিহিতা হবে না। কেননা গোনাহ নির্ভর করে ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও নিয়তের উপর; এ মর্মে ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন: ( নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতকে ভুল, বিস্মৃতি ও জোরপূর্বক কৃত কাজের দায়ভার থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ) সুনান ইবনে মাজাহ, সনদ সহীহ।
بارك الله لي ولكم في القرآن العظيم …
দ্বিতীয় খুতবা:
বিবেকবান মুসলিমের উচিত, মুক্তির লাভের আশাব্যঞ্জক হাদিসগুলোর যুক্তি দেখিয়ে সে যেন নিজেকে পাপাচার ও অবাধ্যতায় লাগামহীনভাবে ছেড়ে না দেয় এবং উদাসীনতা প্রদর্শন না করে। কেননা তার কাছে তার গোনাহ মাফের নিশ্চিত কোন গ্যারান্টি নেই। যে কোন কারন বা প্রতিবন্ধকতা তার গোনাহ মোচনে বাধা হতে পারে!
আর নিরাপদ সেই ব্যক্তি যে আশা ও আশঙ্কা উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করে চলে। বেশি বেশি সৎ আমল করে এবং তার রবের প্রতি সুধারণা রাখে। পাশাপাশি কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং ছগীরা গোনাহকেও অবহেলা করে না। রাসূল সাঃ বলেছেন: ( সাবধান! তোমরা ছোট ছোট গোনাহ থেকে বেঁচে থাক। কেননা ছোট ছোট গোনাহের উদাহরণ যেমন একদল লোক কোন উপত্যকায় অবতরণ করল; তারপর অমুক একটি কাঠ আনল, তমুক একটি কাঠ আনল। এভাবে অবশেষে এমন পরিমাণ কাঠ জমা করল যে তারা সেগুলো দিয়ে রুটি পাকাতে সক্ষম হল। জেনে রাখ! যখনই ছোট ছোট গোনাহে ব্যক্তি জড়িয়ে পড়বে, সেগুলো তাকে ধ্বংস করে দিবে। ) মুসনাদে আহমাদ।
জ্ঞাতব্য যে, উল্লেখিত ঈমানী মর্মগুলো যখন হৃদয়ে স্থির হবে, তখন জীবন পরিচালনায়, আচরনে উন্নতি এবং সমাজ সংস্কার ও গঠনে তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
একজন মুসলিম যখন আল্লাহর এই বাণীটি শুনবে: [ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد. অর্থ: সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।] সূরা ক্বাফ: ১৮। তখনি এটি তাকে এমন সতর্কদৃষ্টি এনে দিবে যে, তা তাকে জিহŸার হেফাযত ও চক্ষু সংবরনের জন্য আহবান জানাবে। সে ধ্বংসের ক্ষেত্রগুলো দেখতে পাবে, ফলে সে তা থেকে বেঁচে থাকবে। যখন সে এই বাণীটি শুনবে: [وإن عليكم لحافظين، كراما كاتبين، يعلمون ما تفعلون. অর্থ: আর নিশ্চয় নিয়োজিত আছেন তোমাদের উপর সংরক্ষকদল;* সম্মানিত লেখকবৃন্দ,* তারা জানে তোমরা যা কর।] সূরা ইনফিতার: ১০-১২। তখন এটি তার সকল কর্মে তার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগিয়ে দিবে। ফলে সে তার নিয়তে একনিষ্ঠ হবে এবং আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে সচেষ্ট হবে; নিজে সৎ হবে এবং অন্যদেরকেও সংশোধন করবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: [ মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, আবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমি তাদেরকে তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দিব। ] সূরা আন-নাহল:৯৭। (সমাপ্ত)