মহানবী ও শিশু অপরাধী

মৌসুমী ফল

মদীনায় ছিলো বহু খেজুর বাগান। অন্যান্য ফলও বেশ কিছু হতো। সাহাবীদের কারো বাগানে সর্বপ্রথম ফল তোলা হলে অনেকে নতুন ফল রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে নিয়ে আসতেন। শিশুরা মজলিসে উপস্থিত থাকলে তিনি তাদেরকে কাছে ডাকতেন এবং সবচেয়ে ছোট শিশুটির হাতে প্রথমে একটি ফল তুলে দিয়ে ফল খাওয়ার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতেন।

খেজুর গাছে ঢিল

একজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন, তিনি ছোটবেলা আনছারদের খেজুর বাগানে যেতেন। খেজুর পাড়ার জন্য ঢিল ছুড়তেন। একদিন বাগানের মালিক এবং কিছু লোক তাকে দৌড়িয়ে ধরে ফেলে। তারা তাঁকে রাসুলুল্লাহর কাছে নিয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঢিল ছুড়েছো কেন ? আমি বললাম খেজুর খাওয়ার জন্য। সোজা উত্তর শুনে রাসুলুল্লাহ একটু চুপ করে রইলেন। আমাকে কোন বকাবকি বা তিরষ্কার করলেননা। শাস্তি না দিয়ে বললেন “যে ফল নিজে গাছ থেকে তলায় পড়ে, সেগুলো কুড়িয়ে খাবে। ঢিল ছুড়বেনা।” আশ্বাস পাওয়ার পর রাসূল (সাঃ) শিশু-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।

ছেড়া জামা সেলাই করা যায়। আহত হৃদয়ের ঘা কখনও শুকায়না। শরীরের কাটা ঘা শুকায়। কিন্তু হৃদয়ের ঘা কখনও শুকায়না। গলায় কাঁটা বের করা যায়। কিন্তু মনের কাটা তোলা যায়না।

শিশুরা যাকে না পছন্দ করে, ভাবতে হবে তার মধ্যে শয়তান লুকিয়ে আছে। ফিরিস্তা যেভাবে শয়তানকে চিনে, শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে বয়স্কদের থেকে বদলোক বেশী চিনে।

দোষ করলে শিশুকে কিছুটা বকতে হবে। ধমক দিতে হবে। তবে রাগের স্বরে নয়। ভালোবাসার সাথে, আন্তরিকতার সাথে। মায়ের মতো দরদ দিয়ে। বকুনীয় পিছনের অনুভূতি নিজের মন থেকে বের হয়ে যাতে শিশুর মন পর্যন্ত পৌঁছায় – এটুকু নিশ্চিত হতে হবে।

শিশুরা দু’মাস আগে কি হয়েছে ভুলে যায়। দু’মাস পরে তাদের কি করতে হবে বা হতে হবে, তা চিন্তা করেনা। তারা বর্তমান নিয়েই বেঁচে থাকে।

শিশুর ভবিষ্যত চিন্তার দায়িত্ব পিতা-মাতা এবং অভিভাবকের। তাদের সন্তানের বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবেনা। সন্তানের ভবিষ্যত তাদেরকেই চিন্তা করতে হবে।

সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে শিশুকে নিয়মতান্ত্রিক, সুশৃঙ্খল ও সংযমী হতে শিক্ষা দিতে হবে।

শিশুকে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু বিবেকহীন ভালোবাসার কারণে শিশুকে প্রয়োজনের সময় শাসন না করে যারা প্রশয় দিয়ে নষ্ট করে, তাদের পাপের ক্ষমা নেই।

যারা নিজ শিশুর ক্ষতি করে তাদের থেকে নিকৃষ্ট মানুষ আর কে হতে পারে ?

ছেলে যদি পুরুষের মত পরিশ্রমী, কষ্ট সহিষ্ণু, উচ্চাকাঙখী এবং প্রজ্ঞাশীল না হয়, তার স্বভাব হবে মেয়েলি। কিন্তু মেয়েদের সহজাত গুণাবলীও তার মধ্যে বিকশিত হবেনা।

মেয়েরা নারীর কোমল গুণাবলী নিয়ে বড় হলে দেবীর মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু মেয়েরা পুরুষের পৌরুষে অভিসিক্ত হলে তা হবে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতম।

যে পিতামাতা তাদের সন্তানের সব আশা, কামনা-বাসনা পূর্ণ করেন তাদের সন্তান মানুষ হবেনা, মানুষ নামের পশু হবে। সমাজের জন্যে নিয়ে আসবে দোযখের যন্ত্রনা।

পশুর মাঝেও ভয় ভীতি আছে। আত্মসংযম মনুষ্যত্বের চাবিকাঠি। শিশুর সব আশা পুরণ। করলে তার মধ্যে সংযম সৃষ্টি হবেনা।

অতি আদর মানব সন্তানকে পিতা-মাতার জীবদ্দশায় দোযখের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেয়। অতৃপ্তিহীন সকল তৃপ্তি মানবকে নেশাখোরে রূপান্তরিত করে।

আপনার শিশুকে যদি আপনি তিরস্কার না করেন, দুনিয়ায় সে তিরস্কৃত হতে পারে।

আপনি যদি আঘাত করে স্বীয় শিশুকে সোজা না করেন, সে জীবন পথে অন্যদের থেকে আঘাত পাবে। সোজা হবেনা। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরো বাঁকা হবে। আপনার আঘাতে আপনার কাছে প্রতিশোধ নিবেনা। নিজের সর্বনাশ করে যতটুকু প্রতিশোধ হয়, ততটুকু ছাড়া।

আপনার শিশুকে আপনি আঘাত দিলেননা, শাসন করলেননা। অন্যের আঘাত খাওয়ার উপযুক্ত হয় – তেমনভাবে কেন গড়ে তুলবেন ? তার চেয়ে নিজে আঘাত দিয়ে আপন সন্তানকে সোজা করে গড়ে তোলা কি সঙ্গত নয় ?

অপরের শাসন অপেক্ষা স্বশাসন, নিজের অন্তরের শাসন অধিকতর কাম্য।

অন্যের ভয়ে বা শাসনে চলা স্বাধীনতাহীনতা। বাইরের বাধ্যবাধকতায় নয়; পিতামাতা, পরিবারে এবং স্বশাসনে জীবন গড়ার মধ্যে রয়েছে তৃপ্তি, আনন্দ, সম্মান ও গৌরব।

গাম্ভীর্য মিশ্রিত নেকী কল্যাণকর। শুধু তারল্য সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় যথােপযুক্ত নয়। মাধুর্যের সাথে থাকতে হবে দৃঢ়তা।

যুদ্ধের ময়দানে শিশু হত্যা

একবার এক যুদ্ধে আকস্মিক আক্রমণকালে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ঠ হয়ে কয়েকটি শিশু মারা যায়। এ সংবাদে মহানবী (সাঃ) খুবই মর্মাহত হন। জনৈক সাহাবী রাসুলুল্লাহর মনের দুঃখ কমাবার জন্য বললেন – “নিহত শিশুরা ছিল অমুসলিম”। এ উত্তর শুনে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ভীষণভাবে রেগে যান। উত্তরে তিনি বলেন, “তারা তোমাদের চাইতে উৎকৃষ্টতর। সাবধান। কখনও শিশু হত্যা করবে না”। দ্বিতীয়বার বললেন, “সাবধান ! শিশু হত্যা করবেনা”।

শিশু হত্যার জন্য রাসুলুল্লাহর (সাঃ) এই দুঃখ এবং সাবধান বাণী শিশুদের জন্য তার কোমল অনুভূতি প্রতিফলিত হয়।

বেদুইন

একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শিশু নাতি হাসান ইবনে আলীকে (রাঃ) চুমু দিলেন। এ সময় আকরা বিন হারিস তামীমী (রাঃ) তাঁর কাছে উপবিষ্ট ছিলেন। শিশুদেরকে রাসুলুল্লাহর আদর স্নেহের দৃশ্যে তিনি আশ্চর্য হলেন।

রাসুলুল্লাকে আকরা তামীমী (রাঃ) বললেন “আমার দশটি সন্তান হয়েছে। আমি কোনদিন তাদের একটিকেও চুমু দেইনি”। রাসুলুল্লাহ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “আল্লাহ যদি আপনার অন্তর থেকে দয়া-মায়া একান্তই তুলে নিয়ে থাকেন, তবে আমার কী করার আছে ? যে ব্যক্তি দয়া করেনা, সে দয়া পায়না”। (হযরত আয়শা এবং জাবির ইবন আবদুল্লা। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস (বুখারী ও মুসলিম)।

শিশুর নরম গালে মায়ের চুমু, মায়ের গালে তিন চার বছরের শিশুর চুমুর দৃশ্য হতে মধুর। দৃশ্য আর কি হতে পারে !

সূত্র: মহানবী ও শিশু বই থেকে। লেখক: এ. জেড. এম. শামসুল আলম

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button